কোরবানী ঈদের সময়ের সত্যি ঘটনা নিয়ে লেখা দুই পর্বের গল্প : আলোকিত অন্ধকারের জনপথে

২য় পর্ব/শেষ পর্ব.


ঈদের একদিন পর, সকাল বেলা, দেখি নারীটি ওখানেই পড়ে আছে। তবে আগের চেয়ে কিছুটা সুস্থ্য। আরো কিছু আয়া-বুয়া ও স্থানীয় কয়েকজন মমতাময়ী, দয়াময়ী মহিলার সাহায্যে জটা পাকানো চুল কাটালাম, নক কাটালাম। পরিস্কার করিয়ে বন্ধু ডাঃ ফেরদৌস এর সাহায্যে- Medicine ward-এ অজ্ঞাত বলে Police case হিসাবে ভর্তি করালাম। ওর সাহায্য পাওয়াতে দ্বিগুণ উৎসাহে কাজ এগোতে লাগল। এখন ডাক্তার, নার্স, স্থানীয় মানুষ, ঔষধের দোকানদার আয়া-বুয়া সবাই সাধ্যমত মানবীয় দায়িত্ব পালন করতে লাগল।

ঈদের দুইদিন পর, সকাল বেলা। Medicine ward unit-IV এর Bed no.Ex-16 তে গিয়ে দেখি নারীটি শুয়ে আছে। দুপুর বেলা দক্ষিণ বঙ্গের আমার দুই জন আত্মীয়--এডভোকেট স্বপন, এডভোকেট সঞ্জিত, আমার ছাত্র-ছাত্রী নিশু, আরজিনা, আলী আহমদকে নিয়ে ওয়ার্ড-এ গিয়ে দেখি নারীটি বসে বসে ভাত খাচ্ছে। নিশু অবাক হয়ে বলছে, স্যার একি !
পুরোপুরি সুস্থ্য। অবাক হবার কারণ সে আমার সাথে প্রথম থেকেই ছিল। এ রকম অবস্থা থেকে একটু ভালোবাসায় ছোঁয়া পেলে মানুষ যে বাঁচতে পারে--এটা তার প্রথম অভিজ্ঞতা। এডভোকেট স্বপনদাকে বললাম, আপনাদের অঞ্চলের মানুষ, দেখুন কথা বলে, কোন ঠিকানা বলে কিনা। স্বপনদা কিছু কথা বললেন, ঠিকানা উদ্ধার করতে পারলেন না। বললেন, আর কিছুদিন পর আবার আসব, আরো সুস্থ্য হোক।

চিকিৎসা বিদ্যার পাশাপাশি মানুষ হিসাবে নৈতিক দায়িত্ব ও কর্তব্য শিক্ষার জন্য এখন প্রতিদিন সকাল এবং অফিস শেষে ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়ে দু’বার রোগীটি দেখতে যাই। আমার পরিবারের উৎসাহ আমার চেয়ে কম নয়। আমার সহধর্মিনী ডাঃ সুপ্রিয়া রায় জামা-কাপড়, ফল নিয়ে একদিন রোগীটিকে দেখে গেছে। গত শুক্রবার পুরান ঢাকার বন্ধু জাহাঙ্গীর আলমকে নিয়ে রোগীটিকে দেখতে গিয়েছিলাম। সব ঘটনা শুনে নিজের অজান্তে বলে ফেললেন, আল্লাহ আপনাকে দিয়ে এই নারীটিকে বাঁচিয়েছেন।

ওয়ার্ডের সিনিয়র নার্স হাসিনা খানম অকৃত্রিম মাতৃস্নেহে রোগীটিকে সেবা করে যাচেছন। এই রকম নার্স হাসপাতালে কিছু সংখ্যায় থাকলে এরকম অজ্ঞাত,অসহায় রোগীর ভাল সেবা হয়। হাসিনা খানম গত শনিবার বললেন,স্যার,মানসিক বিভাগে ভর্তি করানো মনে হয় লাগবে না।রোগী কথা-বার্তা ভালই বলছে। আমি আর একটু চেষ্টা করে দেখি। এখন সে নিজে খায়। নিজে নিজেই বাথরুমে যায়। সবার সাথে একটু একটু কথা বলে।আমি শুনলাম,খুশি হলাম, বললাম, মানসিক বিভাগে না নিলে তার প্রকৃত চিকিৎসা হবে না।

অফিসে বসে ভাবছি, বিস্তীর্ণ শীতের কুয়াশা অথবা অন্ধকারের পথে আমরা আজো হাজার বছর ধরে পথ হাঁটছি। এত মানুষ, এত সম্পদ, এত কুরবানী, এত আনন্দ, আবার মানুষের কারণে কত যন্ত্রণা, কত দুর্বিসহ ঘটনা ঘটে। একজন Diabetic রোগী, সারাদিনে আধা কেজি খাবারও খেতে পারেনা অথচ কোটি কোটি টাকার সম্পদ তার। সম্পদ বাড়ানোর জন্য এদেশের মুষ্টিমেয় কিছু মানুষ, হেন কোন খারাপ কাজ নেই--যা তারা করে না। যদি এরা যাকাত ঠিকমত আদায় করত অথবা সরকারী নিয়মে ট্যাক্স ঠিকমত দিত তাহলে এদেশের পথে পথে এ রকম নারীরা পড়ে থাকত না।

কেন যে সমাজ কল্যাণ মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে মানুষকে সচেতন করছে না--বুঝিনা। মানুষরূপী কিছু মানসিক ভারসাম্যহীন যাদের কে খুব সহজ করে পাগল বলি ; এরা আমাদের আশে পাশে থাকে বিড়াল কুকুরের মত ছন্নছাড়া হয়ে। ফুটপাতের সর্বহারারা তো তবুও ভিক্ষা বা কাজ এর মাধ্যমে খাবার চাইতে পারে। এরা তাও পারে না। কেউ তাদের কাছে ঘেঁষতে দেয় না।

মানুষ, প্রকৃতির এ নির্মম খেলা থেকে কিছুই শিখে না। শিখে না ইতিহাস থেকে, শিখে না এ নিথর পড়ে থাকা মানুষরূপী এ নারীটির জীবন থেকে। তবে এ কাজ থেকে একটা বিষয় বুঝতে পারলাম । সাধারণ মানুষরা কেউ একা একা জামেলায় জড়াতে চায় না। তবে মানবীয় গুনাবলী প্রকাশ করার সুযোগ সবাই চায়, সবাই খুঁজে। চায় একজন নেতা এবং তার নি:স্বার্থ নেতৃত্ব। এই যে আমি, নেতৃত্ব দিয়ে কাজটি শুরু করেছি, এখন সবাই যার যার সাধ্য মত কাজ করছে। আসুন, আমরা শুরু করি, আমরা জাগি, আমরা জাগলে, সবাই জাগবে, জাগবে বাংলাদেশ।

No comments:

Post a Comment