রামু সহিংসতা সাম্প্রদায়িক নাকি রাজনৈতিক

সাম্প্রতিক কক্যবাজারের রামু, চটৃগ্রামের পটিয়া ও পাশ্ববর্তী অন্যান্য এলাকায় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর সংঘটিত নাশকতা বিষয়ে কিছু বলবার আগে ইতিহাস থেকে সামান্য আলোকপাত করতে চাই্।

সভ্যতার শুরু থেকে এ পৃথিবীতে যত যুদ্ধ-বিগ্রহ ঘটেছে, তার অধিকাংশই ছিল ধর্ম যুদ্ধ (অথবা অন্য কোন বিষয় নিয়ে দ্বন্ধ শুরু হলেও, শেষ পর্যন্ত তা ধর্ম যুদ্ধের রূপ নিত)। আদিতে ধর্মীয় যুদ্ধ এমনি নৃসংশ রূপ নিত যা বাঘ-হায়েনা-শকুন এর শিকারকালীন সময়ে কিছুটা বুঝা যায়। সভ্যতার উন্নতির কারণে বর্তমান আগ্রাসণের যুদ্ধ, দেশ দখলের যুদ্ধ ধর্ম যুদ্ধের মত এতটা নৃসংশ হয়তো হয়না, এত মানুষও মারা যায় না, তবে যুদ্ধের উপকরণ (বিশেষ করে গোলাবারুদ) বেড়ে যাওয়ায় সম্পদের ক্ষতি, আহতের সংখ্যা পূর্বতন ধর্মীয় যুদ্ধের চেয়ে বেশী হয়। ধর্ম যুদ্ধ হোক আর আগ্রাসণের অথবা অন্য কোন যুদ্ধ হোক কোন যুদ্ধই মানুষ চায় না। তবে হিসাব করে দেখা গেছে, সব ধর্মীয় যুদ্ধে নিহতের সংখ্যা অন্য সব যুদ্ধে নিহতের সংখ্যার চেয়ে অনেক বেশী এবং প্রায় সব যুদ্ধের সুত্রপাত তুচ্ছ বিষয় নিয়ে।



বৌদ্ব ধর্মের পৃষ্ঠপোষক, বাংগালী ও বাংলাদেশের গোড়া পত্তনকারী পাল রাজাগণ সুদীর্ঘ ৪০০ বছর বাংলাদেশ শাসন করেন। তারপর হিন্দু ধর্মের পৃষ্ঠপোষক সেন রাজাদের এবং মুসলিম তুর্কী, পাঠান, মোগল রাজা-নবাবদের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ অত্যাচার বা নিগৃহের কারণে বৌদ্ধরা মাইগ্রেশন করে বা পালাতে থাকে। কিছু নেপালে (সূত্র: চর্যাপদ), কিছু তিব্বতে, অধিকাংশ পূর্বদিকে চলে আসে । মুসলমান আমলে বহু বছর চট্রগ্রাম, পার্বত্য চট্রগ্রাম আরাকানের অধীনে ছিল।


১৪০৪ সালে নরমিখলা নামে এক যুবরাজ আরাকার শাসন করতেন। তিনি দেশীয় এক সামন্তরাজার বোনকে অপহরণ করে রাজধানী রংগেতে নিয়ে আসেন। ১৪০৬ সালে বার্মার রাজা মেংশো আই আরাকান দখল করলে নরমিখলা তৎকালীন বাংলার রাজধানী গৌড়ে এসে আশ্রয় নেন। তখন ইলিয়াস শাহীর রাজবংশ গৌর থেকে বাংলা শাসন করতেন। গৌরের সুলতান জালালুদ্দীন শাহের সাহায্যে নরমিখলা ১৪৩০ সালে স্বীয় রাজ্য ফিরে পান। নরমিখলা ধর্মান্তরিত হয়ে মুহাম্মদ সোলায়মান শাহ নাম ধারণ করেছিলেন এবং তার রাজ্যে মুসলিম সভাসদ, সৈন্যতে ভরপুর ছিল। রাজারা বৌদ্ধ নামের সাথে একটি মুসলিম নামও ধারণ করতেন। তারা কতটা মুসলিম ছিলেন, নাকি নামেই মুসলিম ছিলেন--তা বার্মার বর্তমান অবস্থা দেখে খানিকটা অনুমান করা যায়। তবে ধরা হয়, বার্মাতে এখান থেকেই মুসলমান জাতীর সূত্রপাত।

৭ম-৮ম শতাব্দীতে চন্দ্রবংশের রাজত্বকালে বঙ্গোপসাগরে কয়েকটি আরবীয় জাহাজ সংঘর্ষে ভেঙ্গে পড়লে নাবিকরা তীরে এসে ভীড়লে রাজা তাদের ব্যবহারে সন্তষ্ট হয়ে এখানে তাদের বসবাসের অনুমতি দেন। তারা স্থানীয় রমনীদের বিয়ে করে সংসার করতে থাকেন। বঙ্গোপসাগরীয় উপকূল থেকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া পর্যন্ত আরো পূর্ব হতেই আরব বণিকদের সাথে বার্মার জনগণের যোগাযোগ ছিল। মহাকবি আলাওল তার পদ্মাবতী কাব্যে রোসাঙ্গ (রোহিংগা) জাতি সম্পর্কে বলেছেন, ’নানা দেশী নানা লোক শুনিয়া রোসাঙ্গ ভোগ আইসন্ত নৃপ ছায়াতলে। আরবী, মিশরী, সামী, তুর্কী, হাপসী, রুমী, খোরসানী, উজবেগী সকল। লাহোরী, মুলতানী, সিন্ধি, কাশ্মীরী, দক্ষিণী, হিন্দী, কামরূপী আর বঙ্গদেশী। বহু শেখ, সৈযদজাদা, মোগল, পাঠান যুদ্ধা, রাজপুত হিন্দু নানা জাতি...।’ রোয়াং, রোঁয়াই, রোহিঙ্গা এবং রোসাঙ্গ শব্দগুলো পরিমার্জিত, পরিবর্তিত হয়ে বাঙ্গালী কবিদের কাছে রোসাঙ্গ হিসাবে, স্থানীয় জনগণের কাছে রোয়াং আর আমাদের কাছে চরম অবহেলিত নিন্দিত বস্তীবাসী এক রোহিঙ্গা জাতি হিসাবে পরিচিত। তাহলে দেখা যাচ্ছে, রোহিঙ্গা জাতির ইতিহাস বেশ প্রাচীন। বার্মা কর্তৃপক্ষের বোধ উদয় হওযা উচিত তারা যতই অপরাধ করুক, এভাবে, দেশ ছাড়া করা উচিত নয়। মোঘল আমলে, ব্রিটিশ আমলেও যারা ওখানে কর্মসুত্রে চিরস্থায়ী বসতি গড়েছে , এমনকি নিকট অতীতে যারা বসতি গড়েছে, স্থানীয়ভাবে বিবাহ করেছে অথবা ঐ দেশে জন্মেছে--তাদের আপন করে নেওয়া উচিত।


এবার আসা যাক আসল কথায়, রামু, চটৃগ্রামের পটিয়া ও পাশ্ববর্তী অন্যান্য এলাকায় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর সংঘটিত নাশকতা শুধু ফেইসবুকে আপত্তিকর ছবি আপলোডকারী উত্তম বড়–য়ার জন্য হয়েছে বলে--আমি মনে করি না। এটা হয়তো কাটা গায়ে নুনের ছিটা দেবার মত বিষয় হয়েছে। দীর্ঘদিন, বিশেষ করে, অতি সম্প্রতি বার্মার মুসলিম রোহিঙ্গা জাতির উপর বর্বরোচিত অত্যাচার, আমেরিকাতে মহানবীকে নিয়ে ব্যঙ্গ চলচ্চিত্র, ফ্রান্সে মহানবীর ব্যাঙ্গ কার্টুন প্রচার, বাংলাদেশে রাজাকারদের বিচার (কক্যবাজার এলাকায় ধর্ম ভিক্তিক রাজনেতিক দলের শক্ত অবস্থান), সরকারী দল কর্তৃক বিরোধী দলের কোনঠাসা অবস্থা, রাষ্ট্র পরিচালনায় সরকারের চরম ব্যর্থতা--এই সব কারণে এলাকাটির স্বার্থান্বেসী কিছু মানুষ সাধারন ধর্মভীরু মানুষদের ভুল বুঝিয়ে তাদের পরিকল্পনা সফল করেছিল। আর গান পাউডার ব্যবহার করে এতগুলো প্রাচীন মন্দির, ঘর-বাড়ি জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দেবার পরও পুলিশ প্রশাসন ঘটনার পরদিন পর্যন্ত কেন নির্লিপ্ত ছিল, সরকারই তা বলতে পারবে। আধুনিক সভ্যতায় দেখা যায়, ধর্ম বা ধর্মীয় কোন স্পর্শ বিষয়ে কোন দাঙ্গা ফ্যাসাত হলে পুলিশ প্রশাসন প্রশ্ন বোধক আচরণ করে। ১৯৪৭ সালে হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গায়, স¤প্রতি বার্মায় রোহিঙ্গাদের ঘর-বাড়ি পুড়িয়ে দেবার সময়ও পুলিশ প্রশ্ন বোধক আচরণ করেছে, করছে।

রামু বা পটিয়ার কোন বৌদ্ধ অন্যায় না করা সত্বেও শুধু ভীন দেশী ধর্মীয় ইস্যু নিয়ে এই বর্বোরোচিত আচরণ কোন সভ্য দেশ, কোন সভ্য মানুষ সমর্থন করতে পারে না। লিবিয়ায় আমেরিকান এক রাষ্ট্রদুতকে হত্যা কারা হয়েছে, রামুতে বৌদ্ধ পাড়ায় আগুন দেওয়া হয়েছে, মুসলিম মানুষদের বুঝা উচিত, পৃথিবীতে খ্রীস্টান, বৌদ্ধ রাষ্টের সংখ্যা অনেক । তারাও যদি আপনাদের মত একই কাজ করে তাহলে এর শেষ কোথায়? ইসলাম এত ঠুনকো ধর্ম নয়, যে কারো অবমাননায়, কারো ব্যঙ্গ আচরণে বিলীন হযে যাবে। বরং যারা নিরপরাধ মানুষকে ধর্মীয় ইস্যুতে হত্যা করে, যারা মসজিদ-মন্দির-গীর্জা-প্যাগোডা ধ্বংশ করে , তারা নিজেরাই ধ্বংশ হয়ে যাবে।
সা¤প্রদায়িক স¤প্রীতি বাংলার আবহমানকালের ঐতিহ্য। প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে বহু ধর্মের মানুষ এদেশে একত্রে শান্তিপূর্ণভাবে জীবন যাপন করে আসছে। ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি নিষিদ্ধ--এই আলোকেই মুসলিম শাসকরা রাজ্য শাসন করেছেন। বৌদ্ধ এক শান্তিপ্রিয় জাতি। অন্ততঃ বাংলাদেশে বৌদ্ধ জাতির সাথে মুসলমান জাতির কোন দ্বন্ধ কোন কালেই শুনা যায়নি। তাহলে কেন ঘটল রামুর ঘটনা...?


আসুন, মানুষকে মানুষ হিসাবে দেখি, ধর্মীয় পরিচয়ের ভিত্তিতে মানুষের মূল্যায়ন বন্ধ করি। ধর্মকে বাহিরে প্রকাশের চেয়ে অন্তরে ধারণ বেশী করি, ধর্ম যেন অধর্ম হয়ে না উঠে সে দিকে খেয়াল রাখি। সেই সাথে যারা ক∙বাজারের রামু, চটৃগ্রামের পটিয়া ও পাশ্ববর্তী অন্যান্য এলাকায় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর সাম্প্রদায়িক ভুত চাপাতে চেয়েছে তাদেরকে ঘৃণা করি।

No comments:

Post a Comment