শারদীয় পূজার গল্পঃ অকালবোধন

অস্তায়মান গোধূলীর সূর্য্যটা দিগন্তে মিশে গেছে। তবে পশ্চিমাকাশে সূর্যের রক্তিম আভা তখনও শ্মশানের শেষ অগ্নির মত জ্বলছে। ঠাকুর বাড়ীর ভিতরে ও বাহিরে ধীরে ধীরে নিরবতা নেমে আসছে। পুরনো ভগ্ন দালানের দেয়াল ঘেঁষে বট গাছ আর শিমুল গাছ পূর্ব ঐতিহ্য আর হারানো স্মৃতি নিয়ে আকাশ পানে চেয়ে আছে; মনে হয়, অতীতের গল্প আকাশকে শুনাচ্ছে, যেন, ইথারে ইথারে সে গল্প ছড়িয়ে যায়, সবখানে। নাম না জানা কোন পাখি হয়তো এই দেয়ালের উপর বসে আনমনে মলত্যাগ করেছিল, কিছু মল দেয়ালে লেগেছিল। দেয়ালকে আশ্রয় করে সেই কবে এই বটগাছ জন্মেছিল--কেউ তা বলতে পারে না। শুরুতে দেয়াল বট গাছকে আশ্রয় দিয়েছিল এখন বটগাছ দালানসহ দেয়ালকে আষ্টে পিষ্টে জড়িয়ে রেখেছে, যেন দেয়াল বটগাছকে ছেড়ে ভেঙ্গে-চুঁড়ে পড়ে না যায়। মনে হয়, বট গাছের অকৃত্রিম কৃতজ্ঞতা প্রকাশ। মাটির উপর সমান্তরাল বটগাছের মোটা দুই শিকরের মাঝে ছোট চাল দেওয়া মন্দিরে কয়েকটা দেব-দেবীর মুর্তি স্মিত হাসিতে চেয়ে আছে দক্ষিণ দিকে। যেন, কোন পুজারী কিবা তাদের প্রেমে ভক্ত প্রিয়জন চরণ ধুলি নিতে আসবে। ঠিক তাই-ই। এই দক্ষিণের স্যাঁতস্যাঁতে মাটির উপর পা ফেলে ফুটফুটে জ্যোৎন্সার মত নিষপাপ একটি তের বৎসরের পিতৃহারা বালক প্রতি সন্ধ্যায় ধূপ-শিখা আর সামান্য অর্ঘাদি নিয়ে পুজো করে। অর্ঘাদি নিবেদন করে কি যেন বলতে থাকে বিড়বিড় করে। পুজোর শেষে দেবীর চরণে লুটিয়ে পড়ে। ওর বিধবা মা ওকে পুজোর ব্যাপারে সাহায্য করে।

এই পুরুনো বনঝোপে ঘেরা ঠাকুর বাড়িতে ওরা দু’টি প্রাণী--মা ও ছেলে টিনের একটি ঘরে বৃষ্টির সময় বৃষ্টিতে ভিজে জ্যোৎন্সা রাতে চাঁদের আলো উপভোগ করে দিন যাপন করে আসছে অনেকদিন থেকে। পুরানো দালানের প্রায়ই ইট ঘঁসে পড়ে। তাছাড়া ওখানে অনেক বিষধর সাপ বাস করে। তাই ওরা ওখানে থাকে না। একসময় পুরো ঠাকুরবাড়ী লোকে পরিপূর্ণ ছিল। ঘরে ছেলে-মেয়েদের চিৎকার, রান্না ঘরে রাধুনীর চিৎকার, উঠোনে বউ-শ্বাশুরীর খোশগল্প, বাইরে মনিব ও চাকরের শশব্দ কথোপকথন। আজ আর সেই কোলাহল নেই। সব থেমে গেছে ধীরে ধীরে। সবার মাথায় যবন ভুত চেপেছে। ক্রমাগত সবাই কোলকাতা চলে যাচ্ছে অথচ কোলকাতার যবনদের মাথায় হিন্দু ভূত চাপা স্বত্বেও কোন যবন আমাদের গ্রামে এসেছে বলে শুনি নাই। বাংগালী হিন্দুদের ধারণা এদেশে যবনদের জন্য থাকা যাবে না। ভারতে সুখ-শান্তি ভরপুর। জিনিষের দাম কম। কিন্তু কেউ বুঝে না, সেখানে পয়সা রোজগারের কি অবস্থা!

কি জানি, হয়তো স্বর্গপুরী ভারতেই অবস্থান করছে; পাসপোর্ট করেই স্বর্গে যাওয়া যাবে। আর তাই হয়তো একদিন কল্যাণরাও কোলকাতা চলে যাবে। যাবেইতো, ব্রাহ্মণের ছেলে কল্যাণ; পুজোই যদি তার কপালে না জুটে, তবে পয়সা পাবে কোথায়? খাবে কি? বাঁচবে কি করে? এমনি করে কল্যাণীদের মত মেয়েদের বিয়ে দিতে যদি উপযুক্ত কায়স্ত ছেলের অভাব হয় তবে তার মত মেয়েরাও কোলকাতা চলে যাবে। কুমার যদি মুর্তিই বিক্রি করতে না পারে--তবে বাঁচবে কি করে। ধর্ম-কর্ম নিয়ে মানুষের এই বিড়ম্বনা, মানুষের এই দেশ ত্যাগ থামবে না বলেই--বাংলাদেশে মাঝে মাঝেই ধ্বনী উঠে ‘চল চল কোলকাতা চল--চল চল ভারত চল।’

‘শ্রীবৃক্ষে বোধযামী ত্বাৎ যাবৎ পুজাৎ কারোম্য হম...।’--এই সংস্কৃত পাঠশেষে আজ সন্ধ্যাবেলা কল্যাণ মন্দিরে পুজো করার পর নমস্কার দিচ্ছিল। ঠিক এই সময়ে পাছে কার যেন মৃদু শব্দ পেল। মাটি থেকে সদ্য পুজারী মাথা উঁচু করে বলল, ‘কিরে কণী এই সন্ধ্যেবেলা এখানে কেন এসেছিস?’ কণী কোন উত্তর না দিয়ে মন্দিরের মাটির উপর ভাসমান স্বচ্ছ ঘটের জল মাথায় ছুঁয়ে দিয়ে হাতটা পিছনে নিয়ে গেল। যেন, সে সদ্য পুজারিণী এমন ভংগীতে কল্যাণের চরণ ধুলি গ্রহণ করল। এরকম ভক্তি কণী ওর মাসীমার কাছে শিখেছে। কল্যাণ ওর দু’হাত ধরে উঠাল। তারপরে ওর চোখের কাছে মুখ নিয়ে বলল ‘কিরে ব্রাহ্মণের ছেলে ভেবে নমস্কার দিলি নাকি দেবতা জ্ঞান করে।’ দশ বছরের এই বালিকার লজ্জা হাসিতে যেন দেব-দেবীর মূর্তিরাও লজ্জা পেল। হঠাৎ করে ওদের মাখার উপর দিয়ে হালকা ঝড়ো বাতাস বয়ে গেল। বটবৃক্ষের শাখা-প্রশাখা থেকে একরাশ পাতা ওদের দু’জনার উপর ঝড়ে পড়ল। সুবাতাস বইতে লাগল গুন গুন গান গেয়ে। ‘তা জানিনা কল্যাণদা, তবে তোমাকে একদিন দেবতার মত পুজো করতেই হবে।’ যেন কণীর হৃদয় কণীকে বলে দিয়েছে--এই তোমার জীবন দেবতা।

হাতে একরাশ চুরি , কানে দুল, ছোট কচি সাদা ধবধবে পায়ে পিতলের ঘুঙুর, চুল গুলো মেঘের চেয়ে কালো আর মুখ বদন--হৃদয়ের সত্যিকারের ভালবাসার মত পবিত্র। নাকটা কিঞ্চিৎ লম্বা আর সরু--দু’নয়নের মোহনায় এসে মিশে গেছে। একটি সুন্দর মেয়ে যেমন সুন্দর, পবিত্র পরিবেশে আরো সৌন্দর্য মন্ডিত হয়ে ওঠে যা ধরা দেয় সৌন্দর্যের পুজারীর কাছে। এখানে সেই সৌন্দর্য কল্যাণের চোখে মুখে ছোঁয়া দিলেও হৃদয়ে অনুভব করার মত বোধজ্ঞান তার নাই। এই বিষয়ে বয়স নারীকে যতটা অগ্রগামী করে পুরুষকে ততটা করে না। ঝর্ণা ধারার মত প্রবাহমান সেই সৌন্দর্যের আংগিকে কল্যাণীর ছোট ঠোঁট রাংগা হাসি যেন সদ্য পুজারীকে একটি প্রশ্ন করতে চায়--বলতো আমি কেমন?

কল্যাণী কল্যাণের ঘাড়ে দু’হাত রেখে দুষ্টু ভংগিতে ফোঁকলা দাঁতে বলতে লাগল, ‘ঠাকুর দাদা আজ শনি বার। মাসীমার তুলসী গাছে শনি ধ্বনি দিয়ে মাসীমাকে শনি পাপ থেকে উদ্বার কর।’ ‘ও হ্যাঁ, আমার মনেই ছিল না। তুই একটু দাঁড়া, এগুলো আমি ঘরে রেখে আসি।’ কল্যাণী শাড়ীর আঁচলটা কোমরে এঁটে বলল, ‘দাদা, আমার কাছে ধুপটা দাও। তুমি এগুলো নাও।’ এগুলো মানে ঠাকুর বাটাতে রাখা বাতাসা আর পেঁপের টুকরো । কল্যাণ অর্ঘ্যাদি থেকে পেঁপের টুকরো হাতে নিয়ে বলল, ‘কণী হা কর।’ ওরা হাঁটতে হাঁটতেই প্রসাদ খেতে লাগল। ঘরের বারান্দায় সব রেখে কল্যাণ কল্যাণীর হাত ধুয়ে দিল, নিজের হাতও ধুয়ে নিল। কল্যাণীর পায়ে স্যাঁতস্যাঁতে মাটির কাদা লেগেছে। কল্যাণী পায়ের কাপড়টা উঁচু করে ধরল, কল্যাণ পায়ে পানি ঢেলে দিল। কাদা সরে গেল। কল্যাণ হাসতে শুরু করল চেপে চেপে। ‘কল্যাণদা হাসছ কেন বলনা ?’ ‘তোর হাত-পা-মুখ সরস্বতী দেবীর মত সুন্দর। কুমার ভগবান তোকে নিজের হাতে বানিয়েছেন।’ যা সত্য কল্যাণের নিষ্পাপ হৃদয় তাই ব্যক্ত করেছে। এখানেই নেই কোন ছলনা--নেই কোন প্রবঞ্চনা। এ কথা শুনার পর শরতের আকাশের মত নির্মল কল্যাণীর মুখ বলতে চাইলো--তুমি ও তো সুন্দর। একথা বলা যায় না,বুঝে নিতে হয় চোখ মুখ আর প্রশান্ত হাসির পট দেখে। কিন্তু তা কি কল্যাণের হৃদয়ে ছোঁয়া দেয়?

এই কণীর মা বাবা কেউ নেই। ও ওর মাসী বাড়ী থাকে। কল্যাণ যাকে কাকী বলে সম্মোধন করে। ওর পুরো নাম কল্যাণী রানী দাস। সবাই ওকে কণী বলে ডাকে। কল্যাণ আজ ওর স্বর্গীয় বাবার ধুতি পড়েছে দুই ভাঁজ করে আর গায়ে ডোরা কাটা গেঞ্জি। কণীর গায়ে ছোট গোলাপী শাড়ী। পাইড়টা সবুজ রংয়ের উপর লাল ডোরা রেখায় ঘেরা। দু’জনের মুখে মিষ্টি হাসি। হাত ধরে দৌড়ে দু’জনে ছুটছে সবুজ ঘাসের সরু রাস্তা ধরে। দু’পাশে ধঞ্চে গাছ। কাকী বাড়ী ওদের বাড়ী থেকে এক পুকুর দুরে। আপন না হলেও কাকী কল্যাণকে খুব আদর করে। গতবারের দুর্গাপুজায় ওর কাকী ওকে একটি লাল জামা দিয়েছে। দু’দিন পরে দুর্গা পুজো আসছে। বাড়ীর কাছাকাছি এসে কণী কল্যাণের হাত চেপে বলল,
ঃ থাম দাদা, একটা কথা বলব
ঃ কি কথা ?
ঃ আমাকে পুজো করতে শিখাবে। তুমি যখন পুজো কর ,আমার খুব ভাল লাগে। মনে হয়, আমি যদি--। দাদা দেবতার কাজে তুমি কত কি বল, দেবতারা তোমাকে কি বলে?
ঃ অনেক কিছু বলে।
ঃ কি বলে?
ঃ তোকে বলা যাবে না। আরো বড় হ তুই তখন বুঝবি।
ঃ তুমি বুজি খুব বড়? এই মেপে দেখ না তোমার কান পর্যন্ত আমার মাথা ঠেকেছে।

ধ্যাৎ শব্দটায় জোড় দিয়ে কল্যাণ হাটতে শুরু করল। কণীর দিকে তাকিয়ে বলল, আমার সাথে বল-
সরস্বতী মহাভাগে
বিদ্যে কমললোচনে।
বিশ্বরূপেবিশালাক্ষী
বিদ্যাংদেহি নমস্তোতেঃ।।
দু’পাশে ধষ্ণে পাতারা ঘুমিয়ে পড়েছে সারাদিনের ক্লান্তি পেরিয়ে। কিছু প্রজাপতি ঘাসের ডগায় বসে কি যেন কানে কানে ঘাসের কাছে বলে। ধীরে ধীরে আঁধারের নিরব ছোঁয়ায় প্রকৃতিতে নিরবতা নেমে আসছে। কাছের কয়েকটা বাড়ীতে উলো উলো জোকার ধ্বনি শোনা যাচ্ছে। বলাকারা নারিকেল গাছের পাতার আড়ালে সারাদিনের হিসেব বুঝে নিচ্ছে। বাদুর পাখীর পাখা ঝাপটানিতে আঁধারের মুর্তি এখনি যেন চলে আসবে।

চঞ্চলা, ঝর্ণার মত নৃত্য পটিয়সী, লাস্যময়ী কল্যাণী বেশীক্ষণ স্থির থাকতে পারেনা। কল্যাণদাকে সে এক সপ্তাহ পর পেয়েছে। সে কথা বলতে চায়। কিন্তু কি বলবে। না সকালে জেঠিমা মাসীমাকে যা বলেছে তাই কল্যাণকে বলবে। ইস্! সে কথা বলা যায়। নিজের কাছে নিজেই প্রশ্ন করে আর ছোট ছোট উত্তর খুঁজে। যেন কল্যাণীর নিজের কাছে প্রশ্ন, বলে দেখিনা কি হয়? আবার কয়দিন পর দেখা হবে? যেন কত যুগের প্রতিক্ষমনা নদী আজ নদের ছোঁয়ায় পেয়েছে জল, পেয়েছে ভালবাসা, পেয়েছে নব জীবন। ‘না বলা কথা বলতে না পারা’--কি যে কষ্ট দেয় সেটা প্রেমাশক্ত মনই বুঝতে পারে। কল্যাণীর খারাপ লাগছে। চোখ বন্ধ করে কল্যাণী বলতে শুরু করল--
ঃ কল্যাণ দা, জেঠীমা আজ খুঁচি বানাতে বানাতে মাসীমাকে কি বলেছে জানো?
ঃ কি? কি বলেছে?
ঃ বলতো কাপড় পড়েছি কেন?
এবার ভাল করে তাকালো কল্যাণ।
ঃ বারে, শখ করে কাপড় পড়ে না বুঝি? তাছাড়া তুই যখন বউ হবি তখন তোকে সব সময় কাপড় পড়তেই হবে।
মুখ হাত দিয়ে ঢেকে, ফোঁকলা দাঁতে হিঃ হিঃ করে লজ্জা অথচ আনন্দের হাসি হেসে কণী বলল ,
ঃ কি বললি দাদা?
ঃ কি?
ঃ ঐ যে বললি?
ঃ বউ? বারে বউ বললে হাসির কি আছে?
ঃ না, ইয়ে--জেঠীমা ঐ কথাই বলেছে।
ঃ কি বলেছে, বল?
কল্যাণ ওর কান চেপে ধরল। কোনমতে হাতটা ছাড়িয়ে কল্যাণের মুখের দিকে চেয়ে লজ্জা পেয়ে দৌড়ে দিল। এক দৌড়ে বাড়ীর নারিকেল গাছের নীচে এসে কণী দাঁড়াল। হাত জোড় করে ক্ষমা চাওয়ার ভংগীতে বলতে লাগল।
ঃ ও কথা বলতে পারব না, বলব না--।

দূর থেকে গান ভেসে আসছে--‘মাগো আনন্দময়ী নিরানন্দ হইওনা...।’ আধ মাইল দুরে ঘোষ পাড়ায় দূর্গাপুজা চলছে। ডোলের শব্দে চারিদিক জয় জয় দূর্গা ধ্বনিতে মেতে উঠেছে। কল্যাণীদের উঠানে বিচিত্র আলপনা। ওদের পুকুরের তীর ছুঁয়ে অনেক ডোল কলমী গাছ। কল্যাণ কণীর ভাই রামকে নিয়ে দক্ষিণের জানালায় সম্মুখে পুকুর ঘাটে পায়চারী করছে। কল্যাণ ডাকাতে শুরু করল, কণী তোমার হয়েছে? দক্ষিণের জানালার ফাঁক দিয়ে কাপড়ের আঁচলটা দেখিয়ে কণী ঠোঁট রাংগা হাসিতে চোখ বন্ধ করে বুজিয়ে দিল, হয়েছে। তারপর মায়ের উদ্দেশ্যে বলতে লাগল, মা আমি পুজোয় গেলাম।

ঘর থেকে ধান দূর্বা নিয়ে লক্ষী মানে কল্যাণীর মাসিমা উঠোনে এসে বলল,
ঃ যাবি কিরে? ধান দূর্বা নিয়ে যা । ও কল্যাণ এখানে আয়।
কাকীমার ডাকে কল্যাণ কাছে গেল। এরপর দু’জনের মাথায় ধান দূর্বার সাথে লক্ষী অদৃশ্য আর্শীবাদ দিল। দু’জনে দু’জনার দিকে চেয়ে হাঁসতে লাগল। তারপর দু’জনে লক্ষীকে প্রণাম করল।
ঃ থাক, বেঁচে থাক। ভগবান তোমাদের মঙ্গল করুন। তাড়াতাড়ি চলে আসিস বাবা। রামকে তো নিয়ে যাচ্ছিস। কাঁদে কি না? নে, এই টাকাটা নিয়ে যা। সবাই কিছু কিনে খাস।

পুজো দেখে দু’জনে বাড়ি ফিরতে লাগল। পথে যেতে কণা বলল, দাদা এতগুলো দেব-দেবী, কাকে পুজো করলে কি হয়? কল্যাণ ওর মুখ পানে তাকিয়ে রামকে বলল, রাম এবার তুমি হাট। রাম কল্যাণীর কোল থেকে নেমে হাটি হাটি পা পা করে এগোচ্ছে। তারপর বলতে শুরু করল,আমি ভাল করে জানিনে কণী। বাবা আগে বলত, দূর্গা শক্তি আর ধন সম্পদের
দেবী, লক্ষী টাকা পয়সা আর শান্তির দেবী, সরস্বতী বিদ্যা আর জ্ঞানের দেবী। গনেশ পুজো করলে দোকানদাররা লাভবান হয় আর কার্ত্তিক শত্রু দূর করে। বাবা বলত সরস্বতী গান, সুর, বিদ্যা, জ্ঞান--অনেক কিছু দেয়, যদি তাকে পুজো করে সন্তুষ্ট করা যায়।
ঃ তা হলে তুমি আমায় সরস্বতী পুজা শিখিয়ে দাও না। প্রতি সন্ধ্যায় আমি পুজো করব।
কল্যাণ হাসতে লাগল।
ঃ কি শিখাব?
ঃ ঐ যে তুমি কি যেন বিড়বিড় করে বল, তা শিখিয়ে দাও ।
ঃ শিখিয়ে দেব কিরে, লক্ষী, সরস্বতী কাছে ওদের ভাই কার্ত্তিকের মতো বর চাইবি।
কল্যাণী লজ্জা পেয়ে যা-শব্দটি করে রামকে কোলে নিল।
ঃ কল্যাণদা,তুমি সরস্বতীর মতো বউ পাবার আশায় পূজো কর। আমি কিন্তু পূজো না করেই কার্তিকের মতো বউ পেয়ে গেছি।


হাঁয় একি! একি বলে ফেলল। যার মুখ থেকে যা বেরোয় না হাজার চেষ্টায়, বুক ফেটে গেলেও। সে আজ...। কি খুঁজে পেল কল্যাণী কল্যাণের মাঝে। ওরা তো ছোট, কি বুঝে-- তবুও একজন একজনকে কাছে পেতে ইচ্ছে করে। কোন আত্মীয়তার টানে? না ওদের মাঝে রক্তের কোন সম্পর্ক নেই--তবুও ওরা পৃথিবীর বুকে বড় আপন হয়ে কবে যে সময় এর সাথে চলতে শুরু করেছে, তা সময়ই জানে। ওদের গল্প গুজবে কোন ছলনা নেই। দু’হৃদয়ের মাঝে অবুঝ ভালবাসা হয়েছে সেতু। সেতুর শক্ত পথে ওদের আশা-আকাঙ্খা, হাসি-কান্না নদীর স্রোতের মত প্রবাহিত হয়। এই স্রোতে কোন ভাটা নেই।


ঐ সময়ের নিরব প্রকৃতিই কল্যাণীর মুখ থেকে ‘না বলা কথাটি’ বের করেছে--যা জমে বরফের মত শক্ত হয়ে কন্ঠনালীতে জমে ছিল, যা ওকে এতদিন দ্বিধান্বিত করতো--বলবে, কি বলবে না। দূর্গাপুজার বাদ্যের আওয়াজ শুনা যাচ্ছে। কণীর মনে হচ্ছে, দূর্গা লক্ষী সবাই যেন, তাদের দেখে হাসছে। কল্যাণী রামকে নামিয়ে ভয়ে ভয়ে কল্যাণের পা ছুঁয়ে প্রনাম করে কি যেন বলতে যাচ্ছিল। ঠোঁট দু’টি কাঁপতে শুরু করেছে। দক্ষিণা বাতাসে ওর চুলগুলি এলোমেলা হয়ে যাচ্ছে। পায়ের ঘুঙ্গুর বাজতে শুরু করেছে। যেন ঘুঙ্গুর বলতে চাচ্ছে, কণী, তুমি দৌড় দাও।


দু’পাশের ধষ্ণে গাছগুলিতে মৃদু বাতাস প্রবাহিত হচ্ছে। প্রজাপতি উড়তে লাগল ঘাস থেকে ঘাসে । শরতের আকাশে কল্যাণ দেখতে পেল কালো মেঘের কালিতে লেখা--‘জয় মা দূর্গা’। গোধূলী লগ্নের শ্র“ভ্র বলাকারা উড়ে যাচ্ছে দুর অজানায়। পঁচা ডোবায় জলকেলিরত শ্র“ভ্র হাঁস। পশ্চাতে তাকিয়ে কল্যাণ দেখতে পেল সন্ধ্যার সুর্যটা পশ্চিমাকাশে ডুবন্তমান। লাল আভা পশ্চিম দিগন্তজুড়ে খাঁ খাঁ করছে। কখনো সেই আভায় মেঘ খন্ডগুলোকে চিত্রকরের আঁকা ছবি, ভেঁজা তুলার স্তুপ, পাহাড়, দ্বীপ--নানান রুপে দেখা যাচ্ছে।

No comments:

Post a Comment