ধারাবাহিক উপন্যাসঃ হৃদয়ের এপিঠ-ওপিঠ পর্ব-১

আমার কিছু কথা


উত্তম পুরুষের বাচন শৈলীতে রচিত ‘হৃদয়ের এপিঠ-ওপিঠ’ উপন্যাসটি ব্যক্তিগত জীবনের পাওয়া না পাওয়ার এই লেখার নায়ক শোভন--যাকে চারপাশের সহস্র জ্বালা-যন্ত্রণা জমাট পাথরের মত আঁকড়ে ধরেছে। মা-বাবা হারিয়ে আত্মীয়-স্বজনহীন এই নিষ্ঠুর পৃথিবীতে সে এক টুকরো লাল ফিতের মত আহত ভালোবাসা নিয়ে তুষের আগুনে জ্বলে-পুড়ে বিরহের বিষাক্ত স্রোতে ভেসে যাচ্ছে লক্ষ্যহীন পথে। সময় আর ধর্মের শক্ত শিকলে বাঁধা বিধর্মী এক কিশোরীকে ভালবাসার অপরাধ সন্ত্রাসে রুপ নিলে, তাকে জেল খাটতে হয়। রক্ত সম্পর্কহীন এক চাচার বাসায় আশ্রিত থাকাকালীন সে জানতে পারে--চাচা পিতা হত্যাকারীদের একজন। রাগে, ক্ষোভে এক ফোঁটা ভালবাসা, এক টুকরো শান্তির জন্য আপন বিবেককে বিসর্জন দিয়ে গন্তব্যহীন শ্যাঁওলা পথে পা বাড়ায়। বিখ্যাত ধনীর একমাত্র মানসিক বিকারগ্রস্ত কন্যাকে নিয়ে আগুন খেলায় সে মেতে উঠে। বিধর্মী মেয়েকে ভালবাসা অসম্পূর্ণ রেখে ব্রেইন ক্যান্সারে মারা যায় তার একমাত্র ছোট ভাই। কেউ কথা রাখেনি তার জীবনে। তার জন্য নিষিদ্ধ, অশান্তির এই বিষাক্ত পৃথিবীতে আহত হৃদয়ে এতিম এই পরাজিত সৈনিক ক্রমাগত দুঃখ-জ্বালা, স্মৃতিগত যšত্রণায় জ্বলতে জ্বলতে নিষিদ্ধ বৃত্তের সীমান্তে পৌঁছে যায়, হয়ে উঠে জীবন্ত লাশ। চুক্তি অনুযায়ী হারাতে হয় মানসিক রোগ হতে সুস্থ, সুন্দরী যুবতীকে। কিন্ত ভালবাসা কি চুক্তি মানে? ভালবাসা যা দেয়--তার চেয়ে অনেক বেশী কেড়ে নেয়। তবুও মানুষ ভালবাসার জন্য সহস্র শিকলের ত্রিভূজ ভেঙ্গে বাইরে বেড়িয়ে আসতে চায়। আর তাইতো ভালবাসার নীল দংশনে বিষাক্ত হয়ে উঠে হৃদয়ের এপিঠ-ওপিঠ।
১৯৯২ সালে এই উপন্যাসটি ‌‌‌‌‌‌‌'দৈনিক সকালের খবর' পত্রিকায় প্র্রকাশিত হয়েছিল। বুর্জোয়া সসাজের বেকার যুবকদের মাঝে উপন্যাসটির আবেদন এখনও একই অটুট আছে। আর তাই..


উৎসর্গ
বাংলাদেশের বেকার যুবকদের--
যারা ভুল করে, ভুল করে এবং
সেই ভুলের যন্ত্রণা সারাজীবন বয়ে বেড়ায়।




হৃদয়ের এপিঠ-ওপিঠ
--শাশ্বত স্বপন

দেড় বছর ধরে ছোটখাট একটা চাকুরী খুঁজছি। এমন কোনদিন নেই, যেদিন আমি চাকুরীর জন্য ছুটোছুটি না করি। আজ এমন একটা অফিসের ওয়েটিং রুমে বসে আছি--যেখানে চাকুরীর পদসংখ্যা বারটি আর আবেদন পত্র জমা পড়েছে তিন শত সাতাত্তরটি। পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকে ধরেই নিয়েছি--আমার চাকুরী হবে না। তবুও আল্লাহ্র মহান অদৃশ্য শক্তির প্রতি দুর্বলতার কারণে ধৈর্য্য ধরে বসে আছি। দেখি, অদৃশ্য শক্তি আমার ব্যক্তিগত জীবনের পঁচিশ বছরের আশাহত মনের সমস্ত দুঃখ-কষ্টের মাঝে একটা বনফুল ফোটান কিনা। জীবনে সুখ নামক অদৃশ্য পাখিকে আপন করতে গিয়ে এমন সব বেদনার সম্মুখীন হয়েছি--যে বেদনা সুখ নামক আকাংখিত পাখীকে ক্রমাগত চাপা দিতে দিতে ছাপান্ন হাজার বর্গমাইল মাটির নিচে পুতে রেখেছে। সুখ কি জিনিষ--আমি জানিনা। তবে জানতে চাই। আমি জানি, আমার হৃদয় খনিতে সুখ আছে--সুখ আছে ছাপান্ন হাজার বর্গমাইল মাটির গভীরে--যা আবিষ্কার করার জন্য অথবা খুঁজে বের করার জন্য, যেসব বিজ্ঞানীদের প্রয়োজন, যেসব সুস্থ্য মস্তিষ্কের মানুষ প্রয়োজন--তারা নেই; আছে অসুস্থ্য মস্তিস্কের মানুষ--যারা নিজেদেরকে কেউ আল্লাহ্র প্রিয় বান্দা, কেউ বুদ্ধিজীবী, কেউ দেশসেবক হিসাবে মনে করে। এরা দলীয়ভাবে আপেক্ষিক ভাল, আপেক্ষিক পূজনীয় কিন্তু পরম পূজনীয় নয়। আপেক্ষিক পূজনীয় বলেই হিংসা-বিদ্বেষ এদের রক্ত প্রবাহে বয়ে চলে অবিরাম। আর এর ফলেই সুখের খনির আর আবিষ্কার করা হয় না বরং সুখ আরো গভীরে চাপা পড়তে থাকে। আমরা দুঃখের মাঝেই সুখের নীড় খুঁজে বেড়াই। পায়ে জুতা নেই বলে খুব একটা আফসোস করি না; কারণ আমাদের আশে পাশে অসংখ্য পঙ্গুরা ভিক্ষা করে, যাদের পা-ই নেই। যদিও বা হঠাৎ করে ধনসম্পদসহ কেউ সুখের ছোঁয়া পায়; তবে পরম আল্লাহ্কে অসংখ্যবার ধন্যবাদ জানায়; ঠিকমত নামাজ-রোজা কায়েম করে। তারপর আসতে আসতে নিজেকে বেহেস্তের যাত্রী প্রমাণ করেেত গিয়ে ধর্মকে নিয়ে ব্যবসা শুরু করে। আর যদি সুখ না পায়, অর্থ-সম্পদ কপালে না জুটে, তবে একজন আরেকজনকে দোষারোপ করে; নয়তো আপন ভাগ্যের কপালে হাজারটা গালি দেয়।


আমাকে ‘ভাইভা’তে ডাকবে--সেই আশায় বসে আছি। আমার সিরিয়াল নং একাত্তর। একেবারে স্বাধীনতা যুদ্ধের সন। মাত্র বার জনকে ভাইভা নেওয়া হয়েছে। দু’একজন ছাড়া সবাই গম্ভীরভাবেই ভাইভা কক্ষ থেকে বের হচ্ছে। বিরাট বড় অফিস। মনে হয়,ওয়েটিং রুমটাই সবচেয়ে বড়। না জানি, প্রতিদিন এখানে কত লোক ওয়েট করে। একটা রুম পূর্বদিকে--যা অন্যান্য রুমগুলি থেকে বেশ হাইফাই মনে হয়। জানতে পারলাম,ওটা মালিকের কক্ষ। বাইরে থেকেই যে ফিটফাট দেখা যচ্ছে, ভিতরে না জানি কি স্বর্গীয়রুপ! আমার দেখারও ইচ্ছে নেইজা--নারও ইচ্ছে নেই। আলু ভর্তা আর ডাউলের মেনুটা যদি মাছ আর নানান সব্জিতে ভরপুর থাকে--তবেই আমার পরম পাওয়া। তবে অবশ্য এটা আপাতত। বড় হবার ইচছা সবারই আছে। একটা গরুও চায়, ময়লা গোয়ালঘর ছেড়ে একটু পরিষ্কার- পরিচ্ছন্ন পাকা করা মেঝের উপর থাকতে। মাঝে মাঝে আমার অনেক বড় হতে ইচ্ছে করে--অনেক বড়। জানি,এটা কোনদিনই সম্ভব না। আবার নিজেকেই বোঝাই, অতি বড় হইও না; ঝড়ে পড়ে যাবে। কিন্ত এটাওতো হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি ছোট হয়ে থাকার ফলে প্রতিদিন ছাগলেরাও আমাকে মারিয়ে যাচ্ছে। আমি মাঝারি থাকতে চাই।
প্রার্থীরা একজন আরেক জনের সাথে কথা বলছে। জাহাজে বারটি পোস্ট খালি। প্রতিটি পোস্টই সাধারণ কেরাণী গোছের। এখানে যারা এসেছে তাদের কেউ এম.এ পাস,কেউ অনার্স পাস, কেউ ডিগ্রী পাস, কেউবা এইচ.এস.সি, এস.এস.সি পাস। একটা বাবুর্চি চাওয়া হয়েছে--যার শিক্ষাগত যোগ্যতা অন্ততঃ অষ্টম শ্রেণী হতে হবে। আমি বি.এ. পাস করেছি দেড় বছর আগে। অভাবের কারণে সামনে পড়ার ইচ্ছা জাগেনি। আর সাধারন কেরাণী মাপের চাকুরীর জন্য এম.এ.পাস প্রার্থী দেখলে সামনে পড়ার যেটুকু ইচ্ছা থাকে, তাও বাষ্পীভূত হয়ে উড়ে যায়। প্রার্থীদের একজন একজন করে পশ্চিমের একটা কক্ষে ডাকা হচ্ছে। আমি তাকিয়ে তাকিয়ে অফিসটা দেখছি। অনেক জায়গায় চাকুরীর জন্য ধন্না দিয়েছি কিন্তু এত হাইফাই, এত সুন্দর অফিস কখনও দেখিনি। যেন, পৃথিবীর আর এক নতুন রূপ। বাইরে এত গরম অথচ এখানে এ.সি’র গুণে কত আরাম! মালিক কক্ষে মালিক ব্যাটা না জানি কি সুখেই আছে। স্বর্গের যদি চোখ থাকত আর এই রূপটা দেখত; তবে নিশ্চয় লজ্জা পেত; নয়তো অন্তঃসার শূন্যের মত আরো গলাবাজি করত। আমাদের সমাজে জ্ঞানী, বুদ্ধিজীবী বলে আখ্যায়িত অনেকেই বেশ গলাবাজি করতে পারে। এরা একজন আরেকজনের জ্ঞানকে তুচ্ছ ভাবে, নিজেকে আরো জ্ঞানী ভাবে। শিক্ষকরা যেমন সবাইকে ছাত্র ভাবে; এরাও তেমনি সবাইকে তাদের বুদ্ধি বা জ্ঞানের অনুগত কিংবা অনুসারী মনে করে।
মালিক কক্ষ থেকে কোর্ট-টাই পরিহিত একজন লোক বের হল। তার পিছু পিছু আরো চার-পাঁচজন। এই প্রথম ব্যক্তি নিশ্চয়ই মালিক। আমরা সবাই উঠে দাঁড়ালাম। তিনি সবার দিকে তাকালেন তাচ্ছিল্যভাবে। একজন লোক বেশ তোষামোদী ভঙ্গীতে মালিকের কাছাকাছি গেল।
- কয়টা দরখাস্ত জমা পড়েছে, জলিল?
- তিনশত সাতাত্তরটি স্যার।
- বল কি!
-হ্যাঁ, স্যার―
- ঠিক আছে। কেউ আসলে বসতে বলো। আমি মিনিষ্ট্রি-তে যাচ্ছি। ফোন আসলে দুইটার পরে করতে বলো। আমার ফিরতে একটা-দেড়টা বেজে যাবে।
- জ্বী স্যার―

নেম প্লেট-এ দেখেছি, তার নাম নজরুল চৌধুরী। আমি তার দিকে তাকিয়ে মনে মনে বললাম, “ভাই, বেহেস্তে কেমন আছেন?” হঠাৎ তার চোখ আমার দিকে পড়ল। আমি ঢোক গিললাম। মনে মনে যে কথা বললাম―তা শুনেছে নাকি? প্রথমবার সম্বিলিতভাবে সালাম দিয়েছিলাম। এখন আরেকবার দিলাম। তিনি মনে হয়, মনে মনে সালাম নিয়েছেন। ধনীরা গরীবদের সালাম মনে মনেই গ্রহণ করে। গরীবদের এরা তোয়াক্কাও করেন না। গরীবরা হল এদের অনুগত, আদেশের দাস। তিনি আমার সামনে আসলেন। আমাকে চিনেন নাকি? এর মত লোক আমাকে চিনবে? অসম্ভব। আমার গলা শুকিয়ে যাচ্ছে। সবাই আমার আর তার দিকে তাকাচ্ছে। তিনি এবার সবার দিকে তাকালেন। তার চার-পাঁচজন অনুসারীদের গাড়ীতে উঠতে বলে তিনি নিজ কক্ষে আবার চলে গেলেন। ঢুকার সাথে সাথে রিং বাজল। একজন, আমার বয়সী ছেলে বলে মনে হয়, অফিসে কাজ করে―ভিতরে ঢুকল। ফিরে এসে আমাকে ঢুকতে বলল। আমার মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়ল। আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। অনেকে অনেক কিছু জিজ্ঞাসা করতে শুরু করেছে। তারা কি যে বলছে তা আমার মাথায় ঢুকছে না। আমার একমাত্র চিন্তা কেন তিনি...? ভিতরে ঢুকলাম। সালাম দিলাম। এই নিয়ে তিনবার। আগে যে দু’বার সালাম দিয়েছি―তা স্পষ্ট মনে নেই। বসতে বললেন। আমি বসলাম। তিনি সিগারেট ধরালেন। বা! কত আরামের জায়গা। ওয়েটিং রুম থেকে আরো আরাম। স্বর্গের আরাম কি আরো বেশী? আমি ঐরকম স্বর্গ চাই না―এ রকম আরাম হলেই চলবে। সিগারেটে দুই-তিনটা টান দিয়ে এস্ট্রেতে ফেলে রাখলেন। আমি তার সামনের অপরূপ টেবিলটার দিকে তাকিয়ে আছি। আশেপাশে তাকাতে ইচ্ছে করছে। মানুষের তৈরি স্বর্গটা দেখতে ইচ্ছে করে। কিন্তু উচিত হবে না। চুপচাপ বসে রইলাম। আমার চোখে রাজ্যের ঘুম নেমে আসছে। দু’এক মিনিট অতিবাহিত হয়েছে। তিনি এবার দীর্ঘশ্বাস ছাড়ালেন।
- কি নাম তোমার?
- শোভন মৃধা।
- কি কর?
- জ্বী, চাকুরী খুঁজছি।
- অবাক হয়েছ?
আমি মাথা নেড়ে হ্যাঁ সম্মতি দিলাম। উনি আমাকে একটা কার্ড দিলেন। ঠিকানা অনুযায়ী বিকালে যেতে বললেন। পরে উনি আলাপ করবেন। মিনিস্ট্রি-তে যাবেন বলে তার হাতে সময় নেই। কার্ডটা আমি না পড়েই পকেটে ঢুকালাম। তিনি উঠলেন। আমাকে নিয়েই বের হলেন। আমি মাথা নিচু করে তার পিছু পিছু হাঁটলাম। নিচে নেমে ড্রাইভারকে বললেন, আমি যেখানে যেতে চাই, সেখানে যেন নামিয়ে দেওয়া হয়। একটা গাড়ীতে তিনি উঠলেন। তার সাথে পিছনের সীটে আরো দু’জন উঠল। বাকীরা আরেকটা গাড়ীতে উঠল। না জানি, কয়টা গাড়ী তার । আমি আমার ভাইভা’র কথা বললাম। তিনি বললেন, এ চাকুরীর দরকার নেই। এখানে চাকুরী হবে না। যার হবার তার হয়েই আছে। ভাইভা দেওয়া হল না। গাড়ীতে উঠতেই আরেক শান্তি। এসি করা গাড়ী। ড্রাইভার আমার সাথে কোন কথা বলল না। আমি তার সায় শব্দ না পেয়ে কিছু জিজ্ঞাসা করিনি। কার্ডটা পড়লাম। ৬৬ নং কামাল আতাতুর্ক রোড, বনানী। নিশ্চয়ই ওখানে বাড়ি। আমাকে তার বাড়িতে যেতে বলল কেন? বেশ চিন্তায় পড়লাম।

( চলবে)



কথা অনুযায়ী বিকাল বেলায় তার বাসায় উপস্থিত হলাম। বিরাট এলাকা। চারদিকে গাছ আর গাছ। মাঝে দু’টি বড় দালান। আশেপাশে ছোটখাট পাকা করা ঘরও আছে। আমি বসে আছি, নজরুল চৌধুরীর বাস ভবনের লনে। আমার এক পাশে নজরুল চৌধুরী, অন্য পাশে আরেকজন লোক আর আমার সম্মুখে গম্ভীর অথচ অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে একজন মহিলা। সম্ভবত মিসেস নজরুল হবে। পাশের লোকটি আমার তথা পুরো জড়ো পরিবেশটা পরিবর্তন করার জন্য আমার দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালেন।
- তোমার নাম কি?
-শোভন মৃধা।
- আব্বার নাম?
- মরহুম ফরহাদ মৃধা।
- কবে মারা গেছেন?
- ’৭৪-এ।
- কিভাবে?
- কে বা কারা যেন আব্বাকে রাতের বেলায় ধরে নিয়ে যায়। তারপর আর কোনদিন ফেরেননি।
ক্স উনার লাশ...?
- পাইনি। অনেক খোঁজাখুঁজি হয়েছে।
- তোমরা কয় ভাই-বোন?
- দুই ভাই,বোন নেই।
- তোমার মা মানে...
- মা নেই।
- তাহলে এতদিন কোথায়...?
- বাবা নিখোঁজ হবার পর তার এক বন্ধুর বাসায় আমরা দুই ভাই মানুষ হয়েছি। মা শোকে শোকে...
- তারপর?
- আর কিছু বলতে ইচ্ছে করছে না।
নজরুল চৌধুরী এতক্ষণ মনোযোগ দিয়ে সব শুনছিলেন। এবার দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মহিলার দিকে তাকালেন। মহিলার চোখ ছলছল করছে। তিনি মৃদু হাসলেন আমার দিকে তাকিয়ে। তারপর বলতে শুরু করলেন―
- তুমি আমার অফিসে চাকুরীর জন্য গিয়েছিলে?
- জ্বী।
- চাকুরী করবে?
- অবশ্যই। দেড় বছর ধরে একটা চাকুরী খুঁজছি।
গাম্ভীর্যপূর্ণ মহিলাটি এবার আমার দিকে করুণ দৃষ্টিতে তাকালেন। তারপর প্রশ্ন করলেন, ‘তোমার বাবা মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন?’ মুক্তিযোদ্ধা! আমার বাবা, আমার বাবা ছিলেন। মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন কিনা সে আমি ভাবতেও চাই না―বলতেও চাইনা। আজকাল মুক্তিযোদ্ধা অনেকটা উপহাসের কার্টুনের মত। যেন ওয়েস্টার্ণ সিরিজের কোন এক গ্র“পের সৈনিক যারা বিপক্ষ শক্তির সাথে বিজয়ী কিন্তু আপন স্বপক্ষের (বিভীষণ) শক্তির কাছে চরমভাবে বিজিত। পত্রিকার পাতায় মাঝে মাঝেই মুক্তিযোদ্ধা, পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধা তথা মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের করুণ চিত্র দেখা যায়। আমি কোন কথা বললাম না। উনি তার নিজের কথা বলতে শুরু করলেন―
- আমার ভাইও যুদ্ধে মারা গেছেন। তাই বলছিলাম। তুমি কিছু মনে করো না। যুদ্ধে কেউ পক্ষে কেউ বিপক্ষে থাকে। এটাই তো যুদ্ধের নিয়ম। মুক্তিযোদ্ধারা আমার ভাইটাকে দালাল মনে করে...
উনি থেমে গেলেন। উনি ভাবছেন, আমার বাবা তার ভাইয়ের মত ছিল। আমার প্রচণ্ড রাগ হল। এখানে একটা চাকুরী মিললে মিলতেও পারে। বাবা মুক্তিযোদ্ধা হোক আর রাজাকার হোক তাতে আমার কিছুই আসে যায় না। যদি বলি বাবা কমরেড ছিলেন। উনারা হাসবেন। যদি বলি সিরাজ সিকদারের সর্বহারা পার্টি করতেন। তাহলে তিনজনেই হয়তো চেয়ারে বিশেষ ভঙ্গীত বসবেন--যেন এক্ষুণি ডাকাত আসবে। আমি মহিলার দিকে তাকিয়ে আবার চোখ টেবিলের দিকে রাখলাম।
নজরুল চৌধুরী হঠাৎ শশব্যস্ত হয়ে উঠলেন। চায়ের একটা কাপ আমার দিকে বাড়ালেন। আরেক কাপ দ্বিতীয় লোকটিকে দিলেন। যার নাম, আমি এখনও জানি না। নিজে এক কাপ নিলেন। মহিলাটি কিছু গ্রহণ করল না। এমনকি চায়ের কাপও না। ট্রেতে ও প্লেটে ফলমুল জাতীয় নানা খাবার কাজের মহিলা দিয়ে গেছে। স্বর্গ বাসিন্দা এই কোটিপতির সাথে আমি খাবার খাচ্ছি। ভাবতেই অবাক লাগে। মুখে খাবার নিলেও গলা দিয়ে সহজে নামতে চায় না। একটা ব্যাপার বেশ অবাক লাগলো। এরা দু’জন, কেউ মহিলাকে কিছু মুখে দিতে বলল না। মহিলা আমার বাবা তথা মুক্তিযোদ্ধাদের ব্যাপারে মনে হয়, কিছু বলতে চেয়েছিলেন। নজরুল চৌধুরী বলে উঠলেন, ‘রাখ এসব ফালতু কথা।’
হ্যাঁ, ফালতু কথা। এখন, এটা একটা ফালতু ব্যাপারই বটে। মুক্তিযুদ্ধ আমিই মেনে নিতে চাই না ভুক্তভোগী হয়েও, আর সেখানে উনারা...। আমি মুক্তিযুদ্ধের চেয়ে আমার বাবাকে, আমার মাকে বড় মনে করি। আমার ভালবাসা আল্পনাকে বড় মনে করি। মুক্তিযুদ্ধ আমাদের সংসার,আমাদের জীবন,আমাদের ভালোবাসা--সবকিছু ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছে। জাতীয় স্বার্থ দেখার মত মন-মানসিকতা যেটুকু ছিল তাও বিলীন হতে হতে একেবারে চৈত্র মাসের রৌদ্র তাপে শুকিয়ে যাওয়া পুকুরের তলায় ঠেকে গেছে। যেখানে আমার তথা আমাদের এ অবস্থা--যেখানে আমি না খেয়ে মরে গেলেও কেউ এক মুঠো খাবার দিয়ে সাহায্য করে না― সেখানে অন্য মানুষ কি অবস্থায় আছে―তারা কি করে বা করল―তা জানার সামান্য আগ্রহও আমার নেই। প্রতিহিংসা বলতে আমার মনে কিছু নেই। স্বার্থপর? হ্যাঁ, স্বার্থপর। আমার মতো অবস্থায় পড়লে বুলি আওড়ানো, মঞ্চ কাঁপানো বক্তারাও বুঝত, মা-বাবা হারানোর ব্যথা কত গভীর, কত জ্বালাময়। দশ বছরের তিলে তিলে গড়ে তোলা গভীর প্রেম বিসর্জন দেওয়া কত কষ্টের! আমাকে সবকিছুই মেনে নিতে হয়েছে। এখন আমার কোন লক্ষ্য নেই। জীবন যেদিকে চলে―চলুক না।
সবাই কেন জানি, চুপচাপ হয়ে আছে। আমি কি বলব―তাও ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না। হঠাৎ দোতলা থেকে প্রচণ্ড একটা শব্দ কানে ভেসে এলো। কিছু একটা ভেঙ্গেছে মনে হয়। গ্রীল দেওয়া দোতলার বারান্দার দিকে তাকালাম। দোতলার দরজাটা খোলা। মূল স্থানে শব্দটা যে আরো জোরালো হয়েছে―এ ব্যাপারে আমি নিশ্চিত। অথচ তিন জনের কেউ সেদিকে ফিরেও তাকাল না। টু শব্দটিও করল না। মনে হয়, উনারা যেন জানেন, দোতলায় কি হয়েছে। খোলা দরজা দিয়ে সালোয়ার-কামিজ পরিহিতা একটা মেয়ে বারান্দায় এলো। গ্রীল ধরে দাঁড়াল। আমরা দোতলা থেকে মনে হয়, পঞ্চাশ গজ দূরে। মোটামুটি পরিস্কার সব দেখা যাচ্ছে। তাকালাম মেয়েটির দিকে। কিশোরী ও যুবতীর মাঝামাঝি মনে হয়। বেশ রাগান্বিত। এই মুহুর্তে ভেঙ্গে যাওয়া ঘটনার সাথে সে জড়িত বলে মনে হচ্ছে। বারবার মাথায় হাত দিচ্ছে। এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে। এক স্থানে স্থির থাকতে পারে না। শিশুর মতো বায়না ধরে গুনগুন করে কি যেন চাইছে। একজন মহিলা দরজা দিয়ে তার কাছে আসল; হাতে এক গ্লাস পানি ও ঔষধ মনে হচ্ছে। মেয়েটি জোড় করে গ্লাসটা নিজের হাতে নিয়ে গ্রীলের ফাঁক দিয়ে নিচে ফেলে দিল। আমি তিন জনের দিকে তাকালাম। একই অবস্থায় আছে। মেয়েটি হঠাৎ আমার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। আমিও তাকিয়ে রইলাম। তারপর তিন জনের দিকে তাকিয়ে দেখি, উনারা একবার আমার দিকে, একবার মেয়েটির দিকে তাকাচ্ছে এবং বেশ আগ্রহ দৃষ্টি নিয়ে। কিছুক্ষণ আগের উত্তেজিত মেয়েটি আমার দিকে তাকিয়ে একেবারে স্থির হয়ে আছে। যেন কি সে দেখেছে। আমি ঢোক গিললাম। একটু ভয়ও পেলাম। মহিলাটি বেশ খুশী ভঙ্গীতে ব্যাপারটা পর্যবেক্ষণ করছে। ব্যাপারটা কিছুই বুঝে উঠতে পারিছ না। এখন আমার কি করণীয়―তাও ভাবতে পারছি না। আমি কি উঠে দাঁড়াব? চলে যাব? নাকি বলব আজ আসি? কিছুই ভাবতে পারছি না। একজন কোটিপতির সামনে অনুমতি না নিয়ে দাঁড়িয়ে যাওয়াটা ঠিক হবে না। চাকুরীর লোভটা আমাকে যেন চেয়ারের সাথে বেঁধে ফেলেছে। বি.এ পাস করে দেড় বছর ধরে চাকুরীর পিছনে ঘুরছি―কোথাও চাকুরী পাচ্ছি না। সাধারণ একটা পিয়নের চাকুরীও মামা-কাকা ছাড়া হয় না। আমি মাথা নিচু করে রইলাম। মহিলাটি তার মেয়েকে ডাকছে― ‘আয় মা―আয়―।’
মহিলার চোখে জল। সে তা আঁচল দিয়ে মুছে আবার ডাকল। আমি বিহ্বল দৃষ্টিতে আবার তাকালাম। বেশ সুন্দরী। তবে রোগারোগা ভাব। অনেকটা নেশাগ্রস্ত রোগীর মত। মেয়েটি গ্রীল ভেঙ্গে লাফ দিয়ে আসতে চাইছে। দ্বিতীয় লোকটি হাতের ইঙ্গিতে কি যেন বোঝাল। মেয়েটি দরজা দিয়ে আবার চলে গেল। এতক্ষণে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লাম। একটা নাটকীয় অবস্থা হতে যেন মুক্তি পেলাম। দ্বিতীয় লোকটি বাসার দিকে তাকিয়ে আছে। তবে কি মেয়েটি এ পথে আসবে? মাত্র এক মিনিটের ব্যবধানে হঠাৎ মেয়েটি নিচতলা থেকে দৌড়ে এলো আমাদের সামনে। লোকটি মেয়েটির হাত ধরল; সে ঝাড়া দিল। কপাল ছুঁয়ে দেখল, জ্বর আছে কিনা। মেয়েটি এক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। কেউ কিছু বলছে না। সবাই যার যার আসনে চুপচাপ বসে আছে। আমার হৃদ্স্পন্দন বেড়ে গেছে। সবাই রহস্যময় কিছু আবিস্কারের আশায় আমার আর মেয়েটির দিকে তাকাচ্ছে। মেয়েটির চোখের জল দু’গাল বেয়ে ঝরছে। এলোমেলো চুল। এবার স্পষ্ট তাকে রোগী মনে হল। পাগল পাগলও মনে হচ্ছে; নতুবা এই বয়েসী একটা মেয়ে এমন করে। পঞ্চাশ গজ দূরে তাকে যে রকম মনে করেছিলাম কাছে আসার পর তাকে আরো সুন্দরী মনে হচ্ছে। যেমনি চেহারা--তেমনি গায়ের রং। তবে বেশ রোগারোগা। মুখমণ্ডল থেকে নিচের দিকে তাকাতেই ‘ফ্রান্সিস―’ বলে এমন জোড়ে চিৎকার করে উঠল যে, আমি ভয়ে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালাম। ভয়ে হাত-পা সহ সমস্ত দেহ কাঁপতে শুরু করেছে। সে চিৎকার দিয়েই আমাকে জড়িয়ে ধরল। তিন জনে টিভির পর্দায় ভাল একটা ছবি যেন উপভোগ করছে। দ্বিতীয় ব্যক্তিটি খুশী খুশী ভাব নিয়ে বত্রিশ দাঁত বের করে হা করে তাকিয়ে আছে। নজরুল চৌধুরী ব্যবসায়ী ভঙ্গীতে ছোটখাট ব্যবসায়ীর জয়-পরাজয়ের দৃশ্য দেখছে। মহিলাটি খুশীতে কাঁদতে শুরু করেছে। মেয়েটি খুব বেশী হলে চল্লিশ সেকেণ্ডের মত আমাকে জড়িয়ে ধরেছিল। সে যে কোন নারী, এ যেন তার চিন্তায় ছিল না। কেন সে আমাকে জড়িয়ে ধরল? বুঝে না উঠতেই সে আমার হাতের তালু দিয়ে তার মুখমণ্ডল ঘষতে শুরু করল। একবারে উন্মাদের মত। তারপর হঠাৎ আমাকে ধাক্কা দিল। আমি পাকা গ্রাউণ্ডে পড়ে গেলাম। মনে হল, সে যা চেয়েছিল―তা পেল না। দ্বিতীয় ব্যক্তি মেয়েটিকে ধরল। আদর করতে লাগল। সে ব্যক্তিকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে কেঁদে কি যেন বলতে লাগল। দু’একটা লাইন আমি ভালভাবে বুঝতে পারলাম― “আংকেল, আই ওয়ান্ট ফ্রান্সিস, প্লিজ ফ্রান্সিসকে এনে দাও...। ”
ফ্রান্সিস কে? আমি বুঝতে পারলাম না। তবে কিছুটা অনুমান করতে পারলাম। মনে হয়, প্রেম ঘটিত ব্যাপার। অবশ্য এটা নাও হতে পারে। নজরুল চৌধুরী ও মহিলা মেয়েটিকে ধরতেই সে কামড় বসাতে চাইল। মনে হয়, ঘটনা বেশ বড়। এখনো আমি স্পষ্ট কিছু জানি না। এই যে এত মানুষ পৃথিবীতে, সবার জীবনে কত ঘটনাই থাকে। দুঃখ-কষ্ট, সুখ-শান্তি নিয়েই মানুষের জীবন। কখনো বড় কোন দুঃখ মানুষকে তেমন ক্ষতি করতে পারে না। আবার কখনো ছোট কোন দুঃখ মানুষকে এমন পথে চালিত করে, যে পথ থেকে সে কখনো ফিরে আসতে পারে না। তাদের দুঃখ ছোট না বড়―তা আমি জানিনা। তবে কোন ব্যক্তির একেবারে মরে যাওয়ার চেয়ে জীবন্মৃত হয়ে থাকা অনেক কষ্টের, অনেক যন্ত্রণার।
লোকটি মেয়েটিকে জোর করে বাসায় নিয়ে যাচ্ছে। আমি হতবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছি। আমি পাকা লন থেকে উঠে দাঁড়িয়েছি। মেয়েটি কয়েকবার পিছন ফিরে আমার দিকে তাকাল। তারপর বাসার ভিতরে অদৃশ্য হল। কিছুক্ষণ সবাই নিরব হয়ে রইল। দু’জনে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে চেয়ারে বসলেন। আমাকেও বসতে বললেন। লোকটি ফিরে এসে জানাল, টিভিটা ভেঙে ফেলেছে। সে ইনজেকশন দিয়ে এসেছে। কিছুক্ষণের মধ্যে ঘুমিয়ে যাবে। এতক্ষণে নিশ্চিত হলাম, উনি একজন ডাক্তার। লোকটি চেয়ারে বসল।
হঠাৎ একটা কুকুরের ঘেউ ঘেউ শব্দ আমার পিছন দিক থেকে গর্জে উঠল। এই শব্দ আমার জীবনে শোনা কোন কুকুরের নয়; বুঝতে পালাম; বিদেশী জাতের কুকুর। এতক্ষণ মনে হয়, ঘুমিয়ে ছিল। শিকল দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছে। আমার চেয়ার থেকে চৌদ্দ-পনর গজ দূরে ছিল। এতক্ষণ খেয়াল করিনি। তার চাহনীর ভঙ্গী ভয়ঙ্কর। অনেকটা বাঘের মত। সারা শরীর লম্বা লম্বা পশমে ভরা। মুখ ঘুরিয়ে ডাক্তারের দিকে তাকালাম। তিনি বললেন,‘তুমি কিছু মনে কর না। ও একজন মেন্টাল পেসেন্ট।’ নজরুল চৌধুরী বলে উঠলেন, ‘থাক, আজ থাক, তুমি কাল এসো। আজ আমারই ভাল লাগছে না।’
নজরুল চৌধুরীকে বেশ ক্লান্ত লাগছে। তিনি ডাক্তারকে কিছু বলতে দিলেন না। আর আমার কাছে বলবেনই বা কেন? আমি তাদের কি উপকারে আসতে পারি? মহিলাটি আজই ব্যাপারটা বলার জন্য আগ্রহ দেখালেও, পরে থেমে গেল। ডাক্তার আমারে কাঁধে হাত রেখে বলল, “ইচ্ছে করে এতক্ষণ পরিচিত হইনি। আমি একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ এবং ঐ যে মেয়েটিকে দেখলে―তার মামা। এ আমার বড় আপা-দুলাভাই। মেয়েটি তাদের একমাত্র সন্তান। এ বংশের প্রদীপ ও উত্তরাধিকারিণী। তোমাকে তোমার চাকুরী সম্পর্কে কিছু বলব না। তুমি কাল এসো, ঠিক এ সময়ে।”
একটা চাকুরী, কি চাকুরী―আমি জানি না। তারা আজ কিছু বলতেও চাইছে না। গোলক ধাঁধাঁর মধ্যে পড়ে গেলাম। মেয়েটি আমাকে জড়িয়ে ধরল। কিন্তু কেন? আমাকে তো তার চিনার কথা না। সে মেন্টাল পেসেন্ট। অতএব পাগলে কিনা করে--ছাগলে কিনা খায়। এ নিয়ে ভাবা বোকামী মাত্র। আমি সালাম দিয়ে আমার পথ মাপতে শুরু করলাম। সামনে একটা গাড়ী। ড্রাইভার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। আমাকে যেতে দেখেই গাড়ীতে উঠতে বলল। আমি ড্রাইভারের দিকে তাকালাম। তারপর পিছন ফিরে তাদের দিকে তাকালাম। আপত্তি সত্ত্বেও মহিলার কথা মত গাড়ীতে উঠতে হল। ড্রাইভারকে সে ডেকে কি যেন বুঝিয়ে দিল।
গোপীবাগের এক ছোট্ট ভাড়া করা বাসায় আমি থাকি, সাথে আরেক জন চাকুরীজীবী বন্ধু থাকে। ছোট ভাইটা ঢাকা কলেজে পড়েÑকলেজ হোষ্টেলেই থাকে। ও নিজে টিউশনি করে। সে টাকায় ওর খরচ চলে না। আমি মাঝে মাঝেই কিছু টাকা ওকে দেই। গাড়ী আমার নির্দেশ মত গোপীবাগের প্রথম লেনে আসতেই থামতে বললাম। সে গাড়ীটা রাস্তার একপাশে থামিয়ে আমার সাথে চলতে শুরু করল ।
- স্যার, বিবি সাব আপনের বাসাটা চিনে যাইতে কইছে।
- ও, আচ্ছা আসুন আমার সাথে।
আমি বুঝতে পারলাম, আমাকে তাদের প্রয়োজনে ডাকার সম্ভাবনা আছে। আমি কথা না বাড়িয়ে ড্রাইভারকে আমার রুমে নিয়ে আসলাম। তার কাছ থেকে জানতে পারলাম, নজরুল চৌধুরী বিরাট ব্যবসায়ী। মতিঝিল বাণিজ্যিক এলাকায় তার তিনটে অফিস। একটা জাহাজ ও মালামাল সংক্রান্ত ব্যবসা, একটা ট্রাভেলস্ সংক্রান্ত ব্যবসা এবং অন্যটি রপ্তানী ও আমদানীমূলক ব্যবসা। তার প্রাইভেট গাড়ীর সংখ্যা ও বাড়ির সংখ্যা ড্রাইভার নিজেও জানে না। তবে তার ধারণা আট-নয়টা প্রাইভেট কার আছে। দেশে বাড়ির সংখ্যা ও দোকানের সংখ্যা দুইশত পঞ্চাশটারও বেশী হবে। বিদেশেও বাড়ি আছে। আমার আর শুনতে ইচ্ছে করল না। আমার জীবন যেখানে ক্ষুধার রাজ্যে গদ্যময়, সেখানে এসব রূঢ় বাস্তব গল্প শুনা মানে বিস্মিত হওয়া ছাড়া আর কিছু নয়। নজরুল চৌধুরীর মত আরো অনেক আছে এদেশে। আগে বাইশ পরিবারের কাছে এদেশ জিম্মি ছিল। বর্তমানে কয় শত পরিবারের কাছে জিম্মি― তা পর্যবেক্ষণ করলেও সঠিক তথ্য পাওয়া যাবে না। আমি ড্রাইভারকে মেয়েটি সম্পর্কে প্রশ্ন করতেই সে চমকে উঠল।
- হায়! হায়! এতক্ষণ আমি কি বললাম!
- কেন কি হয়েছে?
- আপনি কোন প্রশ্ন করলে উত্তর দেওয়া নিষেধ ছিল।
- কেন?
- জানি না। তয় কারণ নিশ্চয়ই আছে।
আসার সময় মহিলা মানে মিসেস নজরুল চৌধুরী তাকে কোন কিছু বলতেও নিষেধ করেছে। কিন্তু ব্যাপারটা কি? ড্রাইভার চলে গেল। চা খাওয়ার কথাও বলা হল না। চা খাওয়া আর না খাওয়া―অন্ততঃ বলাটা সৌজন্যতা। কিন্তু ড্রাইভারকে খাওয়ানোর সৌজন্যতা আমার মনে আসেনি। মানুষ সব সময় তার চেয়ে অপেক্ষকৃত ছোট লেভেল এর মানুষকে সৌজন্যতা দেখাতে চায় না, যদি সেখানে স্বার্থ না থাকে। ড্রাইভার আর আমি অবশ্য সমান স্তরেরই। শিক্ষা ও ভাষাগত কারণে হয়তো সে নিচু কিন্তু তার চাকুরী আছে, আমার তাও নেই। তবুও তাকে ছোটই মনে হল। ড্রাইভার যদি অনেক সময় গল্প করত, তবে তাকে কিছু না কিছু খাওয়ানো হত। অনেকক্ষণ গল্প করলে অন্ততঃ চা,সিগারেট পান করার কথা মনে পড়ে।
বিছানায় শুয়ে পড়লাম। খাওয়ার কথা এতক্ষণ ভুলেই ছিলাম। ক্ষুধা জিনিসটা বেশ বুদ্ধিমান। এই ভাবনার সময়ে তার উদয় হওয়া উচিত নয়―সে হয়তো বুঝতে পেরেছে। তবে শরীরটা বেশ দুর্বল লাগছিল। ভাবতে চাই না ঘটে যাওয়া ঘটনাকে। তবুও এসে পড়ে, আসে। মুরাদের আসার কথা ছিল। এসেছে কিনা জানি না। হাত ঘড়ির কথা এতক্ষণ মনেই ছিল না। তাকিয়ে দেখি, সাড়ে সাতটা বেজে গেছে। টেবিলের উপর ঘড়িটা রাখতেই দেখি, একটা সাদা কাগজ ভাঁজ করা। খুলে দেখি মুরাদ লিখে গেছে ‘পরীক্ষা সামনে, ফর্ম ফিলাপ করতে হবে। এক হাজার টাকা লাগবে।’ ট্রাংকে খুব বেশী হলে তিনশত টাকা আছে। কয় তারিখের মধ্যে টাকাটা লাগবে, তাও লিখে যায়নি। পাতিলের দিকে তাকালাম। হ্যাঁ, বুয়া ভাত রান্না করে দিয়ে গেছে। আলু ভর্তা আর ডিম। একটার দিকে ভাত খেয়েছি। ক্ষুধাতো লাগবেই। নজরুল চৌধুরীর লনে এককাপ চা আর এক টুকরো ফল মুখে দিয়েছিলাম। কারো বাসায় নতুন আসলে একটু খাবার মুখে দিয়ে সৌজন্যতা দেখাতে হয়। বেশী খেতে নেই। গৃহকর্ত্রী-গৃহকর্তা আনকালচার ধারণা পোষণ করতে পারে। কোনমতে আলু ভর্তা, ডিম দিয়ে ভাত খেয়ে শুয়ে পড়লাম। মেয়েটির চেহারা চোখের পর্দায় ভেসে উঠল। সাথে সাথে আল্পনার চেহারাও। চোখের দুই মেরুতে দু’জন। একজন মেন্টাল পেসেন্ট―সে কখনো কেঁদে,কখনও হেসে আমার দিকে আসছে। অন্যজন কিশোরী থেকে বধু হয়ে ক্রমাগত অদৃশ্য জগতে মিশে যাচ্ছে। আল্পনাৃ। সারাটা দেহ অসার হয়ে উঠল। দশ বছরের প্রেম। বিয়ের দৃশ্যটা চোখে ভাসলেই রাগে, ক্ষোভে, ঘৃণায় চোখ-মুখ লাল হয়ে উঠে। একটা ’৭১ আমাদের পুরো সংসার,আমাদের জীবন তছনছ করে দিয়েছে। এতিম হওয়ার পর থেকে ধুকে ধুকে মরতে মরতে জীবন্ত লাশ হয়ে বেঁচে আছি। মানুষের সবচেয়ে বড় শাস্তি হল শান্তি থেকে বিচ্যুত হওয়া; আমি সেই অশান্তির মধ্যে নিমজ্জমান।
আমি ভুলে যেতে চাই, যা কিছু অতীত―ভুলে যেতে চাই ’৭১,’৭৪। ভুলে যেতে চাই মা-বাবাকে। ভুলে যেতে চাই আল্পনাকে। কিন্তু পারি না। মনে হয়, একটা বিশাল আকৃতির বেলুনকে চাপ দিচ্ছি। ফলে আরো প্রবল বেগে পানি ঝরছে। ছিদ্রের সংখ্যা আরো বাড়ছে। না, আমি এই বেলুনটাকে আর চাপ দেব না। এভাবেই পানি পড়তে থাক। এক সময় নিশ্চয় খালি হবে। কবে হবে জানি না। হৃদয়ের উপর চাপ দেওয়া বোকামী। মানুষের জীবনে এমন কিছু স্মৃতি থাকে, যা সে কখনও ভুলতে পারে না। আমিও পারব না। উপমা দিয়ে হৃদয়কে বোঝানা যায় না। কন্ট্রোল করতে গেলেও সমস্যা। হে আল্লাহ, যদি কষ্টই দিয়েছ―তবে তা বহিবার শক্তি দাও। যে মানুষ অন্য মানুষকে উপদেশ দেয়, সে নিজেও সেই সব উপদেশ মানতে পারে না। আমি অনেককে বোঝাই, যুক্তি দেখাই, অথচ নিজে বুঝতে চাই না―বুঝি না।
আমার রুমমেট সেলিম, আজ আর রুমে আসবে না। গতকাল বলে গেছে। কোথায় তার বন্ধুর বিয়ে হচ্ছে, সেখানে দু’দিন থাকতে হবে। রুমে শুধু আমি একা। ‘আমি বাঁচতে চাই’ উপন্যাসের শেষ অংশটা লিখতে ইচ্ছে করছে কিন্তু যে আগুন আর বরফ মিশ্রিত ভাষা দিয়ে লিখতে চাই―সে ভাষা এখনো হৃদয়ে আসে নাই। আমি আমার রক্ত দিয়ে, সূর্যের চোখের জলে প্লাবিত করে উপসংহার টানতে চাই―পারি না। শত চেষ্টা করেও পারি না। একটা কবিতা লিখব বলে ভাবলাম। কিন্তু হায়! শুরু হয় চিঠির মত; না হয় ছন্দ কবিতা, না হয় গদ্য কবিতা। এ যে বেদনার আত্মবিলাপ। রক্ত নদীর মোহনায় দাঁড়িয়ে হৃদয়ের বিস্ফোরিত কণ্ঠস্বর শুনি। এই মিলন মোহনায় দাঁড়িয়ে কি করে বিচ্ছেদ ঘটাব অনুপম আর কল্পনার শাশ্বত ধারার প্রেম। লেখা সামান্য এগোতেই সেই আল্পনা আর আল্পনা...। এখন আবার যুক্ত হয়েছে মানসিক রোগী। সন্ধ্যায় একটা টিউশনি আছে। এক হিন্দু মেয়েকে পড়াই। ভিকারুন্নেসা স্কুলের দশম শ্রেণীর ছাত্রী--নাম সিঁদুর। দুই মাসও হয়নি অথচ মেয়েটি বলে আমি তার এক শত বছরের চেনা। অলরেডী সে আমাকে একটা কবিতাও লিখে দিয়েছে। বলেছে, কেমন হয়েছে বলবেন? কবিতাটি এরকম―
“আমাকে একটু ভালোবাসা দেবে?
এক টুকরো লাল ফিতের মতো ভালবাসা।
কি বললে ! তোমার কাছে ভালবাসা নেই?
আমি হচকিত হয়ে পাহাড়ের কাছে ছুঁটলাম
পাহাড়কে শুধালাম,
পাহাড়, আমাকে একটু ভালোবাসা দেবে
অতি দূর নক্ষত্র থেকে ছুটে আসা
আমি এক শুষ্ক মরুভূমি
যার বুকে ভালোবাসার এক ফোঁটা জল নেই
............................। ”
এরকম কবিতা ভাল না বলে উপায় আছে? সে নিশ্চয় চেয়েছে, আমি কবিতাটি খুব ভাল বলি। আমি নিশ্চয় ভাল বলব। খারাপ হলেও ভাল বলতাম। কারন কবি চান তার কবিতা পাঠক ভাল বলুক। অন্ততঃপক্ষে সবাই একটা ধন্যবাদের আশা করে। আমি সিঁদুরকে নিশ্চয়ই ধন্যবাদ জানাব। আমিও কবিতা লিখি, তবে তা খুব বেশী হলে তিন-চার দিন থাকে। কখনও লিখি আর ছিঁড়ে ফেলি। কখনও কবিতাগুলি আহত হয়ে বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকে। কিন্তু উপন্যাস, গল্পগুলি যত্ন করে রেখে দিই। কেন? জানি না। কবিতা ভাল লাগে না; লাগলেও দু’একটা ভাল লাগে। তাও বেশীদিন নয়। সিঁদুর কবিতা লিখে। তার ভাল লাগা যেমন আপেক্ষিক, ভাল লাগার সময়টাও আপেক্ষিক।


( চলবে...)

No comments:

Post a Comment