স্বপ্নের বীজ বোনার অপেক্ষায়

                          
                                   

গ্রীষ্মের শেষ, বর্ষার শুরু--আষাঢ় মাস; গত মাসের মত এ মাসেও  সূর্যের সাথে যুদ্ধ করে মেঘ খন্ডগুলো হেরে গেছে। ফলে সমস্ত মেঘ খন্ড হিমালয়ে একত্র হয়ে আবার আক্রমণের প্রস্তুতি নিচ্ছে। এদিকে গ্রাম বাংলার মাঠ-ঘাট ফেটে চৌচির হয়ে গেছে। নদী-নালার পানি রেখা একবারে তলায় ঠেকে গেছে। অসংখ্য ফল গাছের ফুলের রেনু রৌদ্রতাপে শুকিয়ে যাচ্ছে। পানির অভাবে ক্ষেতের ফসল কেমন যেন, হাহাকার করছে। ভোর হবার পর থেকেই সূর্যের প্রচন্ড তাপ পৃথিবীর বুক জুড়ে দগ্ধ কেয়ামতের সংকেত দিয়ে যাচ্ছে। নিরব নিথর দুপুরবেলা রাখালেরা গাছের ছায়ার গরুগুলিকে বেঁধে গামছাটা শীতল ঘাসের উপর বিছায়ে শুয়ে পড়ে। কৃষক গাছের ছায়ায় বসে লুঙ্গি দিয়ে দেহের ঘাম মুছে, মাথার বিড়া দিয়ে বাতাস করছে। এদের দেখে মনে হয় যেন, আগুন থেকে উঠে এসেছে। হাত-পা মুখ লাল হয়ে আছে রৌদ্রতাপে। গাছে গাছে পাখিরা থেমে থেমে ডেকে চলেছে। মাঠে মাঠে গরু-ছাগল-ভেড়া--প্রাণীগুলি সূর্যেরও তাপদাহে একটানা ডেকে চলেছে। এর মাঝে দু’একটা ছেলে-মেয়েকে গোবর কুড়াতে দেখা যাচ্ছে । কিছুদূরে দক্ষিণে বড় রাস্তা দিয়ে একটা ছোট ট্রাক যেতেই ধুলি-বালি উড়ে অন্ধকার হয়ে গেল। পথের পাশে বড় বড় গাছের ছায়ায় লুঙ্গি গামছা বিছায়ে পথিক বিশ্রাম করছে। চারদিক হঠাৎ নিরব হয়ে  গেলে দূর হতে দুই-একটি ঘুঘুর ঘু-ঘু ডাক শোনা যায়। মনে হয়, এরা যেন বৃষ্টির জন্য স্রষ্ঠার কছে মিনতি করছে। চৌচির মাঠ-ঘাট আর তৃষ্ণার্ত ফসল ক্রমাগত মিনতি করে চলেছে স্রষ্ঠার কাছে। মাঝে মাঝে ছোট ছোট ছেলেমেয়ে, কখনও বড়দের কণ্ঠ থেকে ধ্বনিত হচ্ছে--আল্লা মেঘ দে--পানি দে--ছায়া দেরে তুই--আল্লা মেঘ দে--। প্রখর বহ্নিজ্বালায় রুদ্রমুখী প্রকৃতি; শুষ্ক চৌচির ফসলের মাঠ; শ্যামলতাহীন রুক্ষ মরুর ধূসরতায় প্রাণহীন প্রকৃতি যেন, এক মৌনী তাপস। আবার হঠাৎ হয়তো একদিন ‘ধূলার ধূসর রুক্ষ উড্ডীন পিঙ্গল জটাজাল’ নিয়ে তপক্লিষ্ট, তপ্ততনু ভীষণ ভয়াল গ্রীষ্ম  অপরাহ্নে ডেকে আনে ক্রুদ্ধ শিবের কালবৈশাখী ঝড়--প্রকৃতিকে ভেঙ্গে চুঁড়ে নতুন করে সাজানোর খেলা শুরু করে। ।
 প্রকৃতি এখন  মাস-দিনের নিয়ম মেনে চলে না। তবুও অপেক্ষা করছি যদি মুসলধারে বৃষ্টি নামে । পুরো জৈষ্ঠ মাসের আম-জাম--কাঁঠাল-জামরুল-লিচুপাকা গরমের মধ্যে শিশির অথবা ভেজা ঘামের মত সামান্য বৃষ্টি হয়েছিল--তাও এক-আধদিন--সেটাও আবার প্রকৃতির চাহিদার সমুদ্রের মধ্যে এক ডোবার মত। অতএব বনের চাতকের মত মনের চাতকও  নির্ঘুম চোখে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে বৃষ্টির জন্য। কর্দমাক্ত মাটিতে কিছু স্বপ্নের বীজ বুনব; হয়তো লাউ, লিচু, জাম অথবা ডাটা শাকÑ কোনটা সংসারের নিত্যদিনের জন্য, কোনটা ছেলে-মেয়ের ভবিষতের জন্য অথবা দেশের ভবিষতের জন্য।
 সারাদিন-সারারাত নির্ঘুমে অপেক্ষায় থাকি--আসুক ঝড়-বৃষ্টি-তুফান, অপূর্ব মেঘের সমারোহে শ্যামল নয়নাভিরাম বর্ষা অতি ভৈরব হরষে সুচণা করুক তার শুভাগমন, আসুক শ্যামছায়াঘন দিন, শুষ্ক প্রান্তর, নদী-নালা ও খালবিলে জাগুক প্রাণোচ্ছ্বাস। প্রকৃতির ধূলি বিষন্ন অঙ্গ থেকে গ্রীমের ধূসর অবসাদ মুছে গিয়ে ফুটে উঠুক সজল বর্ষার শ্যামল সুন্দর রূপশ্রী। জেগে উঠুক স্বপ্নের বোনা বীজ থেকে অংকুরিত চারা গাছ। আসুক পুষ্প বিকাশের লগ্ন। কদম, কেয়া, জুঁই, গন্ধরাজ, হাসনাহেনা বিচিত্র বর্ণ ও গন্ধের উৎসবে শুরু হোক মেঘ, বৃষ্টি আর আলোর মেলা।


ঠিক এমনি মুহুর্তে চৌরা পাড়ার (যারা নদীর চর বা চরের কাছাকাছি বাস করে) দশ-বারোজন কিশোরী-যুবতী এবং মধ্যবয়সী মহিলা “কুলা ঠান্ডা করতে”




    সূর্য পশ্চিম দিকে হেলতে আরম্ভ করলে পরাজিত মেঘ খন্ডগুলি সদলবলে দক্ষিণ দিক থেকে প্রচন্ড বেগে ছুটতে আরম্ভ করে। মুহুর্তের মধ্যে শুরু হয় ঝঞ্চা, বিদুৎ চমকায়   মুহুর্মুহু, দিগন্ত প্রসারিত হয় বজ্র-নির্ঘোষে, পথের ধূলিকনা ও নদীর তীরের বালুকারাশি বিক্ষিপ্ত হয়ে চারদিক ঢেকে ফেলে


ঝড়ের তান্ডব লীলায় গাছ-পালার শাখা- প্রশাখা ভেঙ্গে যাচ্ছে। কিছু কিছু উঁচু ভিটির গাছের গোড়া সহ উঠে যাচ্ছে। বাঁশবন ধরাশায়ী হয়ে পড়ছে পাখিদের বাসা ভেঙ্গে যাচ্ছে। এরা ঝড়ের বাতাসে উড়ছে। নিজেদের গতি ঠিক না রাখতে পেরে চিৎকার করছে। কালীদের উঠান লতা-পাতা আর বিভিন্ন ময়লায় ভরে গেছে। তুলসী উত্তর ঘর থেকে আর শেফালী দক্ষিণ ঘর থেকে ভগবানকে ডাকছে।
দুপুর আর সন্ধ্যার মাঝামাঝি হল বিকাল। পূর্বাকাশে আবছা রংধনু উঠেছে। মেঘের গুড়–ম গুড়–ম শব্দের ফলে পুকুর হতে অনেক কইমাছ ডাঙ্গায় অল্প জলে লাফালাফি করছে। কালীদের বাসার দক্ষিণের বিস্তৃত অগভীয় ডোবায় (অনেকটা ছোট্র ক্ষেতের মত) অনেক পানি জমেছে। তরলের ধর্ম অনুযায়ী, এই পানি নি দিকে পুকুরে গড়িয়ে যাচ্ছে। এই ডোবায় নেমে কিছু ছেলেমেয়ে মাছ ধরছে। কেউ কাগজের নৌকা, জাহাজ বানিয়ে ঐ জলে ভাসিয়ে হাত তালি দিয়ে







কোরবানী ঈদের সময়ের সত্যি ঘটনা নিয়ে লেখা দুই পর্বের গল্প : আলোকিত অন্ধকারের জনপথে

২য় পর্ব/শেষ পর্ব.


ঈদের একদিন পর, সকাল বেলা, দেখি নারীটি ওখানেই পড়ে আছে। তবে আগের চেয়ে কিছুটা সুস্থ্য। আরো কিছু আয়া-বুয়া ও স্থানীয় কয়েকজন মমতাময়ী, দয়াময়ী মহিলার সাহায্যে জটা পাকানো চুল কাটালাম, নক কাটালাম। পরিস্কার করিয়ে বন্ধু ডাঃ ফেরদৌস এর সাহায্যে- Medicine ward-এ অজ্ঞাত বলে Police case হিসাবে ভর্তি করালাম। ওর সাহায্য পাওয়াতে দ্বিগুণ উৎসাহে কাজ এগোতে লাগল। এখন ডাক্তার, নার্স, স্থানীয় মানুষ, ঔষধের দোকানদার আয়া-বুয়া সবাই সাধ্যমত মানবীয় দায়িত্ব পালন করতে লাগল।

ঈদের দুইদিন পর, সকাল বেলা। Medicine ward unit-IV এর Bed no.Ex-16 তে গিয়ে দেখি নারীটি শুয়ে আছে। দুপুর বেলা দক্ষিণ বঙ্গের আমার দুই জন আত্মীয়--এডভোকেট স্বপন, এডভোকেট সঞ্জিত, আমার ছাত্র-ছাত্রী নিশু, আরজিনা, আলী আহমদকে নিয়ে ওয়ার্ড-এ গিয়ে দেখি নারীটি বসে বসে ভাত খাচ্ছে। নিশু অবাক হয়ে বলছে, স্যার একি !
পুরোপুরি সুস্থ্য। অবাক হবার কারণ সে আমার সাথে প্রথম থেকেই ছিল। এ রকম অবস্থা থেকে একটু ভালোবাসায় ছোঁয়া পেলে মানুষ যে বাঁচতে পারে--এটা তার প্রথম অভিজ্ঞতা। এডভোকেট স্বপনদাকে বললাম, আপনাদের অঞ্চলের মানুষ, দেখুন কথা বলে, কোন ঠিকানা বলে কিনা। স্বপনদা কিছু কথা বললেন, ঠিকানা উদ্ধার করতে পারলেন না। বললেন, আর কিছুদিন পর আবার আসব, আরো সুস্থ্য হোক।

চিকিৎসা বিদ্যার পাশাপাশি মানুষ হিসাবে নৈতিক দায়িত্ব ও কর্তব্য শিক্ষার জন্য এখন প্রতিদিন সকাল এবং অফিস শেষে ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়ে দু’বার রোগীটি দেখতে যাই। আমার পরিবারের উৎসাহ আমার চেয়ে কম নয়। আমার সহধর্মিনী ডাঃ সুপ্রিয়া রায় জামা-কাপড়, ফল নিয়ে একদিন রোগীটিকে দেখে গেছে। গত শুক্রবার পুরান ঢাকার বন্ধু জাহাঙ্গীর আলমকে নিয়ে রোগীটিকে দেখতে গিয়েছিলাম। সব ঘটনা শুনে নিজের অজান্তে বলে ফেললেন, আল্লাহ আপনাকে দিয়ে এই নারীটিকে বাঁচিয়েছেন।

ওয়ার্ডের সিনিয়র নার্স হাসিনা খানম অকৃত্রিম মাতৃস্নেহে রোগীটিকে সেবা করে যাচেছন। এই রকম নার্স হাসপাতালে কিছু সংখ্যায় থাকলে এরকম অজ্ঞাত,অসহায় রোগীর ভাল সেবা হয়। হাসিনা খানম গত শনিবার বললেন,স্যার,মানসিক বিভাগে ভর্তি করানো মনে হয় লাগবে না।রোগী কথা-বার্তা ভালই বলছে। আমি আর একটু চেষ্টা করে দেখি। এখন সে নিজে খায়। নিজে নিজেই বাথরুমে যায়। সবার সাথে একটু একটু কথা বলে।আমি শুনলাম,খুশি হলাম, বললাম, মানসিক বিভাগে না নিলে তার প্রকৃত চিকিৎসা হবে না।

অফিসে বসে ভাবছি, বিস্তীর্ণ শীতের কুয়াশা অথবা অন্ধকারের পথে আমরা আজো হাজার বছর ধরে পথ হাঁটছি। এত মানুষ, এত সম্পদ, এত কুরবানী, এত আনন্দ, আবার মানুষের কারণে কত যন্ত্রণা, কত দুর্বিসহ ঘটনা ঘটে। একজন Diabetic রোগী, সারাদিনে আধা কেজি খাবারও খেতে পারেনা অথচ কোটি কোটি টাকার সম্পদ তার। সম্পদ বাড়ানোর জন্য এদেশের মুষ্টিমেয় কিছু মানুষ, হেন কোন খারাপ কাজ নেই--যা তারা করে না। যদি এরা যাকাত ঠিকমত আদায় করত অথবা সরকারী নিয়মে ট্যাক্স ঠিকমত দিত তাহলে এদেশের পথে পথে এ রকম নারীরা পড়ে থাকত না।

কেন যে সমাজ কল্যাণ মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে মানুষকে সচেতন করছে না--বুঝিনা। মানুষরূপী কিছু মানসিক ভারসাম্যহীন যাদের কে খুব সহজ করে পাগল বলি ; এরা আমাদের আশে পাশে থাকে বিড়াল কুকুরের মত ছন্নছাড়া হয়ে। ফুটপাতের সর্বহারারা তো তবুও ভিক্ষা বা কাজ এর মাধ্যমে খাবার চাইতে পারে। এরা তাও পারে না। কেউ তাদের কাছে ঘেঁষতে দেয় না।

মানুষ, প্রকৃতির এ নির্মম খেলা থেকে কিছুই শিখে না। শিখে না ইতিহাস থেকে, শিখে না এ নিথর পড়ে থাকা মানুষরূপী এ নারীটির জীবন থেকে। তবে এ কাজ থেকে একটা বিষয় বুঝতে পারলাম । সাধারণ মানুষরা কেউ একা একা জামেলায় জড়াতে চায় না। তবে মানবীয় গুনাবলী প্রকাশ করার সুযোগ সবাই চায়, সবাই খুঁজে। চায় একজন নেতা এবং তার নি:স্বার্থ নেতৃত্ব। এই যে আমি, নেতৃত্ব দিয়ে কাজটি শুরু করেছি, এখন সবাই যার যার সাধ্য মত কাজ করছে। আসুন, আমরা শুরু করি, আমরা জাগি, আমরা জাগলে, সবাই জাগবে, জাগবে বাংলাদেশ।

কোরবানী ঈদের সময়ের সত্যি ঘটনা নিয়ে লেখা দুই পর্বের গল্প : আলোকিত অন্ধকারের জনপথে

১ম পর্ব

মিটফোর্ড হাসপাতালে চাকুরীতে যোগদানের দিন এবং তারপরও আরো কিছুদিন বুড়িগঙ্গার বিষাক্ত পানির দুর্গন্ধে বেশ কষ্ট হয়েছিল আমার। ভাবতাম, আর সব মানুষেরা কিভাবে চলছে। কিছুদিন পর এই পরিচিত গন্ধ আমার নাকের Olfactory nerve স্বাভাবিকভাবে মেনে নিয়েছে এবং আমি আর এখন গন্ধ পাই না। হাসপাতালে রোগীর ভীড় খুব বেশী। এখানে কোন কোন বিভাগের Out door এর ডাক্তাররা দিনে ২০০-৩০০ জন রোগী দেখে । Out door এর রোগীদের মধ্যে ৮০% মুখ খোলা বোরকা পড়া মহিলা, ৫% মুখ ঢাকা বোরকাপড়া (হাত-পা এর আঙ্গুলসহ), ১০% লুঙ্গি-শার্ট পড়া, আর বাকীরা লুঙ্গির সাথে গেঞ্জি, লুঙ্গির সাথে পাঞ্জাবী-টুপী, কেউবা শুধু লুঙ্গি পড়ে, কিছু রোগী প্যান্ট শার্ট ইত্যাদি পরিধান করে এখানে আসে। পরিধানের এই বর্ণনা দিয়ে বুঝাতে চাচ্ছি, এদের প্রায় সবাই অতি সাধারণ মানুষ। এ দেশের দারিদ্র আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে এরা আচ্ছাদিত। এদের সবাই ধর্মভীরু। আমাদের চিকিৎসার পাশাপাশি এরা তাবিজ-কবজ, ডিমপড়া, পানিপড়া, পীর-ফকির ইত্যাদিতেও বিশ্বাস করে। যোগদান করার পর থেকে আমার মনে হয়েছে আমি সতেরশ অথবা আঠারশ শতাব্দিতে এসে পড়েছি। রোগীরা খুবই সহজ-সরল এবং রোগ-বালাই সম্পর্কে এদের ধারণা হাস্যকর। দরিদ্রতা, অজ্ঞতা, অশিক্ষা, পারিবারিক অশান্তি এদেরকে মনে হয়, একুশ শতকের আলোকিত অন্ধকারের জনপথে আবদ্ধ করে রেখেছে।
হাসপাতালের প্রথম গেটের গলি দিয়ে রোগী, রোগীর সাথী ও সাধারণ মানুষের যাতায়াত খুব বেশী। প্রথম গেটের গলি দিয়ে হাসপাতালের দক্ষিণ দিকের গেট পার হয়ে বুড়িগঙ্গা ঘাটে যাওয়া যায় এবং সেই ঘাট দিয়ে বিষাক্ত পানিপথ নৌকাযোগে পর হয়ে কেরানীগঞ্জ যাওয়া যায়। কোরবানী ঈদের আগের কয়েকদিন প্রথম গেটের গলি দিয়ে রোগী ও সাধারণ মানুষের যাতায়াত খুব বেশী দেখা গেছে। বিশেষ করে, ঈদের দুই দিন আগে নয়া বাজার হাটের গরু, ছাগল, মোটর গাড়ী, রিকসা, ভ্যান আর মানুষের প্লাবনে প্লাবিত হয়েছে মিটফোর্ডের রাস্তা, হাসপাতালের গেট, বুড়িগঙ্গা ব্রীজের এপারের তীরদেশ। প্রথম গলি দিয়ে ঢুকতে হাতের বাম পাশের ছোট ফুটপাতে সাড়ে তিন হাতের কম পরিমাণ জায়গার সাপের মত কুন্ডুলী পাকিয়ে একটি কঙ্গালসার, অর্ধনগ্ন নারী পড়ে আছে গত কয়েকদিন যাবৎ। প্রায়ই দেখতাম, কিছু মানুষ উৎসুক হয়ে দেখছে ; কেউ কথা বলতে চেষ্টা করছে। আমি নারীর কাছে ভীড় করা মানুষের নানা কথা শুনেছি ; নানা জন নানা ধরণের কথা বলেছে ; কিভাবে সাহায্য করা যায় --তাও আমি শুনেছি তাদের আলোচনা থেকে। আমিও ভীড় করা মানুষের একজন, দায়িত্ব এড়িয়েছি। তবে ভেবেছি, শত শত ধর্মভীরু মানুষ, বোরকা পড়া রোগী, তাদের সাথিরা অথবা কোন ষ্টাফ নিশ্চয়ই Emergency-তে নিয়ে যাবে। কিন্তু না, ঈদের দিন পর্যন্ত কেউ আসেনি তার সাহায্যে।
ঈদের পরের দিন। গেট দিয়ে ঢুকতেই গরু-ছাগলের বিষ্টার চেয়েও বেশী তীব্র গন্ধ নাকে এসে লাগল। না, এ গন্ধ কোন পশুর নয়, মানুষের মলমূত্রের গন্ধ। বাম দিকে তাকালাম। সেই নারী, অর্ধনগ্ন, মলত্যাগ করে তার চারপাশে ছড়িয়েছে। মনে হল, পূর্বের কয়টা দিন এ নারী মানুষ নাকি কুকুর বিড়াল--এ গবেষণায় ছিল। কারণ এ নারী খাবার ছাড়া আর কিছু চাইতে পারে না। তার পরিচয় সে নিজেও জানে না। মানুষের মত (অস্পষ্ট স্বরে ) দু’একটা কথা বললেও কুকুর, বিড়ারের মতই ঠিকানাবিহীন। নিরব, নিথর দেহ সাপের মত কুন্ডুলী পাকিয়ে আছে। অসুস্থ গরু অথবা গাভী হলেও কোন কাজে আসত। এ যে মানুষরূপী শান্ত কোন প্রাণী; এর জন্য আলোচনা হতে পারে; কোন কর্ম হতে পারে না। নারীর মুখটা দেখা যাচ্ছে না। মনে হচ্ছে, She is going to die--পৃথিবীর মানুষ রূপী নির্দয় জন্তু-জানোয়ারের চেহেরা সে দেখতে চায় না। কারণ এ রকম কোন
জানোয়ারের কাছ থেকে আঘাত পেয়েই সে আজ মানসিক বিকারগ্রস্ত, নাম ঠিকানাবিহীন কোন প্রাণীর মত। কয়েকদিনে মশার কামড়ে হাত-পাত-মুখ Purpuric spot এর মত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রক্ত জমাট চিহ্নে ভরে গেছে।
ঈদের আগের দিনের মত, ঈদের পরের দিনও অফিস খোলা। রোগী কম। আমি আমার স্টাফ মনিরকে নিয়ে কিছু করার ইচ্ছা প্রকাশ করলাম। মনির নারীটির কাছে গিয়ে বলল, স্যার মহিলা স্টাফদের আসতে বলি ? আমি চিরায়ত সমাজ প্রথায় মাথানত করে ওর কথার অর্থ বুঝলাম। বসে না থেকে দু’একজন আয়া-বুয়া নিয়ে ইসলাম, কোরবানী, বেহেস্ত-দোজখ, পাপ-পূন্য এবং এই নারী সম্পর্কে নানা মত আলোচনা করলাম। বুঝাতে চেষ্টা করলাম, এই যে নারী, আধা মরা কুকুর-বিড়ালের মত পড়ে আছে, কেউ নেই তার,খাবার চাইবার শক্তিও নেই, একটি মশা তাড়াবার শক্তিও নেই, কয়দিন যাবৎ না খাওয়া--আমরা কেউ জানি না। এটা কি তার দোজখের
শাস্তি হচ্ছে না? আজ আমরাও যদি দেখে না দেখার ভান করি, একদিন আল্লাহপাক আমাদের কাউকেও এভাবে শাস্তি দিতে পারেন....ইত্যাদি, নানা ভাবে তাদের বুঝালাম। আয়া-বুয়ারা আমাকে বড় পরহেজগার মানুষ মনে করল। ওদের টাকা দিলাম স্যালাইন, সিরিঞ্জ, ইনফিউশন সেট, ভিটামিন কিনার জন্য । ওরা নারীটিকে গোসল করাল। ফুটপাতকে খোলা ছাদের Single patient ward বানালাম। স্যালাইন ঝুলিয়ে দিলাম দেয়ালের সাথে দড়ি বেঁধে। হাসপাতাল থেকে কিছু ঔষধ আনলাম। এখন কিছু মানুষ এবং ঔষধের দোকানীরা ঔষধ, পানি দিচ্ছে। মনে হলো “তুমি জাগলে, সবাই জাগবে--জেগে উঠবে একদিন বাংলাদেশ।''
বলে রাখা ভালো--আমি ধর্ম, ঈশ্বর, পাপ-পূন্যে বিশ্বাসী কোন মানুষ নই। আমি ধর্মভীরু নই, বিবেক বিশ্বাসী কর্মভীরু মানুষ। মানুষ হবার জন্য জ্ঞান হবার পর থেকে চেষ্টা করছি। মানুষ কিছুটা হতে পেরেছি বলে কখনও কখনও মনে করতে ইচ্ছে হয়; পরক্ষণে ভয় হয় মানুষ হবার অপরাধে মানুষরূপী অমানুষেরা অথবা ভন্ড, ধার্মিকরূপী অধার্মিকেরা আমাকে পদে পদে যদি কাঁটা ছড়ায়ে দেয়।
নারীটিকে স্যালাইন সেট করার সময় কয়েকবার Canula দিয়ে পিক করতে হয়েছে ধমনী পাচ্ছি না বলে। ধমনীগুলি মৃত্যু ভয়ে যেন চুপসে গেছে। পিক করার সময় সব রোগীই ব্যথা অনুভব করে। এই নারীটির যেন কোন অনুভুতিই নেই। বলেই চলেছে, ‘মোরে পানি দে, কইলজাটা জ্বইল্লা গেল’। বুঝলাম, বরিশাল অথবা দক্ষিণ বঙ্গের মানুষ। এই প্রথম মুখখানা দেখলাম ; শত শত কষ্টের ছাপ তার চোখে মুখে ; বয়স বেশীই মনে হয়। চুলগুলিতে যেন জট লেগে আছে শহরের যানজটের মত। বুড়ীগঙ্গার মত দুর্গন্ধ তার আশে পাশে। বুয়ারা তাকে গোসল করায়ে পরিস্কার করালেও, তার মলমূল যা চারিদিকে ছড়িয়ে আছে, তা পরিস্কার করেনি। নিথর দেহ পড়ে আছে। চিবুক বসে গেছে । গাল দুটি ঢুকে গেছে মুখের ভিতর। হাড়-গোড় যেন বের হয়ে আসতে চায় কারণ এ দেহ তাদের খাবার দেয়না। মাঝে মাঝে গোঙ্গানোর শব্দ, কাকে যেন গালি দিচ্ছে। ভাবি, হে প্রকৃতি, এ নারীটি যা তোমারই জীবন্ত অংশ; পানি, ভাত শব্দগুলি মনে রেখেছে; মনে রাখেনি স্থান-কাল-পাত্র অথবা ঠিকানা। কারণ এ সমাজে ঠিকানাবিহীন মানুষ ভাবা যায় না। বড় দুর্ভাগা এ দেশে তারা।
এই যে এ কাজটি করছি, কেউ ভাল বলছে, কেউ অবাক হচেছ। কেউ বলছে, সারাদেশে এ রকম মানুষ হাজার হাজার কয়টার সেবা করবেন, স্যার। আমি বললাম, আমরা ১৭ কোটি মানুষ যদি ১০ জনে মিলে একজনের জন্য নূন্যতম দায়িত্ব পালন করি ,তাহলে তো হবে। সবাই আমরা যে যার জায়গা থেকে দায়িত্ব পালন করতে পারি । হাসপাতালের স্টুয়ার্ড গোলাম মোস্তফাকে সব বললাম। তিনি উৎসাহ নিয়ে আমার সাথে থাকা বুয়াকে বললেন, এই তুমি প্রতিদিন যতবার খুশী খাবার নিয়ে যাবে। স্যার, খাবার নিয়ে কোন চিন্তা করবেন না।
(চলবে)

দূর্গা পূজার ইতিহাস

--শাশ্বত স্বপন

  দূর্গা পূজার ইতিহাসদূর্গা পূজা কবে, কখন, কোথায় প্রথম শুরু হয়েছিল--তা জানা যায় না। ভারতের দ্রাবিড় সভ্যতায় মাতৃতান্ত্রিক দ্রাবিড় জাতির মধ্যে মাতৃদেবীর পূজার প্রচলন ছিল। সিন্ধু সভ্যতায় ( হরপ্পা ও মহেঞ্জোদারো সভ্যতা) দেবীমাতার, ত্রিমস্তক দেবতা, পশুপতি শিবের পূজার প্রচলন ছিল। দূর্গা শিবের অর্ধাঙ্গিনী--সে হিসাবে অথবা দেবী মাতা হিসাবে পূজা হতে পারে। তবে কৃত্তিবাসের রামায়নে আছে, শ্রী রাম চন্দ্র কালিদহ সাগর (বগুড়ার?) থেকে ১০১ টি নীল পদ্ম সংগ্রহ করে সাগর কূলে বসে বসন্তকালে সীতা উদ্ধারের জন্য সর্বপ্রথম শক্তি তথা দুর্গোৎসবের (বাসন্তি পূজা বা অকাল বোধন) আয়োজন করেছিলেন। মারকেন্দীয়া পুরান (Markandeya Purana ) মতে, চেদী রাজবংশের রাজা সুরাথা(Suratha) খ্রীষ্ঠের জন্মের ৩০০ বছর আগে কলিঙ্গে (বর্তমানে ওড়িষ্যা) Duseehera নামে দূর্গা পুজা প্রচলন করেছিল। নেপালে Duseehera বা Dashain নামেই পুজা হয়। যদিও প্রাচীন ওরিষ্যার সাথে নেপালের পূজার কোন যোগসূত্র আছে কিনা জানা নাই।

মধ্য যুগে বাংলা সাহিত্যে দূর্গা পূজার অন্তিত্ব পাওয়া যায়। ১১শ শতকে অভিনির্ণয়-এ, মৈথিলী কবি বিদ্যাপতির দূর্গাভক্তিতরঙ্গিনীতে দূর্গা বন্দনা পাওয়া যায়। বঙ্গে ১৪শ শতকে দুর্গা পূজার প্রচলন ছিল কিনা ভালভাবে জানা যায় না। ১৫১০ সালে কুচ বংশের রাজা বিশ্ব সিংহ কুচবিহারে দূর্গা পূজার আয়োজন করেছিলেন। ১৬১০ সালে কলকাতার বারিশার রায় চৌধুরী পরিবার প্রথম দূর্গা পূজার আয়োজন করেছিল বলে ধারণা করা হয়।
আধুনিক দূর্গা পূজার প্রাথমিক ধাপ ১৮ম শতকে নানা বাদ্য যন্ত্র প্রয়োগে
 ব্যক্তিগত, বিশেষ করে জমিদার, বড় ব্যবসাযী, রাজদরবারের রাজ কর্মচারী পর্যায়ে প্রচলন ছিল। পাটনাতে ১৮০৯ সালের দূর্গা পূজার ওয়াটার কালার ছবির ডকুমেন্ট পাওয়া গেছে। ওরিষ্যার রামেশ্বরপুরে একই স্থানে ৪০০ শত বছর ধরে সম্রাট আকবরের আমল থেকে দূর্গা পূজা হয়ে আসছে। বার ইয়ার বা বারোয়ারী পূজা প্রথম হুগলীর গুপ্তিপাড়ার ১২ জন বন্ধু মিলে ১৭৬১ সালে আয়োজন করেছিল। সম্ভবত সেই থেকে বারোয়ারী পূজা শুরু। ১৯১০ সালে সনাতন ধর্মউৎসাহিনী সভা ভবানীপুরে বলরাম বসু ঘাট লেনে এবং একই জেলায় অন্যান্যরা রামধন মিত্র লেন, সিকদার বাগানে একই বছরে ঘটা করে প্রথম বারোয়ারী পুজার আয়োজন করে।

১৭১১ সালে অহম রাজ্যের রাজধানী রংপুরে শারদীয় পূজার নিমন্ত্রণ পেয়েছিলেন ত্রিপুরা রাজ্যের দূত রামেশ্বর নয়ালঙ্কার। নবাব সিরাজ-উদ-দ্দৌল্লার আক্রমনে কলকাতার একমাত্র চার্চ ধ্বংশ হবার পর সেখানে কোন উৎসব করা অবস্থা ছিল না। পলাশীর যুদ্ধে বিজয় লাভের জন্য ১৭৫৭ সালে কলকাতার শোভা বাজার রাজবাড়িতে রাজা নব কৃঞ্চদেব
লর্ড ক্লাইভের সন্মানে দূর্গা পূজার মাধ্যমে বিজয় উৎসবের আযোজন করেছিলেন।
 ১৯২৬ সালে অতীন্দ্রনাথ বোস জাতি,ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সবাইকে পূজা উৎসবে অংশগ্রহণের জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে দূর্গা পূজা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল (যেমন, কবি নজরুলের আনন্দময়ীর আগমনে কবিতা, বঙ্কিচন্দ্রের বন্দে মা তরম কবিতা,পরবর্তীতে ভারতের জাতীয় সংগীত...)। বৃটিশ বাংলায় এই পূজা ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পায়। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে দূর্গা স্বাধীনতার প্রতীক হিসাবে জাগ্রত হয়। বিংশ শতাব্দির প্রথমার্ধে এই পূজা ঐতিহ্যবাহী বারোয়ারী বা কমিউনিটি পূজা হিসাবে জনপ্রিয়তা লাভ করে। আর স্বাধীনতার পর এই পূজা পৃথিবীর অন্যতম প্রধান উৎসবের মর্যাদা পায়।

সরকারী বা জাতীয়ভাবে এই উৎসবকে দূর্গা পূজা বা দূর্গা উৎসব হিসাবে অভিহিত করা হয়। দক্ষিণ এশিয়ায় এটাকে শরৎ কালের বার্ষিক মহা উৎসব হিসাবে ধরা হয় বলে ইহাকে শারদীয় উৎসবও বলা হয়। কার্তিক মাসের ২য়দিন থেকে ৭ম দিন পর্যন্ত এই উৎসবকে মহালয়া, ষষ্ঠি, মহাসপ্তমী, মহাঅষ্টমী, মহানবমী ও দশমী নামে পালন করা হয়। রামায়ন অনুসারে, অকালে বা অসময়ে দেবীর আগমন বা জাগরণ বলে বসন্তকালের দূর্গা উৎসবকে বাসন্তি পূজা বা অকালবোধনও বলা হয়।

দূর্গা পূজা ভারতে অসম, বিহার, ঝাড়খন্ড,উড়িষ্যা ও পশ্চিমবঙ্গে ব্যাপকভাবে উৎযাপন করা হয়। সেখানে ৫ দিনের ছুটি ঘোষণা করা হয়। পশ্চিম বঙ্গ ও ত্রিপুরায় (যেখানে বাঙ্গালী হিন্দুরা ব্যাপক সংখ্যায় বসবাস করে) সবচেয়ে বড় সামাজিক, সাংস্কৃতিক উৎসব হিসাবে ইহা পালিত হয়। এ ছাড়াও পূর্ব ভারতের বা বঙ্গেও কলকাতা, হুগলী, শিলিগুড়ি, কুচবিহার, লতাগুড়ি, বাহারাপুর, জলপাইগুড়ি এবং ভারতের অন্যান্য অঞ্চল যেমন, আসাম, বিহার, দিল্লী, উত্তর প্রদেশ, মহারাষ্ট্র, গোয়া, গুজরাট, পাঞ্জাব, কাশ্মীর, অন্ধ্র প্রদেশ, কর্ণাটক, তামিলনাড়ু, কেরালায় ঘটা করে এই উৎসব পালন করা হয়। নেপালে ও ভুটানেও স্থানীয় রীতি-নীতি অনুসারে প্রধান উৎসব হিসাবে পালন করা হয়।

বাংলাদেশের ঢাকা, চট্রগ্রাম, খুলনা, সিলেট, রাজশাহী, সিলেট, রংপুর, বগুরা এবং অন্যান্য জেলায়ও ব্যাপক আয়োজনের মধ্য দিয়ে এই উৎসব পালন করা হয় এবং সরকারীভাবে এক দিনের এবং হিন্দুদের জন্য তিন দিনের ছুটি ঘোষনা করা হয়। বিদেশে যেমন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট, যুক্তরাজ্য, কানাডা, অষ্ট্রেলিয়া, জামার্নী, নেদারল্যান্ড, ফ্রান্স, সিঙ্গাপুর, মরিশাস, ফিজি, টোবাকো, কুয়েত,মালয়েশিয়া সহ বিশ্বের বহু দেশে অভিবাসী হিন্দুদের বা বাঙালী হিন্দুদের নানা সংগঠন এই উৎসব পালন করে থাকে। ২০০৬ সালে, মহাদূর্গা পূজা অনুষ্ঠান ব্রিটিশ মিউজিয়ামের গ্রেট কোর্টে অনুষ্টিত হয়েছিল। বঙ্গে এই পূজাকে শারদীয় পুজা, শারদোৎসব, মহা পূজা, মাযের পূজা, ভগবতী পূজা এবং বসন্তকালে বাসন্তী পুজা বা অকালবোধন হিসাবে উৎযাপন করা হয়। বিহার, আসাম, উড়িষ্যা, দিল্লী, মধ্যপ্রদেশ--এ দূর্গা পূজা, মহারাষ্ট, গুজরাট,উত্তর প্রদেশ, পাঞ্জাব, কেরালায় , হিমাচল প্রদেশ, মহীশুর, তামিলনাড়–,অন্ধ্র প্রদেশে এ পূজাকে নবরাত্রি পূজা বলা হয়।

বাংলাদেশের সাতক্ষীরার কলারোয়ার ১৮ শতকের মঠবাড়িয়ার নবরত্ন মন্দিরে (১৭৬৭) দূর্গা পূজা হত বলে লোকমুখে শোনা যায়। ঢাকেশ্বরী মন্দির চত্বরে আছে দুই ধরনের স্থাপত্যরীতি মন্দির। প্রাচীনতমটি পঞ্চরত্ন দেবী দূর্গার যা সংস্কারের ফলে মূল চেহেরা হারিয়েছে। মন্দিরের প্রাচীন গঠনশৈলী বৌদ্ধ মন্দিরের মত। ধারনা করা হয়, দশম শতকে এখানে বেীদ্ধ মন্দির ছিল--যা পরে সেন আমলে হিন্দু মন্দির হয়েছিল এবং ১১শ বা ১২শ শতক থেকে এখানে কালী পূজার সাথে দূর্গা পূজাও হত। ইতিহাসবিদ দানীর মতে, প্রায় সাড়ে পাঁচশো বছর আগে রমনায় কালী মন্দির নির্মিত হয়েছিল এবং এখানেও কালী পূজার সাথে দূর্গা পূজা হত।

সূত্রঃ
১.দূর্গা পূজা, উইকিপিডিয়া, ফ্রি এনসাইক্লোপিডিয়া
২.বাংলাদেশ ও পাক ভারতের ইতিহাস, জে.এম. বেলাল হোসেন সরকার, আনোয়ারুল হক মজুমদার, আবদুল আউয়াল
৩. ঢাকা স্মৃতি বিস্মৃতির নগরী, মুনতাসীর মামুন
৪.দৈনিক পত্রদূত, সাতক্ষীরা।

শারদীয় পূজার গল্পঃ অকালবোধন

অস্তায়মান গোধূলীর সূর্য্যটা দিগন্তে মিশে গেছে। তবে পশ্চিমাকাশে সূর্যের রক্তিম আভা তখনও শ্মশানের শেষ অগ্নির মত জ্বলছে। ঠাকুর বাড়ীর ভিতরে ও বাহিরে ধীরে ধীরে নিরবতা নেমে আসছে। পুরনো ভগ্ন দালানের দেয়াল ঘেঁষে বট গাছ আর শিমুল গাছ পূর্ব ঐতিহ্য আর হারানো স্মৃতি নিয়ে আকাশ পানে চেয়ে আছে; মনে হয়, অতীতের গল্প আকাশকে শুনাচ্ছে, যেন, ইথারে ইথারে সে গল্প ছড়িয়ে যায়, সবখানে। নাম না জানা কোন পাখি হয়তো এই দেয়ালের উপর বসে আনমনে মলত্যাগ করেছিল, কিছু মল দেয়ালে লেগেছিল। দেয়ালকে আশ্রয় করে সেই কবে এই বটগাছ জন্মেছিল--কেউ তা বলতে পারে না। শুরুতে দেয়াল বট গাছকে আশ্রয় দিয়েছিল এখন বটগাছ দালানসহ দেয়ালকে আষ্টে পিষ্টে জড়িয়ে রেখেছে, যেন দেয়াল বটগাছকে ছেড়ে ভেঙ্গে-চুঁড়ে পড়ে না যায়। মনে হয়, বট গাছের অকৃত্রিম কৃতজ্ঞতা প্রকাশ। মাটির উপর সমান্তরাল বটগাছের মোটা দুই শিকরের মাঝে ছোট চাল দেওয়া মন্দিরে কয়েকটা দেব-দেবীর মুর্তি স্মিত হাসিতে চেয়ে আছে দক্ষিণ দিকে। যেন, কোন পুজারী কিবা তাদের প্রেমে ভক্ত প্রিয়জন চরণ ধুলি নিতে আসবে। ঠিক তাই-ই। এই দক্ষিণের স্যাঁতস্যাঁতে মাটির উপর পা ফেলে ফুটফুটে জ্যোৎন্সার মত নিষপাপ একটি তের বৎসরের পিতৃহারা বালক প্রতি সন্ধ্যায় ধূপ-শিখা আর সামান্য অর্ঘাদি নিয়ে পুজো করে। অর্ঘাদি নিবেদন করে কি যেন বলতে থাকে বিড়বিড় করে। পুজোর শেষে দেবীর চরণে লুটিয়ে পড়ে। ওর বিধবা মা ওকে পুজোর ব্যাপারে সাহায্য করে।

এই পুরুনো বনঝোপে ঘেরা ঠাকুর বাড়িতে ওরা দু’টি প্রাণী--মা ও ছেলে টিনের একটি ঘরে বৃষ্টির সময় বৃষ্টিতে ভিজে জ্যোৎন্সা রাতে চাঁদের আলো উপভোগ করে দিন যাপন করে আসছে অনেকদিন থেকে। পুরানো দালানের প্রায়ই ইট ঘঁসে পড়ে। তাছাড়া ওখানে অনেক বিষধর সাপ বাস করে। তাই ওরা ওখানে থাকে না। একসময় পুরো ঠাকুরবাড়ী লোকে পরিপূর্ণ ছিল। ঘরে ছেলে-মেয়েদের চিৎকার, রান্না ঘরে রাধুনীর চিৎকার, উঠোনে বউ-শ্বাশুরীর খোশগল্প, বাইরে মনিব ও চাকরের শশব্দ কথোপকথন। আজ আর সেই কোলাহল নেই। সব থেমে গেছে ধীরে ধীরে। সবার মাথায় যবন ভুত চেপেছে। ক্রমাগত সবাই কোলকাতা চলে যাচ্ছে অথচ কোলকাতার যবনদের মাথায় হিন্দু ভূত চাপা স্বত্বেও কোন যবন আমাদের গ্রামে এসেছে বলে শুনি নাই। বাংগালী হিন্দুদের ধারণা এদেশে যবনদের জন্য থাকা যাবে না। ভারতে সুখ-শান্তি ভরপুর। জিনিষের দাম কম। কিন্তু কেউ বুঝে না, সেখানে পয়সা রোজগারের কি অবস্থা!

কি জানি, হয়তো স্বর্গপুরী ভারতেই অবস্থান করছে; পাসপোর্ট করেই স্বর্গে যাওয়া যাবে। আর তাই হয়তো একদিন কল্যাণরাও কোলকাতা চলে যাবে। যাবেইতো, ব্রাহ্মণের ছেলে কল্যাণ; পুজোই যদি তার কপালে না জুটে, তবে পয়সা পাবে কোথায়? খাবে কি? বাঁচবে কি করে? এমনি করে কল্যাণীদের মত মেয়েদের বিয়ে দিতে যদি উপযুক্ত কায়স্ত ছেলের অভাব হয় তবে তার মত মেয়েরাও কোলকাতা চলে যাবে। কুমার যদি মুর্তিই বিক্রি করতে না পারে--তবে বাঁচবে কি করে। ধর্ম-কর্ম নিয়ে মানুষের এই বিড়ম্বনা, মানুষের এই দেশ ত্যাগ থামবে না বলেই--বাংলাদেশে মাঝে মাঝেই ধ্বনী উঠে ‘চল চল কোলকাতা চল--চল চল ভারত চল।’

‘শ্রীবৃক্ষে বোধযামী ত্বাৎ যাবৎ পুজাৎ কারোম্য হম...।’--এই সংস্কৃত পাঠশেষে আজ সন্ধ্যাবেলা কল্যাণ মন্দিরে পুজো করার পর নমস্কার দিচ্ছিল। ঠিক এই সময়ে পাছে কার যেন মৃদু শব্দ পেল। মাটি থেকে সদ্য পুজারী মাথা উঁচু করে বলল, ‘কিরে কণী এই সন্ধ্যেবেলা এখানে কেন এসেছিস?’ কণী কোন উত্তর না দিয়ে মন্দিরের মাটির উপর ভাসমান স্বচ্ছ ঘটের জল মাথায় ছুঁয়ে দিয়ে হাতটা পিছনে নিয়ে গেল। যেন, সে সদ্য পুজারিণী এমন ভংগীতে কল্যাণের চরণ ধুলি গ্রহণ করল। এরকম ভক্তি কণী ওর মাসীমার কাছে শিখেছে। কল্যাণ ওর দু’হাত ধরে উঠাল। তারপরে ওর চোখের কাছে মুখ নিয়ে বলল ‘কিরে ব্রাহ্মণের ছেলে ভেবে নমস্কার দিলি নাকি দেবতা জ্ঞান করে।’ দশ বছরের এই বালিকার লজ্জা হাসিতে যেন দেব-দেবীর মূর্তিরাও লজ্জা পেল। হঠাৎ করে ওদের মাখার উপর দিয়ে হালকা ঝড়ো বাতাস বয়ে গেল। বটবৃক্ষের শাখা-প্রশাখা থেকে একরাশ পাতা ওদের দু’জনার উপর ঝড়ে পড়ল। সুবাতাস বইতে লাগল গুন গুন গান গেয়ে। ‘তা জানিনা কল্যাণদা, তবে তোমাকে একদিন দেবতার মত পুজো করতেই হবে।’ যেন কণীর হৃদয় কণীকে বলে দিয়েছে--এই তোমার জীবন দেবতা।

হাতে একরাশ চুরি , কানে দুল, ছোট কচি সাদা ধবধবে পায়ে পিতলের ঘুঙুর, চুল গুলো মেঘের চেয়ে কালো আর মুখ বদন--হৃদয়ের সত্যিকারের ভালবাসার মত পবিত্র। নাকটা কিঞ্চিৎ লম্বা আর সরু--দু’নয়নের মোহনায় এসে মিশে গেছে। একটি সুন্দর মেয়ে যেমন সুন্দর, পবিত্র পরিবেশে আরো সৌন্দর্য মন্ডিত হয়ে ওঠে যা ধরা দেয় সৌন্দর্যের পুজারীর কাছে। এখানে সেই সৌন্দর্য কল্যাণের চোখে মুখে ছোঁয়া দিলেও হৃদয়ে অনুভব করার মত বোধজ্ঞান তার নাই। এই বিষয়ে বয়স নারীকে যতটা অগ্রগামী করে পুরুষকে ততটা করে না। ঝর্ণা ধারার মত প্রবাহমান সেই সৌন্দর্যের আংগিকে কল্যাণীর ছোট ঠোঁট রাংগা হাসি যেন সদ্য পুজারীকে একটি প্রশ্ন করতে চায়--বলতো আমি কেমন?

কল্যাণী কল্যাণের ঘাড়ে দু’হাত রেখে দুষ্টু ভংগিতে ফোঁকলা দাঁতে বলতে লাগল, ‘ঠাকুর দাদা আজ শনি বার। মাসীমার তুলসী গাছে শনি ধ্বনি দিয়ে মাসীমাকে শনি পাপ থেকে উদ্বার কর।’ ‘ও হ্যাঁ, আমার মনেই ছিল না। তুই একটু দাঁড়া, এগুলো আমি ঘরে রেখে আসি।’ কল্যাণী শাড়ীর আঁচলটা কোমরে এঁটে বলল, ‘দাদা, আমার কাছে ধুপটা দাও। তুমি এগুলো নাও।’ এগুলো মানে ঠাকুর বাটাতে রাখা বাতাসা আর পেঁপের টুকরো । কল্যাণ অর্ঘ্যাদি থেকে পেঁপের টুকরো হাতে নিয়ে বলল, ‘কণী হা কর।’ ওরা হাঁটতে হাঁটতেই প্রসাদ খেতে লাগল। ঘরের বারান্দায় সব রেখে কল্যাণ কল্যাণীর হাত ধুয়ে দিল, নিজের হাতও ধুয়ে নিল। কল্যাণীর পায়ে স্যাঁতস্যাঁতে মাটির কাদা লেগেছে। কল্যাণী পায়ের কাপড়টা উঁচু করে ধরল, কল্যাণ পায়ে পানি ঢেলে দিল। কাদা সরে গেল। কল্যাণ হাসতে শুরু করল চেপে চেপে। ‘কল্যাণদা হাসছ কেন বলনা ?’ ‘তোর হাত-পা-মুখ সরস্বতী দেবীর মত সুন্দর। কুমার ভগবান তোকে নিজের হাতে বানিয়েছেন।’ যা সত্য কল্যাণের নিষ্পাপ হৃদয় তাই ব্যক্ত করেছে। এখানেই নেই কোন ছলনা--নেই কোন প্রবঞ্চনা। এ কথা শুনার পর শরতের আকাশের মত নির্মল কল্যাণীর মুখ বলতে চাইলো--তুমি ও তো সুন্দর। একথা বলা যায় না,বুঝে নিতে হয় চোখ মুখ আর প্রশান্ত হাসির পট দেখে। কিন্তু তা কি কল্যাণের হৃদয়ে ছোঁয়া দেয়?

এই কণীর মা বাবা কেউ নেই। ও ওর মাসী বাড়ী থাকে। কল্যাণ যাকে কাকী বলে সম্মোধন করে। ওর পুরো নাম কল্যাণী রানী দাস। সবাই ওকে কণী বলে ডাকে। কল্যাণ আজ ওর স্বর্গীয় বাবার ধুতি পড়েছে দুই ভাঁজ করে আর গায়ে ডোরা কাটা গেঞ্জি। কণীর গায়ে ছোট গোলাপী শাড়ী। পাইড়টা সবুজ রংয়ের উপর লাল ডোরা রেখায় ঘেরা। দু’জনের মুখে মিষ্টি হাসি। হাত ধরে দৌড়ে দু’জনে ছুটছে সবুজ ঘাসের সরু রাস্তা ধরে। দু’পাশে ধঞ্চে গাছ। কাকী বাড়ী ওদের বাড়ী থেকে এক পুকুর দুরে। আপন না হলেও কাকী কল্যাণকে খুব আদর করে। গতবারের দুর্গাপুজায় ওর কাকী ওকে একটি লাল জামা দিয়েছে। দু’দিন পরে দুর্গা পুজো আসছে। বাড়ীর কাছাকাছি এসে কণী কল্যাণের হাত চেপে বলল,
ঃ থাম দাদা, একটা কথা বলব
ঃ কি কথা ?
ঃ আমাকে পুজো করতে শিখাবে। তুমি যখন পুজো কর ,আমার খুব ভাল লাগে। মনে হয়, আমি যদি--। দাদা দেবতার কাজে তুমি কত কি বল, দেবতারা তোমাকে কি বলে?
ঃ অনেক কিছু বলে।
ঃ কি বলে?
ঃ তোকে বলা যাবে না। আরো বড় হ তুই তখন বুঝবি।
ঃ তুমি বুজি খুব বড়? এই মেপে দেখ না তোমার কান পর্যন্ত আমার মাথা ঠেকেছে।

ধ্যাৎ শব্দটায় জোড় দিয়ে কল্যাণ হাটতে শুরু করল। কণীর দিকে তাকিয়ে বলল, আমার সাথে বল-
সরস্বতী মহাভাগে
বিদ্যে কমললোচনে।
বিশ্বরূপেবিশালাক্ষী
বিদ্যাংদেহি নমস্তোতেঃ।।
দু’পাশে ধষ্ণে পাতারা ঘুমিয়ে পড়েছে সারাদিনের ক্লান্তি পেরিয়ে। কিছু প্রজাপতি ঘাসের ডগায় বসে কি যেন কানে কানে ঘাসের কাছে বলে। ধীরে ধীরে আঁধারের নিরব ছোঁয়ায় প্রকৃতিতে নিরবতা নেমে আসছে। কাছের কয়েকটা বাড়ীতে উলো উলো জোকার ধ্বনি শোনা যাচ্ছে। বলাকারা নারিকেল গাছের পাতার আড়ালে সারাদিনের হিসেব বুঝে নিচ্ছে। বাদুর পাখীর পাখা ঝাপটানিতে আঁধারের মুর্তি এখনি যেন চলে আসবে।

চঞ্চলা, ঝর্ণার মত নৃত্য পটিয়সী, লাস্যময়ী কল্যাণী বেশীক্ষণ স্থির থাকতে পারেনা। কল্যাণদাকে সে এক সপ্তাহ পর পেয়েছে। সে কথা বলতে চায়। কিন্তু কি বলবে। না সকালে জেঠিমা মাসীমাকে যা বলেছে তাই কল্যাণকে বলবে। ইস্! সে কথা বলা যায়। নিজের কাছে নিজেই প্রশ্ন করে আর ছোট ছোট উত্তর খুঁজে। যেন কল্যাণীর নিজের কাছে প্রশ্ন, বলে দেখিনা কি হয়? আবার কয়দিন পর দেখা হবে? যেন কত যুগের প্রতিক্ষমনা নদী আজ নদের ছোঁয়ায় পেয়েছে জল, পেয়েছে ভালবাসা, পেয়েছে নব জীবন। ‘না বলা কথা বলতে না পারা’--কি যে কষ্ট দেয় সেটা প্রেমাশক্ত মনই বুঝতে পারে। কল্যাণীর খারাপ লাগছে। চোখ বন্ধ করে কল্যাণী বলতে শুরু করল--
ঃ কল্যাণ দা, জেঠীমা আজ খুঁচি বানাতে বানাতে মাসীমাকে কি বলেছে জানো?
ঃ কি? কি বলেছে?
ঃ বলতো কাপড় পড়েছি কেন?
এবার ভাল করে তাকালো কল্যাণ।
ঃ বারে, শখ করে কাপড় পড়ে না বুঝি? তাছাড়া তুই যখন বউ হবি তখন তোকে সব সময় কাপড় পড়তেই হবে।
মুখ হাত দিয়ে ঢেকে, ফোঁকলা দাঁতে হিঃ হিঃ করে লজ্জা অথচ আনন্দের হাসি হেসে কণী বলল ,
ঃ কি বললি দাদা?
ঃ কি?
ঃ ঐ যে বললি?
ঃ বউ? বারে বউ বললে হাসির কি আছে?
ঃ না, ইয়ে--জেঠীমা ঐ কথাই বলেছে।
ঃ কি বলেছে, বল?
কল্যাণ ওর কান চেপে ধরল। কোনমতে হাতটা ছাড়িয়ে কল্যাণের মুখের দিকে চেয়ে লজ্জা পেয়ে দৌড়ে দিল। এক দৌড়ে বাড়ীর নারিকেল গাছের নীচে এসে কণী দাঁড়াল। হাত জোড় করে ক্ষমা চাওয়ার ভংগীতে বলতে লাগল।
ঃ ও কথা বলতে পারব না, বলব না--।

দূর থেকে গান ভেসে আসছে--‘মাগো আনন্দময়ী নিরানন্দ হইওনা...।’ আধ মাইল দুরে ঘোষ পাড়ায় দূর্গাপুজা চলছে। ডোলের শব্দে চারিদিক জয় জয় দূর্গা ধ্বনিতে মেতে উঠেছে। কল্যাণীদের উঠানে বিচিত্র আলপনা। ওদের পুকুরের তীর ছুঁয়ে অনেক ডোল কলমী গাছ। কল্যাণ কণীর ভাই রামকে নিয়ে দক্ষিণের জানালায় সম্মুখে পুকুর ঘাটে পায়চারী করছে। কল্যাণ ডাকাতে শুরু করল, কণী তোমার হয়েছে? দক্ষিণের জানালার ফাঁক দিয়ে কাপড়ের আঁচলটা দেখিয়ে কণী ঠোঁট রাংগা হাসিতে চোখ বন্ধ করে বুজিয়ে দিল, হয়েছে। তারপর মায়ের উদ্দেশ্যে বলতে লাগল, মা আমি পুজোয় গেলাম।

ঘর থেকে ধান দূর্বা নিয়ে লক্ষী মানে কল্যাণীর মাসিমা উঠোনে এসে বলল,
ঃ যাবি কিরে? ধান দূর্বা নিয়ে যা । ও কল্যাণ এখানে আয়।
কাকীমার ডাকে কল্যাণ কাছে গেল। এরপর দু’জনের মাথায় ধান দূর্বার সাথে লক্ষী অদৃশ্য আর্শীবাদ দিল। দু’জনে দু’জনার দিকে চেয়ে হাঁসতে লাগল। তারপর দু’জনে লক্ষীকে প্রণাম করল।
ঃ থাক, বেঁচে থাক। ভগবান তোমাদের মঙ্গল করুন। তাড়াতাড়ি চলে আসিস বাবা। রামকে তো নিয়ে যাচ্ছিস। কাঁদে কি না? নে, এই টাকাটা নিয়ে যা। সবাই কিছু কিনে খাস।

পুজো দেখে দু’জনে বাড়ি ফিরতে লাগল। পথে যেতে কণা বলল, দাদা এতগুলো দেব-দেবী, কাকে পুজো করলে কি হয়? কল্যাণ ওর মুখ পানে তাকিয়ে রামকে বলল, রাম এবার তুমি হাট। রাম কল্যাণীর কোল থেকে নেমে হাটি হাটি পা পা করে এগোচ্ছে। তারপর বলতে শুরু করল,আমি ভাল করে জানিনে কণী। বাবা আগে বলত, দূর্গা শক্তি আর ধন সম্পদের
দেবী, লক্ষী টাকা পয়সা আর শান্তির দেবী, সরস্বতী বিদ্যা আর জ্ঞানের দেবী। গনেশ পুজো করলে দোকানদাররা লাভবান হয় আর কার্ত্তিক শত্রু দূর করে। বাবা বলত সরস্বতী গান, সুর, বিদ্যা, জ্ঞান--অনেক কিছু দেয়, যদি তাকে পুজো করে সন্তুষ্ট করা যায়।
ঃ তা হলে তুমি আমায় সরস্বতী পুজা শিখিয়ে দাও না। প্রতি সন্ধ্যায় আমি পুজো করব।
কল্যাণ হাসতে লাগল।
ঃ কি শিখাব?
ঃ ঐ যে তুমি কি যেন বিড়বিড় করে বল, তা শিখিয়ে দাও ।
ঃ শিখিয়ে দেব কিরে, লক্ষী, সরস্বতী কাছে ওদের ভাই কার্ত্তিকের মতো বর চাইবি।
কল্যাণী লজ্জা পেয়ে যা-শব্দটি করে রামকে কোলে নিল।
ঃ কল্যাণদা,তুমি সরস্বতীর মতো বউ পাবার আশায় পূজো কর। আমি কিন্তু পূজো না করেই কার্তিকের মতো বউ পেয়ে গেছি।


হাঁয় একি! একি বলে ফেলল। যার মুখ থেকে যা বেরোয় না হাজার চেষ্টায়, বুক ফেটে গেলেও। সে আজ...। কি খুঁজে পেল কল্যাণী কল্যাণের মাঝে। ওরা তো ছোট, কি বুঝে-- তবুও একজন একজনকে কাছে পেতে ইচ্ছে করে। কোন আত্মীয়তার টানে? না ওদের মাঝে রক্তের কোন সম্পর্ক নেই--তবুও ওরা পৃথিবীর বুকে বড় আপন হয়ে কবে যে সময় এর সাথে চলতে শুরু করেছে, তা সময়ই জানে। ওদের গল্প গুজবে কোন ছলনা নেই। দু’হৃদয়ের মাঝে অবুঝ ভালবাসা হয়েছে সেতু। সেতুর শক্ত পথে ওদের আশা-আকাঙ্খা, হাসি-কান্না নদীর স্রোতের মত প্রবাহিত হয়। এই স্রোতে কোন ভাটা নেই।


ঐ সময়ের নিরব প্রকৃতিই কল্যাণীর মুখ থেকে ‘না বলা কথাটি’ বের করেছে--যা জমে বরফের মত শক্ত হয়ে কন্ঠনালীতে জমে ছিল, যা ওকে এতদিন দ্বিধান্বিত করতো--বলবে, কি বলবে না। দূর্গাপুজার বাদ্যের আওয়াজ শুনা যাচ্ছে। কণীর মনে হচ্ছে, দূর্গা লক্ষী সবাই যেন, তাদের দেখে হাসছে। কল্যাণী রামকে নামিয়ে ভয়ে ভয়ে কল্যাণের পা ছুঁয়ে প্রনাম করে কি যেন বলতে যাচ্ছিল। ঠোঁট দু’টি কাঁপতে শুরু করেছে। দক্ষিণা বাতাসে ওর চুলগুলি এলোমেলা হয়ে যাচ্ছে। পায়ের ঘুঙ্গুর বাজতে শুরু করেছে। যেন ঘুঙ্গুর বলতে চাচ্ছে, কণী, তুমি দৌড় দাও।


দু’পাশের ধষ্ণে গাছগুলিতে মৃদু বাতাস প্রবাহিত হচ্ছে। প্রজাপতি উড়তে লাগল ঘাস থেকে ঘাসে । শরতের আকাশে কল্যাণ দেখতে পেল কালো মেঘের কালিতে লেখা--‘জয় মা দূর্গা’। গোধূলী লগ্নের শ্র“ভ্র বলাকারা উড়ে যাচ্ছে দুর অজানায়। পঁচা ডোবায় জলকেলিরত শ্র“ভ্র হাঁস। পশ্চাতে তাকিয়ে কল্যাণ দেখতে পেল সন্ধ্যার সুর্যটা পশ্চিমাকাশে ডুবন্তমান। লাল আভা পশ্চিম দিগন্তজুড়ে খাঁ খাঁ করছে। কখনো সেই আভায় মেঘ খন্ডগুলোকে চিত্রকরের আঁকা ছবি, ভেঁজা তুলার স্তুপ, পাহাড়, দ্বীপ--নানান রুপে দেখা যাচ্ছে।

রোহিঙ্গা সমস্যা এবং রামু সহিংসতা..../কেন ঘটল রামুর ঘটনা...?

কক্সবাজারের রামু, উখিয়া, টেকনাফ চট্রগ্রামের পটিয়া ও পাশ্ববর্তী অন্যান্য এলাকায় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর সংঘটিত নাশকতা বিষয়ে কিছু বলবার আগে বার্মা, আরকানের ইতিহাস থেকে সামান্য আলোকপাত করতে চাই।

সভ্যতার শুরু থেকে এ পৃথিবীতে যত যুদ্ধ-বিগ্রহ ঘটেছে, তার অধিকাংশই ছিল ধর্ম যুদ্ধ (অথবা অন্য কোন বিষয় নিয়ে দ্বন্ধ শুরু হলেও, শেষ পর্যন্ত তা ধর্ম যুদ্ধের রূপ নিত)। আদিতে ধর্মীয় যুদ্ধ এমনি নৃসংশ রূপ নিত যা বাঘ-হায়েনা-শকুন এর শিকারকালীন সময়ে কিছুটা বুঝা যায়। সভ্যতার উন্নতির কারণে বর্তমান আগ্রাসনের যুদ্ধ, দেশ দখলের যুদ্ধ ধর্ম যুদ্ধের মত এতটা নৃসংশ হয়তো হয় না, এত মানুষও মারা যায় না, তবে যুদ্ধের উপকরণ (বিশেষ করে গোলাবারুদ) বেড়ে যাওয়ায় সম্পদের ক্ষতি, আহতের সংখ্যা পূর্বতন ধর্মীয় যুদ্ধের চেয়ে বেশী হয়। ধর্ম যুদ্ধ হোক, আগ্রাসনের যুদ্ধ হোক অথবা অন্য কোন যুদ্ধ হোক--কোন যুদ্ধই মানুষ চায় না। তবে হিসাব করে দেখা গেছে, সব ধর্মীয় যুদ্ধে নিহতের সংখ্যা অন্য সব যুদ্ধে নিহতের সংখ্যার চেয়ে অনেক বেশী এবং প্রায় সব যুদ্ধের সুত্রপাত তুচ্ছ বিষয় নিয়ে।

বৌদ্ব ধর্মের পৃষ্ঠপোষক, বাংগালী ও বাংলাদেশের গোড়া পত্তনকারী পাল রাজাগণ সুদীর্ঘ ৪০০ বছর বাংলাদেশ শাসন করেন। তারপর হিন্দু ধর্মের পৃষ্ঠপোষক সেন রাজাদের এবং মুসলিম তুর্কী, পাঠান, মোগল রাজা-নবাবদের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ অত্যাচার বা নিগৃহের কারণে বৌদ্ধরা মাইগ্রেশন করে বা পালাতে থাকে। কিছু নেপালে (সূত্র: চর্যাপদ), কিছু তিব্বতে, অধিকাংশ পূর্বদিকে চলে আসে । মুসলমান আমলেও বহু বছর চট্রগ্রাম, পার্বত্য চট্রগ্রাম আরাকানের অধীনে ছিল।


১৪০৪ সালে নরমিখলা নামে এক যুবরাজ আরাকার শাসন করতেন। তিনি দেশীয় এক সামন্তরাজার বোনকে অপহরণ করে রাজধানী রংগেতে নিয়ে আসেন। ১৪০৬ সালে বার্মার রাজা মেংশো আই আরাকান দখল করলে নরমিখলা তৎকালীন বাংলার রাজধানী গৌড়ে এসে আশ্রয় নেন। তখন ইলিয়াস শাহীর রাজবংশ গৌর থেকে বাংলা শাসন করতেন। গৌরের সুলতান জালালুদ্দীন শাহের সাহায্যে নরমিখলা ১৪৩০ সালে স্বীয় রাজ্য ফিরে পান। নরমিখলা ধর্মান্তরিত হয়ে মুহাম্মদ সোলায়মান শাহ নাম ধারণ করেছিলেন এবং তার রাজ্যে মুসলিম সভাসদ, সৈন্যতে ভরপুর ছিল্। রাজারা বৌদ্ধ নামের সাথে একটি মুসলিম নামও ধারন করতেন। রাজ্য দখলে রাখা এবং গৌরের সুলতানদের অনুগ্রহ পাবার জন্য তারা মুসলিম নাম ধারণ করেছিলেন, মনে প্রাণে তারা মুসলমান ছিলেন না, তার বংশধররা সে ধারা বজায়ও রাখেনি। ধারণা করা হয়, আরাকান (চট্রগ্রাম, পার্বত্য চট্রগ্রাম সহ) তথা বার্মাতে এখান থেকেই মুসলমান জাতির সূত্রপাত।

৭ম-৮ম শতাব্দীতে চন্দ্রবংশের রাজত্বকালে বঙ্গোপসাগরে কয়েকটি আরবীয় জাহাজ সংঘর্ষে ভেঙ্গে পড়লে নাবিকরা তীরে এসে ভীড়লে রাজা তাদের ব্যবহারে সন্তুষ্ট হয়ে এখানে তাদের বসবাসের অনুমতি দেন। তারা স্থানীয় রমনীদের বিয়ে করে সংসার করতে থাকেন। বঙ্গোপসাগরীয় উপকূল থেকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া পর্যন্ত আরো পূর্ব হতেই আরব বণিকদের সাথে বার্মার জনগণের যোগাযোগ ছিল। প্রাথমিকভাবে মধ্যপ্রাচ্যের মুসলমান ও স্থানীয় আরাকানীদের সংমিশ্রণে রোহিঙ্গা জাতির উদ্ভব। পরবর্তীতে চাঁটগাইয়া, রাখাইন, আরাকানী, বার্মিজ, বাঙালী, ভারতীয়, মধ্যপ্রাচ্য, মধ্য এশিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মানুষদের মিশ্রণে উদ্ভুত এই সংকর জাতি এয়োদশ-চর্তুদশ শতাব্দীতে পূর্ণাঙ্গ জাতি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। পঞ্চদশ শতাব্দী হতে অষ্টাদশ শতাব্দী পর্যন্ত আরাকানে রোহিঙ্গাদের নিজেদের রাজ্য ছিল। মহাকবি আলাওল তার পদ্মাবতী কাব্যে রোসাঙ্গ (রোহিংগা) জাতি সম্পর্কে বলেছেন, ‘নানা দেশী নানা লোক শুনিয়া রোসাঙ্গ ভোগ আইসন্ত নৃপ ছায়াতলে। আরবী, মিশরী, সামী, তুর্কী, হাপসী, রুমী, খোরসানী, উজবেগী সকল। লাহোরী, মুলতানী, সিন্ধি, কাশ্মীরী, দক্ষিণী, হিন্দী, কামরূপী আর বঙ্গদেশী। বহু শেখ, সৈযদজাদা, মোগল, পাঠান যুদ্ধা, রাজপুত হিন্দু নানা জাতি...।’ রোয়াং, রোঁয়াই, রোহিঙ্গা এবং রোসাঙ্গ শব্দগুলো পরিমার্জিত, পরিবর্তিত হয়ে বাঙ্গালী কবিদের কাছে রোসাঙ্গ হিসাবে, স্থানীয় জনগণের কাছে রোয়াং আর আমাদের কাছে চরম অবহেলিত নিন্দিত বস্তীবাসী এক রোহিঙ্গা জাতি হিসাবে পরিচিত। সাঙ্গু নদীর পাড়ে বাঁশখালি থানার পূর্ব দিকের পাহাড়ী এলাকায় রোহিংগারা সংখ্যাগরিষ্ঠ। এখানকার রোহিঙ্গারা প্রায় ৩০০ বছর আগে আরাকানী রিফিউজি হিসাবে বংশ পরষ্পরায় বসবাস করে আসছে।

তাহলে দেখা যাচ্ছে, রোহিঙ্গা জাতির ইতিহাস বেশ প্রাচীন। বহুকাল থেকেই তারা অত্যাচার সহ্য করে আসছে। বার্মা কর্তৃপক্ষের বোধ উদয় হওযা উচিত, তারা যতই অপরাধ করুক, এভাবে, দেশ ছাড়া করা উচিত নয়। মোঘল আমলে, ব্রিটিশ আমলেও যারা ওখানে কর্মসুত্রে চিরস্থায়ী বসতি গড়েছে , এমনকি নিকট অতীতে যারা বসতি গড়েছে, স্থানীয়ভাবে বিবাহ করেছে অথবা ঐ দেশে জন্মেছে--তাদের আপন করে নেওয়া উচিত।

আমরা রোহিঙ্গাদের আমাদের দেশে স্থায়ীভাবে বাস করতে দিয়ে মহৎ হতে পারতাম কিন্ত আমাদের এই ছোট্র দেশ, এমনিতেই আমাদের বিস্ফোরিত জনসংখ্যাকে, আমাদের নিজেদের উদ্বাস্তুদের সামাল দিতে পারছি না, তার উপর আরো জনসংখ্যা--মরার উপর খাড়ার ঘা হয়ে উঠবে। কক্যবাজার, টেকনাফ, বান্দরবানের কেউ হয়তো বলবে, আপনার নিজের জায়গায় রোহিঙ্গাদের থাকতে দিন। আমি বা আমরা হয়তো পারব না, অন্যকে মানবিক হতে উপদেশ দেওয়া সহজ, নিজে মানবিক হওয়া এত সহজ নয়। বাস্তবে, স্বার্থপরতা থেকেই রাষ্টের সৃষ্টি। আরো সহজ করে বলতে গেলে, রাষ্ট্র নিজেই স্বার্থপর, নিজের জনগণের জন্যে রাষ্ট্রকে স্বার্থপর হতেই হবে, রাজনীতি আর কূটনীতিতে মানতবতার স্থান প্রশ্নসাপেক্ষ। বাংলাদেশের সীমান্ত খুলে দিলে রোহিঙ্গা বন্যায় বাংলাদেশের পূর্বাংশ তথা পুরো বাংলাদেশ প্লাবিত হবে। বার্মারা জাতি হিসাবে অসামাজিক। সমুদ্র মামলায় হেরে আমাদের উপর চাপ বাড়াচ্ছে দর কষাকষির স্বার্থে। আর এনজিও, এ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, জাতিসংঘের কর্তা-ব্যক্তিরা নিজেদের স্বার্থেই এই সমস্যা যুগের পর যুগ জিইয়ে রাখবে।


নিপীড়িত রোঙ্গিগারা মুসলিম জঙ্গী সংগঠনের পথে পা বাড়াতে পারে। বার্মা কর্তৃপক্ষ রোহিঙ্গাদের অত্যাচার করে জঙ্গী হতে উৎসাহিত করছে। বাংলাদেশ ও থাইল্যান্ড রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সবচেয়ে বড় আশ্রয়দাতা। এই দুটো দেশে মুসলিম জঙ্গি কর্মীদের একটি বড় উৎস হল রোহিঙ্গা। রোহিঙ্গাদের নিপীড়ণ করে জঙ্গিদের অন্ধকার পথে ঠেলে দিয়ে মায়ানমার শুধু নিজের পায়ে কুড়োল মারছে না, বরং বাংলাদেশ, মায়ানমার, থাইল্যান্ডসহ দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার এই অঞ্চলে স্থায়ী একটি সমস্যা সৃষ্টি করেছে। রোহিঙ্গারা ধনে-মানে, বিদ্যা-বুদ্ধি, চিন্তা-চেতনায় এতটায় দরিদ্র যে, ( এ যেন, বাংলাদেশে বিহারী রিফিউজি?) তারা নিজের ধর্মের মহৎ বাণী অন্য সম্প্রদায়ের মধ্যে ছড়াতে পারছে না। আবার বৌদ্ধরা ধনে-মানে, বিদ্যা-বুদ্ধি, চিন্তা-চেতনায় উন্নত হওয়া সত্বেও বুদ্ধের বাণী রোহিঙ্গাদের মাঝে ছড়াতে পারছে না বা ছড়াতে চাইছে না। (যদিও অতীতের মত গ্রামকে গ্রাম গণহারে ধর্মান্তরিত হওয়ার কথা আধুনিক যুগে শুনা যায় না।) বিলুপ্তির পথে উপমহাদেশের ব্রাক্ষ ধর্ম, সৃষ্টি থেকেই কোয়ানটিটি নয়, কোয়ালিটি মেনটেইন করত। বৌদ্ধরাও হয়তো ব্রাক্ষদের অনুসরণ করছে। উঁচু লেবেলের ধার্মিকদের দিয়ে ধর্মের প্রবাহ ধারার বিস্তৃতি হয় না। সাধারণ, অতি সাধারণ ধর্মভীরুদের অধিক সংখ্যায় যুক্ত করতে হয়। কারণ এরাই ধর্মকে বাঁচিয়ে রাখে শতাব্দির পর শতাব্দি।


এবার আসা যাক আসল কথায়, রামু, চটৃগ্রামের পটিয়া ও পাশ্ববর্তী অন্যান্য এলাকায় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর সংঘটিত নাশকতা শুধু ফেইসবুকে আপত্তিকর ছবি আপলোডকারী ( তার ফেইজবুকে ট্যাগ করা?) উত্তম বড়ুয়ার জন্য হয়েছে বলে, আমি মনে করি না। এটা হয়তো কাটা গায়ে নুনের ছিটা দেবার মত বিষয় হয়েছে। দীর্ঘদিন, বিশেষ করে, অতি সম্প্রতি বার্মার মুসলিম রোহিঙ্গা জাতির উপর বর্বরোচিত অত্যাচার, আমেরিকাতে নবীকে নিয়ে ব্যঙ্গ চলচ্চিত্র, ফ্রান্সে মহানবীর ব্যাঙ্গ কার্টুন প্রচার, বাংলাদেশে রাজাকারদের বিচার (কক্সবাজার এলাকায় ধর্ম ভিক্তিক রাজনেতিক দলের শক্ত অবস্থান), সরকারী দল কর্তৃক বিরোধী দলের কোনঠাসা অবস্থা, রাষ্ট্র পরিচালনায় সরকারের চরম ব্যর্থতা--এই সব কারণে এলাকাটির স্বার্থান্বেসী কিছু মানুষ সাধারন ধর্মভীরু মানুষদের (সাথে রোহিঙ্গাদেরও) ভুল বুঝিয়ে তাদের পরিকল্পনা সফল করেছিল। আর গান পাউডার ব্যবহার করে এতগুলো প্রাচীন মন্দির, ঘর-বাড়ি জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দেবার পরও পুলিশ প্রশাসন ঘটনার পরদিন পর্যন্ত কেন নির্লিপ্ত ছিল, সরকারই তা বলতে পারবে। আধুনিক সভ্যতায় দেখা যায়, ধর্ম বা ধর্মীয় কোন স্পর্শ বিষয়ে কোন দাঙ্গা ফ্যাসাত হলে পুলিশ প্রশাসন প্রশ্ন বোধক আচরণ করে। ১৯৪৭ সালে হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গায়, সম্প্রতি বার্মায় রোহিঙ্গাদের ঘর-বাড়ি পুড়িয়ে দেবার সময়ও পুলিশ প্রশ্ন বোধক আচরণ করেছে, করছে।

রামু বা পটিয়ার কোন বৌদ্ধ অন্যায় না করা সত্বেও শুধু ভীন দেশী ধর্মীয় ইস্যু নিয়ে এই বর্বোরোচিত আচরণ কোন সভ্য দেশ, কোন সভ্য মানুষ সমর্থন করতে পারে না। লিবিয়ায় আমেরিকান এক রাষ্ট্রদুতকে হত্যা কারা হয়েছে, রামুতে বৌদ্ধ পাড়ায় আগুন দেওয়া হয়েছে, মুসলিম মানুষদের বুঝা উচিত, পৃথিবীতে খ্রীস্টান, বৌদ্ধ রাষ্টের সংখ্যা অনেক । তারাও যদি আপনাদের মত একই কাজ করে তাহলে এর শেষ কোথায়? ইসলাম এত ঠুনকো ধর্ম নয়, যে কারো অবমাননায়, কারো ব্যঙ্গ আচরণে বিলীন হযে যাবে। বরং যারা নিরপরাধ মানুষকে ধর্মীয় ইস্যুতে হত্যা করে, যারা মসজিদ-মন্দির-গীর্জা-প্যাগোডা ধ্বংশ করে, তারা নিজেরাই ধ্বংশ হয়ে যাবে।

সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বাংলার আবহমানকালের ঐতিহ্য। প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে বহু ধর্মের মানুষ এদেশে একত্রে শান্তিপূর্ণভাবে জীবন যাপন করে আসছে। ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি নিষিদ্ধ--এই আলোকেই মুসলিম শাসকরা রাজ্য শাসন করেছেন। বৌদ্ধ এক শান্তিপ্রিয় জাতি। অন্ততঃ বাংলাদেশে বৌদ্ধ জাতির সাথে মুসলমান জাতির কোন দ্বন্ধ কোন কালেই শুনা যায়নি। তাহলে কেন ঘটল রামুর ঘটনা...?

আমরা দুঃখিত, লজ্জিত। সবুজ সুপারিবীথিকে পেছনে রেখে ধ্বংসস্তূপের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকা ক্ষতবিক্ষত গৌতম বুদ্ধ আমাদের ব্যথিত করে। আমরা মরমে মরে যাই। নিজেকে অসহায় মনে করি--যখন জানতে পারি, এ ঘটনার প্রস্তুতি গোয়েন্দা সংস্থার আগে থেকেই জানা ছিল। শ্রীলংকা বা থাইল্যান্ডে যখন আমাদের দূতাবাসের সামনে ওই দেশের নাগরিকরা ঘটনার প্রতিবাদ জানায়, আমাদের বুকে তখন রক্তক্ষরণ হয়। ভাবি, 'আমরা কি এই বাংলাদেশ চেয়েছিলাম!' ২৯-৩০ সেপ্টেম্বর ঘটে যাওয়া রামু বা পটিয়ার ঘটনা কোনো সভ্য দেশের, কোনো সভ্য মানুষ সমর্থন করতে পারে না।
এই বৌদ্ধ জাতিকে বারো শত শতাব্দির পরে এই ভূখন্ড ছেড়ে পালাতে হয়েছিল চর্যাপদের মত মহামূল্যবান সম্পদ নিয়ে নেপাল, তিব্বত এবং অন্য ভূখন্ডে। আমরা কি আবার সেই সময়ে ফিরে যাচ্ছি। আসুন, মানুষকে মানুষ হিসাবে দেখি, ধর্মীয় পরিচয়ের ভিত্তিতে মানুষের মূল্যায়ন বন্ধ করি। ধর্মকে বাহিরে প্রকাশের চেয়ে অন্তরে বেশী ধারণ করি, ধর্ম যেন অধর্ম হয়ে না উঠে সে দিকে খেয়াল রাখি। সেই সাথে যারা কক্সবাজারের রামু, চটৃগ্রামের পটিয়া ও পাশ্ববর্তী অন্যান্য এলাকায় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর সাম্প্রদায়িক ভুত চাপাতে চেয়েছে তাদেরকে ঘৃণা করি।

রামু সহিংসতা সাম্প্রদায়িক নাকি রাজনৈতিক

সাম্প্রতিক কক্যবাজারের রামু, চটৃগ্রামের পটিয়া ও পাশ্ববর্তী অন্যান্য এলাকায় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর সংঘটিত নাশকতা বিষয়ে কিছু বলবার আগে ইতিহাস থেকে সামান্য আলোকপাত করতে চাই্।

সভ্যতার শুরু থেকে এ পৃথিবীতে যত যুদ্ধ-বিগ্রহ ঘটেছে, তার অধিকাংশই ছিল ধর্ম যুদ্ধ (অথবা অন্য কোন বিষয় নিয়ে দ্বন্ধ শুরু হলেও, শেষ পর্যন্ত তা ধর্ম যুদ্ধের রূপ নিত)। আদিতে ধর্মীয় যুদ্ধ এমনি নৃসংশ রূপ নিত যা বাঘ-হায়েনা-শকুন এর শিকারকালীন সময়ে কিছুটা বুঝা যায়। সভ্যতার উন্নতির কারণে বর্তমান আগ্রাসণের যুদ্ধ, দেশ দখলের যুদ্ধ ধর্ম যুদ্ধের মত এতটা নৃসংশ হয়তো হয়না, এত মানুষও মারা যায় না, তবে যুদ্ধের উপকরণ (বিশেষ করে গোলাবারুদ) বেড়ে যাওয়ায় সম্পদের ক্ষতি, আহতের সংখ্যা পূর্বতন ধর্মীয় যুদ্ধের চেয়ে বেশী হয়। ধর্ম যুদ্ধ হোক আর আগ্রাসণের অথবা অন্য কোন যুদ্ধ হোক কোন যুদ্ধই মানুষ চায় না। তবে হিসাব করে দেখা গেছে, সব ধর্মীয় যুদ্ধে নিহতের সংখ্যা অন্য সব যুদ্ধে নিহতের সংখ্যার চেয়ে অনেক বেশী এবং প্রায় সব যুদ্ধের সুত্রপাত তুচ্ছ বিষয় নিয়ে।



বৌদ্ব ধর্মের পৃষ্ঠপোষক, বাংগালী ও বাংলাদেশের গোড়া পত্তনকারী পাল রাজাগণ সুদীর্ঘ ৪০০ বছর বাংলাদেশ শাসন করেন। তারপর হিন্দু ধর্মের পৃষ্ঠপোষক সেন রাজাদের এবং মুসলিম তুর্কী, পাঠান, মোগল রাজা-নবাবদের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ অত্যাচার বা নিগৃহের কারণে বৌদ্ধরা মাইগ্রেশন করে বা পালাতে থাকে। কিছু নেপালে (সূত্র: চর্যাপদ), কিছু তিব্বতে, অধিকাংশ পূর্বদিকে চলে আসে । মুসলমান আমলে বহু বছর চট্রগ্রাম, পার্বত্য চট্রগ্রাম আরাকানের অধীনে ছিল।


১৪০৪ সালে নরমিখলা নামে এক যুবরাজ আরাকার শাসন করতেন। তিনি দেশীয় এক সামন্তরাজার বোনকে অপহরণ করে রাজধানী রংগেতে নিয়ে আসেন। ১৪০৬ সালে বার্মার রাজা মেংশো আই আরাকান দখল করলে নরমিখলা তৎকালীন বাংলার রাজধানী গৌড়ে এসে আশ্রয় নেন। তখন ইলিয়াস শাহীর রাজবংশ গৌর থেকে বাংলা শাসন করতেন। গৌরের সুলতান জালালুদ্দীন শাহের সাহায্যে নরমিখলা ১৪৩০ সালে স্বীয় রাজ্য ফিরে পান। নরমিখলা ধর্মান্তরিত হয়ে মুহাম্মদ সোলায়মান শাহ নাম ধারণ করেছিলেন এবং তার রাজ্যে মুসলিম সভাসদ, সৈন্যতে ভরপুর ছিল। রাজারা বৌদ্ধ নামের সাথে একটি মুসলিম নামও ধারণ করতেন। তারা কতটা মুসলিম ছিলেন, নাকি নামেই মুসলিম ছিলেন--তা বার্মার বর্তমান অবস্থা দেখে খানিকটা অনুমান করা যায়। তবে ধরা হয়, বার্মাতে এখান থেকেই মুসলমান জাতীর সূত্রপাত।

৭ম-৮ম শতাব্দীতে চন্দ্রবংশের রাজত্বকালে বঙ্গোপসাগরে কয়েকটি আরবীয় জাহাজ সংঘর্ষে ভেঙ্গে পড়লে নাবিকরা তীরে এসে ভীড়লে রাজা তাদের ব্যবহারে সন্তষ্ট হয়ে এখানে তাদের বসবাসের অনুমতি দেন। তারা স্থানীয় রমনীদের বিয়ে করে সংসার করতে থাকেন। বঙ্গোপসাগরীয় উপকূল থেকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া পর্যন্ত আরো পূর্ব হতেই আরব বণিকদের সাথে বার্মার জনগণের যোগাযোগ ছিল। মহাকবি আলাওল তার পদ্মাবতী কাব্যে রোসাঙ্গ (রোহিংগা) জাতি সম্পর্কে বলেছেন, ’নানা দেশী নানা লোক শুনিয়া রোসাঙ্গ ভোগ আইসন্ত নৃপ ছায়াতলে। আরবী, মিশরী, সামী, তুর্কী, হাপসী, রুমী, খোরসানী, উজবেগী সকল। লাহোরী, মুলতানী, সিন্ধি, কাশ্মীরী, দক্ষিণী, হিন্দী, কামরূপী আর বঙ্গদেশী। বহু শেখ, সৈযদজাদা, মোগল, পাঠান যুদ্ধা, রাজপুত হিন্দু নানা জাতি...।’ রোয়াং, রোঁয়াই, রোহিঙ্গা এবং রোসাঙ্গ শব্দগুলো পরিমার্জিত, পরিবর্তিত হয়ে বাঙ্গালী কবিদের কাছে রোসাঙ্গ হিসাবে, স্থানীয় জনগণের কাছে রোয়াং আর আমাদের কাছে চরম অবহেলিত নিন্দিত বস্তীবাসী এক রোহিঙ্গা জাতি হিসাবে পরিচিত। তাহলে দেখা যাচ্ছে, রোহিঙ্গা জাতির ইতিহাস বেশ প্রাচীন। বার্মা কর্তৃপক্ষের বোধ উদয় হওযা উচিত তারা যতই অপরাধ করুক, এভাবে, দেশ ছাড়া করা উচিত নয়। মোঘল আমলে, ব্রিটিশ আমলেও যারা ওখানে কর্মসুত্রে চিরস্থায়ী বসতি গড়েছে , এমনকি নিকট অতীতে যারা বসতি গড়েছে, স্থানীয়ভাবে বিবাহ করেছে অথবা ঐ দেশে জন্মেছে--তাদের আপন করে নেওয়া উচিত।


এবার আসা যাক আসল কথায়, রামু, চটৃগ্রামের পটিয়া ও পাশ্ববর্তী অন্যান্য এলাকায় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর সংঘটিত নাশকতা শুধু ফেইসবুকে আপত্তিকর ছবি আপলোডকারী উত্তম বড়–য়ার জন্য হয়েছে বলে--আমি মনে করি না। এটা হয়তো কাটা গায়ে নুনের ছিটা দেবার মত বিষয় হয়েছে। দীর্ঘদিন, বিশেষ করে, অতি সম্প্রতি বার্মার মুসলিম রোহিঙ্গা জাতির উপর বর্বরোচিত অত্যাচার, আমেরিকাতে মহানবীকে নিয়ে ব্যঙ্গ চলচ্চিত্র, ফ্রান্সে মহানবীর ব্যাঙ্গ কার্টুন প্রচার, বাংলাদেশে রাজাকারদের বিচার (কক্যবাজার এলাকায় ধর্ম ভিক্তিক রাজনেতিক দলের শক্ত অবস্থান), সরকারী দল কর্তৃক বিরোধী দলের কোনঠাসা অবস্থা, রাষ্ট্র পরিচালনায় সরকারের চরম ব্যর্থতা--এই সব কারণে এলাকাটির স্বার্থান্বেসী কিছু মানুষ সাধারন ধর্মভীরু মানুষদের ভুল বুঝিয়ে তাদের পরিকল্পনা সফল করেছিল। আর গান পাউডার ব্যবহার করে এতগুলো প্রাচীন মন্দির, ঘর-বাড়ি জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দেবার পরও পুলিশ প্রশাসন ঘটনার পরদিন পর্যন্ত কেন নির্লিপ্ত ছিল, সরকারই তা বলতে পারবে। আধুনিক সভ্যতায় দেখা যায়, ধর্ম বা ধর্মীয় কোন স্পর্শ বিষয়ে কোন দাঙ্গা ফ্যাসাত হলে পুলিশ প্রশাসন প্রশ্ন বোধক আচরণ করে। ১৯৪৭ সালে হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গায়, স¤প্রতি বার্মায় রোহিঙ্গাদের ঘর-বাড়ি পুড়িয়ে দেবার সময়ও পুলিশ প্রশ্ন বোধক আচরণ করেছে, করছে।

রামু বা পটিয়ার কোন বৌদ্ধ অন্যায় না করা সত্বেও শুধু ভীন দেশী ধর্মীয় ইস্যু নিয়ে এই বর্বোরোচিত আচরণ কোন সভ্য দেশ, কোন সভ্য মানুষ সমর্থন করতে পারে না। লিবিয়ায় আমেরিকান এক রাষ্ট্রদুতকে হত্যা কারা হয়েছে, রামুতে বৌদ্ধ পাড়ায় আগুন দেওয়া হয়েছে, মুসলিম মানুষদের বুঝা উচিত, পৃথিবীতে খ্রীস্টান, বৌদ্ধ রাষ্টের সংখ্যা অনেক । তারাও যদি আপনাদের মত একই কাজ করে তাহলে এর শেষ কোথায়? ইসলাম এত ঠুনকো ধর্ম নয়, যে কারো অবমাননায়, কারো ব্যঙ্গ আচরণে বিলীন হযে যাবে। বরং যারা নিরপরাধ মানুষকে ধর্মীয় ইস্যুতে হত্যা করে, যারা মসজিদ-মন্দির-গীর্জা-প্যাগোডা ধ্বংশ করে , তারা নিজেরাই ধ্বংশ হয়ে যাবে।
সা¤প্রদায়িক স¤প্রীতি বাংলার আবহমানকালের ঐতিহ্য। প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে বহু ধর্মের মানুষ এদেশে একত্রে শান্তিপূর্ণভাবে জীবন যাপন করে আসছে। ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি নিষিদ্ধ--এই আলোকেই মুসলিম শাসকরা রাজ্য শাসন করেছেন। বৌদ্ধ এক শান্তিপ্রিয় জাতি। অন্ততঃ বাংলাদেশে বৌদ্ধ জাতির সাথে মুসলমান জাতির কোন দ্বন্ধ কোন কালেই শুনা যায়নি। তাহলে কেন ঘটল রামুর ঘটনা...?


আসুন, মানুষকে মানুষ হিসাবে দেখি, ধর্মীয় পরিচয়ের ভিত্তিতে মানুষের মূল্যায়ন বন্ধ করি। ধর্মকে বাহিরে প্রকাশের চেয়ে অন্তরে ধারণ বেশী করি, ধর্ম যেন অধর্ম হয়ে না উঠে সে দিকে খেয়াল রাখি। সেই সাথে যারা ক∙বাজারের রামু, চটৃগ্রামের পটিয়া ও পাশ্ববর্তী অন্যান্য এলাকায় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর সাম্প্রদায়িক ভুত চাপাতে চেয়েছে তাদেরকে ঘৃণা করি।

কাঁচুলি

দূর মসজিদ থেকে সুমুধুর কন্ঠে ভোরের আযান প্রকৃতিতে প্রবাহমান বাতাসের মত ছড়িয়ে পড়ল। কি সুমুধুর সে আযান--‘আস্সালাতো খাইরুন মিনান নাউম...।’ পদ্মার বুকে জেগে উঠা দোয়াল্লীর চরের প্রকৃতিতে কেমন জানি নিরবতা ভাঙ্গতে শুরু করল। দূর থেকে আযানের ধ্বনি ধীরে ধীরে এ গাঁয়ে এসে বাতাসের সাথে মিশে যায়। গ্রামটির নাম স্বর্ণগ্রাম। হ্যাঁ স্বর্ণগ্রাম। এ গাঁয়ে এক কালে সোনা ফলত। সোনার ফসলে মুখরিত হত এ গাঁয়ের সহজ সরল জীবন যাত্রার। মাটির মত মায়াশীল মায়েরা মেয়ের নাম তাই হয়তো রাখতো স্বর্ণলতা, সবুজী, সোনাবিবি ইত্যাদি। ফসলের নামে নাম রাখত ছেলেদের--শৈষশ্যা, ধনিয়া, নীলা ইত্যাদি। আজ আর সেই দিন নেই। আউশ ধানের চালের সাথে মিশে গেছে ইরি ধানের চাল । খাঁটি সরিষা আজ আর পাওয়া যায় না। মানুষেরা আজ ছন্নছাড়া, ক্ষুধার্ত, তৃষ্ণার্ত । দু’বেলা জোটে না দু’মুঠো ভাত। দরিদ্র চাষী হাড় ভাঙ্গা খাঁটুনী আর দেহের ঘাম দিয়ে সোনালী ফসল ফলায়। তবুও জীবনের বিড়ম্বনা।

আযানের সুমুধুর কন্ঠের তান শেষ হতেই এক ছোট কুঁড়েঘর থেকে কান্নার একটানা একটা আওয়াজ পূর্বদেক থেকে পশ্চিম দিকে মিশে গেল। কোন এক কঙ্কালসার জননী তার কঙ্কালদেহ ব্যবচ্ছেদ করে একটি সন্তান প্রসব করে কোঁকাতে কোঁকাতে পৃথিবীর কঠিন জটিলতা থেকে সাধ্যহীন ভারের দেহটি হেলিয়ে দিল নরম মাটিতে। শিশুটি বিদ্রোহ করে উঠল তার মায়ের মৃত্যুর জন্য। শিশুটি আযানের ধ্বনির বিকল্প এক আযান শুরু করল। ওয়া...ওয়া...ওয়া...। যেন বলছে, আমি এসেছি আমাকে বাঁচাতে দাও...আমি বাঁচতে চাই...।

মলিন, অসহায় মুখে মাথায় হাত দিয়ে খড়ের উপর বসে আছে এক প্রৌঢ় বয়েসী দাঁড়িওয়ালা লোক। সে কাঁদছে একটি পাঁচ বৎসরের মেয়ে ফতিকে কোলে নিয়ে। ফতি ঘুমিয়ে আছে বাবার কোলে। আতুড় ঘরে চিরনিদ্রায় শায়িত আছে তার বউ জহুরা। জহুরার পেটের চামড়া পিঠের চামড়ার সাতে মিশে আছে। চোখ দুটি ডুবে গেছে। মুখটি মৃত বৃদ্ধের মত শুকিয়ে আছে। কপালটি ছোট আর তাতে জমে আছে কয়েক ফোঁটা জল বিন্দুতে গড়া দুর্গন্ধ ঘাম। এই পৃথিবী ছাড়তে তার এইটুকু ঘামের প্রয়োজন পড়েছিল। প্রয়োজন পড়েছিল এই ছোট শিশুটি জন্ম দেবার। এক টুকরা চটের ছালা তার বুকে; আর নাভি থেকে হাঁটু পর্যন্ত এক টুকরো ছিন্ন কাপড়। অতি দুর্বল দেহ তার। অবুঝ বাচ্চার কান্না থামাতে ধাই বুকের উপর চঠের ছালা সরিয়ে বাচ্চাটির মুখে মায়ের দুধের একটি বোঁটা ঢুকিয়ে দিয়েছে । বাচ্চাঁিট কাঁদতে কাঁদতে মায়ের বুকে ঘুমিয়ে গেছে, আর তার দেহ সেই ভোর থেকে মায়ের বুকে কাঁচুলি হয়ে আছে ।

ভোর হয়ে গেছে। জহুরা চিরনিদ্রায় শুয়ে আছে। এক বুড়ো ধাই নিজের এক হাত কপালে রেখে অন্য হাত দিয়ে মরা মায়ের বুক থেকে শিশুটিকে নিজের কোলে তোলে নিল। শিশুটি ধাইয়ের বুকে খুঁজছে তার খাবার। বুড়ো ধাই একটি চুষনি শিশুটির মুখে পুড়ে দিল। শিশুর কান্না থেমে গেল। তাহলে ক্ষুধাই কি মানুষকে কাঁদায় চেঁচায়। যাদের আছে... তারাও তো কাঁদে, তারাও তো আরো পাবার জন্য চিৎকার করে। বুড়ো ধাই গুমড়ে গুমড়ে কাঁদছে আর তার সাদা কাপড়ের আঁচল দিয়ে চোখ মুছছে। শিশুটি আবার কাঁদছে। আতুড় ঘরের বাইরে কেহ কাঁদছে, কেহ আফসোস করছে। কেহ শকুনের মতো পাখা মেলতে চেষ্টা করছে। ওরা চায় শিশুটিকে...।

এক টুপিওয়ালা মৌলবী--নিঃসন্তান সে--চান্দু মিয়াকে লক্ষ্য করে বলছে,
ঃ কি করবা চান্দু--আল্লার মাল আল্লায় লইয়া গেছে। তোমার আমার হিম্মত আছে, যে হেরে ঠেকাই। লও দাফনের কামডা হাইরা হালাই।
ষোড়শী যুবতী চান্দু মিয়ার বড় কন্যা স্বর্ণলতা। বড় নর্তকী সে। পাড়াময় তার অবাধ যাতায়াত। তার প্রতি লোভ বিপত্মীক কালাই বেপারীর। সে মৌলবীর দিকে তাকিয়ে চেঁচিয়ে উঠল,
ঃ কি যে কন মুন্সী ভাই; আমি তো সব ব্যবস্থা কইরা হালাইছি। এই যে কাফনের কাপড়।
আরেকজন বলে উঠল,
ঃ কি যে কও কালাই ভাই; আমি তো লোক পাঠাইয়া দিছি কবর খোঁড়ার লিগা।
মুন্সী প্রচন্ড রেখে গেল। সে কালাই বেপারীর দু’জন সাঙ্গপাঙ্গদের দিকে রাগত চোখে তাকিয়ে বলল,
ঃ না আমগো খাইয়া কাম নাই। হেরা হাজী মোঃ মহসীন। চল তোরা...।
কালাই বেপারী আড়চোখে ৩য় জনের দিকে তাকাতেই সে চলে গেল ‘হু-’ শব্দ করে।

নাড়ার স্তূপে সেই মধ্যরাত থেকে মেঝো মেয়ে ফতিকে কোলে নিয়ে চান্দু মিয়া মাথায় হাত দিয়ে বসে ছিল। নাড়ার উপর মেয়েকে শোয়ায়ে আতুর ঘরের দিকে সে ধীরে পায়ে এগোতে লাগল। আতুর ঘরের একেবারে কাছে পূর্বদিকে ফিরে এক দৃষ্টিতে অনেকক্ষন দাঁড়িয়ে রইল। ঘর থেকে অস্পষ্ট কান্না এখন স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হতে লাগল। ম্বর্ণলতা কাঁদছে। ওর বান্ধবীদের স্ন্তানা স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে চান্দু মিয়া। কালাই বেপারী চান্দু মিয়ার নিকটে এসে বলতে লাগল, “চাচাজান, আপনে ভাইঙ্গা পইরেন না। তাইলে স্বর্ণারে কে বুঝাইব। ... কি করবেন, আল্লায় যা করে, ভালর লাইগাই করে। আল্লার উপর ভরসা রাহেন। কহন আল্লা পাক কি খেল দেহান--কেউ বুচতে পারে না।” এবার চান্দুমিয়া চিৎকার করে উঠল, ‘আল্লায় যা করে ভালই করে? তয় ঐ মাছুম পোলাডার কি অইব, কে অরে বাঁচাইবো? কে অরে পালব? ’ কালাই বেপারী এবার শশব্্যস্ত হয়ে বলতে লাগল, ‘কেন? কেন? আমার মা আর লতা মানে স্বর্ণলতা--ওরা পালব।’ ভবিষ্যতের নির্মম আঘাত চান্দু মিয়া কালাই বেপারীর চোখের আনন্দের মাঝে দেখতে পেল।

কালাই বেপারীর ইশারায় তার লোকজন সব ব্যবস্থা করতে লাগল। কালাই বেপারীর মৃতা ১ম স্ত্রীর ঘরের ছেলে রুহুল চিৎকার করতে লাগল,‘ আব্বা, ও আব্বা, লতা খালা বেহুশ অইয়া গেছে।’ চান্দু মিয়া দৌড়ে ঘরে গেল। চিৎকার করে সে কাঁদতে লাগল মেয়ের নাম ধরে।

অনেক সময় বয়ে গেল। স্বর্ণলতার বান্ধবী কণা চান্দু মিয়ার কাঁধে হাত রেখে বলল, ‘অরে রাহেন চাচা, মৌলভীসাব জানাজায় আপনেরে ডাহে।’ স্বর্ণলতাকে নিজের হাত থেকে বিছানায় শুয়ায়ে চান্দু বাইরে বেড়িয়ে গেল। পূর্বদিকে তাকাতেই সূর্যের প্রখর রেখা তার চোখে তীব্র আঘাত দিতে লাগল। অনেক বেলা হয়ে গেছে। আদুকে নিয়ে মোল্লার ধান কাটতে হবে। আজ মোল্লার টাকা দেবার কথা। আজ তাকে ধান কাটতে যেতেই হবে । সে এদিকে ওদিকে অনুসন্ধিৎসু চোখে তাকাতে লাগল। কোথাও আদুকে দেখতে পেল না। সোজা উঠান বরাবর সে হাঁটতে লাগল। উঠানের পূর্ব প্রান্তে এসে, সে উত্তর দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে গেল। সব ব্যবস্থা হয়ে গেছে। ঈমামসাব তাকে ডাকছে।
বুকের না বলা সুপ্ত বেদনা যেন মেঘ গর্জনের মত প্রচন্ড গর্জনে তার সমস্ত জীর্ন দেহ ভেঙ্গে চূর্ন-বিচূর্ন করে দিল। এবার সে নিজের কান্না চেপে রাখতে পারল না। আঠার বৎসরের সংসার জীবন তার। জহুরার বাবার মৃত্যুর সময় জহুরাকে তার বাবা চান্দু মিয়ার কাছে দিয়ে যায়। চান্দু তখন মাছ ধরত নদীতে। ছোট বেলা থেকেই বউ-জামাই আর পুতুলের বিয়ে খেলতে খেলতে একদিন তারা সত্যিই বউ-জামাই হয়ে গেল। যতটুকু জমি-জমা ছিল--তা দিয়ে কোনমতে চান্দুর সংসার চলত। ছোট বেলা থেকে চান্দু ছিল হেংলা-পাতলা। এ নিয়ে জহুরা প্রায়ই ঠাট্টা করত--
ঃ তুই আর মোটা অলিনা চান্দু।
ঃ দেহিস, এই ধান কাডনের কাঁচি ধইরা কইতাছি, একদিন মোটা অমু। তুই তহন হিন্সায় মরবি।
তারপর দুজনেই হাসতে হাসতে একে অপরকে জড়িয়ে ধরত। স্বর্ণলতা জন্মের দু’একদিন আগে চান্দু জহুরাকে বলেছিল-
ঃ ঐ জহুরা কতো আমাগো মাইয়া না পোলা অইব।
জহুরা হেসে বলেছিল--
ঃ ওমা! তোমার কি অইব। অইব সেন আমার, তুমি তো পোলা মানুষ--
ঃদূর! আমার কথা কইতাছিনি। তোর পেটের কথা কইতাছি।
ঃ পোলা অইব--
খিলখিল হাসিতে চান্দু হেসেছিল সেদিন। বউয়ের গালে চুমো দিয়ে বলল,
ঃ যাউক, টেহা-পয়সা লাগবে না। মাইয়া অইলে কত টেহা লাগে।
ঃ মাইয়াই অইব--
ঃ কি কইলি? পেডের মধ্যে পাড়া দিয়া তরে কব্বরে পাডামু।
হলও তাই। ফি বছর একটি করে চারটি মেয়ে হল চান্দুর। দুইটি মেয়ে মারা গেল আবহমান বাংলার চিরাচরিত নিয়ম অনুসারে। ছেলে পাওয়ার আশায় চান্দু বেকুল হয়ে উঠল। তার কতস্বপ্ন! ছেলেকে নিয়ে সে ধান কাটতে যাবে ভোগদিয়ার বিলে। ছেলে ডোলা নিয়ে ডাঙায় বসে থাকবে, সে মাছ ধরবে। ছেলেকে নিয়ে মাছ ধরা তার বড় শখ। এমনি একটি স্বপ্ন জহুরার মৃত্যুর তিনদিন আগে জহুরাকে শুনিয়েছিল।
ঃজানস জহুরা--তরে আমি বকি। তয় মনে সুক পাইনা। তুই আমার লগে রাগ করছস। কর,রাগ কর। বেশী কইরা কর। আমি কি হুদাহুদি রাগ করিরে। একটা পোলার লিগা আমি কত স্বপ্ন দেহি। জানস কাইল রাইতে স্বপ্নে দেহি আমগো একটা পোলা অইছে। কি সুন্দর! আমি অরে কোলে লইয়া ধান মাড়াইতাছি মোল্লাগো উডানে। তুই ঘোমটা দিয়া--


স্ত্রীর কোকানিতে সেদিনকার স্বপ্নের কথা চান্দু জহুরাকে আর বেশী শুনাতে পারেনি। তবে চান্দুর স্বপ্ন পূরণ হয়েছিল। জহুরা আর দেখতে পায়নি তার ছেলে নাকি মেয়ে হয়েছে। মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত জহুরা কোনদিন চান্দুর উপর রেগে কথা বলেনি। স্বাস্থ্যবতী দেহটি ক্রমেই চান্দুর মত শীর্ণ হয়ে আসছিল। ঈদের কোন এক বিকালে চান্দু জহুরার মুখের দিকে তাকিয়ে কিছু কথা বলতে গিয়ে থেমে গিয়েছিল। সেদিন সে বলতে চেয়েছিল--সে আবার বিয়ে করবে। জহুরা জানত; বুঝতে পারত স্বামীর মনের কথা। স্বর্ণলতাকে আদর করতে করতে জহুরা দুঃখের মাঝেও হেসে বলেছিল--তোর যদি সোয়াধ হয় আরেকটা বিয়া--
চান্দু মরিচ দিয়া পান্তা ভাত খাচ্ছিল। হঠাৎ সে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে গেল। আদুকে ডাকতে ডাকতে সে কাচি নিয়ে মাঠে চলে গেল।

সহজ-সরল আদু আজ ৫ বৎসর হল চান্দুর সাথে কাজ করে। শিবচর তার বাড়ী। দুনিয়াতে তার কেউ নেই। বয়স তার সতের। হালকা-পাতলা গড়ল। হালকা ফর্সা, নাকটা তীরের মত চোকা। চোখ দুটি স্বর্ণলতার ভাষায় ‘বিলাই চোখ’। অনেকে আদুকে আধা পাগলও বলে। আদু আর স্বর্ণলতার সম্পর্ক ছিল এ রকম: হয়তো আদু দৌড়ে গরু ঘর থেকে এসে বলল, ঐ স্বর্ণ, ভাত দে--
ঃ ভাত খাওন লাগবো না। বাজান না খাইয়া কামে গেছে। তুমিও যাও--
জহুরা আদুকে ডেকে বসান।
ঃ স্বর্ণা তুই আদুকে ভাত দে--
ঃ বহ আদু ভাই। আমি ঠাট্টা কল্লাম।
ঃ আইজ তোর লিগা শাপলা ফুল আনুম না বিল থিকা।
ঃ কও কি আদু ভাই। এই তোমার পা ধইরা কইলাম আর ঠাট্টা করুম না।

সবাই দাঁড়িয়ে আছে উঁচু ঢিবির উপর। খাটের উপর মৃতা জহুরাকে শোয়ায়ে সবাই খাটটিকে ধরে কাঁধে তুলল। তারপর ছয় বেয়ারার পালকি চলছে আল্লার নামে...। সবার মাথায় টুপি। স্বর্ণলতা হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। নিস্তব্ধ সে। আদুর ভীষণ জ্বর। সে কোনমতে বিছানা থেকে উঠে গরু দু’টিকে ঘাস দিয়ে তেঁতুল গাছের গোড়ায় বসে মাথাটা গাছের গোড়ায় হেলিয়ে দিল। আদুর অভ্যাস হল গান গাওয়া। যত সুখ অথবা দুঃখ তার থাকুক, সে গান গাইবে । জ্বরের ঘোরেও সে গান গাইবে। তার গান ক্ষেতের অন্য সব মজুররা খুব পছন্দ করে। কোথা থেকে যে এত গান শিখেছে, সেও জানেনা। তেঁতুল গাছের গোড়ায় বসে পশ্চিম দিকে তাকিয়ে সে জহুরা চাচীর চিরযাত্রা দেখছে। তার কন্ঠ থেকে গান বের হয়ে এল । সে গাইতে লাগল--আমারে সাজাইয়া দিও নওসার সাজন...।

উঁচু ঢিবির উপর স্বর্ণলতা দাঁড়িয়ে ছিল। সে এক পা দু’পা করে আদুর কাছে আসতে লাগল। নিজেকে আজ সে বড় অসহায় ভাবছে। আজ আদুর কাছে বসতে তার খুব ইচ্ছে করছে। আদুকে আজ বড় আপন মনে হচ্ছে। কে বলে আদু পাগল? আদু যে মনের কথা বলতে পারে। এ পৃথিবীতে তার মত কে তাকে এত আদর করে--কেউ না। প্রতিদিনের কত আব্দার সে পূরণ করার জন্য চেষ্টা করে। আজ মনে পড়ে, তাকে সে কত বকেছে কারনে-অকারনে।

আদুর গান শেষ। সে কাঁদছে। স্বর্ণা আদুর চোখের জল নিজের আঁচল দিয়ে মুছে দিল। তারপর আদু ভাই বলে চিৎকার দিয়ে তার বুকে মাথা রেখে কাঁদতে লাগল। এ কান্নার শেষ নেই। এ কান্না আনন্দের। এ কান্না ভালোবাসার । আদু স্বর্ণার মাথা উঠিয়ে বলল, স্বর্ণা, ঐ দেক্, চাচী বেহেস্ত যাইতাছে।

দুই চাকার পঙ্খীরাজ

গান্ধীর মাঠ। অনেকের সাথে আমিও মনে করতাম, মহাত্মা গান্ধী কোন একদিন এ মাঠে জনসভা করেছিলেন। সেই থেকে এই মাঠের নাম গান্ধীর মাঠ। আসলে তা নয়। মাঠের পশ্চিম পাশে ছিল ডাক্তার পাড়া। নারী শিক্ষার অগ্রগতির জন্য এই ডাক্তার পাড়ার গান্ধি পরিবারের কোন এক মহাত্মা মাঠের পূর্ব পাশের বালিকা বিদ্যালয়ের মেয়েদের খেলাধূলার জন্য এই জায়গাটি দান করেছিলেন। যদিও মাঠটি আন্তজেলা ফুটবল প্রতিযোগিতার মাঠ হয়ে খ্যাতি অর্জন করে এলাকার ছেলেদের তথা সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত ছিল। এছাড়াও লৌহজং কিশোর সংঘের নাটক, দূর্গাপূজা, মেলা, বাইসাইকেল শেখা, স্কুলের বার্ষিক প্রতিযোগিতা, রাজনৈতিক জনসভা ইত্যাদি কারণে বছরে কখনও কখনও মাঠটি ঘাসশূণ্য হয়ে যেত। লৌহজং উপজেলার বহু মানুষ এ মাঠের ফুটবল আর বাইসাইকেলের স্মৃতি নিয়ে দীর্ঘদিন বেঁচে থাকবে। আজ আর গান্ধীর মাঠ নেই। বর্তমানে গান্ধীর মাঠসহ উপজেলার প্রায় অর্ধেক পদ্মার কড়াল গ্রাসে বিলীন হয়ে গেছে। লৌহজংবাসীর স্মৃতিতে আজও জেগে আছে এ মাঠ।
এ মাঠের দক্ষিণ-পশ্চিম কোনে ছিল একটি পুরনো সাইকেলের গ্যারেজ। দিঘলী বাজারের ভিতরে আরো ২টি গ্যারেজ ছিল। সকাল থেকে দেখতাম, সবাই সাইকেল ভাড়া নিয়ে চালানো শিখতো। যারা ভালো পারতো তারাও চালাতো। কেউ কেউ ঘন্টায় ৫ টাকা করে কয়েক ঘন্টা ভাড়া নিয়ে দূর-দূরন্তে বন্ধু অথবা আত্মীয়দের বাড়িতে চলে যেত। আমার খুব ইচ্ছে হত, সাইকেল চালানো শিখতে। কিন্তু পকেটের অবস্থা ভালো ছিল না। তাছাড়া আমি খুব ভীতু ছিলাম। দু’একবার পরিচিত জনের ভাড়া নেওয়া বাইসাইকেলে উঠে একটু-আধটু চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু ভয়ে বারবার পড়ে যেতাম। তাই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অন্যদের চালানো দেখতাম। বন্ধু দেলোয়ারের ভাড়া করা সাইকেল একবার শিখতে যাওয়ার বেশী চেষ্টা করতে গিয়ে হাঁপিয়ে উঠেছিলাম। বারবার সামনের দিকে না তাকিয়ে নিচের দিকে তাকাতাম আর পড়ে যেতাম। সেদিন আমার প্রচন্ড শ্বাসকষ্ট হয়েছিল। ব্যক্তিগত জীবনে আমি ছিলাম হাঁপানী রোগী। উত্তেজিত হলে, ভয় পেলে, শ্বাসকষ্ট আরো বেড়ে যায়। আমার এরকম অবস্থা দেখে দেলোয়ার আমাকে মাঠে ফেলে পালিয়ে গিয়েছিল। একদিন পরে আমি ওর বাসায় গিয়ে বলে আসলাম বন্ধু, আমি মরি নাই।
ছোট বেলা থেকে আমি ছিলাম স্বপ্নে-বিভোর একজন মানুষ। ভাবনার আকাশে বাইসাইকেল নিয়ে কত যে মাঠ-ঘাট-পথ পাড়ি দিয়েছি। কেউ আমার সাথে জিততে পারত না। স্বপ্নে বিভোর হয়ে দুই চাকার পঙ্খীরাজ মানে বাইসাইকেল নিয়ে উড়াল দিয়ে জ্বীন-পরীর দেশে কতবার যে গিয়েছি হাঁপানী রোগের ঔষধ আনতে। কারণ আমার মা তাবিজ-কবজ, পানি-পরা, রসুনের তেল-পড়া চিকিৎসা করাতে করাতে ক্লান্ত হয়ে গিয়েছিল। কোন এক ফকিরের কাছ থেকে মা শুনেছিল জ্বীন-পরীর দেশ থেকে ঔষধ এনে খেলে হাঁপানি রোগ চিরতরে ভালো হয়ে যায়।
সে যাই হোক, আমার খুব খারাপ লাগতো যখন দেখতাম দুই বন্ধু অথবা দুই ভাই-বোন মিলে সাইকেল চালিয়ে মাঠ-ঘাট পেড়িয়ে যাচ্ছে। যদি আমি এরকম পারতাম, তাহলে আমার বোনকে সাইকেলের, পেছনে নিয়ে স্কুলে যেতে পারতাম। দুই ক্রোশ দূরে স্কুল, দূরত্বের কারণে বোনটির বেশী লেখাপড়াও হলো না।
তবে বন্ধুর সাইকেলের পিছনে ওঠে ২১ শে ফেব্রোয়ারীর ভোর রাতে পাল বাড়ীর ফুল বাগান থেকে ফুল চুরি; শীতের ভোরে দূরের কোন বড়ই গাছ থেকে বড়ই পেরে গৃহকর্তা দেখার আগেই কেটে পড়া; আলু খেতের মেঠো পথ দিয়ে যাবার সময় আলু চুরি করে পুঁড়িয়ে ভর্তা খাওয়া; কাপালী বাড়ীর পাকা গাব পেরে আমাদের ধরার আগেই সাইকেল দিয়ে দ্রুত পলায়ন--আজ সব মনে পড়ে। কোন বন্ধুর ভালোবাসার মানুষটি থাকত দূরের কোন গ্রামে। তার জন্য চিঠি লিখতে লিখতে কবে যে নিজের অজান্তে আমি সখা হয়ে গেছি--তা বুঝতে পারলাম বন্ধুটি ছেঁকা খাওয়ার পড়। ভোমালী বাড়ীর বুড়ির গরুর দুধ বেঁচতে প্রায় যেতে হতো বাজারে। আমি দুধের জগ অথবা বালতি হাতে রেখে সাইকেলের পেছনে বসতাম আর বন্ধু দেলোয়ার সাইকেল চালিয়ে যেত বাজারে। এই সাইকেলের পেছনে থেকে কত যে ভাল কাজ করেছি; মন্দ কাজ করেছি--তা লিখে শেষ করা যাবে না।
বন্ধু দেলোয়ারের সখিদের তালিকা ছিল বড় লম্বা। এই সখিদের জন্য ফুল আর পত্র বাহক হিসাবে আমার একটা সুনাম ছিল--দুর্নামও ছিল। গ্রীষ্মের দাবদাহে জনজীবন বিপর্যস্ত। সাইকেল নিয়ে ক্লান্ত দেহে বন্ধুদের প্রেমিকাদের কত যে চাঁপা, বেলী, বকুল, জুঁই, জবা, করবী ফুল দিয়েছিÑতার হিসাব নেই। বর্ষার অঝোর ধারা মাথায় নিয়ে কদম ফুল আর শাপলা দিয়ে সখিদের খুশি করতে না পেরে, অপেক্ষায় ফিরে আসি শরতে। শিউলী ফুল দিয়ে মালা গেঁথে সাইকেলকে সাঁজিয়ে কোন বন্ধুর সাইকেলের পেছনে বসে ছুটে চলি শরতের কাঁশবনের সীমান্ত দিয়ে হেমন্তের কোন রাস্তায়, কোন নতুন সখির খোঁজে। পাকা ধানের মৌ মৌ গন্ধের মেঠো পথে শেফালী আর কামেলী ফুল হাতে নিয়ে ছুটে চলি নতুন কোন গাঁয়ে। বাইসাইকেল কখনও একাত কখনও ওকাত হয়ে চঞ্চলা হরিণের মত পথ চলে। কনকনে ঠান্ডা প্রকৃতিতে গলায় মাফলার জড়িয়ে শিশির মাখা শীতের সকালে অথবা সন্ধ্যায় জঙ্গলের আঁকা-বাঁকা পথে গোলাপ, চন্দ্রমল্লিকা, রজনীগন্ধা, দোপাটি, বেলী, সূর্যমুখী অথবা পিঠা পায়েস, এমনকি রাতের বেলা চুরি করা খেজুরের রস দিয়ে কতনা অভিমান ভাঙ্গিয়েছি কত সখিকে।
কোন সখিই বেশী দিন থাকে নাই--আমার বন্ধুদের জীবনে। ওদের জন্য চিঠি লিখতে লিখতে আমিও নিজের অজান্তে সখা হয়েছি সখি ছাড়াই; হয়েছি স্বপ্নে-বিভোর কবি। পকেটে হাঁপানীর ট্যাবলেট অথবা ইনহেলার নিয়ে আমার জীবনে দুই চাকার পঙ্খীরাজ, বাইসাইকেল চালানো শেখা আর হয় নাই। পরিণত এই বয়সে এখন আর সেই ইচ্ছা নেই। কারণ সেই কৈশোর, সেই পুরনো সাইকেল, সেই বন্ধুরা, সেই সখিরা আজ আর নেই।

অনামিকাঃ এক বনফুল

কয়েকদিন ধরে মেয়েটার খুব জ্বর। সকালে একটু কমলেও দুপুরে আবার বেড়ে যায়। বিকালে মেয়েটার দিকে তাকাতে আমার খুব কষ্ট হয়। সে আমার মেয়ে নয়। তবুও কোন অংশে পিতৃত্বকে একটুখানি খাঁট করিনি তার কাছে। জীবনে কোনদিন বিয়ে করিনি। জীবন মানে ৪২ বৎসরের বিরহ-জ্বালায় জর্জরিত এক মরুময় হৃদয়। ‘সময়ের কাছে জীবনের পরাজয়’--মেনে নিয়ে আজো চিরকুমার হয়ে আছি অথচ মেয়েটাকে বলে চলেছি, দেখিস একদিন হুট্ করে একটা বুড়ী-বউ নিয়ে আসব। অনি আমার এই হাস্যোজ্বল কথার অর্থ বুঝে। নিজের অজান্তে বনিয়ার কাছে লেখা চিঠি, যা কোনদিন বনিয়াকে পাঠানো হয়নি, অনি পড়েছে, অনেকবার। কোন কোন সময় দশটা প্রশ্ন করলেও একটার উত্তরও ঠিকমত তার কাছে পাওয়া যায় না। তার বয়স ১৫ বৎসর হল--নবম শ্রেণীতে পদার্পণ হল অথচ সে একটুও পরিবর্তন হল না। বাজার থেকে তার প্রিয় একটা বস্তু কিনে এনে দিলে সে হালকাভাবে আনন্দ প্রকাশ করে । যেমন, জ্বর আসার আগে তাকে সুন্দর এক জোড়া জুতা এনে দিয়েছিলাম। সে উহা তার হাতে নিয়ে অনেকক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে রইল। এভাবেই সে আনন্দ প্রকাশ করে । কখনও হাসতে দেখিনি বললে ভুল হবে। একদিন শিকারী কুকুরটাকে কাঁধে নিয়ে হাঁটছিলাম বারান্দাতে। আর তা দেখে সে এমন একটু মৃদু হাসল যে--তা বুঝবার আগেই বাতাসে মিলিয়ে গেল।

হ্যাঁ, সে আমার মেয়ে নয়। কিন্তু কোন অপরিচিত স্থানে কারো সাথে দেখা হলে বলেই ফেলবে আপনার বড় মেয়ে বুঝি? হ্যাঁ, আমার বড় মেয়ে--একমাত্র মেয়ে। কোলকাতার ‘বৌ বাজার’ এলাকার তাজমহল হোটেলের কোন এক কামড়ার বারান্দায় কান্নারত প্রায় ৫ বছরের শিশু, কোন কথা বলে না, ভীড়ের মাঝে যেতেই এক ভদ্রলোক বলে ফেলল, এই সর সর, মেয়ের বাবা এসে গেছে। আপনার মেয়েই তো নাকি ? একবারে বাপের মত চেহেরা? আশে পাশে শকুনের মত পাখা ঝাপটানি আমার সারা দেহে কম্পন দিয়ে উঠল। এত সুন্দর একটা মেয়ে ? ওকে লালন-পালন করে বড় করলে দালালরা ভাল ব্যবসা করতে পারবে। লোকটা বলল, আমার মত চেহেরা। আমি নিজের অজান্তে বলে ফেললাম, হ্যাঁ, আমার মেয়ে। আপনারা যার যার কাজে যান। কান্নার্ত মেয়েটিকে কোলে নিতেই সে আমার কাঁধে ঘুমিয়ে গেল।

এই সেই মেয়ে--অনামিকা--কুড়িয়ে পাওয়া এক বনফুল। পরিচয় অজ্ঞাত বলে আমি নাম রেখেছি অনামিকা। তার কোন কিছু দরকার হলে সে কানের কাছে ফিসফিস করে এমনভাবে বলবে যেন কত গোপনীয় ব্যাপার। মেয়েটা এত বড় হয়েছে অথচ আজো সে তার বিছানা শূন্য রেখে আমার বিছানায় ঘুমাবে এবং তার এক হাত আমার গায়ের উপর থাকবেই। স্কুলে আমাকেই দিয়ে আসতে হবে এবং নিয়ে আসতে হবে। পাড়ার অনেক ছেলেই বাঁকা চোখে তার দিকে তাকায়। সে সামান্য ভ্র“ক্ষেপও করে না। একদিন বন্ধুসুলভ আচরণে তাকে বলেছিলাম, মাগো কোন ছেলেটাকে তোমার ভাল লাগে? সে অকপট জবাব দিল, তোমাকে।
আমি আর কোন প্রশ্ন করতে সাহস করলাম না। হঠাৎ বৈশাখের আকাশে ঝড় বইতে শুরু করল। মেঘের বিকট আওয়াজে ভয় পেয়ে অনি আমার গায়ে হেলান দিয়ে পড়তে শুরু করল, একেবারে নিঃশব্দে। আকাশের এত রহস্য অথচ কোন প্রশ্ন অনি আমাকে করে না। মনে হয়, ও যেন সব জানে। বাসায় ঞঠ আছে অথচ ওটা সে অন করে ১০ মিনিট স্থির থাকতে পারে না। খুব ভাল অনুষ্ঠান হলে আর তার প্রিয় কলা-কুশলী হলে হয়তো পুরো অনুষ্ঠান দেখবে। আবার কখনও ‘হাত-পা শির শির করে, মাথা খুব ভারী মনে হয়’--এই কথা বলেই আমার গায়ে হেলান দেবে।
ঃ বিপা ?
ঃ কি মা?
হ্যাঁ, ও আমাকে বিপাই বলে। আমিই বলেছি ওকে বিপা বরতে। সবাই অবশ্য অবাক হয়। আমার কথা হল আমি তো ওকে জস্ম...।
এই শেষ। আর কিছু বলবে না। জোড় করে দু’একটা কথা বলব, দেখব ঘুমিয়ে গেছে। একবার ঘুমিয়ে গেলে আর জাগিয়ে ভাত বা ঔষধ খাওয়ানো যাবে না। একদিন সুন্দর একটা শাড়ী এনে দিয়েছিলাম। সে ওটা বুয়ার সাহায্যে পরে আমার গলা ধরে বলল, বিপা, কেমন দেখাচ্ছে? বললাম, বা! খুব সুন্দর মামনি ! তার কপালে চুমো দিলাম। ঠোঁট দু’টি দৈর্ঘ্যে প্রশস্ত করে আর চোখ দু’টি খুব ছোট করে সে তার আনন্দ প্রকাশ করল। আদর করে বললাম, তোকে বড় ঘরে বিয়ে দেব মা?

সে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। বুকে দু’একটা কিল দিয়ে চলে গেল। তারপরের দিন দেখা গেল শাড়ী আর নেই। হয়তো কাউকে দিয়েছে, নয়তো ফেলে দিয়েছে। বাসায় ফিরার পথে একদিন একটা মেয়ে বলল, ‘স্যার, আপনের মাইয়া আমারে এই সালোয়ার, কামিজ, শাড়ী দিয়া দিছে। একেবারে নতুন স্যার--আমি হেরে বুঝাইলাম...।’

মেয়েকে বুঝালাম। সে কোন কথা বলল না। এ নিয়ে আমি আর কোন কথা বাড়ালাম না। সে রাতে খেল না। নিজের বিছানায় শুয়ে রইল। আমি সিগারেট ধরালাম। যদিও অনির জন্য সিগারেট খাওয়া একেবারে ছেড়েই দিয়েছি। তবুও আজ ছোট ভাই, বনিয়ার কথা মনে পড়ল। দুঃখ পেলাম, অনি এত দামী শাড়ীটাও...। কিছুক্ষণ পরে অনি কেঁদে কেঁদে আমার হাত ধরল। সিগারেট ফেলে দিল। গলা ধরে কাঁদতে লাগল। ‘ না মাগো, তোকে আমি বিয়ে দেব না, সত্যিই বলছি।’
আরেক দিন দু’টো চিঠি--একটা টেবিলের উপর, আরেকটা বিছানায় দেখলাম। বিছানারটা ও খুলে পড়েছে। আমি চিঠি দুটি পড়তে শুরু করলামÑ
‘‘অনামিকা,
না, তুমি নায়িকা। তুমি শুধু আমারি নায়িকা। শুভেচ্ছা নিও।
কেমন আছ? এতদিন ধরে তোমার পিছনে ছুটেছি অথচ আজও... । আমি মাস্তান হয়ে যাব। তারপর তোমাকে জোড় করে... অনি আমি তোমাকে ছাড়া বাঁচবো না। ইতি, তোমারি বিরাজ’’
‘‘অনি
সেদিনকার অপরাধ ক্ষমা করিও। এত চিঠি তোমাকে দিলাম। অথচ সব চিঠি তুমি ডাস্টবিনে ফেলে দাও শুনে খুব...।’’

আর পড়লাম না। তাহলে বুঝা যাচ্ছে অনেকদিন থেকেই...। আশ্চর্য! ছেলে দুটি এত করে প্রেম নিবেদন করছে অথচ তার কোন অনুভূতি নেই। আমি ছেলে দুটিকে চিনি। অনিকে ডাকলাম,
ঃ অনি, মাগো কে চিঠি দিয়েছে?
ঃ কি যেন নাম, সাইরাজ আর ওটা বিরাজ দিয়েছে।
ঃ তুই আনলি কেন?
ঃ জোর করে দিল যে।
আমি কয়েক দিন দেখলাম। না, তার দৃষ্টি সমান্তরাল। চলতে পথে কোন দিকে তার দৃষ্টি নেই। একদিন দরজার করিডোরে বসে আছি। হঠাৎ কে যেন অনির পড়ার ঘরের জানালায় নক করলো। অনি জানালা খুলে দিল।
ঃ আমার চিঠির উত্তর দিলে না কেন?
ঃ কি উত্তর দেবো, আমি পড়িনি তো। আমাকে এখন প্রশ্ন করো--সব উত্তর দেব।
ঃ Do you love me? মানে, আমাকে তুমি ভালবাস?
ঃ হ্যাঁ
ঃ সাইরাজকেও ?
ঃহ্যাঁ
ঃ কাকে বেশি ভালবাস ?
ঃ বিপাকে।
ঃ বিপা আবার কে ?
ঃ আমার বাবা।
ছেলেটা চলে গেল। আমি ডাকলাম,
ঃ অনি কে এসেছিল ?
ঃ বিরাজ
ঃ কি বলল তোমাকে ?
তারপর অনি সব বলল আমার কাছে। আমি রাত আটটার দিকে ডঃ ওয়াদুদের কাছে গেলাম । এই নিয়ে দশ বার হলো। মনোবিজ্ঞানীর কাছে পূর্বে পাঁচ বার গিয়েছি। কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। ঔষধ জোর করে হলেও খাওয়াতে লাগলাম দিনের পর দিন। স্কুলে ও নিজেই গেল। বাড়ী ফিরে কেঁদে কেঁদে অফিসে আমাকে টেলিফোন করল, ‘বিপা ওর আমাকে আরো চিঠি দিয়েছে। বিরাজ মুখে চুমু দিয়েছে।’

আমি বিকালে বিরাজ ও সাইরাজকে বুয়াকে দিয়ে ডাকালাম। ওরা দুজনই এল। ছেলের মত ওদের আদর করলাম। তারপর বুঝাতে শুরু করলাম। ওরা দু’জনেই নিজেদের ভুল বুঝল। ‘আমাদের মাফ করবেন স্যার।’ ওরা আমাকে স্যার বলে কারণ এক সময় ওদের আমি পড়াতাম ।
ঃ ওর কি রোগ হয়েছে, স্যার ?
ঃ ওর রোগ কিছুই ধরা পড়ছে না। তোমরা ওকে বিরক্ত করো না। তোমরা ওর বন্ধু। যখর ইচ্ছা হয়ে বাসায় এসে ওর সাথে গল্প করো--
ঃ অনি
ঃ কি বিপা?
ঃ ওদের জন্য চা বিস্কুট আনো।
ও একেবারে অবুজ। অনেক কিছু মনে হয় বুঝেÑআবার মনে হয় কিছুই বুঝে না। ‘বিপা, বিরাজকে চুমু দিয়ে দেই, আর সাইরাজকে আদর করে দেই, তারপর চা বিস্কুট দেই?’ করলোও তাই--ওরা দুজনে ভুল বুঝতে পেরে দু’চোখে জল নিয়ে চলে যেতে চাইলে অনি, সাইরাজকে ডাকল, ‘দাড়াও সাইরাজ ভাই, সিগারেট খাবে না। সিগারেট নিয়ে যাও।’ দুজনই দ্রুত পায়ে হেঁটে চলে গেল। মাঝে মাঝে আমি গভীর রাতে জেগে উঠি। তারপর আনমনে কিছুক্ষন বারান্দায় হাঁটে। বাথরুমে যেতে ভয় পেলে আমার গলা ধরে বলবে,
ঃ বিপা, ও বিপা, বাথরুমে যাব। ভয় করে। সাদা কি যেন...।
বাথরুমের কাজ শেষ হলে যদি মন ভাল থাকে তবে ওকে নিয়ে ছাদে চলে যাই। তারপর হয়তো প্রশ্ন করি --
ঃ অনি, কখনও মা-বাবার কথা মনে পড়ে?
ঃ আগে পড়তো, এখন মনে পড়ে না। বিপা আবার সেই স্বপ্ন দেখেছি। আমি শুধু হেঁটেই চলেছি অজানা এক নির্জন দ্বীপে। সেখানে তুমি, সাইরাজ, ছালমা খালা, ভূয়া কেউ নেই।


হ্যাঁ, এই একই স্বপ্ন অনি এই পর্যন্ত কম করে হলেও একশবার দেখেছে। স্বপ্ন দেখে সকালে আমার কাছে সব বলত। মনোবিজ্ঞানীর ঔষধেও কিছু হচ্ছে না।
ঃ গান গাইতে ইচ্ছে করে অনি ?
ঃ গান শুনবে বিপা ?
ঃ হ্যাঁ গাও মা--
অনি গান শুরু করলো, ‘তুই ফেলে এসেছিস কারে--মন মনরে আমার ...।’
গান শেষ হতেই আবার শুরু করল, ‘আমি চলে গেলে--পাষানের বুকে লিখ না আমার নাম...।’
হঠাৎ অনি গান থামিয়ে দিলো--
ঃ বিপা, ভাল লাগে না। জানো বিপা মাঝে মাঝে আমার ফুটবল খেলতে ইচ্ছে করে। কিন্তু মেয়েরা যে ফুটবল খেলে না। বিপা তোমাকে কতবার বলছি, তুমি বিয়ে কর। ছালমা খালা কিন্তু খুব ভাল। কোন ছেলে বিয়ে করবে বলে কথা দিয়েছিল। তারপর...।
ঃ মাগো, তুমি আগে ভাল হও।
ঃ আমিতো ভালই আছি। কি হয়েছে বিপা আমার। বলনাÑ
ঃ সেটাইতো বুঝতে পারলাম না মা ?

এমনি করে এস.এস.সি পরীক্ষার সময় চলে এল। তার অবস্থার আরো অবনতি ঘটল। সাইরাজ নামের পাড়ার ছেলেটি যথাসাধ্য তাকে সাহায্য করত। এখন সে তার শ্রেষ্ঠ বন্ধু। খুব গল্প করে। তবে অনির চেয়ে সাইরাজকে বেশী কথা বলতে হয়। গত মে মাস থেকে মে অনিকে অংক করাচ্ছে। সে কোন বিষয়ে খুব একটা ভাল না। তার কিছুই মনে থাকে না। আমি একদিন লেট করে অফিস থেকে বাসায় ফিরে দেখি সাইরাজ ওর মাথায় জল ঢালছে। বুয়া ছুটাছুটি করছে।
ঃ কি হয়েছে সাইরাজ ?
ঃ স্যার, আমি অন্যায় করে ফেলেছি?
ঃ কি অন্যায় করেছ ?
ঃ অনি অনেকক্ষন ধরে কেমন জানি করছে। কাছে এসে আমার ঘাড়ে মাথা রেখে চোখ বুজলো। আমি ওকে আদর করে বললাম, তুমি সুস্থ হলে আমি তোমাকে নিয়ে অনেক দূরে চলে যাব ,শুধু তুমি আর....। স্যার--
ঃ তোমার জন্য নয়--এ কথার জন্যও নয়। ও আজ কয়েকদিন ধরে এমন করছে...
ঃ বিপা, বুকে খুব কষ্ট। ছালমা খালাকে একটু ডাক না।
ছালমাকে ডাকা হল, সে মায়ের মত অনিকে সেবা করতে লাগল। ছালমা পাশের বাসায় থাকে, সাইরাজের ফুপু। একদিন বিকালের দিকে বিরাজ আমাদের বাসায় এসে তার ভুলের কথা বারবার বলতে লাগল, লেখাপড়া না করে বন্ধুদের সাথে এত দিন গা ভাসিয়ে চলেছিল। আজ সে বোম্বে চলে যাচ্ছে তার বড় ভাইয়ের কাছে। যাবার সময় সে অনিকে একটা সুন্দর ছবি দিল। ‘প্রকৃতির মাঝে ধামমান সময়ের কাটা’ খুব সুন্দর ছবি। মাথায় হাত দিয়ে সে অনিকে আদর করল।‘চুমু দিলে না বিরাজ ভাই ?’ বিরাজ যে ওকে এত ভালবাসত--তা আজ বুঝলাম। কেঁদে কেঁদে সে অনিকে আশীর্বাদ করল। ‘ তুমি সুস্থ হও অনি। ভগবান তোমার আয়ু...। ’
আর বলতে পারলা না। সে চলে গেল। আমি কোন কথাই বললাম না। অনি আমার হাত ধরে কিছুক্ষন তাকাল বিরাজের দিকে। তারপর বিছানায় এসে ঘুমিয়ে গেল। তারপর কখনও বিরাজ সম্পর্কে একটা প্রশ্মও তুলেনি আমার কাছে।


এসএসসি পরীক্ষা শেষ। অনি আর আমি এখন লন্ডনের আইএলজিএমআর হাসপাতাল-এ। বিপদ-জনক কোন রোগ ধরা পড়ল না। এখানে এসে সে পুরোপুরি সুস্থ। সুন্দর চেহারা ক্রমান্বয়ে বাদামী হতে লাগল। ইচ্ছে করে ওকে নিয়ে লন্ডনেই থেকে যাই। কিন্তু সামর্থ্য? চাকরী না হয়ে যদি বড় ব্যবসা হত। লন্ডনের বিভিন্ন দর্শনীয় স্থান ঘুরে বেড়ালাম। তারপর আবার ফিরে এলাম দেশে। অফিস করার ফাঁকে ফাঁকে আমি টেলিফোর করি। গল্প করি কি খাবে, আজ কোথায় যেতে ইচ্ছে করে ?
ঃ জানো বিপা, সাইরাজকে ওর বাবা আমেরিকা পাঠিয়ে দেবে। সকাল থেকে আমার খুব খারাপ লাগছে।
ঃ সাইরাস কেমন মা ? কেমন লাগে ওকে তোমার ?
ঃ মাথা ঘুড়ছে। আবার শরীর শিরশির করছে। ১১ টার দিকে বমি করেছি বিপা। ছালমা খালা এসেছিল। সাইরাজ ঔষধ দিয়ে গেছে।
ঃ মাগো, আমি এক্ষূনি আসছি।
ঃ বিপা,আারটিয়া পাখি আনবে না।
ঃ হ্যাঁ এখনি আনবো।
লন্ডনে যখন ছিলাম তখন অনিকে বলেছিলাম, দেশে গিয়ে একজোড়া টিয়া পাখী কিনে দেব। বাড়ি যাবার পথে টিয়া পাখী কিনে নিয়ে যেতে হবে। কিন্তু এখানে কোথায় টিয়া পাখি পাওয়া যায়। বেল টিপ দিলাম। পিয়ন এল--
ঃ শুন, এখানে কোথায় টিয়া পাখী পাওয়া যায়, জানো?
ঃ জে স্যার, জানি।
ঃ এই টাকা নাও। তুমি এখনি এক জোড়া পাখি কিনে আনবে । শুন,খাচা সহ আনবে।

খাঁচা সহ টিয়া পাখি এনে দিলাম অনির হাতে। সেই প্রশস্ত েঠাটের মৃদু হাসি।
ঃ বিপা, সাইরাজ আমাকে ধানমন্ডির লেকে নিয়ে যাবে।
ঃ যেও মা।
কয়েকদিন সাইরাজ এসে বিভিন্ন জায়গায় বেড়াতে নিয়ে যায়। কখনও অসুস্থ হয়ে সাইরাজের দু’হাতের বাহুতে শায়িত অবস্থায় ফিরে আসে, কখনও হাত ধরে ফিরে আসে। তবুও মনে হয় দু’তীরে দু টি মন। একদিন সাইরাজকে জিজ্ঞাসা করলাম,
ঃ ওকে কতটুকু বুঝলে ?
ঃ সামান্যও না স্যার।
সাইরাজকে আমি ইচ্ছা করে ওর পিছনে লাগিয়েছি। দেখতে চেয়েছি পরিবর্তন। --কোন পরিবর্তন হল না।


আমরা এখন পিজি হাসপাতালের করিডোরে। অনি অপারেশন থিয়েটার কক্ষে। মনে হচ্ছে, মেয়েটা যেন একা হয়ে যাচ্ছে। ডাক্তারের চেম্বারে ঢুকলাম।
ঃ স্যার, আমার মেয়ের রোগটার নাম কি?
ঃ দেখুন, ব্যক্তিগত জীবনে বহু রোগ নিয়ে পরীক্ষা করেছি-- চিকিৎসা করেছি But her disease is unknown. বিভিন্ন রোগের লক্ষন দেখা যাচ্ছে তার দেহে। দেখা যাক হৃৎপিত্ত, বৃক্ক, ইৎধরহ এর কি অবস্থা লন্ডনের রির্পোটগুলো দেখলাম। ঝঁমমবংঃরড়হ অনুযায়ী ঔষধ খাওয়ালেন। অথচ--
ঃ স্যার এ রোগের কি কোন নাম নেই ? আপনাদের...
ঃ না, দেখুন আপনার মেয়ের বিগত ৭ বৎসরের যে চিকিৎসাগত রিপোর্ট তা বিভিন্ন রোগের--এমন কোন রোগ বলতে পারছি না যার কারনে এত উপসর্গ তথা এই অবস্থার সৃষ্টি হতে পারে। আচ্ছা দু’দিন অপেক্ষা করুন।

দু’দিন নয়, ৫ দিন অপেক্ষা করলাম। অনিকে নিয়ে গবেষণা চলছে। বিকাল ৫ টা আমার পাশে সাইরাজ। ডাক্তারের চেম্বারে ঢুকলাম। আমাকে বসতে বললেন। আমি বসলাম। ডাক্তার পরিচয় করালেন,
ঃ উনি একজন জীবানুবিদ ডঃ রতন চন্দ্র মন্ডল। উনারা চার জন হলেন গবেষক।
সাক্ষাৎ করার কথা। না, কেউ হাত বাড়াল না। সবাই চিন্তিত। জীবানুবিদ আমার পাশের চেয়ারে এসে বসলেন। বুঝা যাচ্ছে সবাই ক্লান্ত।
জীবানুবিদ বলতে শুরু করলেন,
ঃ আপনার মেয়ে, তাইনা--
কথাটা না বললেও চলত। তবুও বোধহয় জড়তা কাটালেন।
ঃ আপনার নিশ্চয় জানা আছে। আজ থেকে অনেক বছর আগে ম্যালেরিয়া রোগ যার হত সে নিশ্চিৎ মৃত্যু পথযাত্রী অথবা কলেরা, যক্ষ্মাই ধরুন...। পরবর্তীতে টিকা, ঔষধ আবিষ্কার হল ফলে রোগ প্রতিরোধ সম্ভব হল।
AID বা Cancer এই ভয়ঙ্কর রোগগুলিও আমাদের Knowledge এর মধ্যে। যদিও এই রোগ গুলিকে পুরোপুরি জয় করা যায়নি। আগে বহু লোক এসব রোগে মারা গেছে আমরা তথা চিকিৎসাকরা সনাক্ত করতে পারিনি। যখন রোগকে সনাক্ত করা গেল তখন এদের নাম দেওয়া হল। আপনার মেয়ের এমনি এক অজ্ঞাত রোগে আক্রান্ত হয়েছে। এটা পৃথিবীতে একেবারে নতুন। কেউ এর নাম তথা পরিচয় জানে না। যদি আমরা ইহা সনাক্ত করতে পারি তাহলে বাংলাদেশের সুনাম হবে। এ রোগে পৃথিবীতে অনেক লোকই মরছে। না, এইডস্ বা ক্যান্সার জাতীয় নয়। এটা এর চেয়েও ভয়ঙ্কর হতে পারে। অবশ্য আমার কথা সঠিক নাও হতে পারে।

আমার শরীর দিয়ে ঘাম বের হল। আমার মেয়েকে কি তাহলে মরতে...। আমি দাঁড়িয়ে গেলাম। দু’জন গবেষক বুঝিয়ে শুনিয়ে বসাল। এখন যে আমি ৮ বৎসরের নাছোর বান্দা শিশু। আমার কাঁদতে ইচ্ছে করছে। আমার বলতে ইচ্ছে করছে আমার মামনীকে ফিরিয়ে দাও। সাইরাজ কাঁদছে, নিরবে। আমি পারছি না, চোখে জল নেই। একজন গবেষক বলতে শুরু করলেন,
ঃ দেহের কোষ নিয়ে পরীক্ষা করে দেখলাম। ২/৩ ধরণের মিথজীবী জীবানু একত্রে আছে। আকারে ব্যাকটেরিয়ার চেয়ে কোনটা ক্ষুদ্র, কোনটা বড়। আলো অথবা সামান্য স্পর্শে এগুলো জড় হয়ে থাকতে পারে ৮ ঘন্টারও বেশী। তাই পরীক্ষা করতে বেশ সময় লেগে গেল। ক্ষুদ্রতা ও জড়তা শক্তির কারণে এ রোগের জীবানু এতদিন মানে লন্ডনেও ধরা পড়েনি। কোন গবেষক হয়তো ৫ঘন্টার বেশী লেন্স নিয়ে বসে থাকেনি। আমার চোখে ধরা পড়ত, আবার হারিয়ে যেত--বেশ বিরক্ত লেগেছে । ২/৩ ধরনের জীবানুর সম্মিলিত ক্রিয়ায় এ রোগ হয়েছে। এ রোগে মানুষ প্রায় এক যুগ পর্যন্ত বেঁচে থাকতে পারে। এটা জস্মগত আবার পরিবেশগতও হতে পারে। আরেকজন গবেষক বলল্,
ঃ স্যার, আমার মনে হয়, জস্ম গত এবং ভাইরাস জাতীয় জীবানু অর্থাৎ এইডস্ এর কোন শাখাও হতে পারে। আবার ভাইরাসের বিবর্তনও হতে পারে।
আরেকজন গবেষক বলল,
ঃ স্যার, বিগত রিপোর্ট অনুযায়ী যা বুঝা যাচেছ, যদি পূর্ব থেকে এ রোগ হয়ে থাকে তবে অনেক রোগ এ জীবানুদের কারণে হয়েছে বলতে হয়। মেয়েটার বাদামী রং এখন অন্য রকম মনে হয়। আমি বলতে চাচ্ছি দীর্ঘ সময় পর পর তার গায়ের রং কিছুটা পাল্টে যায়--যা পূর্বের কোন রোগের লক্ষণই নয়। সুতরাং এ রোগ যে কোন রোগ থেকে পৃথক। তবে নতুন কোন হরমোন সম্পর্কে আমি গবেষণা করতে চাই।
চতুর্থ জন বলছে,
ঃ স্যার আমি প্রথম এবং শেষ সিদ্ধান্তের প্রতি রায় দিচ্ছি এবং আমিও হরমোনের ব্যাপারে আরো গবেষনা করতে চাই। সেই সাথে melanocytes ও melanin নিয়েও কাজ করতে চাই।
ঃ ঠিক আছে সব পরে দেখা যাবে। এখন ডাক্তার তুমি রোগীর বাবাকে Finishing টা বুঝিয়ে বল। ডাক্তার আমার মাথায় হাত দিযে বলল,
ঃ বাস্তব বড় কঠিন, তবুও এমন কোন লোক নেই যে, বাস্তবের মুখোমুখি হয়নি। God creats us and he take away us. There is no man who cross the death...no one......


কামাল সাহেব আপনার কন্যা আমাদের নতুন এক রোগের সঙ্কেত দিয়ে দিল। কাগজ পত্রগুলি ভাঁজ করলেন। তারপর আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, অনামিকাকে আল্লাপাক বেহেস্তবাসী করুন। ইন্নালিল্লাহে রাজেউন...অনি ইহজগতে নেই। সাইরাজ এবার সশব্দে কাঁদতে লাগল। কত বৎসর পর চোখের দু’তীরে পানি অনুভব করলাম। বড় শান্তি, বিভৎস্য শান্তি আমার। এখন আমার চেয়ে সুখী কে আছে! আজ কোথায় বনিয়া তুমি...আমার ভয়ঙ্কর আনন্দ দেখে যাও। তুমি ছলনা করেছ--অনিও করলো। ভালোবাসা দিয়ে কাউকেই বেঁধে রাখতে পারলাম না। ভালবাসার বন্ধন এত শিথিল! ডাক্তার আবার শুরু করলেন,
ঃ আপনার মেয়েকে আমাদের তথা পৃথিবীর মানুষের কল্যাণে দান করুন।

ওকে নিয়ে দেশের বাইরেও গবেষণা হবে। signature করে এলাম। কি লিখা ছিল জানিনা। তবে মেয়েকে দান করে এলাম। এ নিয়ে ভাবলাম না কারণ ওকে কবর দেওয়াও ঠিক হবে না। ওতো হিন্দু, জৈন, শিখ, ব্রাহ্মও হতে পারে। তাই বিশ্বের কল্যাণে দাহ করে এলাম একটা স্বাক্ষর দিয়ে।
বাড়ী ফিরে শুনি সাইরাজ কিছুতেই খেতে চায় না। ওর আপু আমাকে জানিয়ে দিয়ে গেল। সাইরাজকে আমার বাসায় এনে খাওয়ালাম। টিয়া পাখী দু’টিকে ছেড়ে দিলাম। তারপর ব্যক্তিগত জীবনের গল্প বললাম। কিছুদিন পর শুনলাম ছালমার বিয়ে হয়ে গেছে। সাইরাজ একদিন বিদায় নিয়ে তার বড় মামার কাছে জার্মানীতে চলে গেল। অনিও চলে গেছে। সবাই...।এখন শুধু আমি একা ....বড় একা...।

ধারাবাহিক উপন্যাসঃ কাকভোর পর্ব-৩

তুলসী, শেফালী তাকে প্রায়ই এ নিয়ে বকাবঝকা করে। এই বয়সেই সে বইয়ের পোকা। তবে পাঠ্যবই তার ভাল লাগে না। কূপমন্ডক জ্ঞানের ভান্ডার মনে হয়। একই বই সারা বছর পড়তে হয়। আর যে সব সিলেবাস অন্তর্ভুক্ত--তা কোন কাজে মেয়েদের লাগে--তা সে ভেবে পায় না। বই প্রণেতাদের চৌদ্দ গোষ্ঠীকে চৌদ্দবার নরকে নিয়ে সে বই পড়া শুরু করে। ক্লাশের স্যার, আপার কাছে প্রাইভেট পড়লে ভালো নম্বর পাওয়া যায়। ক্লাশে যে পড়া হয়--তা প্রাইভেট না পড়লে শেষ হয় না। বিজ্ঞান বইয়ে বারবার ‘এসো নিজে করি’--যা দারুণ বিব্রতকর। পদ্ধতিটা ধনী স্কুলের ছাত্র--ছাত্রীদের জন্য প্রযোজ্য। কারণ এসো নিজের করি, পরীক্ষার যন্ত্রপাতি আর ব্যয়ক্ষমতা গ্রাম্য স্কুলতো দূরের কথা শহরের বহুস্কুলের সরঞ্জাম ভান্ডারেও থাকে না । আর কিছু থাকলেও সময় ব্যয় করে প্রেকটিক্যাল করানোর মত মন মানসিকতা নুন আনতে পান্তা ফুরোয় শিক্ষকের থাকেই না।
গ্রাম অঞ্চলে আজো মেয়েরা ই.অ নয়, বিয়া পাশ করার জন্য লেখাপড়া করে। যেন, ভাল বর পাবার জন্যই তাদের এ লেখাপড়া। বর পক্ষরা কনের হাতের লেখা দেখে শিক্ষার মান যাচাই করেন। তাই মেয়েরা হাতের লেখা সুন্দর করার জন্য সদা সচেষ্ট থাকে। তাছাড়া নিজের ভবিষ্যৎ সন্তানদের প্রাথমিক জ্ঞানদানের জন্যও তাদের বিয়া পাশের লেখাপড়া কাজে লাগে ।
কালী কবিতা লিখতে পারে। কিন্তু কাউকে দেখাতে পারে না। বেশ লজ্জা হয়। একবার একটা কবিতা লিখে সারাস্কুলে ঝড় তুলেছিল । অনেকেই তাকে খারাপ বলেছে। দু’একজন শিক্ষক-শিক্ষিকা তাকে ‘পাকনা’ মেয়ে বলেছে। চঞ্চুরী কিশোর সংঘ তার কাছে একটা কবিতা চেয়েছে দেওয়ালিকায় ছাপানোর জন্য। সে আগের লজ্জার কথা স্মরণ করে কবিতা দেয়নি। ক্লাশের শিক্ষিকা দীপ্তি আপা কবিতা দিয়েছে। সে বয়স্ক বলেই হয়তো পেরেছে। মেয়েরা প্রেম নিয়ে কিছু লিখলেই সবার মনে সন্দেহ হয়Ñবুঝি প্রেম করে অথবা ছ্যাকা খেয়েছে। আসলে সমাজে অভ্যস্ততা নেই বলেই এত বিড়ম্বনা। খেলা নিয়েই কত কথা উঠে। স্কুল পর্যায়ে খেলার পরই উপজেলা পর্যায়ে খেলা। কালী সাঁতার, দৌড় ও হাইজ্যামে অংশগ্রহণ করবে। গত বছর জেলা পর্যায়ে সে দৌড়ে সেকেন্ড ও হাইজ্যামে থার্ড হয়েছে। এবার আরো ভাল করার ইচ্ছা। কিন্তু ছেলেদের মত কোথাও সে দৌড় প্রেকটিজ করতে পারে না। মাঠে সকালে একদিন দৌড়াতে গিয়ে দেখে ছেলেরা ফুটবল খেলছে। নাসরিন মাঠের একপ্রান্তে ব্যায়াম শুরু করল। কালী মাঠের সাইড দিয়ে দৌঁড়াতে শুরু করল। ছেলেরা তা দেখে হাসাহাসি করতে লাগল। নাসরিনের বড় ভাই তখন ফুটবল খেলছিল। সে দু’জনকে ধমক দিয়ে বাড়ীতে পাঠিয়ে দেয়। স্কুলে টিফিন পিরিয়ডে প্রেকটিস করতে কালীর মোটেও ভাল লাগে না। তখন সে থাকে ক্ষুধার্ত। তুবও একটু আধটু প্রেকটিস করে। ধানমন্ডিতে মেয়েরা ক্রিকেট খেলছে, ফুটবল খেলছে অথচ গ্রামে এসবের কি হাস্যকর অবস্থা। এখানে নারীকে ঠেলে দেওয়া হয় পশ্চাতের ইতিহাসে, বাল্যবিবাহে পারলে সতীদাহে বা আত্মঘাতির দিকে।
গ্রামে বাল্যবিবাহ সবচেয়ে বেশী হয়। যদি একটা ছেলে কোন একটা মেয়ের পিছনে লাগে তবে মেয়ের মা-বাবা ও অভিভাবকগণ পাত্র দেখতে শুরু করে দেন আর যদি মনের আনন্দের জন্য কোন মেয়ে কোন ছেলেকে ভালোলাগে বা মিনি বিনোদনের খোরাক হিসাবে কোন ছেলেমেয়ে প্রেম করে তবে ছেলেতো ছেলে থাকেই; মেয়ে, হোক সে বালিকা কিংবা কিশোরী আতœজ্ঞানী অভিভাবকরা তাকে বউ বানিয়ে বরের হাতে তুলে গ্রাম ছাড়া করে দীর্ঘ একটা নিঃশ্বাস ছাড়েন। এ নিঃশ্বাস কখনও শান্তি কখনো অশান্তি বয়ে আনে। কিন্তু শান্তি অশান্তি যাই বয়ে আসুক কন্যাকে বিদায় না করে স্বস্তি পায় না। কন্যার প্রেম যদি সমাজে ছড়ায় তবে নাকি তাদের মুখ দেখানো দায় হয়ে পড়ে। যারা বদনামকে এড়িয়ে চলে,গ্রহন করতে ঘৃনাবোধ করে, বদনাম তাদের ঘড়েই এসে ভর করে। প্রেম করা আমাদের সমাজে যেন মহাপাপ এবং সব দোষ যের শুধু কন্যার। প্রেম মহৎ, প্রেম আল্লার দান--এসব যারা বলে অথবা যারা প্রেম ছাড়া সিনেমাকে সিনেমা মনে করেন না, তাদের কন্যা বা বোন যদি প্রেম করে বসে তবে তাদের অবস্থা...। অপরের যত ক্ষতি তা মহৎ বলেও মেনে নেওয়া যায় কিন্তু নিজের ক্ষতি তা যত মহৎ--ই হোক ,মেনে নেওয়া বড় কষ্ট।

জন্মের পর থেকে মেয়েরা পিতামাতা আর নারীত্বের নিয়মে বন্ধি থাকে। সমাজে নরীদের জন্য যা সিদ্ধ, হোক সেটা ভাল বা মন্দÑ পিতা-মাতারা সমাজের মান রক্ষার্থে তাই করে। যেমন অতীতে ধর্মও সমাজের মানÑইজ্জত বাঁচাতে সতীদাহ নামক উর্বর মস্তিষ্ক থেকে আবিস্কৃত ভন্ড একটা প্রথা ছিল; চিরবিধবা নামক কুসংস্কার, স্বার্থসম্বলিত একটা রীতি ছিলা আজো বহু নিয়ম সমাজে আরশোলার মত বেচে আছে। সবাই বলে মা-বাবা যা করেন ছেলেমেয়েদের মঙ্গলের জন্যই করেন। তারপর মা-বাবার মঙ্গল সিদ্ধবিবাহ দেবার পর দেবক্রম কন্যা যদি রিটান্ট বাপের বাড়ী ফিরে আসে তখন কেউ কেউ হয়তো বলে মা-বাবা দেখে শুনে বিয়ে দেয় নাই? কিন্তু অধিকাংশ বলবে মেয়ের ভাগ্য খারাপ। কেউ বলবে অলক্ষ্মী মেয়ে। শুভস্য শীঘ্রম আর শুভ লগ্ন দেখে বিয়ে দিয়েও ৯০%বর-কন্যে যে অসুখী--সে কথা ভ্র“নাক্ষরে কেউ ভাবে বলে, মনে হয় না। এত অগ্নি, বায়ু, মাটি ইত্যাদি সাক্ষী ও আশীবাদ দ্বারা বিয়ে হয়Ñতারপরও ভেঙ্গে যায়Ñসংসার অশান্তিতে ভরে থাকে।

গ্রাম অঞ্জলে ছোট ছোট মেয়েরা ভোর সকালে উঠে শীতকালে ১মাস সূর্য পূজা করে । গুনে গুনে ৫ বছরে ৫ বার করতে পারলে পঞ্চম বারের শেষের দিন পাড়ার সকলকে নিমন্ত্রণ কওে মেয়েকে সূর্যের সাথে অভিভাবকরা বিয়ে দেয়। ঠিক বিয়ের মতই নিয়ম-কানুন। সুর্য থাকে আকাশে আর আবীর দিয়ে আঁকা সূর্যমূর্তি থাকে উঠোনে। বিভিন্ন রং দিয়ে আাঁকা ছবি বেশ তেজদীপ্ত থাকে। সূর্যের সাতে বিয়ে দেবার পর শুরু হয় ভোজন। অবশেষে, সবাই আর্শীবাদ করে, বড় হয়ে এই শিশুকন্যা যেন সূর্য দেবতার মত বর পায়।
কিন্তু আমার জানা মতে আমি ১৪/১৫টি মেয়ের সংসার জীবন দেখেছি। দেখেছি মেয়েদের কাঁদতে কাঁদতে বাপের বাড়ী ফিরতে। সেই মেয়েদের প্রত্যেকেরই ছোট বেলায় সূর্য দেবতার সাথে বিয়ে হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে সূর্যদেবতার মত এমন তেজী বর, যৌতুক মার্কা শ্বশুর আর ঝগড়াটে শ্বাশুরী পেয়েছে--যা তারা স্বপ্নেও ভাবেনি। আমার মনে হয় গতানুগতিক বিশ্বাসের ফলেই এসব কুসংস্কার আজো প্রবাহমান। এগুলো যদি বাঙ্গালীর সংস্কৃতি হিসাবে মেনে নেওয়া হয়, তবে তা হবে গ্রহণীয়।
অথচ ধর্মের এতসব অতীত, বর্তমান কুসংস্কার দেখে, শুনেও উর্বর মস্তিস্কের মানব প্রফুল্ল বন্দোপাধ্যায় কেমন করে বললেন, হিন্দু ধর্ম অতি আদি এবং বিজ্ঞান সম্মত বলেই আজো টিকে আছে। মনে হয় আরশোলা তত্ত্ব । বাবরী মসজিদের মত ৫০০ বছরের পুরনো ভারতীয় ঐতিহাসিক সম্পদ যারা রামের মান রক্ষার্থে, ধর্ম রক্ষার্থে ভেঙ্গেছে তারা আসলে ধর্ম ব্যবসায়ী নাকি রামের হনুমানের বংশধর অনুসন্ধান করতে ইচ্ছে করে।
কোন একদিন কালী, মিলন ও নাসরিনকে কাছিমের মাংস খাইয়েছিল। অবশ্য ওরাই ইচ্ছে করে খেতে চেয়েছে। কালী পরবর্তীতে গরুর মাংস খেয়েছে। এবার আগের মত প্রতিক্রিয়া হয়নি। কোন কালে , কোন সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে কোন কারণে, কোন যুক্তি দেখিয়ে কারা এসব খাওয়া নিষেধ করেছেÑতা কি বর্তমানের এ যুগে প্রবাহমান থাকবে? সমাজ পরিবর্তনশীল। একই ধর্মের লোকদের জন্য যে জিনিস হারাম সেই একই জিনিস স্থান, কালভেদে কোথাও হালাল রূপে প্রতীয়মান হয়। যদি সেই আদ্যিকালের নিয়ম মানতে হয় তবে সতীদাহ, চিরবিধবা, শিশুবিবাহ আবার শুরু হোক। মুসলমান নারীদের ইংরেজী তথা পূঁথিগত শিক্ষা বন্ধ করে বোরখার আড়ালে চাপা দেওয়া হোক। যারা ধর্মের এতসব গোঁড়ামী সৃষ্টি করেছিল, যারা ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র এবং এই চার জাতের মধ্যে হাজার হাজার বর্ণ--বৈষম্য সৃষ্টি করেছিল তারা স্বর্গের জানালা দিয়ে পৃথিবীতে উঁকি দিয়ে ফোঁকলা দাঁতে হাসতে থাকবে। এদের আনন্দ দেখে ভগবান খুশী হবেন কিনা জানিনা। সারাদিন উপাস থেকে দেব-দেবীদের পূজা দেবার মত মনমানসিকতা অন্যান্য হিন্দু মেয়েদের থাকলেও কালীর তা এক বিন্দুও নেই। আগে তা পূর্ণভাবেই ছিল। তার চিন্তাশক্তি এখন অন্যরকম হয়ে গেছে। এখন সে খুবই কঠিন, খুবই নরম মনের মানবী। এতটা দিন সে পূজা--পার্বণ করে যা পেয়েছে তা মনে রাখতে চায়না। টানা-পোড়া সংসার তাদের। বিদ্যার দৌড় ঠাকুরঘর পর্যন্ত। কোনদিনই সে মেধাবিনী ছাত্রী ছিল না। স্বরস্বতী মেধাবিদ্যা দেননি বলেই ২/১ বিষয়ে ফেল তার নিত্য ব্যাপার। সব হিন্দু মেয়েরাই লক্ষ্মী পূজা করে লক্ষ্মী পাবার জন্য। কিন্তু শ্বশুর বাড়ী গিয়ে কি রকম লক্ষ্মী কপালে জুটে তা কালী ভালভাবেই পর্যবেক্ষণ করেছে। লক্ষ্মীপূজা করে কোন মেয়ে কি রকম ধনসম্পদের মালিক হয় তা বরের যৌতুকের দাবীর ফল ভোগ করলেই বুঝা যায়।
বেশ কয়েকমাস হল কালীপদ দোকানে একজন কর্মচারী রেখেছে। ছেলেটির নাম পাশা। এতিম খানায় ৮ম শ্রেণী পর্যন্ত কোনমতে লেখাপড়া করেছে। ত্রিজগতে তার আপন কেউ নেই। আগে বালিগাঁও বাজারে এক মুদির দোকনে কাজ করত। ছেলেটি খুব ভাল। আচারÑব্যবহারও সুন্দর। খরিদ্দারকে সুন্দর কথায় বশ করতে পারে। কালীপদ আশ্বাস দিয়েছে এই দিঘলী বাজারেই তাকে একটা দোকান করে দেবে। পাশার বয়স ২৩/২৪ হবে। চেহেরাতে জ্ঞানী জ্ঞানী ভাব। ছোটবেলা থেকে অন্যের বাড়িতে মানুষ হয়েছে। সে মুসলমান কিন্তু নামায--রোজাতে তার সামান্য লক্ষ্যও নেই। কালীর সাথে তার একটা ভাল মিল, দু’জনেই গল্প--পড়ুয়া। পাশা রাতÑদিন দোকানে থাকে। কালীপদ বাড়ীতে ভাত খাইয়ে ওর জন্য খাবার নিয়ে যায়। আবার কখনও পাশাও বাড়ীতে খেয়ে দোকানে কালীপদের জন্য ভাত নিয়ে যায়। কালীর সাথে প্রথম ৬ মাস ভাল করে তেমন কথা হয়নি। ৬ মাস পর থেকে গল্পের বই চেয়ে নেবার সময় পাশা ওর সাথে দু’একটা কথা বলা শুরু করেছে। তবে আস্তে আস্তে কথা বাড়তে থাকে।

(চলবে)

*** উপন্যাসটি ১৯৯১-৯২ সালে রচিত,তাই পাঠকদের ঐ সময়ের স্কুল সিলেবাস স্মরণ করার জন্য অনুরোধ করছি।

কবিতাঃ কে তুমি

কে তুমি!
এত চেনা!
ধীর, স্থির, সুনয়না সদা লাস্যময়ী
কে তুমি?

এতদিন কোথায় লুকিয়ে ছিলে?
কেনইবা এলে ফিরে এ ধরায়
আমারি সম্মুখে--
দেবী কিবা শ্রেষ্ঠতম হুর হয়ে!

আমার যে অনেক সময় পেরিয়ে গেছে
অনেক অপেক্ষায় ছিলাম আমি,
তুমি আস না, তুমি এলে না
তুমি একেবারেই এলে না!
ভেবেছি তখন--
তুমি কোন দিনও আর আসবে না।


তবে, হঠাৎ কেন এ সূর্যোদয়!
আমি কি তন্দ্রাচ্ছন্ন নাকি নিদ্রায়?
এই, তুমি আমায় চিমটি কেটে দাও
দেখতো, আমি কি জীবিত না মৃত?
জীবিত?
তবে তুমি?
না, না, আর ভাবতে চাইনা
কেন এলে? কেন এলে?
বোধহয়, না এলেই ভাল ছিল।

ধারাবাহিক গল্পঃ সোনালি আঁশের গল্প

পাটখড়ি
--শাশ্বত স্বপন


দূর মসজিদ থেকে সুমুধুর কন্ঠে ভোরের আযান প্রকৃতিতে প্রবাহমান বাতাসের মত ছড়িয়ে পড়ল। কি সুমুধুর সে আযান--‘আস্সালাতো খাইরুন মিনান নাউম...।’ প্রকৃতিতে কেমন জানি নিরবতা ভাঙ্গতে শুরু করল। দূর থেকে আযানের ধ্বনি ধীরে ধীরে এ গাঁয়ে এসে বাতাসের সাথে মিশে যায়। গ্রামটির নাম স্বর্ণগ্রাম। হ্যাঁ স্বর্ণগ্রাম। এ গাঁয়ে এক কালে সোনা ফলত। সোনার ফসলে মুখরিত হত এ গাঁয়ের সহজ সরল জীবন যাত্রার। মাটির মত মায়াশীল মায়েরা মেয়ের নাম তাই হয়তো রাখতো স্বর্ণলতা, সবুজী, সোনাবিবি ইত্যাদি। ফসলের নামে নাম রাখত ছেলেদের--শৈষশ্যা, ধনিয়া, নীলা ইত্যাদি। আজ আর সেই দিন নেই। আউশ ধানের চালের সাথে মিশে গেছে ইরি ধানের চাল । খাঁটি সরিষা আজ আর পাওয়া যায় না । মানুষেরা আজ ছন্নছাড়া, ক্ষুধার্ত, তৃষ্ণার্ত । দু’বেলা জোটে না দু’মুঠো ভাত। দরিদ্র চাষী বৃষ্টির অভাবে দেহের ঘাম দিয়ে চৈত্রালী ফসল ফলায়। তবুও জীবনের বিড়ম্বনা।

আযানের সুমধুর কন্ঠের তান শেষ হতেই ছোট এক কুঁড়েঘর থেকে চান মিয়া আরেক কুঁড়ে ঘরের দিকে মুখ করে বারবার ডাকতে লাগল, আদু--‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌'আরে ঐ আদু, দরজা খোল, আযান দি হালাইছে...।' চান্দু ঘরের কোণার মাটির কলস থেকে এক বালতি পানি নিয়ে বাইরে গেল। তারপর বালতি থেকে এক বদনা পানি ভরে নিয়ে জঙ্গলে ঘেরা বাঁশ আর পাটের চট দিয়ে বানানো পায়খানায় চলে গেল। প্রকৃতির কাজ শেষ করে পুকুরে গিয়ে ওযু করে ঘরে এল। উত্তর ঘরে চেয়ে দেখল আদু তখনও দরজা খুলে নাই। চান্দু আবার ডাকতে শুরু করল। না-- কোন সারা শব্দ নাই। চান্দু দরজার কাছে গিয়ে দরজাটা বারবার ধাক্কা দিল। পটপট্ করে উঠল পাটখড়ির দরজা, কয়েকটা পাটখড়ি ভেঙ্গেই গেল। গতকাল আদু হাড়ভাঙ্গা খাঁটুনী খেটেছে। তাই তার এত গভীর ঘুম! ‘--আদু, আরে ঐ আদু, পাট বেঁচতে যাবি কোন সুম্?’ আদু এবার গোঙ্গানী দিয়ে উঠল, হাত-পা মোড়ামুড়ি দিয়ে উঠে দরজা খুলল। ‘-- কিরে তর ঘুম অইল, ওসমানগো টলার তো যাইবগানে, তারাতারি আগদে যা--।’ চান্দু নামাজটা শেষ করে বউয়ের মাথায় হাত দিয়ে বলল, জহুরা, আরে এই জহুরা ওঠ--। তারপর নিজেই পান্তা ভাত থালে নিয়ে মরিচ, পিয়াজ খুঁজতে লাগল। কোথাও পিয়াজ-মরিচ না পেয়ে জহুরাকে আবার ডাকতে লাগল--‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌ 'ঐ জহুরা পিয়াজ-মরিচ কৈ রাখছস? হুদা পান্তা খাওন যায়! এই জহুরা--।'


বাঁশ, কাঠ আর পাটের দড়ি দিয়ে বানানো ছোট পাটাতনে চান্দুর বড় মেয়ে স্বর্ণলতা আর ছোট মেয়ে ফতি, নীচে মাটির উপর হোগলা আর কচুরী দিয়ে বানানো মাদুর বিছিয়ে চান্দু আর জহুরা ঘুমায়। জহুরা হোগলা ও কচুরী অথবা রোদে শুকানো শুধু কচুরী ডগা দিয়ে মাদুর বানাতে পারে। কাঠের দাম বেশী বলে কাঠ দিয়ে পাটাতন গড়তে পারেনি। খাট কিনার সামর্থ নেই বলে মেয়ে দু’টোর জন্য বাঁশ, জীর্ণ কাঠ আর পাট দিয়ে নিজ হাতে পাটাতন বানিয়েছে। গত কয়েক মাসের গতরে খাটা জমানো টাকা দিয়ে নিজের পরিবারের জন্য দু’চালা ঘর তৈরী করেছে। আর উত্তরের ঘরটা--ছন, বাঁশ আর পাটখড়ির তৈরী, যেখানে আদু থাকে, সেটা একই অবস্থায় আছে। তবে স্বর্ণার বিয়ের আগে ঐ ঘরটার ছনের ছাউনি পরিবর্তন করে টিন দিয়ে চালা দেবার বিষয়ে প্রায়ই কথা উঠে।


জহুরা অসুস্থ শরীর নিয়ে ঘুম থেকে উঠে হাত-মুখ ধুয়ে পিয়াজ-মরিচ-লবণ দিয়ে ভর্তা তৈরী করেছে। আদু লুঙ্গি দিয়ে হাত-মুখ মুছে চান্দু মিয়ার সাথে খেতে বসল। জহুরা দু’জনার থালাতে সব ভর্তা ভাগ করে দিল।
--এ কি করলা, সব ভরর্তা--
--আরো পিয়াইজ-মরিছ আছে--
খাওয়া শেষে আদু ঢেকুর দিল। লুঙ্গিটা মাজায় ভালভাবে পেচিয়ে গেন্জিটা গায়ে দিয়ে চাচীর দিকে তাকাল--
--চাচীগো, গলা দিয়া বেক ভাত বাইর অইয়া আইতে চায়--
--যাও বাজান দুপুরে তোমার বরশীতে ধরা টাকী মাছ রান্দুমনে-
মজার খাবারের কথা শুনে আদু মুচকী হাসি দিল। গতকাল ফতিকে সাথে নিয়ে বোগদার বিল থেকে বরশী দিয়ে সে বারোটা টাকি মাছ ধরেছে।
-- চাচী, গোটা দুই টাকী দিয়া বর্তা কইরেন।
--আইচ্চ--
চান্দু ঘরে গিয়ে বড় মেয়েকে ডাকতে লাগল--
--স্বর্ণা, মাগো, ওট মা, পাটগুলান উত্তর ঘর থিকা উডানে আন, টলারে উডাইতে অইব। ওট মা--
স্বর্ণা এক পাইরা শাড়ীটা ঠিক করে হাম্ দিয়ে বিছানা থেকে উঠল। ছিঁড়া-ফাঁড়া কাঁথাটা ছোট বোন ফতির গায়ে ভালভাবে জড়ায়ে দিল। স্বর্ণা উত্তর ঘর থেকে তিনটা চটের টুকরা এনে উঠানে বিছিয়ে দিল। আর এই সুযোগে আদু আশে-পাশে তাকিয়ে ভিজা হাত স্বর্ণার শাড়ীর আঁচলে মুছে নিল।
--এই কর কি!
--কিরে তোর শাড়ীতে গন্ধ কেন ? রাইতে বিছিনায় মুতছসনি ?
--দূর! তোমার মতনি...

স্বর্ণা লজ্জা পেয়ে উত্তর ঘওে চলে গেল। না, আদু এ পরিবারের কেউ নয়। পিতৃমাতৃহীন এই ছেলেটি নাওখোলা, নাওডোবা, বড়কৃষ্টনগর হাঁটে হাঁটে ভিক্ষা করে। চান্দুর নিজের কোন ছেলে সন্তান না থাকায় ছলেটির জন্য তার খুব মায়া লাগে। ছেলেটি দরাজ গলায় বেশ পল্লীগীতি গায়। প্রায়ই চান্দু ওকে হাঁটে দেখতে পায়। গত বছর নাওডোবার হাঁটে এসে ওর সাথে খাঁতির করে সে ওকে বাড়িতে নিয়ে আসে। সেই থেকে সে চান্দুর সাথে গৃহস্থালী কাজ করে।
-- চাচা, আগের মতন এইবার পাট ফিরতি আনুম না কছকি! ১০০০ টাকা দরে না বেচতে পারলে মোল্লাগো সুদ দিমু কেমনে? মাইয়া ডাঙ্গর অইচে না--বিয়া দেওন লাগব না?
-- হ,বয়স কি অইছে-- দেহস না কালাই বেপারী কেমন তাগাদা শুরু করছে। আরে বেডা, তর বউ আছে--পোলা আছে --আমার মাইয়া লইয়া টানাটানি কেন?
--চাচা, এই পাট ধইয় কইতাছি--অরে খুন করুম। শালার পাট কাইট্রা দিলাম--শালায় ১০০ টাকার কথা কইয়া ৫০ টাকা দিল। আর কইল তার পশ্চিমের ক্ষেত কাইট্রা দিলে তহন এই ৫০ টেকা দিয়া দিব।
-- হ, অইছে ও মাথায় ল। হুন গাঙ্গে যাইয়া ওসমাইননাগো টলারে উডাবি, বুচছস্--
-- হ, বুচছি--

ট্রলারে চান্দু মিয়ার সাথে শওকত মিয়ার কথা চলছে। সেও হাঁটে পাট বিক্রি করতে যাচ্ছে। গতকাল একজন মহিলা শওকত মিয়ার বাড়িতে এসে তার পরিবারের সবাইকে বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা সম্পর্কে বুঝিয়ে গেছে। সে বিষয়ে শওকত চান্দুকে বলছে,
--জানস চান্দু, কাউলকা এক শিখ্খিত মাতারি আমাগো বাইতে আইয়া আমাগো কাসুরে ইসকুলে যাওনের কতা কইতাছে। আমাগোও পড়নের কতা কইতাছে। হেয় কয় আমরা নাকি চখ থাকতেও কানা। নিজেগো নামডা নিজেরা লিখতে পারলে--কত কামে লাগে । ঠিক অইতো কইছে, তাই না? আরে এট্রু লেহাপড়া জানলে মোল্লায় আমাগো জমিডা টিপসই দিয়া লইতে পারে? কিন্ত কি করুম চান্দু, সংসারে ১০ জন মানুষ আমরা, একলা কামে সংসার চলে না। কাসু আমার লগে কামে গেলে ৫০ টাকা পায়। অহন কও, লেহাপড়া আগে, না কাম আগে। আগে পেডের মইদ্যে ভাত গেলে তো তারপর অন্য কথা। না খাইয় মইরা গেলেও তো কোন হালায় জিগায় না।
-- আর কইও না শওকত বাই, আমাগো জীবনে শান্তি নাই। দেহ আউজগা হাডে পাডের কি অবস্থা অয়।

(চলবে)

ধারাবাহিক উপন্যাসঃ কাকভোর পর্ব-২

 থাক, আজ তোমার ছুটি।
কালী রাতের বেলায় মায়ের কাছে সব বলে দেয়। পরদিন শংকর পড়াতে আসল শেফালী তাকে কিঞ্চিৎ ব্যঙ্গ করে বিদায় করে দেয়। পরবর্তীতে আরো একজন ডিগ্রীতে পড়–য়া ছেলে মাস্টার হিসাবে রাখা হয়। ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটলে কালীপদ রঞ্জিতা নামের এক মহিলার কাছে তাদের পড়তে দেয়। দু’জনেই মহিলার বাসায় পড়তে যায়।

বার্ষিক পরীক্ষার খারাপ রেজাল্টের জন্য কালীপদ কালীকে মেরেছে। সারারাত সে ঘুমাতে পারেনি। শুধু খারাপ রেজাল্ট আর শংকর স্যারকে নিয়ে ভেবেছে। শংকর স্যার যা বলেছে--তা যদি সে মাকে না বলত, তবে নিশ্চয় মা তাকে বিদায় করত না। তার মঙ্গলের জন্য শংকর কি বলতে চেয়েছিল। শংকর সেদিন কান্নার্ত চোখে বিদায় নিয়েছিল। কালী লজ্জায় মুখ দেখাতে পারেনি। শংকর থাকলে হয়তো সে দুই বিষয়ে ফেল করত না। অংকেও এত খারাপ নাম্বার পেত না। গার্হস্থ্য বিজ্ঞানে সে ফেল করেছে। এই বিষয় তার মোটেও ভাল লাগে না। মাছ-মাংস, শাক-সবজি কিভাবে কুটতে হয়, রান্না-বান্না করতে হয়, ছেলেমেয়ে কিভাবে লালন-পালন করতে হয়, ঘর-দরজা কিভাবে পরিষ্কার রাখতে হয়-এই সব মুখস্ত করা তার মোটেও ভাল লাগে না। কালী ভাবে, বিদেশে কি গার্হস্থ্য বিজ্ঞান, কৃষি বিজ্ঞান আছে? সেখানে নাকি মেয়েরাও কৃষিকাজ করে। অথচ আমাদের দেশে...। কালীর ধর্ম সাবজেক্টটা পড়তে আগে ভাল লাগত--এখন ভাল লাগে না। তার মাঝে মাঝে মনে হয়, সিলেবাসে ধর্ম বিষয়টা না থেকে মহামনীষীদের জীবনী থাকলে অনেক ভাল হত। এগুলো পড়ে কেউ ধার্মিক হয়েছে বলে, তার মনে হয় না। বরং পা-তাপ করে বৃদ্ধ বয়সে হরি হরি, রামরাম শুরু করে। তার মতে এই বইটা বার্ধক্য সময়ে বাধ্যতা মূলক করা উচিত।
সপ্তম শ্রেণীর ১ম ক্লাশে একদিন মর্জিনা শিক্ষিকা সবাইকে জিজ্ঞাসা করেছিল --কে কি হতে চায়? সবাই বিভিন্ন পেশার কথা বলেছে। কিন্তু কালী বলেছে --সে আদর্শ গৃহিনী হবে, হাড়ি-পাতিল মাজবে, সন্তানাদি লালন-পালন করবে। নইলে গ্রাহস্ত্য বিজ্ঞানের অবমাননা হবে। ধর্ম-কর্ম করবে, সতীত্ব প্রমাণের জন্য সীতার মত অগ্নি-পরীক্ষা দেবে, স্বর্গ পাবার জন্য দেব-দেবীদের সন্তুষ্ট করবে--গীতা পড়বে, মহাভারত পড়বে --সীতা পড়বে, দ্রোপদী পড়বে। সীতার মত হতে হবে --দ্রোপদীর মত নয়। শিক্ষিকা অবাক হয়ে বলে, এতটুকু মেয়ে বলে কি ! এত সাহস তোমার !

বসন্তের এক দুপুর বেলা কালী বিছানায় শুয়ে নিজেকে নিয়ে ভাবছিল। কেন সে মেয়ে হল, স্রষ্টা কেন তাকে মেয়ে বানিয়ে পাঠাল আর পাঠালই যদি তবে তাকে এত কুৎসিৎ করে বানাল কেন ? পরের জন্মে সে কি পুরুষ হয়ে জš§াবে? আর যদি জন্মেও সে কি করে বুঝবে আগের জ জন্মে কালী নামে সে জ জন্মেছিল । কোথা যেন লেখা আছে একজন মানুষ জন্মের আগে সে ৮৪ লক্ষ বার বিভিন্ন জীব হয়ে জন্মেছিল। আর ভাবতে পারল না। ধর্মরহস্য নিয়ে ভাবলেই যত বাঁধা আসে। হঠাৎ মা তাকে ডাকতে শুরু করেছে। কালী মুখ কালো করে চিছানা থেকে উঠে এলো। একটি বিড়াল তার পায়ের কাছে আসতেই সে লাথি মারল খুব জোড়ে। বিড়াল ব্যথা পেয়েছে বলে মনে হল না। বিশ্ববেহায়ারা সহজে মরে না। তৃতীয় বিশ্ব যুদ্ধের পর তেলাপোকার সাথে হয়তো এরাও বেঁচে থাকবে। কালী ভাবে ৩য় বিশ্ব যুদ্ধ কবে হবে? ৩য় বিশ্বযুদ্ধ কি পৃথিবীর জন্য খুব জরুরী দরকার? এটা স্রষ্টার ব্যাপার-স্যাপার। এ নিয়ে ভাবলেও কোন লাভ নেই। যখন হবার তখনই হবে। আবার মায়ের ডাক এলো। অভি কাঁদছে। নিশ্চয়ই ঘুম থেকে উঠেছে। মা চিৎকার করে বলছেন ওকে কোলে নিতে। কালী অভিকে কোলে নিয়ে বাইরে বেড়িয়ে এল। অভির তবুও কান্না থামছে না। সন্মুখে তাকিয়ে সে দেখল এক মহিলা দক্ষিণ ঘরের ছায়ায় মোড়া পেতে বসে আছে। সে পান চিবুচ্ছে। একটি কাক তার পিছনে রাখা ব্যাগ থেকে কি যেন টানছে। মহিলা হাত উঠিয়ে কাক তাড়াল। শেফালী পাটি বিছিয়ে তার পাশে বসল। মহিলা কি যেন খুব গুরুত্ব সহকারে শেফালীকে বোঝাচ্ছে। শেফালী খুব মনোযোগে তা শুনছে। কালীর কোলে থাকা ভাইটি মায়ের কোলে যাওয়ার জন্য অবিরাম কেঁদে চলেছে।

 কালী, অভিকে দিয়ে যা 
 কে, বড় মেয়ে বুঝি?
 হ্যাঁÑ
 বেচেঁ থাক। এদিকে আসতো মা-
কালী তার সামনে এসে মাথা নিচু করে রইল।
 কোন ক্লাশে পড়?
 এবার সেভেন-এ
 ভাল করে পড়বা? আই.এ,বি.এ. পড়বা, বুঝলা?
 কি হবে এত পড়ে? হাড়ি-পাতিলই মাজতে হবে।
মহিলা হতভম্ব। সে এই ভদ্র, নম্র মেয়েটির এমন একটা কথা আশা করেনি। মা তাকে ধমকাল।
 ঐ তুই যা--। মেয়েটার একটু যদি জ্ঞান থাকত। কি হবে ওকে পড়িয়ে বলেন? ঘরের কোন কাজ করতে চায় না। ছেলেদের মত গ্রাম দৌড়ায়।
 থাক, আর একটু বড় হলেই সব ঠিক হয়ে যাবে।

কালী দক্ষিণ ঘরে মায়ের খাটে শুয়ে পড়ল। এখান থেকে সে মহিলার কণ্ঠস্বর স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে। ঘরের খুঁটিতে চলমান পিঁপড়া সে হত্যা করতে শুরু করল। আর বলতে লাগল--
 ভগবানের অদৃশ্য আদেশে আমি আজ তোদের যম হলাম। আমারও যম আছে। আমাকে হত্যা করলে সেই যমের যেমন পাপ হবে না। তোদের মারলেও আমার পাপ হবে না। তোদের মৃত্যুটা হয়তো আমার হাতেই লেখা ছিল। শেফালী অভির জন্য যেখানে বার্লি রেখেছিল সেখানে একটি চিকা ইতস্তত হাঁটতে লাগল। কালী চিকাটিকে তারাল না। আজ তার কিছু ভাল লাগছে না। শংকর তাকে আর কোনদিন পড়াতে আসবে না। মহিলা হঠাৎ জোড় গলায় শেফালীকে বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা, বাল্য বিবাহের পরিণতি সম্পর্কে বোঝাচ্ছেন। স্ত্রী শিক্ষা সম্পর্কে দীর্ঘ এক বক্তিতা দিলেন।
জানেন দিদি, স্ত্রী শিক্ষা একান্ত প্রয়োজন। সন্তানের লালন-পালন, শিক্ষা-দীক্ষার গুরু দায়িত্ব প্রথমেই থাকে মায়ের উপর ...। মা শুনছেন আর হ্যাঁ হ্যাঁ করছেন। কতটুকু মায়ের মাথায় ঢুকবে আর কতটুকু অন্য কান দিয়ে বের হয়ে যাবে কালী তা জানে। বিকালে খেলা শেষে সন্ধ্যায় বাড়ী ফিরলেই বিয়ের কথা, শ্বশুর বাড়ীর কথা উঠে যাবে। মহিলার গলার স্বর হঠাৎ নীচে নেমে গেল। সে শেফালীকে পরিবার পরিকল্পনা সম্পর্কে জ্ঞান দিচ্ছে। উত্তর ঘর থেকে অনিতা ঠাকুরমাকে ডাকছে। তুলসী রান্নাঘর থেকে উত্তর ঘরে গেল। উত্তর ঘরে মুরগীর বাচ্চারা পাতিলে রাখা চাউল ফেলে দিয়েছে মেঝেতে। কালীর এই ছোট বোন অনিতা ঘরকুনো। একেবারে কালীর উল্টো। জয়ের দুই বছরের ছোট। কথা খুব কম বলে। সে মায়ের কাছেই পড়ে। সব সময় মায়ের আঁচলে আঁচলে থাকে।
আজ রাতে নিতাই শীলের নারিকেল গাছ থেকে কালী, নাসরিন, দীপা, মিলন, কল্যাণ সকলে মিলে নারিকেল চুরি করার সমস্ত পরিকল্পনা করে ফেলেছে। নিতাই শীলের বাড়ী কালীদের বাড়ীর কাছাকাছি। পড়ার ফাঁকে পায়খানায় যাবার কথা বলে কালী নিতাই শীলের নারিকেল বাগানে চলে আসে। কালী নারিকেল গাছে উঠল। নারিকেলের গুচ্ছ কেটে দরিতে বাঁধতে লাগল। একটি নারিকেল তার হাতের গিঁট দেওয়া দড়ি থেকে মাটিতে পড়ে যায়। ফলে ভীষণ শব্দ হয়। নীতাই শীল কে কে করে চিৎকার দিয়ে হারিকেন নিয়ে বাগানে আসে। নাসরিন, দীপা, মিলন, কল্যাণ পালিয়ে যায়। কালী গাছ থেকে তারাতারি নামতে গিয়ে মাটিতে পড়ে যায়। বেশ ব্যথা পায়। নিতাই শীল ওর কান ধরে কালীপদের কাছে নিয়ে আসে। বকাবকি করে নীতাই শীল বাড়ী ফিরে। কালীপদ কালীকে খুব মারে। রাতে কালী ভাত না খেয়ে কেঁদে কেঁদে ঘুমিয়ে পড়ে। তুলসী ওকে জোড় করে গুম থেকে উঠায়ে ভাত খাইয়ে দেয়। কালীকে তুলসী বোঝাতে থাকে।
 শুন, তুই যদি খোদাইষাড়ের মত চলিস -- তাহলে তোর বাবায় তোরে বিয়া দিয়া দিব।
 ইস্ বিয়া দিয়া দিব, বুড়ী বলল একটা কথা । ঐ বুড়ী মিলনওতো চুরি করছে। ওর মা ওরে বকব --বিয়া দিব ? নাসরিনরে ওর মা-বাবায় বিয়া দেবার কথা বলে ? বাবায় যতবার আমাকে মারে ততবার আমারে বিয়া দেয়, মাও আমারে বিয়া দেয়।
 ঐ মিলন, নাসরিনের কথা বলিস, ওরা তো মুসলমান।
 আহারে মুসলমান ! কাল কল্যাণরে জিজ্ঞাসা করব, ওর মা ওকে বিয়ার কথা বলেছে কিনা ?
 ওরাতো পুরুষ মানুষ।
 আর তুমি তো মেয়ে মানুষ। এজন্যই তো সাদা কাপড় পড়, উপাস কর, নিরামিষ খাও, একাদশী কর। ঐ বুড়ী কারো বউ মারা গেলে সে কি সাদা কাপড় পড়ে--উপাস করে--একাদশী করে --নিরামিষ খায় ?
 আহারে, এই জন্যইতো ভগবান আমাদের মেয়ে বানিয়েছে।
 আর তাদের ছেলে বানিয়েছে। আমি ভগবানের কাছে যাব। তুমি আমারে উনার কাছে নিয়ে যাও।
 হায়,হায় বলে কি? পাপ হবে, এই কথা বলতে নাই।
 হ্যাঁ, তোমার পাপ হবে--আমার হবে না। আমি মারা গেলে ভগবতীকে ধরব।
 ঐ পাগল হলি। তোর পেটে এত ! কালীপদরে বলব, তোরে যেন তারাতারি বিয়া দেয়।
 বা-বা! আবার বিয়া ! আর কতবার বিয়া দিবা ?

কিছুদিন পর এক সন্ধ্যারাতে হঠাৎ শিখাদের বাড়ীতে অনেক মানুষের চিৎকার শুনা গেল। কালী, তুলসী, শেফালী--কেউ কিছু বুঝতে পারল না। তুলসী জয়ের হাতে হারিকেন দিয়ে কালীসহ তারা তিনজনে শিখাদের বাড়ী মুখী যাত্রা শুরু করল। বাড়ীতে গিয়ে দেখে এক আধাবয়সী পুরুষকে ঘিরে আছে অনেক মানুষ। উঠানের মাঝখানে লোকটি বসে আছে। দাঁড়ি আর পোশাক-আশাকে বুঝা যাচ্ছে উনি একজন ফকির। শিখাকে জিজ্ঞাসা করে কালী জানতে পারল, ফকির ভাড়ে বসেছে। ফকির পাগলের মত হাত দুটি মাটিতে চাপরাচ্ছে। শিখা বলল, এই ফকির, মানুষের যে কোন সমস্যার সমাধান করে দিতে পারে। শিখার বৃদ্ধ দাদা বেশ কিছুদিন ধরে পাগলামী করছে। বৃদ্ধ বয়সে পাগলামী অসম্ভব কিছু নয়। হতে পারে। অথচ সকলের ধারণা অন্যরকম। শিখার কাকাত ভাই যার বয়স ১০ মাস, তার সব সময় অসুখ লেগেই থাকে। আরো অনেকের খারাপ বাতাসের ছোঁয়া, ভূত-পেত্মী ইত্যাদি ধরণের রোগ আছে। কালী শিখার কাকার দিকে তাকিয়ে আছে। কাকা ফকিরকে জিজ্ঞাসা করছে, কি করলে তার পুত্র আরোগ্য লাভ করবে। ফকির ক্লান্ত মুখে অদ্ভুদ ভংগীতে বলতে লাগল, ৫টাকা আটানা মাজারে দিতে হবে। ৫ সের চাল আর ৫ সিকে ৫ জন ভিক্ষুককে দিতে হবে এবং ৫ পুকুরের পানি মিশিয়ে আবুল ফকির কে দিতে হবে। তার পড়া পানি বাচ্চাকে খাওয়াতে হবে।
আবুল ফকির সেই। সবাই বলে, আবুল ফকির একজন দিব্য মহাপুরুষ। সে এক অলৌকিক মানব। ছোট ছোট ছেলেমেয়ে থেকে শুরু করে যুবক-যুবতী, প্রৌঢ়-প্রৌঢ়া সবাই অবাক হয়ে দেখছে। কালীর বিশ্বাস হচ্ছে না। তবু কালীর জানতে ইচ্ছে করছে অতি গোপনীয় একটা ব্যাপার যা এতগুলি মানুষের সামনে বলা যাবে না।
 ঠাকুরমা, বারেকের বাবা কাগজে কি লিখেছিল?
 কি জানি, গোপন ব্যাপার।
 আমিও কাগজে লিখে দেই?
 কি লিখবি?
 তোমাকে বলা যাবে না।
 তোর বাবার ব্যবসা ভাল যাচ্ছে না। ফকিরকে জিজ্ঞাসা করি।
ফকিরকে জিজ্ঞাসা করা হল। সে একদামে একটা তাবিজ কিনতে বলল এবং আবুল ফকিরের কাছে যেতে বলল । কালী এতক্ষণে শিখার কাছ থেকে কলম নিয়ে গোপনীয় সমস্যাটা লিখেছে। নাসরিন জিজ্ঞাস করল,
 কি লিখেছিস?
 বলা যাবে না।
কাগজটা ফকিরের সারগেদের মাধ্যমে ফকিরকে দেওয়া হল। সে মুখে পুড়ে সত্যি সত্যি খেয়ে ফেলল। ৩/৪ মিনিট অদ্ভূত ভংগী করে বলল, খুব শীঘ্রই ফল পাবে।
আবুল ফকির তার কর্ম মহৎ থেকে মহত্তর করার জন্য কারো কাছ থেকে টাকা-পয়সা নিত না। যা খরচ হয় শুধু তাই নিত। সবাই এজন্য তাকে জোড় করে লাউ, কুমড়া, চাউল, ডাউল, শাক-সবজি ইত্যাদি দিয়ে আসে। এসব দিয়ে তার সংসার ভালই চলে। তার মুখের জোড় আছে। গ্রাম্য শালিশীতে বসলে সবাই সাবধানে কথা বলে। তাকে কেউ কিছু বলতে সাহস পায় না। কারণ সে বান মারতে পারে। সে মনসা পূজায় ভোগ দেয়। কালীপূজায় সক্রিয়ভাবে হিন্দুদের সাথে থাকে। তার গুরু নাকি শ্মশান কালী।
কালীর গাঁয়ের রং কবে, কিভাবে ফর্সা হবে। কবে তার চেহেরা ভগবান সুন্দর করে দেবে--এই দুইটা লাইনই সে কাগজে লিখেছিল। দীর্ঘ দুই মাস পরও সে তার ফল পায়নি। বরং সে আরো অনাকর্ষণীয় হয়ে উঠছে। দেহ মোটা হচ্ছে। চেহেরা ফুলে যাচ্ছে। তবে কালীপদ ভাল ফল পেয়েছিল। তার ব্যবসা এখন খুব ভাল চলছে। মায়ের দেওয়া তাবিজ সে মাকে খুশী করার জন্য মাজায় দিয়েছিল। প্রথম দিন স্নান করার সময় নদীতে ফেলে দিয়েছে। এখন ঈদের মওসুম। ব্যবসা তো ভাল হবেই। কিন্ত তুলসীর ধারণা তাবিজের কারণেই হয়েছে। ফলে সে আবুল ফকিরের বাড়ীতে চাউল, ডাউল, শাক-সবজি ইত্যাদি নিজ হাতে দিয়ে এসেছে।
কথা প্রসঙ্গে কালী বড় ঈদের আগের দিন নাসরিনের সাথে বাজী ধরল সে গরুর মাংস খাবে। নাসরিন ১০০ টাকা বাজী ধরল। ঈদের পরের দিন। দিনটি ছিল বৃহস্পতিবার। বিকালের দিকে কালী সত্যি সত্যি গরুর মাংস খেল। তবে সামান্য একটু মুখে দিয়েছে চোখ বন্ধ করে। যা খেয়েছে তার চেয়ে বেশী বমি করে দিয়েছে। চিরাচরিত নিয়ম সে ভাঙ্গতে পারেনি। যে জিনিস খাওয়াতে মানুষ অভ্যস্ত নয়--তা তারা সহজে খেতে পারে না--খেলেও হজম করতে পারে না। অনেক দেশেই সাপ কেঁচো, তেলাপোকা ইত্যাদি খাদ্য হিসাবে চলে। অথচ আমাদের দেশের সাধারণ মানুষ শুনলেও থুথু ফেলায়। আসলে অভ্যস্ততা হলো খাদ্যের পূর্বশর্ত। বাজী ড্র হিসাবে ধরা হয়েছে। কালী সারাদিন--সারারাত অপরাধ অপরাধ মনে করে বিবেকের কাছে প্রশ্নবানে বিদ্ধ হয়েছে। যেভাবে মোরগ-মুরগীর মাংস খাওয়া শিখেছিল সেভাবে যদি গরু খাওয়া শিখত তবে কোন অসুবিধা, ঘৃনাবোধ হত না। কিন্তু প্রত্যেক ধর্মেই কিছু কিছু বিধি নিষেধ আছে--যা একজনকে অপর জনে থেকে আলাদা করে। তবুও যে খাদ্য সময়, অবস্থান ও পরিবেশ পরিপ্রেক্ষিতে নিষিদ্ধ তা ভিন্ন সময়, ভিন্ন অবস্থান ও ভিন্ন পরিবেশে হয়ে উঠে সিদ্ধ।

সন্ধ্যাবেলা কালী শুদ্ধ কাপড়--চোপর পড়ে লক্ষ্মীর পাঁচালী পড়তে শুরু করল। তুলসীকে সামনে দেখে সে জোড়ে পড়তে লাগল। মাঝখানে থেমে সে নিজের কথা বলতে লাগল।
 মা, মা লক্ষ্মী আমাকে সুন্দর বানিয়ে দাও। আমি যেন দীপা, নাসরিনের মত সুন্দরী হই।
 কিরে, কি বলিস পাঁচালী পড়ার সময়, পাঁচালী পড়া শেষ হলে যা চাওয়ার চাইবি। এত জোড়ে চাসকে ?
 আরে বুড়ী, যখন ঝড় উঠে তখন তো হরিবল হরিবল করে--পবন ঠাকুর, পবন ঠাকুর করে জোড়ে চিৎকার কর--তখন জোড়ে বল কেন? হরিতো সব জায়গায় থাকে। আস্তে বললেও শুনে। তুমিতো চিৎকার করে বল, হরি যেন ভাল করে শুনতে পায়। আমিও মা লক্ষ্মীরে ভাল করে শুনাই । পেঁচামার্কা কান হলে তো আস্তে বললে শুনবে না--তাই জোড়ে বলি। এত বছরতো আস্তে বলছিÑমনে হয়, কানে শুনে নাই। এবার জোড়ে বলি। তোমার ভাই কার্তিকের মত আমাকে একটা বর দিও। আমাকে সুন্দরী বনিয়ে দিও।
 ঐ লক্ষ্মী মায়ের কাছে এসব চাস কেন? লক্ষ্মী মা তো এসব দেয় না।
 তবে কোন দেবীর পূজা করলে সুন্দরী হওয়া যায়--সেই দেবীর নাম বল। তেত্রিশ কোটি একটি দেব-দেবীর মধ্যে সেই দেবী নাই ?
 ঐ তোর আজকাল কি হয়েছে, আগে তো এমন ছিলি না।
 আমার মত হলে তুমি বুঝতে, কেন এমন হয়েছি?

৮ম শ্রেণীতে উঠার পর কালী আগের চেয়ে আরো বেশী পরিবর্তন হয়ে গেছে। ওর তনিমা মাসী ঢাকা থেকে ওর জন্য অনেক বই ও ম্যাগাজিন পাঠায়। সময় পেলে, কখনও লেখাপড়া বাদ দিয়ে শিখা, নাসরিনদের নিয়ে সে সেসব বই পড়ে। কোন লেখা তার মন মত হলে নাওয়া-খাওয়া ভুলে সে লেখা শেষ করে।


(চলবে)