স্বপ্নের ডানায় উড়ে ইতিহাসের পথে

জীবনের চলার পথ বড় আঁকা-বাঁকা, উঁচু-নিচু, কন্টকাবৃত আর যৌবনের উত্তাল সমুদ্রপথে ভাঁঙ্গা ভাঁঙ্গা হাজারো স্বপ্নের ঢেউগুলিতে থাকে না কূল, থাকে না কিনারা। তবুও মাঝে মাঝে উঁকি দেয় অবাস্তব ও অসম্ভব কিছু স্বপ্ন। যৌবনের কোন ধর্ম নেই, ভয় নেই, অসম্ভবপর কোন বিষয় নেই; আর তাই যৌবন কোন বাধাঁই মানতে চায় না।

যৌবনের স্বপ্নগুলো ছুঁয়ে দেখতে, অনুভব করতে খুব ইচ্ছে হয়। যদি স্বপ্নের হাত ধরে উড়ে যেতে পারতাম সেই সুপ্রাচীন হরপ্পা-মহেঞ্জোদারো সভ্যতায় অথবা দেখতে পারতাম কিভাবে ইরাক-ইরান-মেসোপটেমিয়া থেকে আর্যস্রোত বাংলা তথা ভারতবর্ষে বয়েছিল, কিভাবে কোনঠাসা হতে হতে বিলীন হয়ে গিয়েছিল অনার্য তথা দ্রাবিড়, কৈবত্য, কোল, ভিল, শবর, পুলিন্দা, কোচ, পোদ প্রমূখ জাতি গোষ্ঠী। কিভাবে সনাতন হিন্দু, জৈন, বৌদ্ধ, মুসলিম ধর্মের আড়ালে হিংস্র, অভাবী, লোভী বিজাতীরা এ বাংলার দ্ধন্ধ সংঘাতহীন শান্ত সোঁদা মাটির কৌম জাতিগুলোকে উদ্ধারের নামে শাসন অথবা উৎখাত করেছিল। কিভাবে বিজাতীয় ধর্মের শাসন এ অঞ্চলের ধর্ম, ভাষা, কৃষ্টি, সংস্কৃতি পরিবর্তন কিবা ধ্বংশ করেছিল্ এবং সময়ের স্রোতে তাদেরকেও পালাতে হয়েছে অথবা হারাতে হয়েছে নিজস্ব ধর্ম, ভাষা, কৃষ্টি, সংস্কৃতি।

বাংলা তথা ভারতবর্ষের প্রাচীন ইতিহাস পড়তে পড়তে আর্য-অনার্য, দ্রাবিড় জাতি; মৌর্য-গুপ্ত-পাল-সেন বংশের শাসন ; চন্দ্রগুপ্ত (ও তার প্রধানমন্ত্রী চাণক্য পন্ডিত)-অশোক-সমুদ্রগুপ্ত-শশাংক-গোপাল-ধর্মপাল-দেবপাল-রামপাল-বল্লাল সেন-লক্ষণ সেন--পরাক্রমশালী সম্রাট আর রাজাদের ভীড়ে আমার যৌবন বারবার ছুটে চলে ৭৫০--১১০০ সাল পর্যন্ত চর্যাপদের সময়কালে। এই সময়টিতে বৌদ্ধ ধর্মের মহাযান শাখাটি বজ্রযান, সহজযান ও কালচক্রযানে ভাগ হয়ে যায়। এর ফলে কঠিন চীবর দানের এই কঠিন ধর্ম থেকে প্রায় চুরাশী জন সিদ্ধাচার্যের জন্ম হয়, ছদ্ম নামে তারা জন্ম দেন বাংলার আদি নিদর্শন চর্যাপদ। ছদ্ম নামের সিদ্ধাচার্যরা হল লুই পা, কাহৃ পা, কুক্কুরী পা,শরহ পা, বিরুপা, শবরী পা, তিলো পা, বীণা পা, ধাম পা, ভুসুক পা, চাটিল পা প্রমুখ। এদের মধ্যে লুই পা,শবরী পা, কুক্কুরী পা, বিরু পা, তিলোপা বাঙ্গালী ছিলেন। এদের লেখাগুলো কেন বাংলা তথা ভারতবর্ষের বাইরে নেপালের রাজদরবারে আশ্রয় নিয়েছিল? ঐ সময়ে কি হয়েছিল এ বাংলায়? সম্রাট অশোক থেকে সম্রাট রামপালের বৌদ্ধ সাম্রাজের সূর্য কিভাবে অস্তমিত হল? লুই পা,শবরী পা, কুক্কুরী পা, বিরু পা, তিলোপা-- ছদ্ম নামের এই বাঙ্গালীরা বাংলার কোথায় জন্মেছিল, কিভাবে সংস্কৃতকে বাদ দিয়ে নিজেদের মুখের ভাষার কাছাকাছি শব্দ দিয়ে কবিতা গান লিখেছিল--ভাবতে বিস্ময় লাগে! লুই পা’র চর্যা১ঃ কাআ তরুবর পঞ্চ বি ডাল। চঞ্চল চীএ পইঠৌ কাল।।... কুক্কুরী পা’র চর্যা-২ঃ দুলি দুহি পিঠা ধরণ ণ জাই। রুখের তেন্তলি কুমহীরে খাই।।... তিলো পা’র চর্যাঃ...জই ণগগা বিঅ হোই মুত্তি তা সুণহ সিআলহ লোমুপ্পাড়ণে অত্থি সিদ্ধি তা জুবই-নিতম্বহ...। ঢেণ্ঢন পা’র চর্যা--৩৩ ঃটালত মোর ঘর ণাহি পড়বেষী। হাড়ীত ভাত নাঁহি নিতি আবেশী।।...

কত পুরাতন অথচ কি আধুনিক ধ্যান-ধারণা। কত সহজ কথায় কি জটিল ধর্ম জ্ঞান তত্ত্ব শতাব্দির পর শতাব্দি ধরে ভক্ত-শিষ্যদের দান করে চলেছেন। খুব ইচ্ছে হয়, যদি দীর্ঘ আয়ু নিয়ে ঐ সময়ে যাওয়া যেত, তাহলে ফিরে এসে বাংলা সাহিত্য ভান্ডার কানায় কানায় পূর্ণ করে দিতাম।

No comments:

Post a Comment