ধারাবাহিক উপন্যাসঃ শ্যাঁওলা-কাঁটা-বেড়া র্পব-১

আস্তিক, নাস্তিক ও উদারপন্থীরা পড়বেন। দয়া করে কপট ধার্মিক এবং (হুমায়ুন আজাদ এর মতে) ইসলাম ধর্ম-১, ইসলাম ধর্ম-২ এর অনুসারীরা পড়বেন না।


‘চল পালিয়ে যাই’--চোখে মুখে ভয়, লজ্জা, ঘৃণা আর হৃদয়ে আবেগ ও অদম্য সাহস নিয়ে এ কথাটি বলার সাথে সাথে ছেলেটি বাম হাত দিয়ে মেয়েটির কাঁশফুলের মত ধবধবে ফর্সা ডান হাত শক্ত করে ধরল। মেয়েটির সারা দেহে বেতার তরঙ্গের মত একটা স্পন্দন বয়ে গেল। ভয় আর লজ্জায় চোখ তার ঝিমিয়ে আসছে। ঘন ঘন শ্বাস-প্রশ্বাসে তার বাড়ন্ত বুকের ঢেউ ক্রমোত্তর বেড়ে চলেছে। বুকের অগোছালো ওড়না মাটিতে খসে পড়ছে। কি করবে সে? ছেলেটির সাথে পালিয়ে যাবে, নাকি বাড়ী ফিরে যাবে? কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে সে ছেলেটির দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। অন্ধ ভালোবাসা, অদম্য সাহস আর ছেলেটিকে আপন করে পাবার পরম ইচ্ছা তার অন্তরে। ‘চল পালিয়ে যাই’--দ্বিতীয়বার এ কথাটি বলার সাথে সাথে ছেলেটি ওকে নিয়ে ছুটে চলল কাঁশবনের মেঠোপথ ধরে। মেয়েটির যেটুকু জড়তা ছিল--তা এতক্ষনে কেটে গেছে। কাঁশবন পেরিয়ে তারা গাঁয়ের দক্ষিণ দিক দিয়ে ফসলের মাঠে এল। একটু থামল। ভেবে নিল, কোন সরুপথে যাবে? অবারিত মাঠ, চারদিকে নানা রকম শষ্যের সমাহার। এটা কি মাস? ছেলেটির কিবা মেয়েটির এই মুহূর্তে কারো কিছু মনে নেই। কোথায় গেলে নিরাপত্তা স্থায়ী হবে; ভবিষ্যতে তারা একত্রে ঘর-সংসার করতে পারবে তো; কল্যানীর অভিভাবকরা তার কাছ থেকে কল্যানীকে কেড়ে নিয়ে যাবে না তো? কি হবে ভবিষ্যতে? তারা ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবে না; অতীতের পূত-পবিত্র ভালোবাসায় তারা সম্মূখের বর্তমানকে টেনে নিয়ে চলছে ভবিষ্যতের দিকে। বারবার পেছন ফিরে তাকাচ্ছে তারা; দেখছে, শত শত কিবা হাজার বছরের পুরনো ধ্রুব মসজিদ আর ধ্রুব মন্দির তাদের পিছু নিয়েছে কিনা; দেখছে, সমাজের যুক্তিহীন কঠোর নিয়মের বৃত্তাকার শিকলগুলি হাত-পা বাধার জন্য ছুটে আসছে কিনা। দুক্ দুক্ করে দুই হৃদয় কাঁপছে। ছেলেটি যত দ্রুত দৌড়াচ্ছে মেয়েটি তত দ্রুত পারছে না। তবুও প্রানপণ ছুটছে আর ছুটছে। মেয়েটির মনে হচেছ শত শিকল যেন তার পা জড়িয়ে ধরছে--তাকে সামনে যেতে দিতে চায় নাÑতাকে ফিরিয়ে আনতে চায় বাপ-দাদার চৌদ্দ পুরুষের মন্দিরে। এ সমাজ, এ ঘটনা না জানার আগেই শত শিকল তাকে হিন্দুত্বের মন্দিরে ফিরিয়ে আনতে চায় নতুবা কোনদিন আর তার প্রবেশাধিকার থাকবে না। কারণ সনাতন হিন্দুত্বের বেড়াজাল বড় কঠোর। এখান থেকে (কষ্ট হলেও) বের হবার দরজা আছে। কিন্তু (শত কষ্ট করলেও) ঢোকার দরজা নেই। তাই আজ থেকে সে ত্যাজ্য কন্যা। কোনদিন তার মা-বাবা কন্যা হিসাবে তাকে গ্রহন করবে না। মা-বাবা চাইলেও সামাজিক কারণে বুকে পাষাণ বেঁধে থাকতে হবে। ভালোবাসা মেয়েটিকে ঘর ছাড়া করে দিল। ছাপ্পান হাজার বর্গমাইলে এরকম এ রকম ঘটনা ঘটেছে কিনা মেয়েটির জানা নেই। পৃথিবী সম্পর্কে তার জ্ঞান কম। আপন গন্ডীর মধ্যেই তার বিশ্ব-বসবাস। জন্মের পর থেকে সে চিনে মা-বাবা, আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী, শ্রীনগর তার গ্রাম; গ্রামটির পুরোপুরি চেনা হয়নি--স্কুল, মন্দির, পুকুর ঘাট, সম্মূখের বিস্তির্ণ মাঠ; পুরনো বটগাছ--যেখানে সে ভালোবাসার প্রতিজ্ঞা করেছিল এবং সবচেয়ে আপন মানুষ--শুভ আর তার বন্ধু-বান্ধবকে। এ পৃথিবীতে কোথায়ও কি হয় বা হচ্ছে, গাঁয়েই বা কি হচ্ছে, সে খবরও সে রাখত না। শুধু শুভ, প্রেম, বন্ধু আর স্বপ্ন--এই ছিল তার সারাদিনের বিষয়। কল্যানী আর শুভর মাঝে কথাবার্তা হত খুব কম। চিঠি আর চোখাচোখিই ছিল প্রেমের সেতু। যখন তারা কথা বলত--সময় আর মানুষকে তোয়াক্কা করত না। কথা বলার সুযোগ সুজন, আরমার আর বাচ্চুই করে দিত। তবে সবচেয়ে বেশী কাজ করত সুজন। গ্রামের মানুষ প্রায়ই তাদের প্রেমের কর্মকান্ড দেখে ফেলত।

কল্যানীর দেহ ছিল হালকা-পাতলা। উচ্চতা প্রায় পাঁচ ফুট দু’এক ইঞ্চি হবে। দূর থেকে এক দৃষ্টিতে তাকালে দেবীর মত মনে হয়, যেন সরস্বতী। অবশ্য বিদ্যার জোর একেবারে ছিল না। দু’এক বিষয়ে ফেল করা তার অভ্যাসে পরিণত হয়েছিল। খুব কাছে আসলে মনে হবে, স্লীম ফিগারের বোম্বের কোন আকর্ষনীয় নায়িকা। হালকা-পাতলা দেহের পেশীগুলি খরগোশের মত তুলতুলে। আর দেহের ত্বক ফর্সাÑইচ্ছা হয় একটু ছুঁয়ে দেখি। খুব একটা হাসি-খুশী সে নয়। তবে তার হাসি প্রায় নিঃশব্দে, গালে টোল পড়ে। দেখতে ভারী সুন্দর লাগে। বুকের ভিতর সর্বদা একটা ভয় কাজ করে। শুভকে না পাওয়ার ভয়। অনেকেই তাকে চিঠি দেয়, ভালোবাসতে চায়। কিন্তু এক শুভ ছাড়া আর কারো কপালে কল্যানীর ভালোবাসার ফোঁটা পড়েনি। সে খেলাধূলা কখনো করে না। তবে খেলাধূলা দেখে। তার দেহের লোমগুলি স্পষ্ট । সাধারণত মেয়েদের লোমগুলি যা হয় তার চেয়ে কল্যাণীর লোমগুলি একটু বড় তবে হলুদাভ। ইটের নীচে অনেক দিন ঘাস চাপা পড়ে থাকলে, যেমন দেখা যায়, তার লোমগুলি অনেকটা সে রকম। কাঁচা হলুদের মত মুখমন্ডল। একবার দেখলে চোখ ফিরানো দায়। হাতের তালুতে তিন-চারটি রেখা সুস্পষ্ট; আর কোন রেখা নেই বললেই চলে। তুলতুলে হাত, ধরে হাঁটতে ইচ্ছে হয়।

চোখ দু’টি যেন, কোন শিল্পীর তুলিতে আঁকা। চোখের মনির রং কালো। তবে পুরোপুরি কালো নয়, লালচে কালো। মনির চারপাশে সাদা অংশে লালচে দু’একটা বিন্দু দেখা যায়। সে বাড়ীতে বসে বা জানালার পাশে বসে যে কোন ছেলের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। অনেকে মনে করে তাকে পছন্দ করেছে। আসলে ভুল। সে শুধু দেখে, আর কিছু বলে না। কেউ ইংগিত করলেও সে সাড়া দেয় না। রঙধনুর সাত রঙে নয় কিন্তু উপবৃত্তাকার অথবা দুই ফাঁলি চাঁদের মত বাঁকা তার চিকচিকে কালো ভ্র“ জোড়া।

মানুষের মুখের সৌন্দর্যের প্রধানতম অংশ নাক। কল্যানীর নাক সরু এবং কিছুটা সম্মুকে বর্ধিত। গ্রামের মহিলারা বলে তীরের মত চোকা নাক। তার রাগ বলতে গেলে নাই। সারা মুখে সামান্য একটা দাগ নেই। গলায় দু’একটা তিলক আছে। ঠোঁট দু’টি কমলার কোষের মত হলুদাভ। তবে হঠাৎ করে দেখলে ঠোঁট দু’টি লালই মনে হয়। খুব মোটাও নয়--খুব পাতলাও নয়। মাঝারী প্রশস্ত ঠোঁট। সর্বদাই স্যাঁতস্যাঁতে থাকে। ছোট ছোট মুক্তাদানার মত চিকচিকে দাঁত। হাসলে সুনিপুন দাঁতগুলি যেন বের হয়ে আসতে চায়।
মাথার কালো চুল, খুব একটা লম্বা নয়। পিঠের মাঝামাঝির চেয়ে নিচে, নাভির সমান বলা যায়। বুকের স্তন্যের আকার খুব একটা বড় নয়। বাড়ন্ত বুক। সেই তুলনায় ঠিক মানান সই চমৎকার ঢেউ। ওড়না খুব একটা পড়ে না। পড়লে গলায় পেঁচিয়ে রাখে। এই বয়সে স্কার্ট পড়লে কল্যানীকে সবচেয়ে আকর্ষনীয় লাগে। পথের এমন কোন লোক নেই, যে ওকে একবার না দেখে। অনেকে কথাও বলতে চায়। কিন্তু সুযোগ হয় না বা প্রত্যুত্তর হয় না বলে অপমানিত হতে হয়।

বিকাল বেলা। বান্ধবীর বাসায় যাবার ভান করে কল্যানী চলে আসে আম বাগানের পেছনে। পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী শুভর বন্ধু সুজন ওখানে অপেক্ষা করছে। কল্যানী সুজনকে দেখতে পেয়ে চারদিকে তাকাল। দেখল, আশেপাশে তৃতীয় কোন ব্যক্তি আছে কিনা না, কেউ নেই। সুজন কল্যানীকে লোক চক্ষুর আড়ালে ধানক্ষেতের কাছে নিয়ে আসে। দু’জন বসে পড়ে। সন্দেহ, কেউ বোধ হয় ক্ষেত নিড়াচ্ছে। না, কেউ নেই। একটা শিয়াল বাড়ন্ত ধান ক্ষেতে ইতঃস্তত ঘুরে বেড়াচ্ছে। সে কল্যানীকে দক্ষিনের ধঞ্চে ক্ষেতের আড়ালে শুভর কাছে নিয়ে এল। এখানে দু’একটা কথা বলে তারা পালিয়ে আসে। যে গাঁয়ের মাঠ দিয়ে তারা ছুটছে--সে গাঁয়ের নাম ফুলকচি। শুভ এ গাঁয়ে আগে কখনো আসেনি। ছুটতে ছুটতে কল্যানী হঠাৎ থেমে গেল। শুভর চোখে তাকিয়ে বলল,

- কোনদিকে যাবে?
- মেইন রাস্তায় গিয়ে বাসে উঠবে।
- যদি বাড়ীর লোক এদিকে খোঁজ করতে আসে?
- এদিকে আসবে না। সবাই ভাববে ঢাকার পথে চলে গেছে।
- আমরা রাতে কোথায় উঠব।
- রিনা আপার বাসায়--লৌহজং এর গাঁওদিয়া গ্রাম।
- আমার কেমন জানি ভয় করছে।
- ভয় করলে চলবে না। এখন আমাদের সাহস দরকার। প্রচন্ড সাহস।
- এতক্ষনে মনে হয় গ্রামশুদ্ধ লোক জেনে গেছে।
- জানুক, সবাই এটাও জানুক--কল্যানীকে আমি আমার জীবনের চেয়ে বেশী ভালবাসি।
- শুভ, মা বোধ হয় অজ্ঞান হয়ে যাবে। ঠাকুরমা শুনলে মরেই যাবে।
- ধর্মান্ধ আর কুসংস্কারচ্ছন্ন মানুষগুলি সব মরে যাক। বেঁচে থাক ধর্মভীরু, শান্তি প্রিয় মানুষেরা। তুমি কি রাগ করলে? আমার মাওতো কাঁদবে। ছোট বোনটি শুনলে ভাইয়া ভাইয়া করে চিৎকার করবে। তুমি তো পলিকে ভাল ভাবেই চেন, একদিন আমাকে না দেখলে কেমন কান্নাকাটি করে। রাতে আমাকে না দেখে হয়তো উপোস করবে, ঘুমাতেও চাইবে না।
- মা-বাবা, ঠাকুরমা, ভাই বোন কারো কিছু হলে আমি কাঁদবো--খুব কাঁদবো। কিন্তু তাই বলে তোমাকে কিছুতেই হারাতে চাই না। তোমাকে ছাড়া আমি বাঁচব না বলেই তো বিয়ের তিন দিন আগে তোমার হাত ধরে পালিয়ে এলাম। ধর্ম-কর্ম বুঝি কিন্তু তার আগে বুঝি তোমাকে। মন্দির বলে যদি আমার হৃদয়ে কিংবা বাইরে কিছু থাকে, তবে সেখানে তোমাকেই দেবতা রুপে ভেবেছি। ভগবানের কাছে প্রার্থনা করেছি তোমাকে--সব কিছুর বিনিময় শুধু তোমাকে।
- কল্যানী, আমি কারো মৃত্যু কামনা করি না--করা উচিতও না। তবে যারা আমাদের ভালোবাসাকে মেনে নেয় না--মেনে নিতে চায় নাÑআমার চোখে সর্বদা তাদের সর্বনাশ দেখি। তুমি, আমি যদি একত্রে জীবন-যাপন করতে পারি--তাতে সমাজের কি আসে যায়?
- আমরা দুই ধর্মের, তাই।
- প্রচলিত এই ধর্মগুলি সৃষ্টি হয়েছে কত বছর আগে? পনের শত,
দুই হাজার, তিন হাজার বছর ধরেই হোক; তার আগে কি ভালোবাসা ছিল না? তখন কিভাবে নারী-পুরুষ ঘর সংসার করত ?

- জানিনা।
- কল্যানী, আমাদের সংসারে ধর্মটা বাইরে--মানে ঈদ,পোষাক, খাবার-দাবার, টুপি ইত্যাদি--যাকে বলে ফ্যাশন। ভিতরে ইউরোপীয় ষ্টাইল। অতএব আমাদের সংসারে তোমার কোন ধর্মগত বা সামাজিকতার অসুবিধাই নেই।
- আমাদেরও এমনি--ধর্ম শুধু মা আর ঠাকুমার কাছে সীমাবদ্ধ। সকাল-বিকাল লক্ষ্মীকে পূজা দিতে হয় বলেই দেওয়া আর বিভিন্ন পূজা-পার্বণ ধর্মগত সামাজিকতা ছাড়া আর কিছুই নয়। আসলে ধর্মে বাধা কোথায়? বাঁধা তো সব দেখছি আমাদের যুক্তিহীন, বিশ্বাস নির্ভর সমাজে।
- ঠিক বলেছ কল্যানী, এ সমাজ থেকে অন্য কোন সমাজে আমাদের যেতে হবে। দূরে, বহুদূরে। যদি হিন্দু সমাজে উঠি বলবো, আমরা হিন্দু। যদি মুসলমান সমাজে উঠি বলবো, মুসলমান। স্থানীয় সামাজিকতা মেনেই আমাদের চলতে হবে। আমাদের দু’জনকে অনেক দুঃখ-কষ্ট সহ্য করতে হবে।
- তবুও শুভ তোমাকে কিছুতেই হারাতে চাই না।
- জীবন বাজী রেখেছি ভালোবাসার জন্য। তোমার জন্য বেঁচে আছিÑযদি মরতে হয় তোমার জন্যই মরব।

কল্যানী শুভকে জড়িয়ে ধরল। দু’জন যেন ধন্য হয়ে উঠল এই সূর্যাস্তের মুহুর্তে। কল্যানী সারা দেহে কি এক অব্যক্ত ভালোবাসার শিহরণ বয়ে বেড়াচ্ছে। সারা মুখ চুমোতে ভরিয়ে দিল দু’জন দু’জনকে। ঘন ঘন নিঃস্বাসের ছোঁয়ায় ভালোবাসার তীব্র কামুক গন্ধ বাতাসে ছড়িয়ে পড়ছে। ধঞ্চে পাতা ঝিমিয়ে পড়েছে সারাদিনের ক্লান্তি শেষে। ছোট ছোট পাখিরা এখনও খাদ্য খুঁজে বেড়াচ্ছে। দুটি প্রজাপতি তাদের দেহের চারপাশে ঘুরছে। সূর্যটার লাল আভা থেকে যেন তাদের ভালোবাসার প্রতি শুভেচ্ছা বিচ্ছুরিত হচ্ছে। ‘আমি তোমাকে ছাড়া বাঁচব না’--দু’জনই প্রতিধ্বনি করে উঠল। হঠাৎ কল্যানীর মুখটা কি এক অব্যক্ত ভয়ে ফ্যাকাশে হয়ে উঠল। মুখের রক্তাভ রংটা যেন নিমিষে নীল হয়ে গেল। শুভর হাঁটুর কাছে বসে পড়ল সে। তখনো নিঃশ্বাসে ভালোবাসার তীব্র গন্ধ বের হচ্ছে। শুভও বসে পড়ল। ক্লান্তি শেষ হলে শুভ বলল ‘চল’।

কল্যানী এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল শুভর দিকে। কি সুন্দর গড়ন এই ফর্সা মুখটা। আদর করে বুকে রাখতে ইচ্ছে করছে। মৃদু একটি হাসি দিয়ে কল্যানী উঠল। ওড়নাটা গুছিয়ে নিল বুকের উপর। তারপর ভালোবাসার মৌসুমী বায়ু--যে বায়ুতে ভালোবাসাকে অসুস্থ’ করার জীবাণু নেই--তারা সে বায়ু পথে ছুটছে নতুন উদ্দমে, নতুন জীবনের সন্ধানে।

আবেগ মানুষকে এমন সব ভাবনায় ফেলে দেয়--যখন সে বাস্তব জীবন সম্পর্কে সব জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। প্রেম মানে অপেক্ষায় থাকা। প্রেম মানেই সময়কে অপব্যবহার করে ভিন্ন চিন্তা বা কল্পনা করা। কিন্তু সময়ই জীবন এবং জীবন খুবই ক্ষনস্থায়ী। সময় ও অপেক্ষা কিংবা সদ্ব্যব্যবহার ও অপব্যবহার পরস্পর বিপরীতধর্মী কাজেই প্রেম ও জীবন বিপরীতধর্মী। জীবন থেকে প্রেমের উৎপত্তি--প্রেম থেকে জীবন নয়। মোটা মোটা বই পড়ে সুজন আর শুভ হয়ে উঠেছিল দার্শনিক। বড়রাও ওদের যুক্তিতে হার মানত। শুভ বন্ধু-বান্ধবকে এসব যুক্তি কথা বুঝাত, তর্ক করত। কিন্তু কল্যানীর প্রেমে পড়ার পর তার সব যুক্তি ধূলোতে মিশে গেছে। কখন যে সে এমন হয়ে গেল--তা সে নিজেও জানে না। তার এখন প্রেমের জন্য জীবন। সে কল্যানী ছাড়া কিছু বুঝে না--কিছু বুঝতেও চায় না। তাদের প্রেমের গল্প গ্রামের আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা কারো কাছে অজানা নয়। মুখে মুখে হাস্যরসিকরা বলে বেড়ায়, হিন্দু লাইলী আর মুসলমান মজনু--নয়া লাইলী-নয়া মজনু।

কাঁশবনের ভিতর দিয়ে ছুটতেই কাঁশপাতায় শুভর হাত কেটে গেল। উঃহু! শব্দটা ছড়িয়ে পড়ল কাঁশবনে। দু’জনেই থেমে গেল। শুভ হাতের রক্ত দিয়ে কল্যানীর কপালে রক্ত সিঁদুর মেখে দিল। তাকাল কিছুক্ষণ। ভাবল, বাঙালীত্ব নাকি হিন্দুত্ব। কেন জানি, তার মনে হল, সে কল্যানীকে ধর্মের নিয়মের চিহ্ন দিয়ে আলাদা করে দিচ্ছে। হ্যাঁ, এটা হিন্দুত্ব। সে চাকু দিয়ে কাঁটা স্থানটিতে আরো কাটল। ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হল। সে রক্ত সে কল্যানীর পায়ে আলতার মত মেখে দিল। মনে মনে সামাজিক নিয়মের ছকটাকে শত ছিন্ন করে বঙ্গোপসাগরে নিক্ষেপ করল।

- কি করছ এসব।
- গভীর প্রেমের চর্চা করছি। যদি তোমাকে স্বাধীন করার জন্য আমার দেহের সমস্ত রক্তের প্রয়োজন হয়, আমি দেব--নিঃশর্তে দেবো--দেবো ভালোবাসার গভীর বিশ্বাসে। আমাকে ভালবেস তুমি--আমারী মত করে।
- শুভ, আমি তো আমার জীবনের চেয়েও বেশী ভালবাসি তোমাকে। কত আত্মীয়-স্বজন আমাকে বুঝিয়েছে। গলায়, হাতে, মাজায় কত তাবিজ-কবচ পড়িয়েছে। কোন কিছুইতো ছিনিয়ে নিতে পারেনি তোমার কল্যানীকে। কোনদিনও জীবন্ত অবস্থায় নিতে পারবে না।
- তুমি ছিলে আমার অতীত, তুমি আমার বর্তমান, তুমি হবে আমার ভবিষ্যৎ। তুমি আমার সময়, তুমি আমার সাধনা--আমার অর্ধেক জীবন।
- শুভ !

কল্যানী ওর ওড়না ছিঁড়ে কাঁটা স্থানটা বেঁধে দিল। শরতের আকাশ মেঘমুক্ত। একেবারে স্বচ্ছ আয়নার মত। সেই স্বচ্ছ নীলকাশে সাদা ভেজা ভেজা তুলোর মত মেঘের ভেলা--সবার মন প্রানকে ছুঁয়ে দেয়--ভাবুক করে তুলে। না, শুভ কিংবা কল্যানী--কাউকে শরতের এই মুহূর্ত ভাবুক করছে না। আকাশ, বাতাস, মাঠ-শষ্য নিয়ে তাদের ভাবার সময় নেই। শৃঙ্খরিত বর্ডার তারা জোড়পায়ে পেরিয়ে যেতে চায়। শুভ বলে চলেছে--‘কুইক...।’ কল্যানী হাঁপাচ্ছে, প্রচন্ড হাঁপাচ্ছে। বুকের ওড়না বারবার খসে পড়ছে। হৃদকম্পনের সাথে কাঁপছে তার বাড়ন্ত বুক। শুভর সেদিকে খেয়াল নেই। সে শক্ত করে কল্যানীর হাত ধরে আছে। সূর্যাস্তের এই সময়ে কৃষকেরা ক্লান্তদেহ নিয়ে ঘরে ফিরে যাচ্ছে। রাখালও গরুর পাল নিয়ে গোয়ালে ফিরে যাচ্ছে। জনশূন্য মাঠ। হঠাৎ কল্যানী হুমড়ী খেয়ে পড়ে গেল। শুভ থামল। কপালে, চিবুকে, গলায়, বুকে ঘামের ঘন পানি বিন্দুগুলি যেন এ সময়ের, এ সমাজের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করছে। সমাজের প্রতি ঘামের মধ্য দিয়ে যেন ঘৃনা বের হচ্ছে। শুভ কল্যানীকে উঠাল। দূর থেকে আযান ভেসে এল। আল্লা হুআকবর আল্লা ...। শুভ পকেট থেকে সুইচ গিয়ার বের করে পেছনে তাকাল। সুজন বেঈমানী করে সব বলে দিয়েছে না তো? কখনও না। ও বলবে না। তাহলে শুভর সন্দেহ হচ্ছে কেন? দেখল আশেপাশে কেউ আছে কিনা। কল্যানী হাঁপাচ্ছে। আযনের ধ্বনি যেন শুভকে ভয় পাইয়ে দিয়েছিল। যদিও সে স্বেচ্ছায় কোনদিন নামায-রোজা পালন করেনি। দু’একবার করেছিল সামাজিকতা রক্ষার্থে আর ভবিষ্যতে করবে কিনা সেটাও সামাজিকতার স্থান, কাল ও পাত্রের উপর নির্ভর করছে। তাই বলে সে নাস্তিক নয়-সৃষ্টিকর্তার প্রতি তার বিশ্বাস ও ভয়--দুই’ই আছে। আবার মাঝে মাঝে সন্দেহও জাগে। সব বিশ্বাসেই একটু না একটু সন্দেহ থাকবেই। যে ব্যক্তি বলে তার কোন একটা বিশ্বাসে সামান্য সন্দেহ ছিল না, বর্তমানেও নেই, ভবিষ্যতেও থাকবে না--তবে সে একটা মিথ্যাবাদী। মুক্ত মন মাত্রই ভুল-শুদ্ধের ছড়াছড়ি। নিজের অজান্তে, নিজের বিরুদ্ধে মন অনেক কাজ করে বসে। কারণ মনের কোন ধর্ম নেই--বরং ধর্মই তার উপর জোর করেই চাপিয়ে দেওয়া হয়। হয়তো এক সময় মন তা মেনে নেয়--তবে পূর্ণভাবে মানতে পারে কি?

কল্যানী ও শুভ সামাজিক মানুষগুলি থেকে পৃথক। তাদের পরিচয় ছড়িয়ে পড়লে কোন সমাজেই শান্তিতে তারা বাস করতে পারবে না। তাই বলে শুভ এসব কেয়ার করে না। না দিক ঠাঁই, এ সমাজ। তারাই দু’জনে নতুন সমাজ গড়বে। তাদের দু’জনার মাঝেই একদিন গড়ে উঠবে নতুন এক সমাজ। খেয়ে না খেয়ে আদিম হয়ে বাঁচবে। তুবও ভালোবাসার সেতু ভাঙ্গতে দেবে না কিছুতেই। কল্যানীর দু’চোখ বেয়ে জল ঝরছে। ঠোঁট কাঁপছে। ওড়না মাটিতে পড়ে আছে। শুভ কল্যানীর কাছে এসে চোখের দিকে তাকাল। আবার নিঃশ্বাসে-প্রশ্বাসে ভালোবাসার তীব্র গন্ধ ছুটছে। ভালোবাসার গন্ধে যেন সোনালী ফসল চিকচিক করে জ্বলছে। যে স্থানে তারা পা রেখেছে সে স্থান যেন সোনা হয়ে গেল। ভালোবাসার গন্ধে কেমন যেন মাদকতা আছে; দুজন দুজনকে টানে এ কোন গোলাপের গন্ধ নাকি রজনীগন্ধার নাকি হৃদয়ের মাঝে ফোঁটা কোন পদ্ম ফুলের সুঘ্রাণ বের হচ্ছে? নিজের অজান্তেই ভালোবাসার মাদকতায় শুভ কল্যানীকে বুকে টেনে নিল। যেন এ সম্পত্তি আর নিজের সম্পত্তি--এক ও অবিচ্ছেদ্য। শুভ ওর ঠোঁট, চিবুক, গলকণ্ঠ, বুক চুমোতে চুমোতে লাল করে ফেলল। কল্যানী ওকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগল। এ কান্না অতি কষ্টের মাঝে ফুটে উঠা একটি গোলাপের জন্য। এ কান্না সুখের জন্য। কিছু কিছু বেদনাতে এমন সুখ নিহিত থাকে--যা ব্যক্তিকে পাগল করে দেয়। শুভ ওর মুখে নিজের মুখ ঘষে আগুন জ্বালাতে চেষ্টা করল। আগুন জ্বলল। কিন্তু দুজনার কেউ তাতে পুড়ে ছাই হল না। এ আগুন জ্বলতে জানে, জ্বালাতে জানে। কিন্তু কল্যানী-শুভ এ মুহুর্তে কেউ এ আগুনে জ্বলতে চাইল না। শুধু আগুন জ্বালিয়ে রাখল দু’জনার বুকে। দু’জনার বুকের স্পন্দন এক হয়ে যেন বাইরে বের হতে চাইল। বুকে বুক চেপে আছে। হৃদয়ের কথা--হদয়ে যাচ্ছে। ভালোবাসার গভীরতা মাপছে, সাহস মাপছে, ঘৃণা মাপছে--সবাই সমান। শুভ কল্যানীর পায়ের কাছে এসে পায়ের ময়লা পরিস্কার করে দিল। এতক্ষণ ময়লাগুলি ছোট ছোট শিকল হয়ে পায়ে জড়িয়ে ছিল--পরাজিত হয়ে বহু ময়লা পা থেকে খসে পড়ছে। দৌঁড়ানোর ফলে পায়ের সেন্ডেল কখন যে খসে পড়েছে--তা মনেও নেই। ফর্সা পায়ে ফোসকা পড়ে গেছে। ভাঙ্গা শামুক রক্তাক্ত করেছে তার টুকটুকে আপেলের মত গোলাপী পা।

- কল্যানী, আসলে আমরা মা-বাবার কাছে বন্ধি--মা-বাবা সমাজের কাছে বন্ধি--সমাজ ধর্মের কাছে বন্ধি--ধর্ম সময়ের কাছে বন্ধি। পাহাড় আকৃতির এত সব বন্ধিদশা থেকে মুক্ত হবার কোন পথ খোলা ছিল না বলেই পালিয়ে এলাম। এ ছাড়া আমাদের আর উপায় ছিল না, আছে কিনা সেটা আমার জানা নেই।
- পালিয়ে এসেছি বলে আমার মধ্যে কোন দ্বিধা নেই। আগে ছিল কিনাÑজানি না। তবে এখন নেই।
- পরে হয়তো হবে পারে?
- হলে মনকে বুঝাব, যে সময়ে পালিয়ে এসেছি--সে সময়ে পালিয়ে আসার খুবই প্রয়োজন ছিলÑআমার জন্য, আমাদের জন্য--ভালোবাসার জন্য--বেঁচে থাকার জন্য।
- হ্যাঁ, কল্যানী--আমিও মনকে বুঝাব, ঐ সময়ের প্রয়োজনেই পালিয়ে এসেছি এবং ঐ সময়ে কোন ভুল মনে হয়নি বলেই ভুল করিনি।

- ভাবছি, দাদা যদি শুনে তবে সব থানায় খবর চলে যাবে।
- হ্যাঁ কল্যাণী, তোমার ম্যাজিষ্ট্রেট ভাইটাকে বড় ভয় করে। এখন তো আছে মানিকগঞ্জ জেলায়। মুন্সিগঞ্জ আর মানিকগঞ্জ জেলা কাছাকাছি। এ দুই জেলা ছেড়ে আমাদের বহুদূরে যেতে হবে। চট্টগ্রামে আমার এক বন্ধু আছে সেখানে উঠব। ঢাকায় থাকা যাবে না।
- হ্যাঁ, ঢাকায় থাকা সম্ভব নয়। সবাই ভাববে, আমরা ঢাকায় আছি। ঢাকায় তোমার, আমার অনেক আত্মীয়-স্বজন। তোমার আত্মীয়-স্বজন হয়তো আমাদের মেনে নেবে কিন্তু আমার আত্মীয়রা কিছুতেই মেনে নেবে না।
- সে আমি ভালভাবেই জানি। সুজন যে নিজেকে এতদিন নাস্তিক বলে ভাবত; সেও কেমন জানি আমতা আমতা করছিল। আমাকে বলে, শুভ, কল্যানী হিন্দু মেয়ে, না মানে আমাদের সমাজ তো--
- এতদিন তুই না বলেছিলি মুচি আর পাল বা বনিক বা দাস বা সাহা বা কুন্ডুর ভালোবাসায় যত বাঁধা--মুসলমান আর ঐ বর্ণগুলোর ভালোবাসায় একই বাঁধা। মুচিরা হিন্দু হলেও হিন্দুরা মুচিদের নিচু পর্যায়ে ভাবে, নীচু চোখে দেখে।
- হ্যাঁ, বলেছিলাম। আমাদের হিন্দুদের মধ্যে দুই বর্ণের বিয়া সামাজিকভাবে খুবই কম হয়। বর্ণে বর্ণে, জাতে জাত মিলিয়ে আমাদের বিয়ে হয়।
- আরো বলেছিলি। এই ভন্ড হিন্দুত্বের গায়ে মুসলমানের ছোঁয়া লাগুক। অন্তত: বর্ণ প্রথা নিপাত যাক।
- হ্যাঁ বলেছিলাম।
- আরো বলেছিলি--কাউকে না কাউকে দুই ধর্র্মের বিয়া শুরু করতেই হবে। তবে না অন্যেরা সাহস পাবে।
- হ্যাঁ বলেছিলাম। এভাবে সবাই বিয়ে করলে হিন্দুরা মুসলমান হয়ে যাবে। মুসলমান কখনও হিন্দু হয় না।
- এখন তোর কাছে মনে হচ্ছে, হিন্দু প্রাণীগুলির পৃথিবীতে থাকা খুবই প্রয়োজন। কোন প্রাণী পৃথিবীতে বেঁচে থাকে বা থাকা উচিত। যারা চলমান প্রতিকূলতাকে জয় করতে পারে। ডারউইনের অস্তিত্ববাদ মনে পড়ে? পৃথিবীতে সেই মানুষকে বেঁচে থাকার কোন প্রয়োজন নেই; যারা আধুনিক জীবনের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে পারে না; যারা বিজ্ঞানকে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে যথেচ্ছ ভাবে ব্যবহার করছে অথচ বিজ্ঞানীদের বকেই চলেছে। বিজ্ঞানকে আড়ালে লুকিয়ে শত বছরের পুরনো মৃত অর্ধমৃত, অন্ধকার, ঘোলাটে বানীগুলিকে ব্যবহার করছে। প্রিন্ট মিডিয়ায় আর ইলেট্রনিক মিডিয়ার পর্দায় বসে বিজ্ঞানের বানী না শুনায়ে ধর্মের বানী শুনাচ্ছে। সমাজ পরিবর্তনশীল। দেশ কোন ধর্মের আইনে চলে না--গণতন্ত্রের আইনে চলে। গণতন্ত্রের আইনে কোথাও লেখা নেই--দুই ধর্মের নারী-পুরুষ কখনও বিয়ে করতে পারে না। হিন্দু- মুসলমান, বৌদ্ধ-খ্রীষ্টান একত্রে বসবাস করলে এমন ঘটনা ঘটবেই যদি ভালোবাসা, প্রেম বলে পৃথিবীতে কিছু থাকে। ভালোবাসা তো দুই-তিন-চার ভাগে বিভক্ত নয়।
- তবুও সামাজিক নিয়মের কথা বলছিলাম। জন্ম থেকে যে দেব-দেবীর কাছে থেকেছে; সে হঠাৎ মসজিদ, নামায, কোরান শরীফ, ঈদ এগুলোর সাথে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারবে তো? তাছাড়া পরিবার থেকে সে ত্যাজ্য কন্যা হয়ে যাবে।
- সামাজিক নিয়মের কথা বলছিস--যা মানুষ যুগ যুগ ধরে কলুর বলদের মতো টানছে--ভবিষ্যতেও টানবে। এই সামাজিক নিয়ম ইচ্ছে করলেই সমাজপতিরা পরিবর্তন করতে পারেন। এই যে আমি কল্যাণীকে ভালোবাসি এবং যদি বিয়েই করি এবং সমাজপতিরা মেনে নেয়, তবে কার বাপের সাধ্য ধর্মের চাবুক টেনে আমাদের আটকাবে? আসলে ধর্ম নয়, সামাজিক কাঠামো পরিবর্তন করা দরকার, তাতে যদি ধর্মের পা মচকে যায়--ধর্ম কাঁদবে না--সে কোনদিন কাঁদেনি--ভবিষ্যতে কাঁদবেওনা; কাঁদবে ধর্মান্ধরা, ধর্মপতিরা, সমাজ পতিরা। আর মসজিদ, নামায বলছিল; দেখ, ধর্ম মানুষের অন্তরের ব্যাপার। বিয়ে হওয়ার পর আমাদের সমাজে কন্যা কন্যা থাকেনা--হয়ে যায় বধূ। কন্যার বাপ আর বধূর বাপ এক নয়। কন্যা বধূ হলে কন্যার বাপ-মা এমনিতেই পর হয়ে যায় অথবা আস্তে আস্তে হয়। আর শ্বশুর-শ্বাশুরী হয়ে উঠে মা-বাবা। তুই মেট্রিকে ছিলি সাইন্স-এ এখন আছিস আর্টস-এ এবং ভালভাবেই মানিয়ে নিয়েছিস। নাকি ভূল বললাম? দেখ সুজন, কল্যাণী আর আমার মাঝে সামান্য সামাজিক তফাৎ আছে কিনা; তার চেয়ে বড় হয়ে দেখা দিচ্ছে, তোর বর্তমানের মানসিক সমস্যা। যুক্তিকে তুই সমাজের বস্তার মধ্যে চাপা দিয়ে রেখেছিস।
শুভ ও কল্যাণী হাঁটছে আর হাঁটছে। সন্ধ্যার সূর্য রেখাগুলি লাল আভা ছড়িয়ে যাচ্ছে। নির্জন মাঠ। তারা হাঁটচ্ছে আর কথা বলছে। হৃদকম্পন সেকেন্ডের কাঁটার মত দুলেই চলছে। কিছুক্ষণ শুভ চুপ করে রইল।
- তারপর সুজন ভাইকে আর কি বললে?

- বললাম, শাহরুখ-গৌরী, রামেন্দু মজুমদার-ফৌরদৌসী মজুমদার, কুমার বিশ্বজিৎ, জুয়েল আইচ--এছাড়াও আরো কত উদাহরন আছে। তারা কি ভালভাবে আছে না?
- সুজন বলল, সে ভিন্ন পর্যায়ে, ঐ পর্যায়ে তুই থাকলে, কেউ কিছু মুখ ফুটে বলতেও পারত না। এখন যে তোরা ছোট? সবাই তোদের ঘৃণা করবে, অপমান করবে। তোদেরকে এ সমাজের অভিভাবকেরা ধর্মপতিদের সাহায্য নিয়ে অত্যাচার করতে পারবে--বিচার বসাতে পারবে। কিন্তু শাহরুখ-গৌরী, রামেন্দু মজুমদার-ফৌরদৌসী মজুমদার, কুমার বিশ্বজিৎ, জুয়েল আইচ--এদেরকে বিচার, অত্যাচার করা এত সহজ নয়। তাদের ঘরে বাইরে গনতন্ত্র আর আধুনিকতা। কিন্তু আমাদের বাইরে গনতন্ত্রÑভিতরে ধর্মতন্ত্র। আর আধুনকতা?
- আমি কিছু বুঝতে চাই না--শুনতে চাই না। কল্যানীকে ছাড়া আমি বাঁচব না। সেটা তুই ভাল করেই জানিস। আমাকে জ্ঞান দিস না। আমি কল্যানী ছাড়া কিছু বুঝি না। আমি মরতে রাজী কিন্তু ওকে হারাতে রাজী না।
- শুভ, রাগ করিস না আমার উপর। নাস্তিক ভাবলেও হিন্দুত্ব যে আমার ভিতরে অটুট আছে--তা আজ, এখন বুঝলাম। জন্মসূত্রে, যে ধর্ম পেয়েছি সেটাকে ত্যাগ করতে চাইলেও, ঘৃনা করলেও--সবাই হিন্দুই বলবে। আজকাল বহু মানুষ (আমার মনে হয়, বেশীরভাগ মানুষ) জন্মসূত্রে হিন্দু বা মুসলমান; প্রকৃত হিন্দু বা মুসলমান নয়; কারন ধর্মের নূন্যতম নিয়মও তারা পালন করে না।
- আবার অনেকে আছে, সব ধর্মের নিয়মই মানে অর্থাৎ স্থান, কালের সাথে তাল মিলিয়ে চলার জন্য সব ধর্মের প্রতি সম্মান দেখায়, মেনেও চলে। আমি সেই অনেকের মধ্যে একজন। মা-বাবা করে আসছে বলে, তাদের খুশী করার জন্য, সম্মান দেখানোর জন্য, আমাদেরকেও তদ্রুপ কাজ করে যেতে হয়--নিয়ম কানুন মানতে হয়।
- সুজন, যে বিধি-নিষেধ আধুনিক আলোকময় বিশ্বে টিকে থাকতে পারে না; কষ্ট হয়, সেই বিধি-নিষেধই টিকে থাকার জন্য হৈচৈ শুরু করে। আর যে বিধি-নিষেধ সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে পারে, টিকে থাকতে পারে--সেই বিধি নিষেধ টু শব্দটি পর্যন্ত কওে না।
- শুভ, তোর ভিতরে যথেষ্ট যুক্তি জ্ঞান আছে। কিন্তু আমি বুঝতে পারছি, ভালোবাসা তোকে অন্ধ করে ফেলেছে। আগুন নিয়ে খেলার পরিনতি ছাই-ই হয়।
- হোক, আমি এখন প্রেমান্ধ। কেয়ামত হলেও ওকে আমি হারাতে চাই না।
শুভ কল্যানীকে নিয়ে দ্রুত হাঁটতে লাগল। পকেটে হাত দিয়ে দেখল টাকাগুলি ঠিকমত আছে কিনা। সমাসপুরের বাস ষ্টপটা দেখা যাচ্ছে। কল্যানী বলল,
- তারপর বললে না, এরপর কি কথা হল?
- তারপর আর কি, ও তোমাকে আনতে গেল। চোখে-মুখে ওর ভয়ের ছাপ দেখেছি।

ওরা দু’জনেই সমাসপুর বাস স্টপের কাছে এসে গেছে। আশেপাশে বাড়ীগুলি থেকে অনেকেই ওদের দিকে তাকাচ্ছে। কিন্তু চিনতে পারছে না। আশে পাশে শুভ তাকাল। না, পরিচিত কেউ নেই। উৎসুক কয়েকটি মেয়ে মানুষ এখনো তাকিয়ে আছে।
- কল্যানী, চোখে-মুখে স্বাভাবিক হও। মনে কর, তুমি আমার বোন।
- মনে মনে--
- কি?
- কিছু না।
- ঐ যে গাড়ী আসছে। তাড়াতাড়ি চল-

সমাসপুর বাস স্টপ থেকে তারা বাসে উঠল। যাত্রীরা হা করে তাকিয়ে রইল কল্যানী আর শুভর দিকে। বিশেষ করে কল্যানীকে পুরুষ যাত্রীরা যেন দিব্য ভারতী অথবা শ্রীদেবী ভাবতে শুরু করেছে। এমন সুন্দরী আর এত আকর্ষনীয় কিশোরী যেন তারা জীবনেও দেখেনি। এক মহিলা তো হুট করে বলেই ফেলল,
- তোমরা যাবে কোথায়?
- মাওয়া
- কোন বাড়ী?
একটি যুবক জিজ্ঞাসা করল। শুভর মনে হল, যুবকটি বাড়ীর কথা জেনে এখনি ঘটক পাঠাবে। শুভ উত্তর দিল না। মহিলাটি আবার বলল।
- তোমার কি হয়?
কল্যানী শুভর দিকে তাকাল। শুভও কল্যানীর দিকে তাকাল। শুভর ইচ্ছে করছে বলতে, বউ। কিন্তু পারল না।
- বোন
- ঢাকা থাক?
- জ্বি
যুবকটির প্রশ্নের উত্তর না দেওয়াতে সে অপমান বোধ করছে। লজ্জিতভাবে সে আড়চোখে মেয়েটিকে দেখছে। মহিলাটির ছেলে নাকি? মহিলাটি আরো জানতে চাইছে। ব্যাপার কি? পুত্র নাকি ভাইয়ের জন্য পাত্রী দেখা হচ্ছে না? শুভ ভাবছে আর মনে মনে বলছে, কোন লাভ নাই। চোখ সামনে বাড়ান। আবার প্রশ্ন--
- মাওয়া কোন বাড়ী উঠবে?
বন্ধু ডালুর বাবার নাম শুভ জানে না। অতএব সে চুপ করে রইল। অবস্থা বেশী সুবিধা নয়। মাওয়া থামতেই দু’জনে নামল। রিক্সায় চড়ে মাওয়া বাজারে এল। ষ্টুডেন্ট লাইব্রেরী থেকে একটা কলম কিনে একশত টাকার নোটটা ভাংতি করল। গাড়ীর সেই যুবক ছেলেটি ওদের পিছনে। কল্যানী শুভকে দেখাল।
- যাও, ছেলেটাকে বল, আপনি কি পাত্রী খুঁজছেন?
- যা, চল--
হাঁটতে হাঁটতে ওরা বন্ধু ডালুর বাসায় এল। বাড়ীর সবাই দু’জনকে হরিণ চোখা দৃষ্টিতে দেখছে। ডালু বাসায় নেই। ঢাকা চলে গেছে গতকাল। মুন্সীগঞ্জ-বিক্রমপুর ভবনে গেলে বন্ধু ডালু, হুমায়ুন কবীর, রবিন, ফিরোজÑওদের সবাইকে পাওয়া যাবে। বিয়ের ব্যাপারে ওদের সাহায্য নিতে হবে। চিন্তা করতে করতে রিক্সায় চড়ে ওরা মাওয়া এল। মাওয়া থেকে ব্রাহ্মণগাও হাইস্কুলের প্রদীপের দোকানে নামল। প্রদীপ ওদের দু’জনে দেখে অবাক।
- কি ব্যাপার শুভ?
- প্রদীপ দা, কাল কি ঢাকা যাবেন?
- হ্যা, মাল কিনতে যাব। কেন?
- রবিন, হুমায়ুন ওদের যাকে পান, বলবেন আমি কাল বিকালে ওদের ওখানে যাব।
- তুমি এই রাতের বেলা কোথায় যাও?
- রিনা আপার বাসায়।
- মেয়েটা কে?
- বিয়াইন
- ও

কথা না বাড়িয়ে ওরা রিক্সা চড়ে ঘোড়াদৌড় এল। শ্রীনগর ডিগ্রী কলেজের ছাত্র প্রদীপ। পড়ালেখাও করে--ব্যবসাও করে। রবিন, কবীরÑওর খুবই ঘনিষ্ট বন্ধু। ডালু, ফিরোজ অবশ্য ততটা ঘনিষ্ট নয়।

এখানে এসে তারা বিপদে পড়ে। পদ্মার কড়াল গ্রাসে লৌহজং থানার উল্লেখযোগ্য দক্ষিনাংশ বিলীন হয়ে গেছে। দিঘলী, সংগ্রামবীর, ভোজগাঁও, গাঁওদিয়ার অধিকাংশ স্থান পদ্মার পানির তলে। শুভ লৌহজং এর পদ্মার ভাঙ্গন শুনেছে। কিন্তু এমন ভয়াবহ--তা সে কল্পনাও করেনি। যদি রিনা আপাদের শ্বশুরবাড়ী বিলীন হয়ে থাকে, তবে তো বিরাট সমস্যা। গাওদিয়া পর্যন্ত রিক্সা যায় না। ঘোড়াদৌড় থেকে লৌহজং স্কুল পর্যন্ত যাওয়া যাবে। তারপর দেড় মাইল হাঁটতে হবে। স্থানে স্থানে রাস্তা ভাঙ্গা। শুভ একজনের কাছে গাঁওদিয়া যাবার পথ সম্পর্কে জানল। রিক্সায় উঠল। রাস্তার দু’পাশে উদ্ধাস্তুদের ছাপরা ঘর আর ঘরগুলিতে হাঁস-মুরগীর মত আবাল-বৃদ্ধ-বণিতারা বসবাস করছে। ছোট ছোট বাচ্চারা চিৎকার চেঁচামেচি করছে। কয়েক ঘরের মহিলারা অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করছেÑহয়তো স্বামীকে নয়তো পাশের মহিলাকে। দক্ষিন দিক থেকে ঘরের বেড়া, দরজা, চাল কুলিরা বয়ে আনছে উত্তর দিকে। রাস্তায় যেন মেলা মিলেছে। ওদের দু’জনার ভয়, পরিচিত কারো সাথে যেন দেখা না হয়। মানুষেরা পদ্মার ভাঙ্গন দেখে নিজ নিজ গন্তব্য পথে চলেছে। নিজেদের মধ্যে ভাঙ্গন নিয়ে আলোচনা করছে। শুভ, কল্যানীর কারো সে সব আলোচনা শুনার সামান্য আগ্রহ নেই। শুভ মনে করতে চেষ্টা করছে, সে দিনের কথা, যে দিন সে তার চাচাত বোন রিনার সাথে তার শ্বশুর বাড়ী গাঁওদিয়া এসেছিল। রাস্তাঘাট গুলি সে মনে করতে পারছে না। জনে জনে জিজ্ঞাসা করে, তারা বেজগাও হাইস্কুলের পাশের ছোট একটা রাস্তা ধারে এগিয়ে চলল। জনে জনে জিজ্ঞাসা করার একটা সমস্যা হচ্ছে, সবাই কল্যানীর দিকে তাকিয়ে থাকে। পারেতো কিছুটা এগিয়ে দেয়। শুভ ঞযধহশং বলে চলে আসে। রাস্তার এক দোকান থেকে কিছু খাবার কিনে তারা হেঁটে হেঁটে খেতে লাগল। ভয় তাদের এখন অনেক কমে গেছে। এই এলাকায় সন্ধ্যা হওয়ার পরই গভীর রাত নেমে আসে। কল্যানী রাস্তায় জন-মানব দেখছে না। আশেপাশের বাড়ীর মানুষজনও ঘর থেকে বাইরে বের হচ্ছে না। সে ভয় পেল।
- আর কতদূর?
রাস্তাটি ফসলের মাঠের বুক ছেদ করে সম্মুখে চলমান। দু’পাশে ফসল আর ফসল। ঝিঁ ঝিঁ পোকারা অনবরত ডাকছে। কল্যানী শুভর হাত ধরে আছে। শুভ পকেট থেকে সিগারেট বের করে ঠোঁটে চাপাল।
- দোকান থেকে তুমি সিগারেটও কিনেছ! সিগারেট খাবে না।
- তুমি যখন কষ্ট দিয়েছিলে। ঠিকমত চিঠি দিতে না--দেখা করতে না--তখন এই সিগারেট ধরেছি। নেশা হয়ে গেছে। এখন অন্ধকার-ভূত, পেত্নী ধরতে পারে। আগুন থাকলে কেউ আসতে সাহস পায় না।
- ইস, কি দুর্গন্ধ!
- কাল থেকে খাব না, ঠিক আছে?
- এই গন্ধ খাও কি করে?
- কোথায় গন্ধ? তোমার দেওয়া বেদনাগুলি গিলছি, হৃদয়কে জানিয়েছি দিচ্ছি।
- কতদিন জানাবে?
- যতদিন তুমি সুখ না দিচ্ছ।


(চলবে)

No comments:

Post a Comment