পাহাড়-ঝরণা-ছড়া-মেঘ-কুয়াশা-নদী আর রহস্যময় পাহাড়

প্রকৃতির পাহাড়-ঝরণা-ছড়া-মেঘ-কুয়াশা-নদী আর রহস্যময় পাহাড় ঘেরা দীঘির অপার সৌন্দর্যের টানে পুরান ঢাকার বন্ধুরা মিলে এ বছরের শুরুতে বেড়াতে গিয়েছিলাম বান্দরবানের বগালেক, কেওকারাডং আর জাদিপাই ঝরণায়। আর সেই সাথে বোনাস হিসাবে পেয়ে যাই বান্দরবনের রাজবাড়ী মাঠের ঐতিহ্যবাহী রাজস্ব আদায়ী অনুষ্ঠান বোমাং রাজপূণ্যাহ্ উৎসবের মেলার শেষ বিকাল ও রাতটি। প্রায় ছয় মাস ধরে নানা পরিকল্পনার মধ্য দিয়ে গত ১৯ শে জানুয়ারী বৃহস্পতিবার রাতে বাস যোগে বন্ধুরা সদলবলে যাত্রা করি মনোমুগ্ধকর সৌন্দর্যে ঘেরা রহস্যময় পাহাড় কন্যার দেশ বান্দরবনের উদ্দেশ্যে। এ যাত্রার প্রধান লক্ষ্য ছিল কেওক্রাডং এর সর্বোচ্চ চূঁড়ায় উঠে পুরান ঢাকার পরিবেশ রক্ষার শপথ স্মরণ করে চূঁড়ার ময়লা-আবর্জনা পরিষ্কার করা। সেই সাথে বান্দরবন শহর, বগালেক আর যাদিপাই ঝরণায় বেড়ানোর বিষয়গুলো পরিকল্পনার মধ্যে ছিল। অপেশাদার এ যাত্রী দলের প্রায় সকলেই অভিযানের পূর্বে পুরো এক মাস ভোর বেলা উঠে ব্যায়াম করতাম। তারপরও বগালেক থেকে যাদিপাই ঝরণা পর্যন্ত একদিনে ১৩ ঘন্টায় আসা-যাওয়া প্রায় ৫২ কি:মি: উচুঁ-নিচু-আঁকা-বাঁকা পাহাড়ী পথ অতিক্রম করতে সবারই ভয়ানক কষ্ট হয়েছিল। আমাদের ১০ সদস্যের ২ জন বগালেকের ২৭০০ ফুট উঠেই অভিযানের সমাপ্তি টেনে লেকের আশেপাশেই বেড়ানো শুরু করে। আরো ৩ জন কেওক্রাডং এর পথ থেকেই ফিরে আসে বগালেকে। গাইডসহ বাকী ৬ জনের টিম শেষ পর্যন্ত অভিযান সফলভাবে সম্পন্ন করি।

রাত ১১টায় সায়দাবাদ থেকে ইউনিক পরিবহনে চড়ে আমরা শুক্রবার সকাল ৮:৩০-এ বান্দরবান শহরে এলাম। দলনেতা মেহেদীর বন্ধু আবুল হোসেন এ শহরের বাসিন্দা, তার পরিচিত এক হোটেলে সকালের প্রাত:ক্রিয়া শেষ করি। পরিকল্পনা মত আবুল হোসেন পর্যাপ্ত শুকনো বিস্কুট নিয়ে সিএনজি করে রুমা বাস স্টেশন, হাফেজঘোনায় আমাদের পৌঁছে দেয়। এখানে এক রেস্টুরেন্টে হালকা নাস্তা করি। রুমা বাস স্টেশন থেকে যেতে হবে কৈক্ষ্যংঝিরি। ঠিক ৯:৩০-এ সিটিং গাড়ীতে করে আঁকা-বাঁকা-উঁচু-নিচু পিচ ঢালা ১০-১২ ফুটের প্রশস্ত রাস্তা দিয়ে মাঝে মাঝে কাত হয়ে পড়ি পড়ি করে দু’পাশে পাহাড় আর গিরিখাদ দেখতে দেখতে ১১:৩০-এ কৈক্ষ্যংঝিরিতে এলাম। পা পথে পাহাড়ী যাত্রা শুরু হল। এখান থেকে হেঁটে দক্ষিণের ঢালু পাহাড়ী পথ বেয়ে প্রায় শুকিয়ে যাওয়া সাঙ্গু নদীতে এসে ট্রলারে উঠে দেড় ঘন্টায় রুমা বাজারে এসে পৌঁছলাম। আবুল হোসেনের মাধ্যমে ঠিক করা গাইড সুমন দত্ত আমাদের ট্রলারের সামনে এসে হাজির।
 (সাঙ্গু নদী আর পাহাড়ের সঙ্গমস্থল--যেখানে জল, সবুজ আর মানুষের পদচারণায় জীবন্ত হয়ে উঠে পাহাড়ী সভ্যতা। )



 বগালেকের পথে
রুমা বাজারে লাঞ্চ করে সেনাবাহিনীর পাহাড় ক্যাম্পে আমরা সবাই এলাম। পাহাড়ের ক্যাম্পে উঠা অভিযানের প্রথম অভিজ্ঞতা। নাম, ঠিকানা, রেজি: লিখার পর জীপে করে কিছুদূর এসে সেনাবাহিনীর আরেকটি ক্যাম্পে এসে রেজি: খাতায় স্বাক্ষর করলাম। দুই ক্যাম্পে প্রায় ঘন্টাখানেক সময় লাগল। বিদেশীদের ক্লিয়ারেন্স পেতে আরো বেশী সময় লাগে। আর্মি সদস্যরা সবাইকে পাঠ দিতে লাগলেন। মনে হল, আমাজান বা আফ্রিকার কোন জঙ্গলে যাচ্ছি অথবা যেন, পাসপোর্ট নিয়ে অন্য দেশের ভিতর দিয়ে আমাদের কোন ছিটমহলে যাচ্ছি অথবা এ যেন, আমার দেশ নয়। ৪টার দিকে আমাদের জীপ বগালেকের পাদদেশে এসে থামল। মনে হল, পাহাড়ী জঙ্গল আর ভয়ঙ্কর গিরিখাদের মধ্য দিয়ে কোন চিত্রশিল্পীর আঁকা সরু আঁকা-বঁাকা পথ দিয়ে আমরা বগালেকের পাদদেশে এলাম। গাইডের ডাকে ঘোর কাটল আমাদের। শীতের জামাকাপড় খুলে সর্ট প্যান্ট আর পাতলা গেঞ্জি পড়ে কিন্ডার গার্ডেন স্কুলের ছাত্রের মত পিঠে ব্যাগ নিয়ে গাইডের দেওয়া দেহ সমান কচি বাঁশে ভর দিয়ে শুরু হল প্রথম পাহাড় অভিযান রিহার্সেল। সমুদ্র পৃষ্ঠ হতে ২৭০০ ফুট উচ্চতায় উঠতে গিয়ে সবাই বিভিন্ন উচ্চতায় হারিয়ে যাই। মোবাইলের নেটওয়ার্ক আসে আর যায়। প্রায় এক ঘন্টার ক্লান্তি শেষে সবাই বগালেক পাহাড়ে উঠে। পাহাড়ের উপড়ে পাহাড় ঘেরা মনোরম লেক, আদিবাসী বম, মারমাদের বসতি আর সবুজ ঢেউ খেলানো বৃক্ষরাজি পরিবেশটাকে একেবারে স্বর্গ বানিয়ে রেখেছে।
                               ( বগালেকের চূঁড়ায় উঠে হিমালয় জয়ের আনন্দ!)



এখানেও আর্মি ক্যাম্প আছে। গাইড আমাদের নিয়ে রিপোর্ট করে আবুল হোসেনের টেলিফোনে বুক করা লেকের দক্ষিণ পাশে ‘সিয়াম দিদি’র বাঁশের তৈরী নিসর্গ কটেজে উঠল। এক রুমে সবাই ক্লান্তি আর ভালোবাসায় মাখামাখি করে বিশ্রাম নিতে থাকি। বিকাল আর সন্ধায় লেকটা ঘুরে লেক সম্পর্কে নানা উপকথার গল্প নিয়ে রাতে আর্মি ক্যাম্পে খেয়ে ১০টার দিকে নিসর্গ কটেজে ঘুমিয়ে পড়ি ।

কেওক্রাডং-এর পথে
শনিবার, সকাল ৬:৪০। প্রধান লক্ষ্যে যাত্রা। বলে রাখা ভাল, আমাদের দলের ম্যানেজার কাম লিডার হল মেহেদী হাসান, সৌখিন ফটোগ্রাফার, সব ছবি তারই তোলা। যদিও তার এটা প্রথম যাত্রা কিন্তু তার কর্মকান্ডে মনে হল এর আগেও সে একাধিকবার এসেছে। তার ভাষায়, এটা তার ৩ বছরের সাধনা। যাই হোক, মেহেদী আর গাইডের নিঁখুত পরিকল্পনায় শুরু হল মহা অভিযান। কুয়াশার অন্ধকারে পূর্ব দিকের মনোমুগ্ধকর ঝিরিপথ দিয়ে চিংড়ি ঝরণা, রংতন পাড়া হয়ে রুমতুম পাহাড়ের ছাউনিতে জলাহার করে আধ ঘন্টা বিশ্রাম নিয়ে ৩ নং রেমাক্রি প্রাংসা ইউনিয়নের সাজানো গোছানো দার্জিলিংপাড়ায় চলে এলাম। পর্যটকরা চাইলে এখানকার কোন কটেজে এক রাত বিশ্রাম নিতে পারেন। দার্জিলিংপাড়ার পূর্বদিকে পাহাড় আর গিরিখাতের ফাঁকে ফাঁকে আদিবাসীদের ঘর-বাড়ি। উপত্যকার মত ঢেউ খেলোনো খাড়া ভূমিতে জুমচাষ আর জুমচাষ, হালকা কুয়াশায় ঘেরা পুরো পার্বত্য এলাকা। মাঝে মাঝে শওকতের দুষ্টামী--‘স্বপনদা, পাহাড় এত উঁচু নিচু কেন, মানি না, মানব না।’ শত ক্লান্তি সত্ত্বেও ওর কথায় সকলে হেসে উঠি। প্রকৃতির সৌন্দর্য আর শুকনো বিস্কুট খেতে খেতে মহাক্লান্তি নিয়ে কেওকাড়াডং পাহাড়ে উঠলাম। পরিচয় হল এ পাহাড়ের ভূপতি লাল মুন থন লালার সাথে। এবার চূঁড়ায় উঠার পালা।
                                          (কেওকাড়াডং এর র্চুঁড়া)



ঠিক বেলা ১০:২৫এ ব্যানার, ক্যামেরা, জাতীয় পতাকা নিয়ে সমুদ্র পৃষ্ঠ হতে ৩১৭২ ফুট উচ্চতায় বিজয়ী বেসে গাইড সহ মোট ৬ জন চূঁড়ায় উঠে আনন্দ উল্লাসে ফোনে বাংলাদেশের এক সময়ের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ কেওক্রাডং বিজয়ের কথা আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবদের জানালাম। চূড়ার পূর্বদিকে পাহাড়-বন জঙ্গল-গাছপালা আর বিস্ময়কর গিরিখাদ, উপত্যকার ফাঁকে ফাঁকে ছোট ছোট আদিবাসী পাড়া, উত্তর ও পশ্চিমে পাহাড়ী পথ, আকাশ আর ঘন কুয়াশার মাঝে মেঘ, দক্ষিণে কুয়াশার চাদরে ঢাকা অতি ঢালু জাদিপাই ঝর্ণায় যাওয়ার পথ, উপরে ভেজা তুলোর মত সাদা মেঘের তুলির আঁচড়ে সীমাহীন নীল আকাশ। আমরা আছি, মেঘের দেশে। বিস্ময়ে বিহ্বল আমাদের চোখ আর মন। তবে চূঁড়ার স্তম্ভ শিলায়, গোলাকার বিশ্রাম ঘরে পোড়া কাঠ, ছাই, ছেঁড়া কাপড়, পানির বোতল ইত্যাদি ময়লা আর দেয়ালে পর্যটকদের নাম, ঠিকানা, ফোন নং-এ ভরা--এতটা ময়লা-আর্বজনা দেখে মনটা আমাদের খারাপ হয়ে গেল। পুরান ঢাকার পরিবেশ রক্ষার শপথ স্মরণ করে চূড়ার ময়লা-আর্বজনা সবাই মিলে পরিষ্কার করলাম। পাহাড় মালিকের সাথে এ বিষয়ে অনেক কথা হল। তিনি বললেন, আবেগ প্রবন পর্যটকরা এখানে উঠে নিজেদের আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। তবে রাতের বার-বি-কিউ উৎসবই বেশী ময়লা করে ফেলে। তবে উনি আমাদের কাছে নিয়মিত পরিষ্কার রাখার অঙ্গিকার করলেন।


জাদিপাই ঝরণার পথে
আমাদের দলের কেউ বগালেক, কেউ দার্জিলিং পাড়া পর্যন্ত এসে আত্নসমর্পন করেছেন। আমরা গাইড সহ মোট ছয় জন শেষ পর্যন্ত কেওক্রাডং থেকে জাদিপাই ঝরণার দিকে যাত্রা করি। আনন্দ আর আবেগে আমার কন্ঠে বেজে চলেছে রবীন্দ্র আর লালনের গান, কবিতা, মাঝে মাঝে শওকতের দুষ্টামী, জাহাঙ্গীরের পায়ের রগ টানের বিড়ম্ভনায় বিরক্ত মেহেদীর চোখ-মুখ। কারণ সে সবার আগে হাঁটলেও মুভ (অবস করার স্প্রে) তার কাছে থাকায় এবং টিম লিডার হওয়ার কারণে তাকে শওকত আর জাহাঙ্গীরের জন্য বারবার থামতে হয়। আমাদের ভূড়িওয়ালা ছোট হাতির ছানা ইঞ্জিনিয়ার কাম ডাক্তার বেলাল আমাদেরকে বিস্মিত করে বারবার আল্লাকে ডাকতে ডাকতে পাকা অভিযাত্রীর মত সমস্ত ট্যুর শেষ করে।
                                               (প্রাসিং পাড়া)



দুই পাশের পাহাড়ী ঘাসের ঢেউ খেলানো সরু পথে শুধুই নামছি। শেষ আর হতে চায় না। হঠাৎ করে কোন লোকালয় দেখতে পেলে ক্লান্তি কমে আসে। প্রাসিংপাড়া। ছিমছাম, পূর্ব-পশ্চিমে খোলামেলা, সকাল-সন্ধ্যা বসে থাকলে সূর্যোদয়-সূর্যাস্ত দুটোই দেখা যায়, তুলে আনা যায় প্রকৃতির তুলিতে আঁকা আলো-ছায়ার অসংখ্য ছবি। এই পাড়ার এক বম নারীর কাছ থেকে অল্প দামে অতি সুস্বাদু পেঁপে খেয়ে আবার চলতে থাকি। খাঁড়া রাস্তা, নামছি তো নামছি, ঘন ঘন শ্বাস-প্রশ্বাস। পা আর চলতে চায় না। জীবনের চরম পথ চলা। প্রায় ১ ঘন্টায় মনে হয়, ২০০০ ফুট নিচের পাহাড় ঘেরা সমতল ভূমিতে নামলাম। সবাই এতটাই ক্লান্ত যে, রুমাল দিয়ে ঘাম মুছতে মুছতে সবাই গেঞ্জি খুলে উদোম গায়ে বাতাস লাগিয়ে আবার হাঁটতে লাগল। জাদিপাই পাড়া পার হয়ে আরো আধা ঘন্টায় সমতল নিসর্গের সরু পথে হেঁটে হঠাৎ করে থেমে যাই। শওকতের চিৎকার,‘ওরে বাপরে, নামবো কেমনে। স্বপন দা, একটা রিকসা ডাকেন।’ ওর কৌতুক যেন, ক্লান্তির উপর শ্রান্তি বয়ে আনে।
সবচেয়ে ভয়ঙ্কর গিরিপথ! এই খাড়া বন্ধুর পথে কিভাবে যে নামলাম, তা মনে হলে এখনও আঁতকে উঠি। ঐ সময়ে পরিবার-পরিজনের কথা খুব মনে হয়েছিল। বাঁশ, দড়ি, পাহাড়ী লতা, গাছের শিকড়-- যা পেয়েছি তাই ধরে যাদিপাই ঝরণায় নামি। ইউরেকা! ঝরণার রূপ দেখে আমাদের কারো কোন ক্লান্তি রইল না। ইচ্ছেমত জল খেলাম,অতি সুস্বাদু জল। পা ডুবিয়ে রাখলাম, পরম শান্তি! প্রায় ৩০০ ফুট উচ্চতার এই ঝরণার উপরে সরু একটি ছড়া দিয়ে অনবরত সুমধুর সুরে পানি ঝড়ছে। শান্ত ঝরণা, ধাপে ধাপে সাজানো গ্রানাইট প্লেট, আঁকা-বাঁকা কোন প্লেট মূল ভিত্তি থেকে বাইরে বেড়িয়ে আছে। ঝরণার সমতলে গ্রানাইট আর বেলে পাথর, খালি পায়ে হাঁটা যায় না। কঠিন স্তরীভূত এত শিলা পাথর হাজার হাজার বছর ধরে এখানে পড়ে আছে মহাকালের সাক্ষী হয়ে। দক্ষিণ-পশ্চিমে তাকিয়ে দেখি কাঠের সিঁড়ির মত শিলা পাথরের প্লেট। ঝরণার গোড়ায় গোসল করার সময় মনে হল, প্লেটগুলি বুঝি এখনি মাথার উপর পড়বে। হঠাৎ করে ঝরণার গতিবেগ ভয়ানকভাবে বেড়ে গেল। সবাই ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে ছুটতে লাগলাম। চারদিকে কোন বৃষ্টি নাই অথচ রংধনু ঝরণার পাদদেশের গা ঘেঁষে। দক্ষিণে তাকিয়ে দেখি সূর্য আলো দিয়ে চলেছে ঝরণার উলম্ব গায়ে। আমার ঘোর কাটল সকলের নাচানাচি দেখে। সবাই খুশি। সম্ভবত গাছের গুড়িতে জল আটকে ছিল অথবা জল আটকে কেউ মাছ ধরছিল। গাছের গুড়ি হঠাৎ সরে যাওয়ায় অথবা মাছ ধরা শেষে পাহাড়ীরা জল হঠাৎ করে ছেড়ে দেয়। জাহাঙ্গীরের সে দিনের উদ্দাম নৃত্য আমাদের বহুদিন মনে থাকবে। ছবি তোলা, গোসল করা শেষ করে হঠাৎ তাকিয়ে দেখি জলের নিচে প্রায় ডুবন্ত বড় এক পাথরে উঠে খালি গায়ে বেলাল নামাজ পড়ছে। মনে হল, পাথরসহ সে ভাসছে।
                              (ছবিঃ মেহেদী হাসান তালাত, ৫ মিনিট আগের ছবি )

                               ( ছবিঃ মেহেদী হাসান তালাত, ৫ মিনিট পরের ছবি )

                                                (হঠাৎ রংধনু)

মনটাকে ঝরণার কাছে রেখে আবার বহু কষ্টে কেওক্রাডং চলে আসি। গল্পে গল্পে দুপুরের খাবার খেয়ে খানিকটা সময় বিশ্রাম নিয়ে ঝিরি পথ দিয়ে ফিরতি পথ চলা। চিংড়ি ঝরণা পর্যন্ত আসতে রাত হয়ে গেল। ঘুটঘুটে অন্ধকার। ঝিঁ ঝিঁ পোকার ডাক আধার প্রকৃতিকে করেছে আরো ভীত সন্ত্রস্ত। যেন, স্বপ্নের হাত ধরে কৃষ্ণপক্ষের রাত্রির এই অন্ধকারে অনন্তের পথে চলেছি এই ঝিরি পথ ধরে। ঢালু পাহাড়ী পথের ফাঁকে ফাঁকে ছোট-বড় অসংখ্য গর্ত। হয়তো বনপোকা, ইঁদুর-শিয়ালের গর্ত। এ পৃথিবীর প্রাণীকুলের মধ্যে দিনের প্রাণীর চেয়ে রাতের প্রাণীর সংখ্যাই বেশী। দেহ সমান বাঁশে ভর দিয়ে ঢালু পথে চলা। হঠাৎ লাল মাটির ধুলোয় পা পিছলে পড়ে আবার ভারসাম্য ঠিক রেখে পথ চলা।
দেহের ওজন মনে হয়, দ্বিগুন হয়ে গেছে। পা ফুলে এমন অবস্থা হয়েছে যে, বিশেষ বেল্ট লাগানো সেন্ডেল খোলার পর জুতা আর কেউ পড়তে পারে নাই। তারপর গাইড আর রবার্ট বমের গাওয়া আর আমাদের তাল মেলানো বাংলা, হিন্দী আর বম গানের সুরে মধ্য রাত পর্যন্ত বার-বি-কিউ উৎসব চলে। মহাক্লান্তি নিয়ে একটানা ঘুমের পরদিন ফিরতি পথে বান্দরবানের বোমাং রাজপূণ্যাহ্ উৎসব বোনাস হিসাবে আমাদের হিসাবের খাতাটাকে পরিপূর্ণ করে দিয়েছে। এখনো চোখ বুজলে ভেসে উঠে, সেই স্মৃতি গাঁথা বান্দরবানের পাহাড়-ঝরণা-ছড়া-মেঘ-কুয়াশা-নদী- কৈক্ষ্যংঝিরি- রুমা বাজার-বগালেক-দার্জিলিংপাড়া-কেওক্রাডং- প্রাসিংপাড়া-জাদিপাই ঝরণা আর রহস্যময় পাহাড় ঘেরা সবুজ জঙ্গল।







হেমন্তের গান

ষড়ঋতুর বাংলাদেশে হেমন্ত এক অদ্ভুত ঋতু। শরৎ শেষে প্রকৃতি কিছুটা মলিন হতে থাকে। আগাম পড়তে শুরু করে শীতের হিম কুয়াশা। ছাই রঙ কুয়াশার চাদর মুড়িয়ে ফেলে সকাল-সন্ধ্যার সুনীল আকাশ। ফসলহীন মাঠ যেন, পরিত্যক্ত জনপদ; এর উল্টো পিঠও আছে। কৃষকের ঘর জুড়ে আনন্দের বন্যা। মাঠশূন্য করা ফসল যে তার গোলা ভরিয়েছে। মিটেছে অভাব। তাই তো দিকে দিকে শুরু হয়ে যায় নবান্ন উৎসব। শুধুই কি নবান্ন! হেমন্তে আরও কত কত উৎসব উদযাপন হয়ে আসছে সেই সুদীর্ঘকাল থেকে।

‘ভাইয়ের কপালে দিলাম ফোঁটা--যমের দূয়ারে পড়ল কাঁটা, যমুনা দেয় যমকে ফোঁটা--আমি দিলাম আমার ভাইকে ফোঁটা।--ভাইয়ের কপালে বোন এই ছন্দ বা মন্ত্র পাঠ করে চন্দন, ঘি, মধু দিয়ে ফোঁটা দেয়; ভাই যেন বিপদ মুক্ত থাকে। ভাইও বোনকে সামর্থ্য অনুযায়ী কিছু দিয়ে আশির্বাদ করে।’--কবে যে এই ভাই ফোঁটা উৎসব শুরু হয়েছে--তা কেউ বলতে পারে না। বলা হয়ে থাকে, এটা অনার্যদের আচার অনুষ্ঠান; কেউ বলে, অনার্য নারী-পুরুষ উভয়েই জঙ্গলে শিকারে যেত, চাষবাস করত আর আর্যদের মধ্যে সাধারনত পুরুষরা যুদ্ধ করত বা শিকারে যেত, তাই বোনরা ভাইদের বিপদ মুক্তির জন্য এই অনুষ্ঠান করত, তাই এটা অনার্যদের
চেয়ে আর্যদের আচার অনুষ্ঠান বলাই যুক্তিযুক্ত। তবে সব অনার্য নৃগোষ্ঠির মধ্যে মাতৃতান্ত্রিক ধারা ছিল না, কোন কোন গোষ্ঠীর মধ্যে পিতৃতান্ত্রিক ধারাও ছিল। অনার্যদের কোন কোন জাতির পুরুষেরা শিকারে বা যুদ্ধে যেত। তাই তাদের বোনেরাও হয়তো ভাই ফোঁটা প্রথম শুরু করে থাকতে পারে।

আর্যরা এই অঙ্গ,বঙ্গ, কলিঙ্গ, সমতট, রাঢ় দখল করার পর আর্য-অনার্য মিশ্রণের ফলে লোকায়ত পূজা-অর্চণা এবং সাংস্কৃতিক ধারায়ও মিশ্রণ ঘটে। পিতৃতান্ত্রিক আর্য সমাজে ধর্মীয় প্রথায় পুরুষ পুরোহিত প্রাধান্য পেলেও মাতৃতান্ত্রিক অনার্য সমাজে নারী পুরোহিতের প্রাধান্য ছিল। যদিও ধীরে ধীরে নারী পৌরোহিত্যের প্রভাব কমতে কমতে এখন গৃহের ছোট ছোট পূজা অর্চনায় সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে। আদিকাল থেকেই অনুকূল আবহাওয়া এবং নানা রকমের শস্য উৎপাদনের মাসগুলোতেই বাঙ্গালীর নানা আনন্দ উৎসব হয়ে আসছে। প্রাচীনকাল থেকে অগ্রহায়ণ মাসেই সবেচেয়ে বেশী ফসল উৎপাদন হয়, মানুষের মন থাকে উৎফুল্ল, ঘরে ঘরে আনন্দ বয়ে যায়। আর তাই হয়তো সম্রাট আকবর এই মাসকেই বছরের প্রথম মাস বা খাজনা তোলার মাস ঘোষণা দিয়েছিলেন।

বাংলার সাংস্কৃতিক ইতিহাসের শিকড় থেকেই নবান্ন উৎসব প্রচলিত। হেমন্তের ধান কাটার পর হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রচলিত অগ্রহায়ণ মাসে অনুষ্ঠেয় অন্ন খাওয়ার উৎসবই হল নবান্ন যা বাঙালি হিন্দুদের মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সব বাঙালির প্রাণের উৎসবে পরিণত হয়েছে। নানা ধরনের দেশীয় নৃত্য, গান, বাজনাসহ আবহমান বাংলার সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পালিত হয়। লাঠিখেলা, বাউলগান, নাগরদোলা, বাঁশি, শখের চুড়ি, খৈ, মোয়ার পসরা বসে গ্রাম্য মেলায়।

আমার গ্রাম্য বেলার জীবনে আমি দেখেছি হেমন্তের ফসল আঁকা মেঠো পথ ধরে কত আনন্দ উৎসবের ধারা বয়ে যেত। মেঠো পথে পথে বাশুরিয়ার সুরের তানে বাতাস-ফসলের নৃত্যে জীবন খুঁজে পায় জীবনের স্বাদ। কার্তিকে শুরু হত নতুন ফসলের উৎসবের প্রস্তুতি পর্ব। কার্তিকের শেষ দিন কার্তিক পূজা, বুড়া-বুড়ীর পূজা, সন্তোসী মায়ের পুজা দিয়ে মাস শেষ হতেই অগ্রহায়ণের প্রতি রবিবার হতে শুরু হত ক্ষেতের বত্ত ; শনিবার থাকত শনিপুজা, তারপর ভাই ফোঁটা উৎসব, গোবাচ্চার জন্য গোরক্ষনাথের পূজা--সারা মাসই দেব-দেবতাকে খূশী করতে নতুন নতুন শস্যের নানা উপাদেয় খাবার তৈরী হত। কার্তিক দেবতার মত বীর যোদ্ধা, সুন্দর অবয়বের বর পাবার আশায় কার্তিক মাসের শেষ দিন সনাতন নারীরা কার্তিক পূজার আয়োজন করে। নতুন বিবাহিত অনেক নারীর নতুন বর দেখলে আমরা যেমন বলে উঠি, মেয়েটি কার্তিকের মত বর পেয়েছে। ব্রাক্ষণ বালকদের মস্তক মুন্ডু করে, কানে ছুঁচ ফুটো করে হেমন্ত-অগ্রহায়ণ মাসেই উপনয়ন বেশী হত। উপনয়নের পর থেকে বালকরা ব্রাক্ষণ হতেন।

যদিও সরকারী পঞ্জিকা আর সনাতন পঞ্জিকার দিন তারিখ এক রকম হয় না। কোথাও কোথাও সরকারী পঞ্জিকা অনুযারী, কোথাও সনাতন পঞ্জিকা অনুযায়ী উৎসব হয়। তিথি-নক্ষত্রের শুভক্ষণ অনুযায়ী পূজার দিন স্থির করা হয়। তাই সরকারী ক্যালেন্ডার অনুযায়ী দেখা যায় আশ্মিনের দূর্গাপূজা হয় কার্তিকে, কার্তিকের কার্তিক পূজা হয় অগ্রহায়ণে। আসলে তিথি-নক্ষত্র, লোকনাথ পঞ্জিকা অনুযায়ী, সনাতন হিন্দুরা দূর্গা পূজার ঘট (মহালয়া) আশ্বিনেই বেদীতে বসায়, কার্তিক পূজার ঘট কার্তিক মাসেই বেদীতে বসায়।

ক্ষেতের বত্ত এক এক অঞ্চলের এক এক জাতি গোত্রের মধ্যে ভিন্নতা দেখা যায়। অগ্রহায়ণ মাসের প্রতি রবিবার সন্ধার পর নতুন চাল দিয়ে ছোট ছোট পিঠা (লবণযুক্ত ও লবণছাড়া), ধান-দূর্বা, তুলসীপত্র, কর্পূর, চালকলার নৈবেদ্য, ধূপধূয়া দিয়ে উঠোনে পুজা হত। উঠোনের মাঝখানে ছোট্ট গর্ত (আয়তাকার পুকুর আকৃতির) করা হত। ক্ষেত দেবতার কিচ্ছা শুনানো হত। পাড়ার সব ছেলেমেয়েরা উঠোনে ছোট্ট পুকুরের চারপাশে বসে মা, কাকীমা, ঠাকুমার মুখে কিচ্ছা শুনত। পিনপতন নিরবতার মধ্যে ছোট ছোট বাচ্চারা গল্পের রাজ্যে ঘুমিয়ে যেত। আমাদেরকে বলা হত, খুব ভোরে উঠে যে পুকুরে ভাসিয়ে দেওয়া পিঠা খাবে, বিশেষ করে প্রথমে যে লবণযুক্ত পিঠা খেতে পারবে, সৌভাগ্যবান হিসাবে দেবতা তার প্রতি অধিক সন্তুষ্ট হবে। তার গোলা ফসলে ভরে যাবে, তার ঘরে ভাল গৃহস্ত, লক্ষ্মী বউ আসবে। খেতের দেবতাকে খুশী রাখতে অনার্য নৃগোষ্ঠি সেই কবে ক্ষেতের বত্ত শুরু করেছিল, আজও তার মিথ স্রোত বয়ে চলেছে এই মিশ্র জাতির মধ্যে।

বাস্তপূজা শীতকালে হলেও কোথাও কোথাও পুরোহিতের পরামর্শ নিয়ে, বিশেষ করে আমাদের বিক্রমপুর এলাকায় কার্তিক-অগ্রহায়ণেও বাস্তুপূজা হত। বিল থেকে হিজল গাছের কচি ডাল এনে, যেখানে ঘর তৈরী হবে সেখানে মাটির তৈরী বেদীর উপর পুঁতে দেওয়া হত। এটিই বাস্তুদেবতার প্রতীক। চাল, গুড় ও দুধ দিয়ে তৈরী পায়েস পুরোহিতের সাহায্যে কলাপাতায় এমনভাবে ঢেলে হিজল গাছের ডালের কাছে রেখে দেওযা হত--যাতে পায়েস গড়িয়ে মাটিতে পড়ে, মাটিতে শোষিত হলেই ধরা হত দেবতা ভোগ গ্রহণ করেছেন। এবার ঘর তৈরীতে বাঁধা নেই। পুরোহিত থেকে আমরা জেনেছি, এই পূজা না করে ঘর বানালে, সংসারে অশান্তি হবে, ঘর কালবৈখাখী ঝড়ে গৃহস্তের উপর ভেঙ্গে পড়বে।

কার্তিক মাসের শুরুতে তুলসী গাছের নিকটে সারা মাস সন্ধ্যা থেকে জ্বালিয়ে রাখা হয় আকাশ প্রদীপ বা গাছ প্রদীপ । আকাশ প্রদীপ এর ক্ষেত্রে বাঁশের আগায় ছোট ঘর বানিয়ে সেখানে মাটির তৈরী মুছিতে সরিসার তেল ঢেলে বিধবাদের পরিত্যক্ত, পরিষ্কার কাপড় বা পাট দিয়ে বানানো সলতার সাথে সরিষা মেখে প্রদীপ জ্বালিয়ে বাঁশটিকে ঘরের ছাদ ছাড়িয়ে আকাশে প্রতিদিন সন্ধ্যা থেকে সকাল পর্যন্ত খাঁড়া করে রাখা হয়। ভূত-প্রেত, অশুভ ছায়া তথা অকল্যাণ থেকে রক্ষা পেতে আকাশ প্রদীপ বা গাছ প্রদীপের পূজা করা হয়।

গাভীর বাচ্চার বয়স একুশ দিন হলে গাভীর দুধ দিয়ে নাড়ু তৈরী করে গোরক্ষনাথ দেবতার উদ্দেশ্যে ভোগ দিয়ে সবাই সমস্বরে বলত, গোরখার নাড়ু, হেউচ্চ...। পূজার পর থেকে গৃহস্তরা গাভীর দুধ খেত। এই পূজা করলে গাভী প্রচুর দুধ দেবে, প্রতি বছর সুস্থ্য বাচ্চা জন্ম দেবে। এই পূজার দিবস নানা গোত্রের সনাতন গৃহস্তরা গাভীর বাচ্চা জন্মের ৭/১৪/২১/২৮ এর মধ্যে রাখেনি, নিয়মের পরিবর্তন এমন হয়েছে যে, সামান্য নিয়মাদি পালন করে প্রথম দিন থেকেই গৃহস্তরা গাভীর বাচ্চার সাথে নিজেরাও দুধ খেত। হেমন্তকালের কার্তিক-অগ্রহায়ণে অথবা নিজেদের ভাল সময়ে গোরক্ষনাথ পূজার অনুষ্ঠান করত। পরিবর্তনের যুগে এই পূজা এখন বিলুপ্তির পথে।

রাখীবন্ধন, মনসাপূজা, দূর্গাপূজা, লক্ষ্মী পূজা, কার্তিক পূজা, কালীপূজা, দীপাবলী পূজা, অমাবস্যার ১ম বা ২য় তিথিতে মুখের দুই পাশে দুই রংয়ের অবয়বে হরিপরমেশ্বর পূজা, পূর্ণিমাতে রাধা কৃঞ্চের জন্য কীর্তন সহকারে রাসলীলা পূজা, বনের অধিবাসীর জন্য বনদেবীর পূজা--নানা পূজা-অর্চণার মাধ্যমে বিপদ-আপদ-মঙ্গল কামনায় শরৎ-হেমন্তের গ্রাম্য বাংলার শাশ্বত সাংস্কৃতিক রূপের সাথে অগ্রহায়ণ-পৌষ মাসে যোগ হয় নানান পাগলের মেলা, পীর-মুর্শীদের ওরস, ওয়াজ মাহফিল। এ সময়ে ফসলে ফসলে ছড়িয়ে থাকে মাঠ-ঘাট-পথ-আঙ্গিনা-ঘর-গোলা। মুসলমানরা প্রথম ফসল দিয়ে মাজার, দরগায় শিন্নি দেয়; কেউবা কোন কিছু পাবার আশায়, কারো রোগ মুক্তি কিংবা মঙ্গল কামনায় পীর-মুর্শীদ বা পাগল বাবার জন্য প্রথম ফসল মানত করে রাখে। মানুষের দ্বারে দ্বারে ভাগ্যলক্ষ্মী কার্তিক-অগ্রহায়ণের কাঁধে চড়ে ঘুরে বেড়ায়, মাঠ-ঘাট শস্য শ্যামলায় ভরে দেয়। আর তাইতো, সনাতন জাতি, উপজাতি ও অন্যান্য ধর্ম জাতির মধ্যে অসীম রহস্যের প্রতি কৃতজ্ঞতায় নিজেদের তৈরী বিশ্বাসের মিথগুলোকে গড়ে তোলে নিজেদের মতো করে, পরিবর্তনও করে নিজেদের সুবিধা মতো।

হেমন্তের নবান্নের সময় প্রকৃতির সঙ্গে সঙ্গে মানুষের মন-মানসিকতায়ও পরিবর্তন আসে। ধানের হরিদ্রা রঙের সঙ্গে একাত্ম হয়ে মেয়ে ও বধূরা হলুদ শাড়ি সায়াহ্নের রক্তিম সূর্যের কিরণ যেন, পায়ের আলতা রঙে শাড়ির পাড়ে উঠে আসে; সেই সাথে ছেলেরাও যেন অঘ্রাণের পাকা হলুদ ধানের আভা ধারণ করে তাদের ফতুয়া ও পাঞ্জাবিতে। তাদের ফতুয়া ও পাঞ্জাবির নকশায় আবহমান বাংলার প্রতিচ্ছবিও ফুটে ওঠে। এ সময় গ্রামবাংলার পাড়া-মহল্লায় বিয়ের ধুম পড়ে যায়। পাকা ধান কিবা নানান শস্যের বিনিময়ে প্রাপ্ত অর্থ দিয়ে কন্যাকে পিতা পাত্রস্থ করেন। বিয়ে বাড়িতে বিয়ের গীত আর আলতা-মেহেদীতে রাঙানোর আসর বসে। মানুষের মুখে মুখে প্রচলিত, এ সময়ে বিবাহ নাকি নতুন সংসারে সুখ ও শান্তি বয়ে আনে।

প্রকৃতির সবুজ ফসল হরিদ্রাভ সাজে নতুনের জাগরণ ঘোষণা করে। শরতের গিঁড়া জল সরে গিয়ে মাঠ-ঘাট ভরে ওঠে সোঁদামাটির গন্ধে। সূর্যের রক্তিম আভা নদীর শান্ত জল আর ভোরের ফসলের কচি ডগায় জমে থাকা শিশিরে পড়ে ঝিকমিক করে, মধুমাখা শীতল বাতাস অঙ্গজুড়ে হিল্লোলিত হয়। ঘরে ঘরে নতুন ধানের চালে শুরু হয় উৎসব। ভোর রাতে বাড়ি বাড়ি ঢেঁকিতে চালের গুড়ি কোটা, চিড়া কোটার শব্দ উঠত--এখন যা অজপাড়া গ্রাম ছাড়া চোখে পড়ে না।

হেমন্তের নবান্ন উৎসবে নতুন ধানের চালের গুড়ি আর গুড় দিয়ে গ্রাম বাংলার ঘরে ঘরে তৈরী হয় নানা রকমের পিঠা, পায়েস। মাটির সরাতে, বেতের থালে, কলাপাতায় অথবা পিতলের প্লেটে সাজানো থাকে গ্রাম বাংলার বাহারি রকমের পিঠা--পাকান পিঠা, ভাপা পিঠা, কুসলি পিঠা, চিতই পিঠা, পাটিসাপটা পিঠা, নকসা পিঠা, পাতা পিঠা, জামাই পিঠা, কাটা পিঠা, চুটকি পিঠা, মুঠা পিঠা, চ্যাপা পিঠা, জামদানী পিঠা, হাঁড়ি পিঠা, ঝুড়ি পিঠা, ফুলঝুরি পিঠা, বিবিখানা পিঠা, মাছ পিঠা, হৃদয় পিঠা, গোলাপ ফুল পিঠা, পেঁচানো পিঠা, ফুল পিঠা, শাহী বিবিখানা পিঠা ইত্যাদি আরো অসংখ্য নামের নানা রকমের পিঠা। মা, বোন, বউদের পিঠাশৈলী আর রাত-দিনের অক্লান্ত পরিশ্রম সকলের স্বাদ, তৃপ্তি আর স্বস্তির মধ্যদিয়ে পিঠা শিল্পের পরিশ্রম সার্থক হয়। জামাইয়ের সাথে শালা-শালী, বিয়াইয়ের সাথে বিয়াইনরা মেতে উঠে গ্রাম-বাংলার মুখে মুখে প্রচলিত ‘ধাঁধা মিলাও--পিঠা খাও’ উৎসবে। এসব পিঠা নিয়েও গ্রাম বাংলায় আছে নানা রকমের মুখরোচক মিথ। অকল্যাণ থেকে রক্ষার জন্য সনাতন হিন্দুরা দেবতা সূর্যকে, কোথাও গরু দেবতাকে আগে পিঠা দিয়ে, মেয়ের জামাইকে (দেবতা রুপে) কলাপাতায় বা বেতের থালাতে পিঠা পরিবেশন করত। বউ-জামাইয়ের আলাদা থালার সাথে পাড়ার সবাই একসাথে পিঠা খেতে বসত। তবে আর্যধারা (সনাতন হিন্দু ?) মতে, আগে জামাইয়ের খাওয়া শেষ হবার পর বউঝিরা খেতে বসত।

নাগরিক সভ্যতার জাঁতাকলে আবহমান কালের সংস্কৃতির অনেকটাই হারিয়ে গেছে। একান্নবর্তী পরিবার প্রথায় মানুষের বন্ধন এক সময় দৃঢ় ছিল। উৎসব মুখর সমাজে সবাইকে সবার প্রয়োজন হত। মানুষে মানুষে সম্পর্ক ছিল সহজ-সরল। ভাইয়ে-ভাইয়ে, বোনে-বোনে সম্পর্ক ছিল আত্মার বন্ধনে। আজ, এখন সে সম্পর্কগুলো শিথিল হয়ে যাচ্ছে। অন্য ধর্মের কথা না হয় বাদই দিলাম, সনাতন হিন্দু জাতিরাই জানে না হাজার বছরের শক্ত বন্ধনের এই ছোট ছোট উৎসবের কথা--যা মিথ হোক আর গল্প-কাহিনী হোক, মানুষের শাশ্বত প্রেম-প্রীতি ভালোবাসাকে বিনা সূতার মালায় হাজার হাজার বছর ধরে বেঁধে রেখেছিল--যা এখন শিথিল হয়ে হিংসা-বিদ্বেষের রূপ ধারণ করেছে।

হেমন্তের রাজদরবারে শীতরাজের আগমণ বার্তা অথবা শীতরাজের হেমন্তরাজ্য দখলের আগাম হুংকার!

হেমন্তকাল। কার্তিকের শেষার্ধ। এ সময়ে সাধারনত ‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌'এ ভরা বাদর, মাহ ভাদর, শূণ্য মন্দির মোর'--আষাঢ়-শ্রাবণ অথবা ভাদ্র মাসের মত বৃষ্টি হবার কথা নয়, কারো মন মন্দির রিক্ত থাকার কথা নয়। এ সময়ে ফসলে ফসলে ছড়িয়ে থাকে মাঠ-ঘাট-পথ। সব প্রাণীদের মাঝে সখা-সখিদের কলকাকলীতে মুখরিত থাকে আকাশ-বাতাস-প্রান্তর। কারো কারো উঠোনে হয়তো প্রথম হেমন্তের ফসল উঠেও গেছে। অথচ গত দুই-তিন দিন ধরে রয়ে-সয়ে, যেন, মানুষের মনে শীতের আগমন স্মরণ করিয়ে দিতে, প্রকৃতির ভালোবাসার বা নিরবতার মাঝে, শীতল ছোঁয়ায় গুড়িগুড়ি বৃষ্টি হচ্ছে, মাঝে মাঝে মুসলধারে।

রাজ-রাজাদের আমলে, রাজা যখন রাজদরবারে প্রবেশ করতেন, তার আগমনের আগে গেটের প্রহরী চুঙ্গা ফুঁকিয়ে ঘোষণা দিতেন, উজিরে আযম, শাহানশাহ...........এখন রাজদরবারে প্রবেশ করিবেন, সবাই হুসিয়ার--। এ সময় রাজদরবারের ভিতরে ও বাহিরে স্ব স্ব পদ মর্যাদা, অবস্থান অনুযায়ী সবাই যেমন প্রস্ততি নিতে থাকে; ঠিক তেমনি করে হেমন্তের প্রথম হলুদ রংয়ের ফসল আঙিনার মেটে রংয়ের সাথে মিশে শীতের বাওয়াইয়া সুরে যেন, আগমনী গান গেয়ে চলেছে। যেন, আকাশ-বাতাস, নদ-নদী-খাল-বিল, দিন-রাতের প্রানী তথা প্রকৃতিকে জানিয়ে দিচ্ছে, শীত রাজ বা শীত দেবীর আগমণ বার্তা কিংবা রাজনীতিগতভাবে বলতে পারি, অসময়ে শীতরাজের হেমন্তরাজ্য দখলের আগাম হুসিয়ার বার্তা !

প্রকৃতি এখন আর নিয়ম মেনে চলে না, চলতে চায় না। আমরা গাছপালা উজার করে, ফসলি জমি ধ্বংশ করে তথা প্রকৃতি উজার করে ঘর-বাড়ি, শিল্প কারখানা গড়ে চলেছি, প্রকৃতির তাপমাত্রা দিনকে দিন বাড়িয়ে চলেছি, ফলে প্রকৃতি তার নিয়ম মানতে পারছে না।

গত কয়েক দিনের বৃষ্টির ফলে আকাশে, গাছে গাছে পাখিদের আনা-গোনা দেখা যায় না। প্রকৃতির পাখিগুলো গাছের ডালে ডালে নিজেদের বাসায় চুপচাপ বসে আছে। বাড়ির পাশের বড়ই গাছের পরজীবী স্বর্ণলতা বৃষ্টির স্পর্শে লাল আভায় চকচক করছে। অসময়ে জলে ভরা ডোবায় ব্যাঙ ডেকে চলেছে অবিরাম। ভিজা বনের শ্যাওলা পথে সাপ ব্যাঙ মুখে নিয়ে চলেছে কোন গুহা পথে। রাতের ঝিঁ ঝিঁ পোকারা বৃষ্টির জলে ভিজে চুপচাপ হয়ে আছে; মাঝে মাঝে দু’একটা পোকা রয়ে রয়ে ডাকছে। শ্মশান, গোরস্থান, বন-জঙ্গল, মেঠোপথ কোথাও হাঁটু বা কোথাও গিঁড়া জলে ভিজে আছে। শিয়ালগুলো পাকা রাস্তার অন্ধকারে গোঁড়াডুবা ডোলকলমীর ঝোপে বিপদাপন্ন সুরে ডেকে চলেছে। সেই সাথে রাস্তার কুকুরগুলিও শিয়ালের সাথে অবিরাম ডেকে চলেছে। গায়ের গৃহীনিরা এ পরিবেশকে অসনিসংকেত মনে করে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থণা করছে। আগাম রোপা আলুর বীজ পঁচে গেছে। কৃষক মাথায় হাত রেখে প্রকৃতির পানে চেয়ে আছে, মিনতি করছে আর যেন বৃষ্টি না হয়।

ষড়ঋতুর কীর্তন করতে গিয়ে প্রকৃতির মত আমার সাহিত্য কবি সত্ত্বাও নিয়ম মেনে গায়নি। শরতের কীর্তন গাইতে শরতের সাথে গেয়েছে বর্ষা ও হেমন্তের পুঁথি গান, বর্ষার কীর্তন গাইতে বর্ষার সাথে গেয়েছে গ্রীষ্ম ও শরতের পুঁথি গান, ঠিক তেমনি করে আমার সাহিত্য কবি সত্ত্বা হেমন্তের কীর্তনেও গেয়ে চলেছে বর্ষা, শরৎ ও শীতের পুথিঁ গান।

বাংলাদেশের আবহাওয়া অফিস ও তাদের আবহাওয়া বার্তাও নিয়ম মেনে চলে না। আজ তাদের আবহাওয়া বার্তায় বলেছে, মুসলধারার বৃষ্টি কার্তিক মাসের ২২ তারিখে শেষ হবে। তারপর প্রকৃতিতে শীতের আগমন শুরু হবে। আজ কার্তিকের ২২ তারিখ। ২৩ তারিখ থেকে ঝরা পাতার গান শুরু হবে। ভরা কার্তিক আর মরা কার্তিক না হয় কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি গেল, (সম্রাট আকবর প্রবর্তিত বাংলা মাসের প্রথম মাস ) অগ্রহায়নের কি হবে, সে তো এখনও আসেইনি। প্রকৃতির এ অবস্থা হলে সম্রাট আকবর অগ্রহায়নকে বছরের প্রথম মাস ঘোষণা দিতেন না। প্রকৃতির সাথে সমসুরে গীত গাইতে গিয়ে বৈশাখ মাস সুবিধাজনক হওযায় হয়তো পরবর্তীতে এ মাসকেই বছরের প্রথম মাস ঘোষণা দেওয়া হয়েছে আর বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ একটি গান দিয়েই এ মাসকে করেছেন বিশ্বনন্দিত।

প্রকৃতির এ বিরূপ কর্মকে কার্তিক দেবতাও সামাল দিতে পারছে না। সদ্য চলে যাওয়া মাসের বিদায় আর নতুন মাসের আগমণকে গ্রহণ করতে ১ লা অগ্রহায়ণ বিকাল বা সন্ধ্যায় গৃহিণীরা লেপ-চাদর মুড়ী দিয়ে হয়তো আঙ্গিনায় আঙ্গিনায় বুড়ার পূজা উৎসব করবে। হাজার বছর ধরে হেমন্তকালে হেমন্তলক্ষ্নী আর কার্তিকের কৃপায় ফসলে ফসলে মানুষের ভাগ্যলক্ষ্নী দ্বারে দ্বারে পৌঁছে যায়। ফসলের ডগার শিশির বিন্দু দিনের প্রথম আলোয় চিকচিক করে উঠে; যেন দিনকে জানিয়ে দেয় সুজলা-সুফলা-শষ্য শ্যামলার আগাম বার্তা। সনাতন জাতি, উপজাতির মাঝে ‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌'ক্ষেত্তের বত্ত' বা খেত ফসলের দেব-দেবতার পূজা শুরু হয়। হলুদ রংয়ের খড়-নাড়ার বিছানায় মাঠে মাঠে শুরু হয় ওয়াজ মাহফিল। দেশ বা দশের কোন কল্যাণ না হলেও হাজার হাজার বছর ধরে ওয়াজ মাহফিল, মিলাদ মাহফিল, মাজার মানত, পূজা-পার্বন, বুদ্ধ বন্দনা, খ্রীস্ট বন্দনা চলছে, চলবে।

(আমার হেমন্ত বন্দনাও চলবে, যদি দেশ ও জাতির কোন উপকার হয় ?! )