বাংলার চিরন্তন নৈসর্গিক ছবি

মেঘ, বৃষ্টি আর আলোর মেলা
--শাশ্বত স্বপন

ভাটিদেশের মানুষের বর্ষা বিলাস যেন, হয়ে উঠে নৌকা বিলাস। বিস্তীর্ণ জলরাশি--যে দিকে তাকাই জল আর জল; বারিধারায় সিক্ত প্রকৃতি; ছোট ছোট বাড়িগুলো যেন, এক একটা দ্বীপ। কাঁদা রাস্তায় পাদুকা হাতে নিয়ে গাঁয়ের মানুষের পথচলা যেন, আর শেষ হতে চায় না। উজানের স্রোতে ভেসে আসা সর্বহারারা জল-কাঁদা মাখা রাস্তার দু’পাশে পোকা-মাকড়ের বসতি গড়ে। বর্ষাকালের আষাঢ় আর শ্রাবন--এ দু’মাস ভাটিবাংলার আকাশে মেঘের ভেলা সাদা কাঁচুলী হয়ে নগ্ন গগনের বক্ষ ঢেকে রাখে, কখনও মেঘের ভেলা আলো আঁধারীর কত না পদ্য লেখার ছবি হয়ে ভেসে বেড়ায়!

গুরুম গুরুম গর্জনে, বিদ্যুতের ঝলকানিতে ঝড় আর বৃষ্টি, কোনদিন বিরামহীন মুসলধারে বৃষ্টি, প্রকৃতির ডোবা-নালা-খাল-হ্রদ-নদী-বিল-বাওর-হাওর-সমুদ্র জলধারাকে কানায় কানায় পরিপূর্ণ করে; তৃষিত ভূমিকে জলদানে করে পরিতৃপ্ত; তৃষ্ণার্ত প্রকৃতিকে করে শান্ত; যেন, প্রকৃতির মাঠ-ঘাট তথা ভূমি বর্ষাকালে পূর্ণ গর্ভধারণ করে মাতৃমমতায় জেগে উঠবে শরতে এবং মাঠ-ঘাট শত শত সহস্র কোটি সন্তানতুল্য শষ্যদানায় ভরিয়ে দিবে। গ্রীস্মের প্রচন্ড দাবদাহে প্রজ্জ্বলিত গ্রামীন জীবনে বর্ষা আনে অনাবিল শান্তি আর পরিতৃপ্তি, বর্ষা আসে স্নিগ্ধ সজল রুপ নিয়ে, ভেঁজা উর্বশীর পায়ের মল বাজিয়ে।

‘কদম ফুলের সমারোহ, মেঘলা আকাশ অথবা অবিরাম বৃষ্টি ভেজা নিসর্গ, বৃষ্টি আর মাটির শাশ্বত ভালোবাসার কর্দমাক্ত পথ’--এ যেন কোন অদৃশ্য শিল্পী তার অদৃশ্য তুলির আঁচড়ে চিরন্তন বর্ষার ছবি এঁকে চলেছে। অবিরাম বর্ষণ ধারায় জানালার ধারে বসে কদম ফুল দেখতে, ঘ্রাণ নিতে কবি মন ব্যাকুল হয়ে উঠে। ভেজা বৃষ্টির বানে, বিলে নৌকা ভাসিয়ে ফুটন্ত শাপলা আর পদ্ম ফুল ছুঁয়ে হারিয়ে যাই যেন, কোন অজানায় অথবা কোন রমণীর ম্মৃতিতে। জুঁই, কেয়া, কেতকী, কামিনী, কুন্দ--বর্ষার নানা ফুলের গন্ধ, শোভা আমাদের অলস সময়কে বিমোহিত করে। ভরা বর্ষায়ও গ্রীস্মকালীন ফলের রেশ থেকে যায়। বর্ষার পেয়ারা, আনারস, আমরা, লেবু আর সাথে সদ্যগত ঋতুর ফল খেয়ে সময় ও স্বাদ দু’টোই মিটে যায়।

শ্রাবনে ও শ্রাবনের শেষে পাট কাঁটা এবং পানিতে ঝাঁক দেওয়া শুরু হয়েছে। কোথাও আবার আগাম পাটের আঁশ ছাড়ানো শুরু হয়ে যায়। গাঁয়ের মানুষেরা ছাতা হাতে নিয়ে পিচ্ছিল পথে বিরক্তি প্রকাশের মধ্য দিয়ে হাঁটে আর খোশগল্প করতে করতে দূর জলদিগন্তে হারিয়ে যায়। ফসলের মাঠগুলি মিলে মিশে যেন হাওর-বাওর-বিল গড়ে তোলে; সারা দেশ জলে থৈ থৈ করে। জলজ উদ্ভিদঃ শ্যাওলা, কচুরীপানা, শাপলা পাতা আর ফুলে ভরে যায় পুরো বিল। বর্ষার জলে আকন্ঠ নিমজ্জিত থাকে মাঠের ফসল, হিজল গাছ, বড়ই গাছ, লতা গুল্ম আর বিরুৎ জাতের ছোট ও ছড়ানো গাছ-গাছালি। হিজলের ডালে বসে দিনের বেলা শকুনেরা আর রাতের বেলা হুতুম েপচা, বাঁদুর মাছ শিকার করে। বিকালের মেঘ মাখা স্নিগ্ধ আলোয় বিল অঞ্চলের উঠতি বয়সী ছেলে-মেয়েরা অথবা বেড়াতে আসা শহুরে বাবুরা নৌকা চড়ে গোধূলী বেলা সূর্যের লালিমা দেখতে দেখতে বাড়ি ফিরে। যুবক-যুবতীদের চোখের চাহনী নতুন কবিতার মত মন নেচে উঠে যেন, ‘দুলছে হৃদয় দুলছে মন, জল ছুঁই ছুঁই সারাক্ষণ...।’

টুইটুম্বর ডোবা-খাল-বিলঃ সরু খালের পাড় ছুঁয়ে যাওয়া সারি সারি পাটক্ষেত, আখক্ষেত, ধঞ্চেক্ষেত। খাল আর ক্ষেতের মাঝে মেঠো পথ। ফসলের পা ছুঁয়ে যাওয়া নিংড়ানো বৃষ্টির পানিতে খাল পরিপূর্ণ ওঠে। প্রায় প্রতিদিনের শ্রাবণ ধারা, কাচা মাটির মেঠো পথটিকে জল কাঁদার চুম্বনে চুম্বনে কোথাও পিচ্ছিল কোথাও কর্দমাক্ত করে রাখে। এ পথের ফাঁকে ফাঁকে উঁচু মাটির ঢিবিতে মানুষের বসতি। বর্ষার জলের স্রোত এ বাড়িগুলির পা ধুয়ে যায়। দিগন্ত বিস্তৃত যত দূরে চোখ যায়, আকাশে ভাসতে থাকে কালো মেঘ আর মেঘ, সমতলে জল আর জল। গোধূলী বেলা পৃথিবীর বুকে ছড়িয়ে পড়া সূর্যের আবদ্ধ আলোটুকু প্রকৃতিকে লাল আভায় আলোকিত করে রাখে।

মেঘ-মেদুর নিসর্গ, শ্রাবণের অবিরাম ধারা, টাপুর-টুপুর বৃষ্টির শব্দে মনে গান বেজে উঠে, ‘এই মেঘলা--ঘরে একলা--পরে কাটে না সময়--কবে আসবে, কবে পাব--ওগো তোমার নিমন্ত্রন...।’ অথবা ‘শাওনও রাতে যদি--স্মরণে আসে মোরে--বাহিরে ঝড়ও বহে--নয়নে বারি ঝরে...।’

সারাদিন তুষার পাতের মত গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি প্রকৃতিকে স্নানে স্নানে পূত-পবিত্র করে সাজিয়ে রাখে। মাঝে মাঝে দমকা হাওয়া, ঝড়ো বাতাস প্রকৃতিকে যেন শিবের প্রলয়ংকারী নৃত্যের পদধ্বনি জানিয়ে যায়। সাদা-কালো নানা আকৃতির, নানা চেহেরার মেঘের দলগুলো দ্রুতবেগে ছুটছে, মেঘে মেঘে বিদ্যুৎ চমকাচেছ, দু’কান স্তব্ধ করার মত আওয়াজ। সেই আওয়াজে পুকুর, খাল থেকে কই মাছগুলো লাফিয়ে লাফিয়ে পাটক্ষেতের দিকে চলে যায়। দুরন্ত ছেলেরা কই মাছ ধরতে পাটক্ষেতের গিঁড়া জলে নেমে পড়ে। মাছ ধরা ভুলে গিয়ে আমি দেখছি পাটের শীর্ষ কচি গুচছ পাতার উপরে প্রকৃতি স্রষ্টার নিপূণ আঁকা আকাশ, মেঘ আর আলোর ছবি। খালের পানিতে যেন, ডুবে আছে সেই ছবি। সাদা মেঘের গা থেকে আলো চলে গেলে মেঘ কালো দেখায়। ঝড় আসার আগে আকাশে কালো মেঘ আর বাতাসের খেলা চলে অনেকক্ষণ। তখন আকাশে অথবা গাছে গাছে পাখিদের আনা-গোনা দেখা যায় না। বড়ই গাছের স্বর্ণলতা বৃষ্টির স্পর্শে লাল আভায় চকচক করতে থাকে। প্রকৃতির পাখিগুলি মেঘের আওয়াজ আর বিদ্যুৎ চমকানোর ভয়ে গাছের ডালে ডালে নিজেদের বাসায় চুপচাপ বসে থাকে। জলে ভরা ডোবায় ব্যাঙ ডেকে চলেছে অবিরাম। রাতের ঝিঁ ঝিঁ পোকারা বৃষ্টির জলে ভিজে চুপচাপ হয়ে আছে; মাঝে মাঝে দু’একটা পোকা রয়ে রয়ে ডাকছে। শ্মশান, গোরস্থান, বন-জঙ্গল, মেঠোপথ জলে ডুবে গেছে। শিয়ালগুলো পাকা রাস্তার অন্ধকারে গোঁড়াডুবা ডোলকলমীর ঝোপে বিপদাপন্ন সুরে ডেকে চলেছে। রাস্তার কুকুরগুলিও শিয়ালের সাথে অবিরাম ডেকে চলেছে। এক সময় শিয়ালের ডাক থেমে যায় অথবা শিয়াল কুকুরের দৌড়াদৌড়ি চলে কিছুক্ষণ; হয়তো শিয়ালেরা কুকুরের বাচ্চা, মুরগীর বাচ্চা, হাঁসের বাচ্চা চুরি করে নিয়ে যায় এবং মানুষের সমবেত চিৎকারে ওরা পালিয়ে বেড়ায়; হয়তো কুকুরেরা ধরা পড়া শিয়াল, বাঘডাসার বাচ্চা নিয়ে টানা হেঁচড়া করে।

আবহাওয়ার সতর্ক বার্তাঃ ‘বিস্তীর্ণ জল সমুদ্রে প্রতিদিন জল ফুলে ফেঁপে বেড়ে চলেছে...।’ উপকূলীয় এলাকার মত গাঁয়ের জল ডুবা পথে, বর্ষার ভিঁজা উঠোনের বাড়িতে বাড়িতে দুঃসংবাদের মাতম বয়ে যায়। কারো ঘরের মাটি চলে যাচ্ছে স্রোতে, কারো শিশু গেছে জলের স্রোতে হারিয়ে, রাতের বেলা কারো গোয়াল ঘরের মাটি আর মুলি বাঁশের বেঁড়া ভেঙে গরু-ছাগল গেছে জলে ভেসে। ট্রলার চেপে সর্বহারা ক্ষুধার্ত মানুষেরা ডাকাত রুপে জলবেষ্টিত দ্বীপের মত বাড়িগুলিতে অন্ধকারে হানা দেয়, লুটে নেয় গৃহস্তের মূল্যবান সম্পদ।

স্কুল অথবা বাজার ফেরত মানুষেরা রাস্তায় দাঁড়িয়ে হাঁক দেয়, ‘ ঐ--- খোকন---, ঐ---জোনাকী---, ঐ--- সুজন---, ঐ---মনা---।’ জলডুবা গাঁয়ের বাড়িতে বাড়িতে বার বার প্রতিধ্বনি হয়। ডাক শুনে হয়তো কেউ কলা গাছের ভেলা, ডিঙি অথবা কোসা নৌকা নিয়ে আসে অথবা সাতরিয়ে পাড় হতে হয় জলে ডুবা ধান ,পাট, হেলেঞ্চা, আঁখ, ধঞ্চে, কচুরী শ্যাঁওলা মাড়িয়ে; ঝাঁক ঝাঁক পোনা মাছ, জোঁক, ডোরা সাপকে পাশ কাটিয়ে; কারো পাতা জাল অথবা বড়শী পায়ে পেঁচিয়ে ভয়ে অথবা আতঙ্কে বর্ষার নৈসর্গিক দিন অথবা রাত--এভাবেই দিনের পর দিন পার হয়ে যায় গ্রাম বাংলার মানুষের। রোগাত্ব, ক্ষুধার্ত, কর্মহীন, ফসলহারা মানুষেরা কচুরীপানার মত বানের জলে ভেসে চলে গ্রাম থেকে শহরে।

বিক্রমপুর থেকে

1 comment: