স্বপ্নের বীজ বোনার অপেক্ষায়

                          
                                   

গ্রীষ্মের শেষ, বর্ষার শুরু--আষাঢ় মাস; গত মাসের মত এ মাসেও  সূর্যের সাথে যুদ্ধ করে মেঘ খন্ডগুলো হেরে গেছে। ফলে সমস্ত মেঘ খন্ড হিমালয়ে একত্র হয়ে আবার আক্রমণের প্রস্তুতি নিচ্ছে। এদিকে গ্রাম বাংলার মাঠ-ঘাট ফেটে চৌচির হয়ে গেছে। নদী-নালার পানি রেখা একবারে তলায় ঠেকে গেছে। অসংখ্য ফল গাছের ফুলের রেনু রৌদ্রতাপে শুকিয়ে যাচ্ছে। পানির অভাবে ক্ষেতের ফসল কেমন যেন, হাহাকার করছে। ভোর হবার পর থেকেই সূর্যের প্রচন্ড তাপ পৃথিবীর বুক জুড়ে দগ্ধ কেয়ামতের সংকেত দিয়ে যাচ্ছে। নিরব নিথর দুপুরবেলা রাখালেরা গাছের ছায়ার গরুগুলিকে বেঁধে গামছাটা শীতল ঘাসের উপর বিছায়ে শুয়ে পড়ে। কৃষক গাছের ছায়ায় বসে লুঙ্গি দিয়ে দেহের ঘাম মুছে, মাথার বিড়া দিয়ে বাতাস করছে। এদের দেখে মনে হয় যেন, আগুন থেকে উঠে এসেছে। হাত-পা মুখ লাল হয়ে আছে রৌদ্রতাপে। গাছে গাছে পাখিরা থেমে থেমে ডেকে চলেছে। মাঠে মাঠে গরু-ছাগল-ভেড়া--প্রাণীগুলি সূর্যেরও তাপদাহে একটানা ডেকে চলেছে। এর মাঝে দু’একটা ছেলে-মেয়েকে গোবর কুড়াতে দেখা যাচ্ছে । কিছুদূরে দক্ষিণে বড় রাস্তা দিয়ে একটা ছোট ট্রাক যেতেই ধুলি-বালি উড়ে অন্ধকার হয়ে গেল। পথের পাশে বড় বড় গাছের ছায়ায় লুঙ্গি গামছা বিছায়ে পথিক বিশ্রাম করছে। চারদিক হঠাৎ নিরব হয়ে  গেলে দূর হতে দুই-একটি ঘুঘুর ঘু-ঘু ডাক শোনা যায়। মনে হয়, এরা যেন বৃষ্টির জন্য স্রষ্ঠার কছে মিনতি করছে। চৌচির মাঠ-ঘাট আর তৃষ্ণার্ত ফসল ক্রমাগত মিনতি করে চলেছে স্রষ্ঠার কাছে। মাঝে মাঝে ছোট ছোট ছেলেমেয়ে, কখনও বড়দের কণ্ঠ থেকে ধ্বনিত হচ্ছে--আল্লা মেঘ দে--পানি দে--ছায়া দেরে তুই--আল্লা মেঘ দে--। প্রখর বহ্নিজ্বালায় রুদ্রমুখী প্রকৃতি; শুষ্ক চৌচির ফসলের মাঠ; শ্যামলতাহীন রুক্ষ মরুর ধূসরতায় প্রাণহীন প্রকৃতি যেন, এক মৌনী তাপস। আবার হঠাৎ হয়তো একদিন ‘ধূলার ধূসর রুক্ষ উড্ডীন পিঙ্গল জটাজাল’ নিয়ে তপক্লিষ্ট, তপ্ততনু ভীষণ ভয়াল গ্রীষ্ম  অপরাহ্নে ডেকে আনে ক্রুদ্ধ শিবের কালবৈশাখী ঝড়--প্রকৃতিকে ভেঙ্গে চুঁড়ে নতুন করে সাজানোর খেলা শুরু করে। ।
 প্রকৃতি এখন  মাস-দিনের নিয়ম মেনে চলে না। তবুও অপেক্ষা করছি যদি মুসলধারে বৃষ্টি নামে । পুরো জৈষ্ঠ মাসের আম-জাম--কাঁঠাল-জামরুল-লিচুপাকা গরমের মধ্যে শিশির অথবা ভেজা ঘামের মত সামান্য বৃষ্টি হয়েছিল--তাও এক-আধদিন--সেটাও আবার প্রকৃতির চাহিদার সমুদ্রের মধ্যে এক ডোবার মত। অতএব বনের চাতকের মত মনের চাতকও  নির্ঘুম চোখে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে বৃষ্টির জন্য। কর্দমাক্ত মাটিতে কিছু স্বপ্নের বীজ বুনব; হয়তো লাউ, লিচু, জাম অথবা ডাটা শাকÑ কোনটা সংসারের নিত্যদিনের জন্য, কোনটা ছেলে-মেয়ের ভবিষতের জন্য অথবা দেশের ভবিষতের জন্য।
 সারাদিন-সারারাত নির্ঘুমে অপেক্ষায় থাকি--আসুক ঝড়-বৃষ্টি-তুফান, অপূর্ব মেঘের সমারোহে শ্যামল নয়নাভিরাম বর্ষা অতি ভৈরব হরষে সুচণা করুক তার শুভাগমন, আসুক শ্যামছায়াঘন দিন, শুষ্ক প্রান্তর, নদী-নালা ও খালবিলে জাগুক প্রাণোচ্ছ্বাস। প্রকৃতির ধূলি বিষন্ন অঙ্গ থেকে গ্রীমের ধূসর অবসাদ মুছে গিয়ে ফুটে উঠুক সজল বর্ষার শ্যামল সুন্দর রূপশ্রী। জেগে উঠুক স্বপ্নের বোনা বীজ থেকে অংকুরিত চারা গাছ। আসুক পুষ্প বিকাশের লগ্ন। কদম, কেয়া, জুঁই, গন্ধরাজ, হাসনাহেনা বিচিত্র বর্ণ ও গন্ধের উৎসবে শুরু হোক মেঘ, বৃষ্টি আর আলোর মেলা।


ঠিক এমনি মুহুর্তে চৌরা পাড়ার (যারা নদীর চর বা চরের কাছাকাছি বাস করে) দশ-বারোজন কিশোরী-যুবতী এবং মধ্যবয়সী মহিলা “কুলা ঠান্ডা করতে”




    সূর্য পশ্চিম দিকে হেলতে আরম্ভ করলে পরাজিত মেঘ খন্ডগুলি সদলবলে দক্ষিণ দিক থেকে প্রচন্ড বেগে ছুটতে আরম্ভ করে। মুহুর্তের মধ্যে শুরু হয় ঝঞ্চা, বিদুৎ চমকায়   মুহুর্মুহু, দিগন্ত প্রসারিত হয় বজ্র-নির্ঘোষে, পথের ধূলিকনা ও নদীর তীরের বালুকারাশি বিক্ষিপ্ত হয়ে চারদিক ঢেকে ফেলে


ঝড়ের তান্ডব লীলায় গাছ-পালার শাখা- প্রশাখা ভেঙ্গে যাচ্ছে। কিছু কিছু উঁচু ভিটির গাছের গোড়া সহ উঠে যাচ্ছে। বাঁশবন ধরাশায়ী হয়ে পড়ছে পাখিদের বাসা ভেঙ্গে যাচ্ছে। এরা ঝড়ের বাতাসে উড়ছে। নিজেদের গতি ঠিক না রাখতে পেরে চিৎকার করছে। কালীদের উঠান লতা-পাতা আর বিভিন্ন ময়লায় ভরে গেছে। তুলসী উত্তর ঘর থেকে আর শেফালী দক্ষিণ ঘর থেকে ভগবানকে ডাকছে।
দুপুর আর সন্ধ্যার মাঝামাঝি হল বিকাল। পূর্বাকাশে আবছা রংধনু উঠেছে। মেঘের গুড়–ম গুড়–ম শব্দের ফলে পুকুর হতে অনেক কইমাছ ডাঙ্গায় অল্প জলে লাফালাফি করছে। কালীদের বাসার দক্ষিণের বিস্তৃত অগভীয় ডোবায় (অনেকটা ছোট্র ক্ষেতের মত) অনেক পানি জমেছে। তরলের ধর্ম অনুযায়ী, এই পানি নি দিকে পুকুরে গড়িয়ে যাচ্ছে। এই ডোবায় নেমে কিছু ছেলেমেয়ে মাছ ধরছে। কেউ কাগজের নৌকা, জাহাজ বানিয়ে ঐ জলে ভাসিয়ে হাত তালি দিয়ে







No comments:

Post a Comment