ধারাবাহিক উপন্যাসঃ কাকভোর পর্ব-১

কাকভোর
--শাশ্বত স্বপন

সকাল বেলা। হাঁস-মুরগী আর বিচিত্র পাখিদের কলরব। গোয়াল ঘর থেকে একটি গরু হাম্বা-হাম্বা করে চিৎকার করছে। গোয়াল ঘরটার পিছনে ঘন বনঝোপ। ভুলেও কেউ রাতে তো দূরের কথা, দিনেও যেতে সাহস পায় না। সবাই বলে, বনঝোপ গোখরা, দুধরাজ, দু’মুখো সাপ ইত্যাদির বাসস্থান--শিয়াল, বাঘডাসা, বেজি, ইঁদুর ইত্যাদি প্রাণীতো আছেই। গরুর দুধ খেতে এসে দুধপেয় সাপ প্রায়ই গণপিটুনীতে মারা যায়। এই ঘনঝোপে, গাবগাছের মাটির উপর ভাসমান শিকড়ে মাথা রেখে বিভৎস্য শান্তিতে একটি মেয়ে ঘুমিয়ে আছে। ভোর বেলা শিয়ালের পাক্কা হুয়া-হুয়া ডাক এ বাড়ীর সকলের মনে ভয়ের আশঙ্কা সৃষ্টি করেছিল। এ বাড়ীর একটি ঘরের দরজা সেই মাঝ রাত থেকে খোলা। হ্যাঁ, এই ঘর হতেই চিরতরে একটি মেয়ে বের হয়েছে। এই ঘরটা উত্তরে, এর সাথে গোয়াল ঘর। পাশে আরো দু’টি ঘর। একটি দক্ষিণে, অন্যটি পশ্চিমে।

দরজা খোলা ঘর হতেই প্রথমে এক বিধবা বৃদ্ধার ভাঙ্গা গলার স্বর শোনা গেল। বৃদ্ধা রাম নাম জপতে জপতে তূলসী তলায় অল্পক্ষণ ধ্যান করে দক্ষিণ ঘরের দরজা ধাক্কা দিয়ে বলতে লাগল, “ওরে কালীপদ, কালী কোথায়? ঘুম থেকে উঠেই দেখি দরজা খোলা। পায়খানার দরজাও খোলা। এই সাত সকালে মেয়েটা কোথায় গেল ? কোথাও তো দেখছি না । ওরে কালীপদ, দরজা খোল। ” দরজা খুলে বের হল একজন পুরুষ, একজন স্ত্রীলোক ও একজন বালক। রাতে মেয়েটি ভাত খায়নি। বৃদ্ধার সাথে ঠাট্রা করতে করতে ঘুমানোর ভান করেছে। সকলের সন্দেহ হল--শুরু হল খোঁজা। কালী-- কালী--রবে প্রতিধ্বনি হচ্ছে বারবার । যখন দেখা গেল গরুর গলায় দড়ি নেই, তখন সবাই গাছে গাছে খুঁজতে লাগল। অবশেষে, বনঝোপের গাবগাছের নীচে পাখি, বেজি, শিয়াল এর চিৎকার আর মাত্রাতিরিক্ত চলাচল লক্ষ্য করে সবাই ঝোপের দিকে এগোল। সবাই দেখল, এক বিভৎস্য সুন্দরী নারীকে!
হ্যাঁ, কালী। এই গল্পের কালী। চির শায়িতা কালী--এই বনঝোপের গাবগাছের নীচে। না, হিন্দুদের দেবী কালী নয় বা সে রকম কোন পূরানের গল্পও নয়--এ পৃথিবীর কালী--অভিশপ্ত এক মানবী--কালো যার গায়ের রং--কদাকার যার সাড়া অবয়ব--দ্রোহে যে পরাজিত হয়েও জয়ী। পরম স্রষ্টা নারী ‘হাওয়া’র বেশী দোষ বলে হয়তো নারী জাতির নরক স্থান পৃথিবীতে তৈরী করেছেন। নারীকে করেছেন বেদনার প্রতিমূর্তি, সহ্যধারী, কান্নার প্রতীক। আবার করেছেন হিংস্র বাঘিনী। তবুও তো অভিশপ্ত নারীজাতি। আর এমনি এক অভিশপ্ত নারী কালী--যার আসল নাম উষা। যে উষারা নারীত্বের সীমাহীন জ্বালা--যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে, বিষাক্ত সময়ের করাল গ্রাসে ধর্ষিতা হয়ে, আঁধারের মাঝে আত্মহত্যার মাধ্যমে সঁপে দেয় অভিশপ্ত জীবন। কালী এমনি এক সময়ের বাস্তব উপমা--নারী জাতির চির চেনা মানবী--একটি প্রতীক--একটি জীবন্ত লাশ।




গ্রীষ্মকাল। সূর্যের সাথে যুদ্ধ করে মেঘ খন্ডগুলো হেরে গেছে। ফলে সমস্ত মেঘ খন্ড হিমালয়ে একত্র হয়ে আবার আক্রমণের প্রস্তুতি নিচ্ছে। এদিকে গ্রাম বাংলার মাঠ-ঘাট ফেঁটে চৌচির হয়ে গেছে। নদী-নালার পানি রেখা একবারে তলায় ঠেকে গেছে। অসংখ্য ফল গাছের ফুলের রেনু রৌদ্রতাপে শুকিয়ে যাচ্ছে। পানির অভাবে ক্ষেতের ফসল কেমন যেন হাহাকার করছে। ভোর হবার পর থেকেই সূর্যের প্রচন্ড তাপ পৃথিবীর বুক জুড়ে দগ্ধ কেয়ামতের সংকেত দিয়ে যাচ্ছে। নিরব নিথর দুপুরবেলা রাখালেরা গাছের ছায়ার গরুগুলিকে বেঁধে গামছাটা শীতল ঘাসের উপর বিছায়ে শুয়ে পড়ে। কৃষক গাছের ছায়ায় বসে লুঙ্গি দিয়ে দেহের ঘাম মুছে, মাথার বিড়া দিয়ে বাতাস করছে। এদের দেখে মনে হয় যেন, আগুন থেকে উঠে এসেছে। হাত-পা মুখ লাল হয়ে আছে রৌদ্রতাপে। গাছে গাছে পাখিরা থেমে থেমে ডেকে চলেছে। অদূরে গরু-ছাগল দু’টিও একটানা ডেকে চলেছে। এর মাঝে দু’একটা ছেলে-মেয়েকে গোবর কুড়াতে দেখা যাচ্ছে । কিছুদূরে দক্ষিণে বড় রাস্তা দিয়ে একটা ছোট ট্রাক যেতেই ধুলি-বালি উড়ে অন্ধকার হয়ে গেল। পথের পাশে বড় বড় গাছের ছায়ায় লুঙ্গি গামছা বিছায়ে পথিক বিশ্রাম করছে। চারদিক হঠাৎ নিরব হয়ে গেলে দূর হতে দুই-একটি ঘুঘুর ঘু-ঘু ডাক শোনা যায়। মনে হয়, এরা যেন বৃষ্টির জন্য স্রষ্ঠার কছে মিনতি করছে। চৌচির মাঠ-ঘাট আর ফসল ক্রমাগত মোনাজাত করে চলেছে স্রষ্ঠার কাছে। মাঝে মাঝে ছোট ছোট ছেলেমেয়ে--কখনও বড়দের কণ্ঠ থেকে ধক্ষনিত হচ্ছে--আল্লা মেঘ দে--পানি দে--ছায়া দেরে--তুই আল্লা মেঘ দে --।

ঠিক এমনি মুহুর্তে চৌরা পাড়ার (যারা নদীর চর বা চরের কাছাকাছি বাস করে) দশ-বারোজন কিশোরী-যুবতী এবং মধ্যবয়সী মহিলা “কুলা ঠান্ডা করতে” কালীদের বাড়ী ঢুকল। কালী উত্তর ঘর থেকে জগ নিয়ে ঘাটে গেল। ঘাট থেকে জল ভরে এনে উঠানে প্রায় সবটুকু ঢেলে দিল আর জগটা ঢেলে দেওয়া পানির কাছে রাখল। মহিলারা তাদের কোলার অগ্রভাগের দুই প্রান্ত মাটির উপর ভাসমান পানিতে ঠেকাল। তারপর গান শুরু করল তারা--আল্লা মেঘ দে--পানি দে--ছায়া দেরে--তুই আল্লা মেঘ দে...। একজন মহিলা আমগাছের কচি ডাল এক কিশোরীর হাতে রাখা জগে ডুবিয়ে ডালটি উঠাল। তারপর ডাল আর ডালের কচি পাতায় লেগে থাকা পানি উত্তর-দক্ষিণ-পশ্চিম--এই তিন ঘরের দরজায় ছিটিয়ে দিল। কালীর মা শেফালী সিঁদুরের কৌটা থেকে আঙ্গুলে সিঁদুর নিয়ে কুলাগুলির অগ্রভাগে মেখে দিল। তারপর কালীর ঠাকুরমা তুলসী দুই টাকা আর কিছু চাউল-পিয়াজ-মরিচ কুলাগুলির একটির উপর রাখল। কুলা নিয়ে সবাই অন্য বাড়িতে চলে গেল। কালী, মিলন ওরা দু’জন ওদের পিছু পিছু গেল। বিকাল তিনটা পর্যন্ত ওরা দলটার সাথে বাড়ী বাড়ী ঘুরেছে আর সুযোগ পেলেই কালী ওদের সাথে গান ধরেছে। এর মধ্যে দলের এক কিশোরীর সাথে কালীর ভাব হয়ে গেছে। কালী জেনে নিয়েছে, ওর নাম লতিফা। লতিফা কালীকে দাওয়াত দিয়েছে বৃহস্পতিবার যেন, সে ওদের বাড়ী যায়। কালী লতিফাকে বলেছে, মা, ঠাকুমা, বাবা বকবে।

সূর্য পশ্চিম দিকে হেলতে আরম্ভ করলে পরাজিত মেঘ খন্ডগুলি সদলবলে দক্ষিণ দিক থেকে প্রচন্ড বেগে ছুটতে আরম্ভ করে। মুহুর্তের মধ্যে শুরু হয় ঝঞ্চা, বিদুৎ চমকায় মুহুর্মুহু, দিগন্ত প্রসারিত হয় বজ্র-নির্ঘোষে, পথের ধূলিকনা ও নদীর তীরের বালুকারাশি বিক্ষিপ্ত হয়ে চারদিক ঢেকে ফেলে। কালী আর মিলন বাড়ীর দিকে ছুটতে আরম্ভ করে। কালীর ঠাকুরমা তুলসী দক্ষিণের সুপারী গাছের কাছে এসে অস্থির চিত্তে কালীকে ডাকছে। মিলন আর কালী দৌড়ে বাড়ীর দিকে আসছে। প্রবল বাতাসে তাদের কথা অস্পষ্ট শোনায়।
 ঐ কালী, তোর ঠাকুমা তোকে ডাকছে। তুই তারাতারি যা--আমি বাড়ী যাচ্ছি।
 ঐ মিলন, ঠাকুমার হাতে লাঠিনারে?
 না, সুপারী গাছ ধরে দাঁড়িয়ে আছে।
বাতাসের প্রবাহে ধূলিকনা তাদের চোখ-মুখে আঘাত করছে। চোখ মিটমিট করে রাখতে হয়। ফলে একটু দূরের জিনিসও ঝাপসা লাগে। কালী দৌড়ে তুলসীর সামনে এসে নাকিয়ে নাকিয়ে কাঁদতে লাগল। তুলসী ওর হাত ধরে চড় দিতে দিতে উত্তর ঘরে নিয়ে গেল।
প্রবল বাতাসে গাছের পাতা ঝরঝর বেগে ঝড়ে পড়ছে। গোয়াল ঘরের গরু ডাকছে। মোরগ-মুরগীগুলি দক্ষিণ ঘরের পাটাতনের নীচে ভয়ে জড়ো-সরো হয়ে আছে। কালীর মা শেফালী খোয়াড়ের দরজা খুলে দিতেই সব হাঁস-মুরগী খোয়াড়ে ঢুকে গেল। তুলসী কালীকে বকছে,
 কালো মেয়ে, সেই দুপুর বেলা গেছে, এখন আসছে। গাছ-পালা ভেঙ্গে পড়ছে। ঐ তোর মাথার উপর একটা ডাল যদি পড়ত। কোথায় গিয়েছিলি, বল?
কালী তুলসীর পা ধরে বসল। ছোট ভাই জয়ও কাঁদতে শুরু করল ভয়ে ।
 ঐ, তুই কাঁদছিস কেন ?
তুলসী জয়কে সান্তনা দিয়ে শেফালীকে ডাকছে --
 বৌ,বৌ দক্ষিণ ঘরের জানালা আটকে দাও। এঁচলা আসছে।
 মা- পশ্চিম ঘরের বাইরের শিকল লাগিয়েছেন ?
 হ্যাঁ
ঝড়ের তান্ডব লীলায় গাছ-পালার শাখা- প্রশাখা ভেঙ্গে যাচ্ছে। কিছু কিছু উঁচু ভিটির গাছের গোড়া সহ উঠে যাচ্ছে। বাঁশবন ধরাশায়ী হয়ে পড়ছে পাখিদের বাসা ভেঙ্গে যাচ্ছে। এরা ঝড়ের বাতাসে উড়ছে। নিজেদের গতি ঠিক না রাখতে পেরে চিৎকার করছে। কালীদের উঠান লতা-পাতা আর বিভিন্ন ময়লায় ভরে গেছে। তুলসী উত্তর ঘর থেকে আর শেফালী দক্ষিণ ঘর থেকে ভগবানকে ডাকছে।
 হরি বল, হরি বল পবন ঠাকুর বয়ে যাও...বয়ে যাও...হরিবল --হরিবল--

হিন্দুদের ঘরে ঘরে শঙ্খের আওয়াজ শোন যাচ্ছে। কালী ঘরের পূর্ব দিকের জানালা খুলে বাইরের অবস্থা দেখতে লাগল ।দূর থেকে আযান ও ভেসে আসছে। কালী, জানালা খোলা রেখে মিলনদের বাসার দিকে আগে তাকাল। ঝাপসা লাগে,কিছুই বোঝা যায়না। দীপাদের বাসার দিকে তাকাতেই প্রবল বাতাস এসে জানালায় আঘাত করল। ফটকের আঘাতে কালীর কপাল ফুলে গেল।
 আহ্! তুই জানালা খুলছিস কেন ? পবন ঠাকুরকে ডাক --
পবন ঠাকুর -- বয়ে যাও -- বয়ে যাও --
জয় ভয়ে তুলসীর গলা জড়িয়ে ধরে আছে। কালী ব্যাথায় কাঁদছে। তুলসি আর শেফালী পবন ঠাকুরকে ক্রমাগত ডেকে চলেছে।
দুপুর আর সন্ধ্যার মাঝামাঝি হল বিকাল। পূর্বাকাশে আবছা রংধনু উঠেছে। মেঘের গুড়–ম গুড়–ম শব্দের ফলে পুকুর হতে অনেক কইমাছ ডাঙ্গায় অল্প জলে লাফালাফি করছে। কালীদের বাসার দক্ষিণের বিস্তৃত অগভীয় ডোবায় (অনেকটা ছোট্র ক্ষেতের মত) অনেক পানি জমেছে। তরলের ধর্ম অনুযায়ী, এই পানি নি¤œদিকে পুকুরে গড়িয়ে যাচ্ছে। এই ডোবায় নেমে কিছু ছেলেমেয়ে মাছ ধরছে। কেউ কাগজের নৌকা, জাহাজ বানিয়ে ঐ জলে ভাসিয়ে হাত তালি দিয়ে আনন্দ করছে। জয় ডোবার পাশে বসে আছে। গত দু’দিন ধরে তার জ্বর। এখন একটু কমেছে।
 দিদি, ঐ দেখ কবিরাজ। গেল গেল দিদি, ধ¬র,ধর।
এই এলাকায় কই মাছ বেশ জনপ্রিয়।তাই কই মাছকে ভালোবাসার খাতিরে কবিরাজ বলা হয়। স্থানীয় কবিরাজের কাছে কোন অসুখ নিয়ে গেলে তিনি অসুখ সাড়ার পর কই মাছ দিয়ে ভাত খেতে বলেন। তাই হয়তো কই মাছকে পথ্যক হিসাবে কবিরাজ বলে ডাকা হয়।
শেফালী উঠান ঝাড় দিচ্ছে। তুলসী ঘরের ভিতরটা পরিষ্কার করছে। কিছুক্ষণ আগে কালীপদ দোকান থেকে এসেছে বাড়ীর অবস্থা দেখার জন্য। অদূরে হাবিবুর তাকে ডাকছে Ñ
 ঐ কালীপদ, সব ঠিকতো?
 হ দাদা, সব ঠিক,তবে রান্নাঘরের চাল উড়িয়ে নিয়ে গেছে পুকুর ধারে। পায়খানাটাও ভেঙ্গে পড়ে গেছে।
বৃদ্ধ নিতাই শীল কালীপদ আর হাবিবকে ডাকছে। পশ্চিমের ঘাট থেকে শেফালী জল আনার জন্য ঘরের বাইরে আসতেই হবি আর নীতাই শীলকে দেখতে পায়। তার মাথার ঘোমটা আধ হাত নীচে নেমে আসে। হাবিব শেফালীকে দেখে এমন ভান করল যেন সে দেখে নাই। মনে মনে বলে উঠল এত সুন্দর বউ অথচ মেয়েটা কত কালো। নিজের জড়তা দূর করার জন্য সে নিতাই শীলকে বলল,
 কি খবর জ্যেঠা?
 ভাল না, তোরা এদিকে আয়। আরে, আম গাছের ডাল ভেঙ্গে গরু ঘরটার উপরে পড়ছে। গরু ঘর ও ভাঙ্গছে , গরুটার ঠ্যাংও ভাঙ্গছে।
কালীপদ আর হবি ছোটবেলা থেকে নিতাই শীলকে দেখতে পারে না। নীতাই শীলের উঠানে বা মাঠে খেলতে গেলে বকা দিত। গাছ থেকে কিছু পেড়েও খাওয়া যেত না। কত নালিশ যে নীতাই শীল অভিভাবকদের কাছে করেছে। তার মুখের ভাষাও খারাপ। অতিরিক্ত রেগে গেলে অভিশাপ দেওয়া শুরু করে।
কালীপদ ফিসফিস করে বলছে --
 যাক, তোমার ঠ্যাংতো ভাঙ্গে নাই?
 কিছু বললি কালীপদ?
 না, জ্যেঠা, বললাম ডালগুলি সরানো দরকার। গরুর পা ঝাড়ন দরকার। কি বলেন হবি ভাই ?
 হ্যাঁ, ঠিক বলেছ। জ্যাঠার বাড়ীতে পুরুষ মানুষতো কেউ নাই।

অস্তয়ামান সূর্যটা দিগন্তে মিশে গেছে। তবে পশ্চিমাকাশে সূর্যের রক্তিম আভা তখনও শ্মশানের শেষ অগ্নির মত জ্বলছে। ঠাকুর বাড়ীর ভিতরে ও বাহিরে ধীরে ধীরে নিরবতা নেমে আসছে। পুরনো ভগ্ন দালানের প্রান্ত ঘেঁষে বট গাছ আর শিমূল গাছ পূর্ব ঐতিহ্য আর নীল বেদনার করুন স্মৃতি নিয়ে আকাশ পানে চেয়ে আছে। মাটির উপর সমান্তরাল বট গাছের মোটা দুই শিকরের মাঝে ছোট একচালা মন্দিরে কয়েকটা দেব-দেবীর মূর্তি ধ্র“ব হাসিতে চেয়ে আছে দক্ষিণ দিকে। যেন কোন পূজারী কিবা তাদের প্রেমে ভক্ত প্রিয়জন পূজা দিতে আসবে। ঠিক তাই-ই।এই দিক্ষণের স্যাঁতস্যাঁতে মাটির উপর পা রেখে ফুটফুটে জ্যোৎসার মত নিষ্পাপ তের বছরের এক পিতৃহারা বালক পূজা দিতে আসছে। প্রতি সন্ধ্যায় ধূপ-শিখা আর সামান্য অর্ঘাদি নিয়ে পূজা করে । পূজার শেষে দেবীর চরণে লুটিয়ে পড়ে কি যেন বিড়বিড় করে বলে। ওর বিধবা মা ওকে পূজার ব্যাপারে সাহায্য করে।
এই পুরনো বনঝোপে ঘেরা ঠাকুর বাড়ীতে ওরা দু’টি প্রাণী--মা ও ছেলে একচালা ভাঙ্গা ঘরে বৃষ্টির সময় বৃষ্টিতে ভিজে, জ্যোৎসা রাতে চাঁদের আলো উপভোগ করে জীবন-যাপন করে আসছে বিগত অনেক বছর ধরে । পুরনো দালানের মাঝে মাঝে ইট খসে পড়ে। তাছাড়া ওখানে অনেক বিষধর সাপ বাস করে। উত্তরে কালীদের ছোট পুকুর পর্যন্ত বিরাট বনঝোপ,সেখানে রাত তো দূরের কথা দিনের বেলায়ও মানুষ যেতে সাহস করে না। সাপ হয়তো এই ঝোপ থেকেই পুরনো দালানে গিয়াছে। তাই কল্যাণরা দালানে থাকে না। দালান থেকে দক্ষিণের একটু দূরে টিনের আর মুলিবাঁশের তৈরী ভাঙ্গা ঘরে বাস করে ওরা। এক সময় পুরা ঠাকুরবাড়ী লোকে পরিপূর্ণ ছিল। ঘরে ছেলে মেয়েদের চিৎকার, উঠানে বউ-শ্বাশুড়ীর খোশ-গল্প, বাইরে মনিব ও চাকরের সশব্দ কথোপকথন।আজ আর সেই দিন নেই--নেই সেই কোলাহল। সব থেমে গেছে ধীরে ধীরে। বিরাট আয়োজনে এখন আর কোন পূজা হয় না। হিন্দু সম্প্রদায়ের মাথায় সা¤প্রদায়িক ভূত চেপেছে। ক্রমাগত সবাই কোলকাতা, আসামে চলে যাচ্ছে।

বাংঙ্গালী হিন্দুদের ধারণা এদেশে মুসলমানদের সাথে থাকা যাবে না। ভারতে সুখ-শান্তি ভরপুর । মানুষের মৌলিক চাহিদাগুলির দাম অপেক্ষাকৃত কম। কিন্তু কেউ বুঝতে চায় না সেখানে কত বেকার, কত বর্ণ-বৈষম্য, পয়সা রোজগারের কি অবস্থা ! কি জানি, হয়তো হিন্দুদের স্বর্গপুরী ভারতেই অবস্থিত। কেননা দেব-দেবীর যত আজব গল্প আর অবিশ্বাস্য পূজা-অর্চনার কারখানাতো সেখানেই--যেখান থেকে রামরাখীর মত স্বার্থতত্ত্ব তৈরী হয়, হচ্ছে। ভাবতে ইচ্ছে করে রাম অবতার কি মৌলবাদীদের স্বর্গের লোভ দেখিয়েছে? নয়তো ৫০০ বছরের পুরনো মসজিদ কি করে ভাঙ্গে ? কাশী, গয়া, বৃন্দাবন যেমন রয়েছে তেমনি রয়েছে বোম্বের মত পাতিস্বর্গ--যেখানে নগ্ন, অর্ধনগ্ন হুর-পরীদের ছড়াছড়ি। আর এই পাতিস্বর্গের শিকড় বাড়তে বাড়তে এদেশের আনাচে-কানাচে এসে গেছে। ভারতের হাজার হাজার দ্রব্যতে বাংলার বাজার জমজমাট। হিন্দি গান ছাড়া আমাদের পেটের ভাত হজম হতে চায় না, সকাল হতে চায়না, অনুষ্ঠান সম্পন্ন হতে চায় না। জীবন চলার পথে হিন্দী ফিল্ম আর হিন্দি গান। অথচ তারপরও বকেই চলেছি ভারতকে। ভারতের রেশ ধরে মাঝে মাঝেই এখানে শুরু হয় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। সংখ্যালঘু হিন্দুরা হুজুগে ভীতু। গাছের একটা পাতা পড়ার শব্দ শুনলে যেমন ভীতু হরিণেরা লম্ফ দিয়ে উঠে, হিন্দুরা তেমনি সামান্য একটা গুজব শুনতে পেলেও পোটলা-পুটলী বাঁধার চিন্তা করে ফেলে। ভাবেও না গুজবটা সত্য না মিথ্যা। ভাববে কি, পারেতো ক কে কনকসার কং বানিয়ে ছড়াতে থাকে। এভাবে চলতে থাকলে কল্যাণরাও একদিন কোলকাতা চলে যাবে। যাবেই তো। কায়স্থ ব্রাক্ষণের ছেলে কল্যাণ--পূজাই যদি না ঘটে তবে পয়সা পাবে কোথায়? বর্ণ-বৈষম্য নামক নিন্দিত কুসংস্কার রক্ষা করে কল্যাণের মা সবিতা যদি ছেলের জন্য কায়স্থ ব্রাক্ষণের মেয়েই না পায়,তবে কূল রক্ষা করার জন্য তথাকথিত রামস্বর্গ ভূমিতে তো যেতেই হবে। ইচ্ছে করলেও তিনি নি¤œবর্ণের কোন হিন্দু মেয়ের সাথে তার পুত্রের বিবাহ দিতে পারেন না। গোঁড়া হিন্দু সমাজ থু থু দেবে। সুযোগ বুঝেই ফতোয়ার মত শাস্ত্রীয় বিচার শুরু হয়ে যাবে। লোকে তাদের নিন্দা করবে। কুমার যদি মূর্তি, হাড়ি-পাতিল বিক্রি করতে না পারে, তবে মূর্তির স্বর্গে তো যাবেই; যেখানে অজস্র মূর্তি সে বিক্রি করতে পারবে। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার রব উঠলেই হিন্দুদের হৃদয়ে প্রতিধ্বনিত হয়--চল চল ভারত চল।“শ্রীবৃক্ষ বোধযামী ত্বাং যাবৎ পূজা করোম্য হম...”--সংস্কৃত পাঠ শেষে কল্যাণ মন্দিরে পূজা করার পর নমস্কার দিল। ঠিক এসময়ে পাশে কারো আগমনের নূপুর বেজে উঠল। মাটি থেকে সদ্য পুজারী মাথা উচুঁ করে বলল, ‘ কিরে কালী এই সন্ধ্যাবেলা এখানে কেন আসছিস?’ কালী কোন উত্তর না দিয়ে মন্দিরের মাটির উপর ভাসমান স্বচ্ছ ঘটের জল মাথায় ছুঁয়ে দিয়ে হাতটা পেছনে নিয়ে গেল। ম্মিত হাস্যে কল্যানের চরণ ধূলি গ্রহণ করল--যেন সদ্য পূজারীনী। কল্যাণ কালীর দু’হাত ধরে উঠাল তারপর কালীর মুখের কাছে মুখ নিয়ে বলল্, ‘কিরে ব্রাহ্মণ জ্ঞানে নমস্কার দিলি, নাকি দেবতা জ্ঞানে’। এগার বছরের এই বালিকার লজ্জা হাসিতে অনড় দেব-দেবীর মূর্তীরা যেন ঈষৎ লজ্জা পেল। বটবৃক্ষের শাখা থেকে একরাশ পাতা ওদের দু’জনার উপর ঝড়ে পড়ল। বাতাস বইতে লাগল গুনগুন সুরে। কালীর কণ্ঠ থেকে ব্যক্ত হল --‘তা জানিনা কল্যাণদা,দিতে হয় তাই দিলাম’। মনে মনে কালী বলতে লাগল কিছু অব্যক্ত কথা যা বালিকারা সহজে ব্যক্ত করতে চায় না। সে জানেনা একজন বিধর্মী ছেলেকে পাওয়ার চেয়ে ব্রাহ্মণের ছেলে পাওয়া অনেক কষ্টের। কারণ গোঁড়া হিন্দু সমাজ কোনদিন মেনে নেয়নি  আজো নিতে চায় না।
হাতে একরাশ চুল, কানে দুল, ছোট কালো কচি পায়ে নূপুর, চুলগুলো মেঘের চেয়েও কালো আর মুখখানি হৃদয়ের সত্যিকারের ভালোবাসার মত পবিত্র। ‘ঠোঁট রাঙ্গা হাসি’ যেন সদ্য পূজারীকে প্রশ্ন করতে চায় ‘বলতো আমি কেমন ?’ কালী কল্যাণের ঘাড়ে দু’হাত রেখে দুষ্টু ভংগীতে বলতে লাগল, ‘ঠাকুর মশাই, আজ শনিবার। ঠাকুরমার তুলসী তলায় শনি ধ্বনি দিয়ে ঠাকুরমাকে শনি পাপ থেকে রক্ষা কর।
 ও হ্যাঁ, আমার মনে ছিল না। তুই একটু দাঁড়া, এক্ষূণি আমি ঘরের মধ্যে এগুলো রেখে আসি।
কালী শাড়ীর আঁচলটা কোমড়ে এঁটে বলল,
 কল্যাণদা, আমার কাছে ধূপটা দাও। তুমি এগুলো নাও। এগুলো মানে পূজোতে দেওয়া বাতাসা আর পেঁপের টুকরা।
কল্যান বাতাসা আর এক টুকরা পেঁপে হাতে নিয়ে বলল,
 কালী, হা-কর।
কল্যাণ আজ আর স্বগীয় বাবার ধুতি পড়েছে দুই ভাঁজ করে আর গায়ে পড়েছে ডোরা কাটা গেঞ্জি। কালী পড়েছে গোলাপী পাইড় দেয়া শাড়ী। দু’জনের মুখে মিষ্টি হাসি। কালীদের বাড়ী কল্যাণদের বাড়ী থেকে এক ছোট্র পুকুর আর এক বনঝোপ দূরে। শেফালী ও তুলসী কল্যাণকে খুব আদর করে। গতবারের দূর্গা পূজার আগে শেফালী ওকে একটি শার্ট ও একটি লুঙ্গি দিয়েছে। বাড়ীর কাছাকাছি এসে কালী কল্যাণের হাত চেপে ধরল,
 একটা কথা বলব,
 কি কথা ?
 আমাকে পূজা করতে শিখাবে ? তুমি যখন পূজা কর,আমার খুব ভাল লাগে। মনে হয় আমি যদি...কল্যাণদা, দেব-দেবীর কাছে তুমি কত কি বলো। দেবতারা তোমাকে কি বলে ?
 অনেক কিছু বলে।
 কি বলে?
 তোকে বলা যাবে না। তুই আরো বড় হ--তখন বুঝবি।
 তুমি বুঝি বড়। এই মেপে দেখনা তোমার কান পর্যন্ত আমার মাথা ঠেকেছে।
 ধাৎ হাঁটতো-
বেশ কিছুদিন আগে মিলন, কল্যাণ, দীপা, নাসরিন, শিখা, কালী--এরা সবাই সিদ্ধান্ত নিয়েছিল পুতুলের বিয়ে দেবে। এই উপলক্ষে তারা সবাই সকাল আর দুপুরের মাঝামাঝি সময়ে একত্র হয়েছে নাসরিনদের বাড়ী। সবাই, যে যাকে দেখেছে তাকেই বিয়ের দাওয়াত দিয়েছে। তবে দাওয়াতীরা ওদের মত ছোট ছোট। সবাই সবার বাড়ী থেকে গ্লাস, জগ, বাটি, চট, পিঁড়ি ইত্যাদি এনেছে। অনুষ্ঠানের আকর্ষণীয় খাবার হল স্পেশাল খিঁচুড়ি। খিচুরীতে দেওয়ার জন্য ঝুমকা ফুল, ডাটাপাতা, পিঁয়াজ, রসুনের ফেলে দেওয়া খোসা ইত্যাদি। তাদের অনুষ্ঠানের এই অখাদ্য অথচ মূল্যবান খাবার এর কারণ হল প্রত্যেকের অভিভাবক প্রত্যেককে কান মলে দিয়েছে যেন চাউল, ডাউল না নেওয়া হয়, আগুন নিয়ে যেন কোন খেলা না হয়। তবে এরা নিজেদের শিশু বা বালক-বালিকা হিসাবে মনে করে না। যেন প্রত্যেকেই অভিভাবক। তবে একবারে যারা শিশু তাদের ব্যাপার ভিন্ন। অনুষ্ঠানের রান্না শেষ। মিলন সবাইকে ডেকে বলতে লাগল,
 ঐ তোরা সবাই খেতে বস, আগে খাওয়া, পরে বিয়া
কথা শেষ না হতেই কল্যাণ বলল্,
 ঐ তোরা চিৎকার করবি না, চুপ করে বস--
ওদের মোট সংখ্যা ১৮ জন। সবাই কলা পাতায় খিচুড়ী নিয়ে মুখের কাছে এনে অয় অয় শুরু করেছে। অর্থাৎ ওরা খাচ্ছে। কিন্তু কালীর ছোট ভাই জয় যার বয়স আড়াই বছর--সে সত্যি সত্যি খেতে শুরু করেছে। কালী তারাতারি জয়ের মুখ থেকে অখাদ্য বের করে ধুয়ে দিল সারা মুখ।
এবার বিয়ের পর্ব। নাসরিন ঘর থেকে একটা পুতুল নিয়ে এলো। কিন্তু ঐ স্ত্রী পুতুলকে বিয়ে করার মত এত বড় বর পুতুল কারো কাছেই ছিল না। তবে নাসরিনের পুতুলটি খুব সুন্দর। কি আর করা যায় এই নিয়ে সবাই চিন্তায় মশগুল। হঠাৎ শিশুদের মাঝে চিৎকার শুনা গেল। চোর ও দুষ্টু বলে পরিচিত সাত্তারকে কেউ দাওয়াত দেয়নি বলে সে বাঘের মুখোস পড়ে সব খাবার চুরি করে নিয়ে গেছে। মিলন বলল, থাক, আমাদের সবাইতো খেয়েছে। পরে সাত্তারকে ধরব। তোরা এক কাজ কর জয়কে বর বানাই।
শিখা বলল্, বলিস কি তাহলে জয় যে পুতুলের চেয়ে অনেক বড় হয়ে গেল।
কালী বলল, তাতে কি হয়েছে, কুদ্দুস কাকার বউকে দেখিসনি। অপরিচিত মানুষরা বউকে কুদ্দুস কাকার পুত্রবধূ নয়তো মেয়ে মনে করে।
হঠাৎ করে নাসরিনের তিন বছরের বোন চুমকী বলে উঠল, “আঁপাঁ, আঁমিঁ বিঁয়াঁ কঁরুঁমঁ। ”
সবাই হাসতে লাগল ওর কথা শুনে। শিখা আদর করে বলল, “চুমকী তুমিতো বিয়া করবা না-- বিয়া বইবা। ”
কালী আর মিলন বরপক্ষ এবং নাসরিন আর কল্যাণ কন্যাপক্ষ। মিলন আর কালী জয়কে নিয়ে নাসরিনদের আলুর গুদাম ঘরে গেল। কল্যাণ আর নাসরিন পুতুল নিয়ে নাসরিনদের বারান্দায়ই রয়ে গেল। এর মাঝে কে কন্যাপক্ষ যাবে কে বরপক্ষ যাবে তা নিয়ে তুমুল হৈচৈ হয়ে গেল । নাসরিনদের বাড়ীতে মা-বাবা, বড় ভাই কেউ ছিল না বলেই এত আনন্দ বয়ে গেল। মা, বাবা অথবা বড় ভাইবোন থাকলে সবই পন্ডশ্রম হত।
বিকাল বেলা। কলেজের ছাত্র শংকর কালী ও জয়কে পড়াচ্ছে। প্রায় এক বছর ধরে শংকর ওদের বাড়ীতে টিউশনি করছে। আজ পড়াতে এসে শংকর প্রচন্ড রেগে গেল। আজ কালীর অংক পরীক্ষা ছিল। অথচ কালী বলছে সারাদিন সে অংক করতে পারেনি। শংকর ওর কান ধরে দুইগালে দু’বার চড় দিল। গলার স্বর সপ্তমে উঠায়ে বলল, কি কাজ করেছিলে সারাদিন ?বল কি কাজ করেছিলে? বল-
কালী কোন কথা বলছে না। জয় ভয়ে ভয়ে গলার ক¤্পন বাড়িয়ে পড়তে লাগল। সে আজ ভাল করে পড়া শিখেনি।
 জয়, কবিতা শিখেছ?
 জ্বী, স্যার।
 বল ,না থাক লিখ।
 স্যার?
 কি?
 কিছু না, থাক।
কালীর বয়স এগার/বার বছর। যতই সে বড় হচ্ছে ততই সে মোটা হচ্ছে। দেখতে অনাকর্ষণীয়। নারীত্বের বিশেষ অঙ্গ বেশ সজাগ হয়ে উঠেছে। শংকর আদর করলেও তার কেমন যেন লাগে? আবার থাপ্পর দিলেও কেমন যেন শরীর শিহরিয়ে উঠে। শংকর ওর অনিচ্ছা সত্ত্বেও অংক পরীক্ষা নিয়েছে। একশপত চৌত্রিশ নাম্বার পেয়েছে। অতএব, তাকে দশ মিনিট কান ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছে। জয় মোটামুটি কবিতার দশ লাইন লিখেছে। তবে শামসুর রাহমান লিখতে গিয়ে শামসুর রহমান লিখেছে। শংকর ওকে একটা ধমক দিলেও খাতায় গুড লিখেছে। জয় খুশীতে আটখানা হয়ে কালীর নিষেধ করা কথা বলে ফেলল।
 স্যার, দিদি ‘পুতুল বিয়ে’ খেলেছে। দিদি শ্বাশুরী হয়েছে।
 তুমি শ্বাশুরী হয়েছ! এই জন্য এই অবস্থা!
কালী রাগত চাহনীতে জয়ের দিকে তাকায়। ঠিক সেই মূহুর্তে শেফালী ঘরে ঢুকে শংকরকে বলল,
 ওকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কান ধরে দাঁড়া করিয়ে রাখবে। সারাটা দিন নাসরিনদের বাড়িতে পুতুলের বিয়ে খেলেছে। কাজের সময় একশবার ডেকেও পাইনা। সারাদিন পড়তেও বসেনি।
 এই যে দেখেন অংক পরীক্ষায় একশতে চৌত্রিশ পেয়েছে। কেমন লাগে মেজাজটা--
শেফালী রাগে ক্ষোভে রান্না ঘরে গিয়ে তুলসী কে বলছে, কালীকে আর এ বাড়ীতে রাখা যাবে না। ওর বাবার সাথে আলাপ করে ওর বিয়ের ব্যবস্থা তারাতারি করতে হবে। শ্বশুর বাড়ী গিয়ে বুজুক কাজের কি ঠেলা!

আজ শুক্রবার। বিকাল বেলা, কালীদের পাড়ার ছেলে মেয়েরা দক্ষিণের ফসলশূন্য মাঠে কানামাছি, বৌচি, দাঁড়িয়াবান্দা ইত্যাদি খেলছে। বড় ছেলেরা খেলার মাঠেই ফুটবল খেলতে চলে যায়। কালী ছোট ছোট ছেলে মেয়েদের নিয়ে ফুটবল খেলছে। মাঝে মাঝে ফুটবল খেরতে তার খুব ভাল লাগে। সে খেলাধূলায় সব সময়ই ভাল। হাইজ্যাম্প, লংজ্যাম্প, সাঁতার, দৌড় ইত্যাদিতে সে খুবই দক্ষ। তবে এ পাড়ার অনেকেই তাকে মদ্দনী বলে। কেউ অগোচরে ‘খোদাই ষাড়’ ও বলে। সবাই খেলায় ব্যস্ত। কালী খুব ভাল সর্ট মারতে পারে। কখনো দেখা যায় খেলার সাথীদের নিয়ে হুড়মুড় করে মাটিতে পড়ে যাচ্ছে। মাথায় বল হেট দিচ্ছে। দূর থেকে মহিলারা ছিঃ ছিঃ করছে। কেউ কেউ কালীকে ধমক দিচ্ছে। সে তবু ও শুনেনা অথবা না শুনার ভান করে। প্রায় সন্ধ্যা গড়িয়ে এসেছে। কিছু কিছু অভিভাবক ছেলে-মেয়েদের ডাকতে শুরু করেছে। ঠিক এমনি মুহুর্তে কালীদের বাড়ীতে চিৎকার শুনা গেল। সবাই ছুটে গেল ওদের বাড়ীতে। ঘটনা ছিল এরকম--গোখরা সাপ কালীদের দুধেল গাইটার দুধ খাচ্ছিল। গরুর দুই পা পেঁচিয়ে বিস্ময়কর ভংগীতে সাপটি দুধের নিপল মুখে পুড়ে আছে। গরু পা নাড়াতে পারছে না। হাম্বা হাম্বা করে ডাকছে। তুলসী কি মনে করে গরুটাকে ঘাস দিতে এসে দেখে এ অবস্থা ।অবশ্য তখন ঘাস দেওয়ার সময় নয়। তুলসী রাস্তায় দাঁড়ানো প্রতিবেশী সিরাজকে ডাক দিয়ে দেখাল। বাড়ীর সবাই ভয়ে আর বিস্ময়ে সাপের দিকে তাকিয়ে আছে। সাপ বুঝতে পেরে যেই যেতে শুরু করেছে তখনি সিরাজ মোটা লাঠি গায়ের সমস্ত শক্তি দিয়ে তিনবার আঘাত করল। ফলে সাপটি মারা গেল। আরেকটি সাপ সবে মাত্র ঝোপ থেকে আসছিল। অবস্থা দেখে পালিয়ে গেল। কালী এসে শুধু মৃত সাপটা দেখল আর ঘটনা শুনল। অনেক বড় সাপ ! সাড়ে পাঁচ হাত হবে।

কালীদের উত্তরের বনঝোপেই এই সাপেরা থাকে। ভারতবর্ষ বিভাগের আগে উত্তরের ঝোপটাতে ছিল কামার আর কুমারদের বাড়ী । এখানে ব্রাহ্মন পরিবার ও ছিল অনেক। দেশ-বিভাগের পর অনেকেই ভারত চলে গেছে। বাকী যারা ছিল মুক্তিযুদ্ধের সময় তারাও চলে গেছে। এখন এই বনঝোপের জায়গা গণিমুন্সীর। দেশ-বিভাগের পর এই ঝোপ বাড়তে বাড়তে ঘন বনঝোপে পরিণত হয়েছে। ঝোপের ভিতরে ভগ্ন পুরানো সমাধী মন্দির, ভগ্ন পূজার ঘর রয়েছে। ভাঙ্গা হাড়িপাতিল আর লোহার টুকরায় ভরা মাটির প্রথম স্তর। গণি মুন্সির বাড়ী ছিল বিস্তৃত ঝোপের উত্তরে। সামান্য একটু জায়গা ছিল। জমিদারের গোমস্তা ছিল বলে তাকে জমিদার বাড়ীর কাছাকাছি থাকতে হতো। জমিদার মারা যাবার পর তার পুত্র কন্যারা ভারতে চলে যায়। জমিদার ব্রাহ্মন পরিবার চলে যাবার পর গণিমুন্সি বাকী ব্রাহ্মনদের সু-কৌশলে তাড়িয়ে ঐ জায়গা পুরোটা দখল করে। এখন যেখানে কল্যাণরা থাকে, এটাই ছিল জমিদারের বাড়ী। মুক্তিযুদ্ধের সময় গণি মুন্সীর পুত্র আযম মুন্সী পাকসেনাদের মোরগ-মুরগীর সাথে কিশোরী, যুবতী ও নতুন বউদের উপহার দিয়ে খুশী করত। আরো হিন্দু তাড়িয়ে জায়গা-জমিন, সোনাদানা কম দামে কিনে রাখত। হিন্দুদের মনে ভয় ঢুকিয়ে তার কাজ সে করত। আবার অনেক হিন্দুদের সে রক্ষাও করেছে। তাদের শাখা-সিদুঁর ফেলে দিয়ে কোরআন শরীফ দিয়ে বসিয়ে রেখেছে। সূরা, কালেমা শিখিয়েছে। সুযোগ বুঝে ভয়ের বীজ বুনে দিয়েছে। আজ সে আযম চৌধুরী। হজ্ব তিনবার পালন করেছেন। দান খয়রাত প্রচুর পরিমাণে করেন। একবার সংসদ সদস্য পদে মনোনয়ন পেয়েছিলেন। পাশ করতে পারেননি।

আযম মুন্সী যুদ্ধের পর পরই ঢাকায় চলে যান এবং রাজনীতিবিদ এক মামার সাথে থাকিয়া মিটিং-ফিটিং করে মুক্তিযোদ্ধা খাতায় নিজের নাম লিখায়েছেন। গ্রামে তিনি কালে ভদ্রে যান। গ্রামে এক বোন আছে--গেলে সেখানেই উঠেন। তারপর তার স্মৃতিবিজরিত বনঝোপ ঘুরে ঘুরে দেখেন। গণি মুন্সীর কবরটা নিজহাতে পরিষ্কার করেন । তারপর জিয়ারত করেন। কখনো কালীদের বাড়ী এসে জলপান করেন। খুব ভাল ব্যবহার করেন গ্রামবাসীদের সাথে। গ্রামের বয়োজেষ্ঠ্যরা তার কুর্কীতি আর সুকীর্তি সম্পর্কে সবই জানেন। কেউ মুখ ফোটে কিছু বলেন না। সে এখন বহু অর্থ সম্পদের মালিক। সাধারণ গ্রাম্যবাসীদের কাচে ধনীরা হল ন্যায়-অন্যায়ের উপরে।

কল্যাণরা আযমমুন্সীর দখলকৃত বাড়িতেই থাকে। সবাই চলে গেলেও আত্মীয়-স্বজনহীন কল্যাণের বাবা ননী গোপাল ভারতে যাননি। ফলে আযম মুন্সী বাস্তুুহারা হিসাবে থাকতে দিয়েছে। বিনা চিকিৎসায় ননী গোপাল মারা গেলে নিঃস্ব সবিতা পুত্রকে বহুকষ্টে লালন-পালন করেছেন। ননী গোপাল মারা গেলে হিন্দু সমাজের অবস্থাপন্নরা সবিতাকে টাকা-পয়সা দিয়ে সাহায্য করত। আযম মুন্সী ও অনেক কিছু দিত। এ বাড়ীর সব ফল-ফলাদি কল্যাণদের ভোগ করার অধিকার সে দিয়েছেন। অনেক মুসলমান প্রোঢ়রা সবিতাকে বিয়ে করতে চেয়েছে। দৃঢ় মনোবল, ধর্ম প্রাণ বলে কেউ তার গায়ে একটা আঁচড় ও দিতে পারেনি। শেফালী, তুলসী, সবিতা আরো অনেকে বাঁশ দিয়ে খুঁচি, ডোলা আর নাইলন সূতা দিয়ে মাছের জাল বোনায়। এগুলো মহেশ কাপালী কিনে নেয়। পরে চড়া দামে অন্য পাইকারদের কাছে বিক্রি করে। এসব ব্যাপারে কালীর বাবা সবাইকে সাধ্যমত সহায়তা করে।

বার্ষিক পরীক্ষা আসন্ন। কালী আগের চেয়ে বেশ মোটা হয়েছে। বুকের আয়তন বয়সের তুলনায় বৃহৎ আকৃতি ধারণ করেছে। শংকর আজ দু’মাস পর ওকে পড়াতে এসেছে। এতদিন সে এসএসসি পরীক্ষার পরবর্তী ছুটি দেশে কাটিয়েছে। সে দু’মাসের মধ্যে হঠাৎ কালীর এ দৈহিক গঠন দেখে রীতিমত অবাক। কালী সবেমাত্র ৬ষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্রী। অথচ অন্যান্য সমবয়সী মেয়ের তুলনায় তার স্ত্রী অংঙ্গগুলি বেশ অগ্রসর। শংকর কালীকে তার পাশে বসাতে গিয়ে নিজের দেহের রক্ত চলাচলের দ্রুততা অনুভব করে। সে ক্ষণে ক্ষণে কালীর বুকের দিকে তাকায়। কালীর অস্বস্থি লাগে। কিছু বলতেও পারে না লজ্জায়। কালী একটা অংক কষতে পারলে শংকর ওর মাথায় ও পিঠে হাত বুলায়। কালীর তখন সারা শরীর শিরশির করে উঠে। এক সময় সে বলে উঠে 
 স্যার ,আমি আসছি।
 কোথায় যাচ্ছ?
 এইতো ও ঘরে।
কালী পশ্চিমের ঘরে গিয়ে বুকে ওড়না জড়িয়ে পড়তে আসল। শংকর অবাক ! দু’জনে হঠাৎ নিরব। শংকর ও অংক করতে বলছে না। কালীও কিছু করছেনা। শুধু আঁকি উঁকি করছে খাতায়।
 জয়, তুমি যাও। তোমার ছুটি। উষা কে লিখতো। এবার আই লিখ, পাশে দু’টা এস দাও। অর্থ কি হল বলতো?
 জানিনা --
 আচ্ছা ব্রেস্ট অর্থ কি বলতো? থাক পারবে না।
কালীর আসল নাম উষা। গাঁয়ের রং কালো বলে সবাই তাকে কালী বলে ডাকে। নামটা কালীর কাছে যেমন অভ্যস্ত, সবার কাছেও তেমনি। কালী স্যারের চোখে মুখে তাকিয়ে বুঝতে পারছে, নিশ্চয় ছিঃ ছিঃ ধরনের অর্থ হবে। স্যার সব সময় ধমক দিয়ে কথা বলতো। আজকে কেন এমন হল। কালীর কাছে রহস্য মনে হচ্ছে।
 লাভ অর্থ কি, বলতো?
কালী কোন কথা বলল না । মুখ গোমড়া করে রইল।
 আচ্ছা কালী, তুমি কাউকে ভালবাস? তোমার মঙ্গলের জন্যই বলছি--
 (রাগত স্বরে) জানিনা--




(চলবে)...

No comments:

Post a Comment