ধারাবাহিক উপন্যাসঃ কাকভোর পর্ব-২

 থাক, আজ তোমার ছুটি।
কালী রাতের বেলায় মায়ের কাছে সব বলে দেয়। পরদিন শংকর পড়াতে আসল শেফালী তাকে কিঞ্চিৎ ব্যঙ্গ করে বিদায় করে দেয়। পরবর্তীতে আরো একজন ডিগ্রীতে পড়–য়া ছেলে মাস্টার হিসাবে রাখা হয়। ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটলে কালীপদ রঞ্জিতা নামের এক মহিলার কাছে তাদের পড়তে দেয়। দু’জনেই মহিলার বাসায় পড়তে যায়।

বার্ষিক পরীক্ষার খারাপ রেজাল্টের জন্য কালীপদ কালীকে মেরেছে। সারারাত সে ঘুমাতে পারেনি। শুধু খারাপ রেজাল্ট আর শংকর স্যারকে নিয়ে ভেবেছে। শংকর স্যার যা বলেছে--তা যদি সে মাকে না বলত, তবে নিশ্চয় মা তাকে বিদায় করত না। তার মঙ্গলের জন্য শংকর কি বলতে চেয়েছিল। শংকর সেদিন কান্নার্ত চোখে বিদায় নিয়েছিল। কালী লজ্জায় মুখ দেখাতে পারেনি। শংকর থাকলে হয়তো সে দুই বিষয়ে ফেল করত না। অংকেও এত খারাপ নাম্বার পেত না। গার্হস্থ্য বিজ্ঞানে সে ফেল করেছে। এই বিষয় তার মোটেও ভাল লাগে না। মাছ-মাংস, শাক-সবজি কিভাবে কুটতে হয়, রান্না-বান্না করতে হয়, ছেলেমেয়ে কিভাবে লালন-পালন করতে হয়, ঘর-দরজা কিভাবে পরিষ্কার রাখতে হয়-এই সব মুখস্ত করা তার মোটেও ভাল লাগে না। কালী ভাবে, বিদেশে কি গার্হস্থ্য বিজ্ঞান, কৃষি বিজ্ঞান আছে? সেখানে নাকি মেয়েরাও কৃষিকাজ করে। অথচ আমাদের দেশে...। কালীর ধর্ম সাবজেক্টটা পড়তে আগে ভাল লাগত--এখন ভাল লাগে না। তার মাঝে মাঝে মনে হয়, সিলেবাসে ধর্ম বিষয়টা না থেকে মহামনীষীদের জীবনী থাকলে অনেক ভাল হত। এগুলো পড়ে কেউ ধার্মিক হয়েছে বলে, তার মনে হয় না। বরং পা-তাপ করে বৃদ্ধ বয়সে হরি হরি, রামরাম শুরু করে। তার মতে এই বইটা বার্ধক্য সময়ে বাধ্যতা মূলক করা উচিত।
সপ্তম শ্রেণীর ১ম ক্লাশে একদিন মর্জিনা শিক্ষিকা সবাইকে জিজ্ঞাসা করেছিল --কে কি হতে চায়? সবাই বিভিন্ন পেশার কথা বলেছে। কিন্তু কালী বলেছে --সে আদর্শ গৃহিনী হবে, হাড়ি-পাতিল মাজবে, সন্তানাদি লালন-পালন করবে। নইলে গ্রাহস্ত্য বিজ্ঞানের অবমাননা হবে। ধর্ম-কর্ম করবে, সতীত্ব প্রমাণের জন্য সীতার মত অগ্নি-পরীক্ষা দেবে, স্বর্গ পাবার জন্য দেব-দেবীদের সন্তুষ্ট করবে--গীতা পড়বে, মহাভারত পড়বে --সীতা পড়বে, দ্রোপদী পড়বে। সীতার মত হতে হবে --দ্রোপদীর মত নয়। শিক্ষিকা অবাক হয়ে বলে, এতটুকু মেয়ে বলে কি ! এত সাহস তোমার !

বসন্তের এক দুপুর বেলা কালী বিছানায় শুয়ে নিজেকে নিয়ে ভাবছিল। কেন সে মেয়ে হল, স্রষ্টা কেন তাকে মেয়ে বানিয়ে পাঠাল আর পাঠালই যদি তবে তাকে এত কুৎসিৎ করে বানাল কেন ? পরের জন্মে সে কি পুরুষ হয়ে জš§াবে? আর যদি জন্মেও সে কি করে বুঝবে আগের জ জন্মে কালী নামে সে জ জন্মেছিল । কোথা যেন লেখা আছে একজন মানুষ জন্মের আগে সে ৮৪ লক্ষ বার বিভিন্ন জীব হয়ে জন্মেছিল। আর ভাবতে পারল না। ধর্মরহস্য নিয়ে ভাবলেই যত বাঁধা আসে। হঠাৎ মা তাকে ডাকতে শুরু করেছে। কালী মুখ কালো করে চিছানা থেকে উঠে এলো। একটি বিড়াল তার পায়ের কাছে আসতেই সে লাথি মারল খুব জোড়ে। বিড়াল ব্যথা পেয়েছে বলে মনে হল না। বিশ্ববেহায়ারা সহজে মরে না। তৃতীয় বিশ্ব যুদ্ধের পর তেলাপোকার সাথে হয়তো এরাও বেঁচে থাকবে। কালী ভাবে ৩য় বিশ্ব যুদ্ধ কবে হবে? ৩য় বিশ্বযুদ্ধ কি পৃথিবীর জন্য খুব জরুরী দরকার? এটা স্রষ্টার ব্যাপার-স্যাপার। এ নিয়ে ভাবলেও কোন লাভ নেই। যখন হবার তখনই হবে। আবার মায়ের ডাক এলো। অভি কাঁদছে। নিশ্চয়ই ঘুম থেকে উঠেছে। মা চিৎকার করে বলছেন ওকে কোলে নিতে। কালী অভিকে কোলে নিয়ে বাইরে বেড়িয়ে এল। অভির তবুও কান্না থামছে না। সন্মুখে তাকিয়ে সে দেখল এক মহিলা দক্ষিণ ঘরের ছায়ায় মোড়া পেতে বসে আছে। সে পান চিবুচ্ছে। একটি কাক তার পিছনে রাখা ব্যাগ থেকে কি যেন টানছে। মহিলা হাত উঠিয়ে কাক তাড়াল। শেফালী পাটি বিছিয়ে তার পাশে বসল। মহিলা কি যেন খুব গুরুত্ব সহকারে শেফালীকে বোঝাচ্ছে। শেফালী খুব মনোযোগে তা শুনছে। কালীর কোলে থাকা ভাইটি মায়ের কোলে যাওয়ার জন্য অবিরাম কেঁদে চলেছে।

 কালী, অভিকে দিয়ে যা 
 কে, বড় মেয়ে বুঝি?
 হ্যাঁÑ
 বেচেঁ থাক। এদিকে আসতো মা-
কালী তার সামনে এসে মাথা নিচু করে রইল।
 কোন ক্লাশে পড়?
 এবার সেভেন-এ
 ভাল করে পড়বা? আই.এ,বি.এ. পড়বা, বুঝলা?
 কি হবে এত পড়ে? হাড়ি-পাতিলই মাজতে হবে।
মহিলা হতভম্ব। সে এই ভদ্র, নম্র মেয়েটির এমন একটা কথা আশা করেনি। মা তাকে ধমকাল।
 ঐ তুই যা--। মেয়েটার একটু যদি জ্ঞান থাকত। কি হবে ওকে পড়িয়ে বলেন? ঘরের কোন কাজ করতে চায় না। ছেলেদের মত গ্রাম দৌড়ায়।
 থাক, আর একটু বড় হলেই সব ঠিক হয়ে যাবে।

কালী দক্ষিণ ঘরে মায়ের খাটে শুয়ে পড়ল। এখান থেকে সে মহিলার কণ্ঠস্বর স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে। ঘরের খুঁটিতে চলমান পিঁপড়া সে হত্যা করতে শুরু করল। আর বলতে লাগল--
 ভগবানের অদৃশ্য আদেশে আমি আজ তোদের যম হলাম। আমারও যম আছে। আমাকে হত্যা করলে সেই যমের যেমন পাপ হবে না। তোদের মারলেও আমার পাপ হবে না। তোদের মৃত্যুটা হয়তো আমার হাতেই লেখা ছিল। শেফালী অভির জন্য যেখানে বার্লি রেখেছিল সেখানে একটি চিকা ইতস্তত হাঁটতে লাগল। কালী চিকাটিকে তারাল না। আজ তার কিছু ভাল লাগছে না। শংকর তাকে আর কোনদিন পড়াতে আসবে না। মহিলা হঠাৎ জোড় গলায় শেফালীকে বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা, বাল্য বিবাহের পরিণতি সম্পর্কে বোঝাচ্ছেন। স্ত্রী শিক্ষা সম্পর্কে দীর্ঘ এক বক্তিতা দিলেন।
জানেন দিদি, স্ত্রী শিক্ষা একান্ত প্রয়োজন। সন্তানের লালন-পালন, শিক্ষা-দীক্ষার গুরু দায়িত্ব প্রথমেই থাকে মায়ের উপর ...। মা শুনছেন আর হ্যাঁ হ্যাঁ করছেন। কতটুকু মায়ের মাথায় ঢুকবে আর কতটুকু অন্য কান দিয়ে বের হয়ে যাবে কালী তা জানে। বিকালে খেলা শেষে সন্ধ্যায় বাড়ী ফিরলেই বিয়ের কথা, শ্বশুর বাড়ীর কথা উঠে যাবে। মহিলার গলার স্বর হঠাৎ নীচে নেমে গেল। সে শেফালীকে পরিবার পরিকল্পনা সম্পর্কে জ্ঞান দিচ্ছে। উত্তর ঘর থেকে অনিতা ঠাকুরমাকে ডাকছে। তুলসী রান্নাঘর থেকে উত্তর ঘরে গেল। উত্তর ঘরে মুরগীর বাচ্চারা পাতিলে রাখা চাউল ফেলে দিয়েছে মেঝেতে। কালীর এই ছোট বোন অনিতা ঘরকুনো। একেবারে কালীর উল্টো। জয়ের দুই বছরের ছোট। কথা খুব কম বলে। সে মায়ের কাছেই পড়ে। সব সময় মায়ের আঁচলে আঁচলে থাকে।
আজ রাতে নিতাই শীলের নারিকেল গাছ থেকে কালী, নাসরিন, দীপা, মিলন, কল্যাণ সকলে মিলে নারিকেল চুরি করার সমস্ত পরিকল্পনা করে ফেলেছে। নিতাই শীলের বাড়ী কালীদের বাড়ীর কাছাকাছি। পড়ার ফাঁকে পায়খানায় যাবার কথা বলে কালী নিতাই শীলের নারিকেল বাগানে চলে আসে। কালী নারিকেল গাছে উঠল। নারিকেলের গুচ্ছ কেটে দরিতে বাঁধতে লাগল। একটি নারিকেল তার হাতের গিঁট দেওয়া দড়ি থেকে মাটিতে পড়ে যায়। ফলে ভীষণ শব্দ হয়। নীতাই শীল কে কে করে চিৎকার দিয়ে হারিকেন নিয়ে বাগানে আসে। নাসরিন, দীপা, মিলন, কল্যাণ পালিয়ে যায়। কালী গাছ থেকে তারাতারি নামতে গিয়ে মাটিতে পড়ে যায়। বেশ ব্যথা পায়। নিতাই শীল ওর কান ধরে কালীপদের কাছে নিয়ে আসে। বকাবকি করে নীতাই শীল বাড়ী ফিরে। কালীপদ কালীকে খুব মারে। রাতে কালী ভাত না খেয়ে কেঁদে কেঁদে ঘুমিয়ে পড়ে। তুলসী ওকে জোড় করে গুম থেকে উঠায়ে ভাত খাইয়ে দেয়। কালীকে তুলসী বোঝাতে থাকে।
 শুন, তুই যদি খোদাইষাড়ের মত চলিস -- তাহলে তোর বাবায় তোরে বিয়া দিয়া দিব।
 ইস্ বিয়া দিয়া দিব, বুড়ী বলল একটা কথা । ঐ বুড়ী মিলনওতো চুরি করছে। ওর মা ওরে বকব --বিয়া দিব ? নাসরিনরে ওর মা-বাবায় বিয়া দেবার কথা বলে ? বাবায় যতবার আমাকে মারে ততবার আমারে বিয়া দেয়, মাও আমারে বিয়া দেয়।
 ঐ মিলন, নাসরিনের কথা বলিস, ওরা তো মুসলমান।
 আহারে মুসলমান ! কাল কল্যাণরে জিজ্ঞাসা করব, ওর মা ওকে বিয়ার কথা বলেছে কিনা ?
 ওরাতো পুরুষ মানুষ।
 আর তুমি তো মেয়ে মানুষ। এজন্যই তো সাদা কাপড় পড়, উপাস কর, নিরামিষ খাও, একাদশী কর। ঐ বুড়ী কারো বউ মারা গেলে সে কি সাদা কাপড় পড়ে--উপাস করে--একাদশী করে --নিরামিষ খায় ?
 আহারে, এই জন্যইতো ভগবান আমাদের মেয়ে বানিয়েছে।
 আর তাদের ছেলে বানিয়েছে। আমি ভগবানের কাছে যাব। তুমি আমারে উনার কাছে নিয়ে যাও।
 হায়,হায় বলে কি? পাপ হবে, এই কথা বলতে নাই।
 হ্যাঁ, তোমার পাপ হবে--আমার হবে না। আমি মারা গেলে ভগবতীকে ধরব।
 ঐ পাগল হলি। তোর পেটে এত ! কালীপদরে বলব, তোরে যেন তারাতারি বিয়া দেয়।
 বা-বা! আবার বিয়া ! আর কতবার বিয়া দিবা ?

কিছুদিন পর এক সন্ধ্যারাতে হঠাৎ শিখাদের বাড়ীতে অনেক মানুষের চিৎকার শুনা গেল। কালী, তুলসী, শেফালী--কেউ কিছু বুঝতে পারল না। তুলসী জয়ের হাতে হারিকেন দিয়ে কালীসহ তারা তিনজনে শিখাদের বাড়ী মুখী যাত্রা শুরু করল। বাড়ীতে গিয়ে দেখে এক আধাবয়সী পুরুষকে ঘিরে আছে অনেক মানুষ। উঠানের মাঝখানে লোকটি বসে আছে। দাঁড়ি আর পোশাক-আশাকে বুঝা যাচ্ছে উনি একজন ফকির। শিখাকে জিজ্ঞাসা করে কালী জানতে পারল, ফকির ভাড়ে বসেছে। ফকির পাগলের মত হাত দুটি মাটিতে চাপরাচ্ছে। শিখা বলল, এই ফকির, মানুষের যে কোন সমস্যার সমাধান করে দিতে পারে। শিখার বৃদ্ধ দাদা বেশ কিছুদিন ধরে পাগলামী করছে। বৃদ্ধ বয়সে পাগলামী অসম্ভব কিছু নয়। হতে পারে। অথচ সকলের ধারণা অন্যরকম। শিখার কাকাত ভাই যার বয়স ১০ মাস, তার সব সময় অসুখ লেগেই থাকে। আরো অনেকের খারাপ বাতাসের ছোঁয়া, ভূত-পেত্মী ইত্যাদি ধরণের রোগ আছে। কালী শিখার কাকার দিকে তাকিয়ে আছে। কাকা ফকিরকে জিজ্ঞাসা করছে, কি করলে তার পুত্র আরোগ্য লাভ করবে। ফকির ক্লান্ত মুখে অদ্ভুদ ভংগীতে বলতে লাগল, ৫টাকা আটানা মাজারে দিতে হবে। ৫ সের চাল আর ৫ সিকে ৫ জন ভিক্ষুককে দিতে হবে এবং ৫ পুকুরের পানি মিশিয়ে আবুল ফকির কে দিতে হবে। তার পড়া পানি বাচ্চাকে খাওয়াতে হবে।
আবুল ফকির সেই। সবাই বলে, আবুল ফকির একজন দিব্য মহাপুরুষ। সে এক অলৌকিক মানব। ছোট ছোট ছেলেমেয়ে থেকে শুরু করে যুবক-যুবতী, প্রৌঢ়-প্রৌঢ়া সবাই অবাক হয়ে দেখছে। কালীর বিশ্বাস হচ্ছে না। তবু কালীর জানতে ইচ্ছে করছে অতি গোপনীয় একটা ব্যাপার যা এতগুলি মানুষের সামনে বলা যাবে না।
 ঠাকুরমা, বারেকের বাবা কাগজে কি লিখেছিল?
 কি জানি, গোপন ব্যাপার।
 আমিও কাগজে লিখে দেই?
 কি লিখবি?
 তোমাকে বলা যাবে না।
 তোর বাবার ব্যবসা ভাল যাচ্ছে না। ফকিরকে জিজ্ঞাসা করি।
ফকিরকে জিজ্ঞাসা করা হল। সে একদামে একটা তাবিজ কিনতে বলল এবং আবুল ফকিরের কাছে যেতে বলল । কালী এতক্ষণে শিখার কাছ থেকে কলম নিয়ে গোপনীয় সমস্যাটা লিখেছে। নাসরিন জিজ্ঞাস করল,
 কি লিখেছিস?
 বলা যাবে না।
কাগজটা ফকিরের সারগেদের মাধ্যমে ফকিরকে দেওয়া হল। সে মুখে পুড়ে সত্যি সত্যি খেয়ে ফেলল। ৩/৪ মিনিট অদ্ভূত ভংগী করে বলল, খুব শীঘ্রই ফল পাবে।
আবুল ফকির তার কর্ম মহৎ থেকে মহত্তর করার জন্য কারো কাছ থেকে টাকা-পয়সা নিত না। যা খরচ হয় শুধু তাই নিত। সবাই এজন্য তাকে জোড় করে লাউ, কুমড়া, চাউল, ডাউল, শাক-সবজি ইত্যাদি দিয়ে আসে। এসব দিয়ে তার সংসার ভালই চলে। তার মুখের জোড় আছে। গ্রাম্য শালিশীতে বসলে সবাই সাবধানে কথা বলে। তাকে কেউ কিছু বলতে সাহস পায় না। কারণ সে বান মারতে পারে। সে মনসা পূজায় ভোগ দেয়। কালীপূজায় সক্রিয়ভাবে হিন্দুদের সাথে থাকে। তার গুরু নাকি শ্মশান কালী।
কালীর গাঁয়ের রং কবে, কিভাবে ফর্সা হবে। কবে তার চেহেরা ভগবান সুন্দর করে দেবে--এই দুইটা লাইনই সে কাগজে লিখেছিল। দীর্ঘ দুই মাস পরও সে তার ফল পায়নি। বরং সে আরো অনাকর্ষণীয় হয়ে উঠছে। দেহ মোটা হচ্ছে। চেহেরা ফুলে যাচ্ছে। তবে কালীপদ ভাল ফল পেয়েছিল। তার ব্যবসা এখন খুব ভাল চলছে। মায়ের দেওয়া তাবিজ সে মাকে খুশী করার জন্য মাজায় দিয়েছিল। প্রথম দিন স্নান করার সময় নদীতে ফেলে দিয়েছে। এখন ঈদের মওসুম। ব্যবসা তো ভাল হবেই। কিন্ত তুলসীর ধারণা তাবিজের কারণেই হয়েছে। ফলে সে আবুল ফকিরের বাড়ীতে চাউল, ডাউল, শাক-সবজি ইত্যাদি নিজ হাতে দিয়ে এসেছে।
কথা প্রসঙ্গে কালী বড় ঈদের আগের দিন নাসরিনের সাথে বাজী ধরল সে গরুর মাংস খাবে। নাসরিন ১০০ টাকা বাজী ধরল। ঈদের পরের দিন। দিনটি ছিল বৃহস্পতিবার। বিকালের দিকে কালী সত্যি সত্যি গরুর মাংস খেল। তবে সামান্য একটু মুখে দিয়েছে চোখ বন্ধ করে। যা খেয়েছে তার চেয়ে বেশী বমি করে দিয়েছে। চিরাচরিত নিয়ম সে ভাঙ্গতে পারেনি। যে জিনিস খাওয়াতে মানুষ অভ্যস্ত নয়--তা তারা সহজে খেতে পারে না--খেলেও হজম করতে পারে না। অনেক দেশেই সাপ কেঁচো, তেলাপোকা ইত্যাদি খাদ্য হিসাবে চলে। অথচ আমাদের দেশের সাধারণ মানুষ শুনলেও থুথু ফেলায়। আসলে অভ্যস্ততা হলো খাদ্যের পূর্বশর্ত। বাজী ড্র হিসাবে ধরা হয়েছে। কালী সারাদিন--সারারাত অপরাধ অপরাধ মনে করে বিবেকের কাছে প্রশ্নবানে বিদ্ধ হয়েছে। যেভাবে মোরগ-মুরগীর মাংস খাওয়া শিখেছিল সেভাবে যদি গরু খাওয়া শিখত তবে কোন অসুবিধা, ঘৃনাবোধ হত না। কিন্তু প্রত্যেক ধর্মেই কিছু কিছু বিধি নিষেধ আছে--যা একজনকে অপর জনে থেকে আলাদা করে। তবুও যে খাদ্য সময়, অবস্থান ও পরিবেশ পরিপ্রেক্ষিতে নিষিদ্ধ তা ভিন্ন সময়, ভিন্ন অবস্থান ও ভিন্ন পরিবেশে হয়ে উঠে সিদ্ধ।

সন্ধ্যাবেলা কালী শুদ্ধ কাপড়--চোপর পড়ে লক্ষ্মীর পাঁচালী পড়তে শুরু করল। তুলসীকে সামনে দেখে সে জোড়ে পড়তে লাগল। মাঝখানে থেমে সে নিজের কথা বলতে লাগল।
 মা, মা লক্ষ্মী আমাকে সুন্দর বানিয়ে দাও। আমি যেন দীপা, নাসরিনের মত সুন্দরী হই।
 কিরে, কি বলিস পাঁচালী পড়ার সময়, পাঁচালী পড়া শেষ হলে যা চাওয়ার চাইবি। এত জোড়ে চাসকে ?
 আরে বুড়ী, যখন ঝড় উঠে তখন তো হরিবল হরিবল করে--পবন ঠাকুর, পবন ঠাকুর করে জোড়ে চিৎকার কর--তখন জোড়ে বল কেন? হরিতো সব জায়গায় থাকে। আস্তে বললেও শুনে। তুমিতো চিৎকার করে বল, হরি যেন ভাল করে শুনতে পায়। আমিও মা লক্ষ্মীরে ভাল করে শুনাই । পেঁচামার্কা কান হলে তো আস্তে বললে শুনবে না--তাই জোড়ে বলি। এত বছরতো আস্তে বলছিÑমনে হয়, কানে শুনে নাই। এবার জোড়ে বলি। তোমার ভাই কার্তিকের মত আমাকে একটা বর দিও। আমাকে সুন্দরী বনিয়ে দিও।
 ঐ লক্ষ্মী মায়ের কাছে এসব চাস কেন? লক্ষ্মী মা তো এসব দেয় না।
 তবে কোন দেবীর পূজা করলে সুন্দরী হওয়া যায়--সেই দেবীর নাম বল। তেত্রিশ কোটি একটি দেব-দেবীর মধ্যে সেই দেবী নাই ?
 ঐ তোর আজকাল কি হয়েছে, আগে তো এমন ছিলি না।
 আমার মত হলে তুমি বুঝতে, কেন এমন হয়েছি?

৮ম শ্রেণীতে উঠার পর কালী আগের চেয়ে আরো বেশী পরিবর্তন হয়ে গেছে। ওর তনিমা মাসী ঢাকা থেকে ওর জন্য অনেক বই ও ম্যাগাজিন পাঠায়। সময় পেলে, কখনও লেখাপড়া বাদ দিয়ে শিখা, নাসরিনদের নিয়ে সে সেসব বই পড়ে। কোন লেখা তার মন মত হলে নাওয়া-খাওয়া ভুলে সে লেখা শেষ করে।


(চলবে)

1 comment: