ধারাবাহিক উপন্যাসঃ কাকভোর পর্ব-৩

তুলসী, শেফালী তাকে প্রায়ই এ নিয়ে বকাবঝকা করে। এই বয়সেই সে বইয়ের পোকা। তবে পাঠ্যবই তার ভাল লাগে না। কূপমন্ডক জ্ঞানের ভান্ডার মনে হয়। একই বই সারা বছর পড়তে হয়। আর যে সব সিলেবাস অন্তর্ভুক্ত--তা কোন কাজে মেয়েদের লাগে--তা সে ভেবে পায় না। বই প্রণেতাদের চৌদ্দ গোষ্ঠীকে চৌদ্দবার নরকে নিয়ে সে বই পড়া শুরু করে। ক্লাশের স্যার, আপার কাছে প্রাইভেট পড়লে ভালো নম্বর পাওয়া যায়। ক্লাশে যে পড়া হয়--তা প্রাইভেট না পড়লে শেষ হয় না। বিজ্ঞান বইয়ে বারবার ‘এসো নিজে করি’--যা দারুণ বিব্রতকর। পদ্ধতিটা ধনী স্কুলের ছাত্র--ছাত্রীদের জন্য প্রযোজ্য। কারণ এসো নিজের করি, পরীক্ষার যন্ত্রপাতি আর ব্যয়ক্ষমতা গ্রাম্য স্কুলতো দূরের কথা শহরের বহুস্কুলের সরঞ্জাম ভান্ডারেও থাকে না । আর কিছু থাকলেও সময় ব্যয় করে প্রেকটিক্যাল করানোর মত মন মানসিকতা নুন আনতে পান্তা ফুরোয় শিক্ষকের থাকেই না।
গ্রাম অঞ্চলে আজো মেয়েরা ই.অ নয়, বিয়া পাশ করার জন্য লেখাপড়া করে। যেন, ভাল বর পাবার জন্যই তাদের এ লেখাপড়া। বর পক্ষরা কনের হাতের লেখা দেখে শিক্ষার মান যাচাই করেন। তাই মেয়েরা হাতের লেখা সুন্দর করার জন্য সদা সচেষ্ট থাকে। তাছাড়া নিজের ভবিষ্যৎ সন্তানদের প্রাথমিক জ্ঞানদানের জন্যও তাদের বিয়া পাশের লেখাপড়া কাজে লাগে ।
কালী কবিতা লিখতে পারে। কিন্তু কাউকে দেখাতে পারে না। বেশ লজ্জা হয়। একবার একটা কবিতা লিখে সারাস্কুলে ঝড় তুলেছিল । অনেকেই তাকে খারাপ বলেছে। দু’একজন শিক্ষক-শিক্ষিকা তাকে ‘পাকনা’ মেয়ে বলেছে। চঞ্চুরী কিশোর সংঘ তার কাছে একটা কবিতা চেয়েছে দেওয়ালিকায় ছাপানোর জন্য। সে আগের লজ্জার কথা স্মরণ করে কবিতা দেয়নি। ক্লাশের শিক্ষিকা দীপ্তি আপা কবিতা দিয়েছে। সে বয়স্ক বলেই হয়তো পেরেছে। মেয়েরা প্রেম নিয়ে কিছু লিখলেই সবার মনে সন্দেহ হয়Ñবুঝি প্রেম করে অথবা ছ্যাকা খেয়েছে। আসলে সমাজে অভ্যস্ততা নেই বলেই এত বিড়ম্বনা। খেলা নিয়েই কত কথা উঠে। স্কুল পর্যায়ে খেলার পরই উপজেলা পর্যায়ে খেলা। কালী সাঁতার, দৌড় ও হাইজ্যামে অংশগ্রহণ করবে। গত বছর জেলা পর্যায়ে সে দৌড়ে সেকেন্ড ও হাইজ্যামে থার্ড হয়েছে। এবার আরো ভাল করার ইচ্ছা। কিন্তু ছেলেদের মত কোথাও সে দৌড় প্রেকটিজ করতে পারে না। মাঠে সকালে একদিন দৌড়াতে গিয়ে দেখে ছেলেরা ফুটবল খেলছে। নাসরিন মাঠের একপ্রান্তে ব্যায়াম শুরু করল। কালী মাঠের সাইড দিয়ে দৌঁড়াতে শুরু করল। ছেলেরা তা দেখে হাসাহাসি করতে লাগল। নাসরিনের বড় ভাই তখন ফুটবল খেলছিল। সে দু’জনকে ধমক দিয়ে বাড়ীতে পাঠিয়ে দেয়। স্কুলে টিফিন পিরিয়ডে প্রেকটিস করতে কালীর মোটেও ভাল লাগে না। তখন সে থাকে ক্ষুধার্ত। তুবও একটু আধটু প্রেকটিস করে। ধানমন্ডিতে মেয়েরা ক্রিকেট খেলছে, ফুটবল খেলছে অথচ গ্রামে এসবের কি হাস্যকর অবস্থা। এখানে নারীকে ঠেলে দেওয়া হয় পশ্চাতের ইতিহাসে, বাল্যবিবাহে পারলে সতীদাহে বা আত্মঘাতির দিকে।
গ্রামে বাল্যবিবাহ সবচেয়ে বেশী হয়। যদি একটা ছেলে কোন একটা মেয়ের পিছনে লাগে তবে মেয়ের মা-বাবা ও অভিভাবকগণ পাত্র দেখতে শুরু করে দেন আর যদি মনের আনন্দের জন্য কোন মেয়ে কোন ছেলেকে ভালোলাগে বা মিনি বিনোদনের খোরাক হিসাবে কোন ছেলেমেয়ে প্রেম করে তবে ছেলেতো ছেলে থাকেই; মেয়ে, হোক সে বালিকা কিংবা কিশোরী আতœজ্ঞানী অভিভাবকরা তাকে বউ বানিয়ে বরের হাতে তুলে গ্রাম ছাড়া করে দীর্ঘ একটা নিঃশ্বাস ছাড়েন। এ নিঃশ্বাস কখনও শান্তি কখনো অশান্তি বয়ে আনে। কিন্তু শান্তি অশান্তি যাই বয়ে আসুক কন্যাকে বিদায় না করে স্বস্তি পায় না। কন্যার প্রেম যদি সমাজে ছড়ায় তবে নাকি তাদের মুখ দেখানো দায় হয়ে পড়ে। যারা বদনামকে এড়িয়ে চলে,গ্রহন করতে ঘৃনাবোধ করে, বদনাম তাদের ঘড়েই এসে ভর করে। প্রেম করা আমাদের সমাজে যেন মহাপাপ এবং সব দোষ যের শুধু কন্যার। প্রেম মহৎ, প্রেম আল্লার দান--এসব যারা বলে অথবা যারা প্রেম ছাড়া সিনেমাকে সিনেমা মনে করেন না, তাদের কন্যা বা বোন যদি প্রেম করে বসে তবে তাদের অবস্থা...। অপরের যত ক্ষতি তা মহৎ বলেও মেনে নেওয়া যায় কিন্তু নিজের ক্ষতি তা যত মহৎ--ই হোক ,মেনে নেওয়া বড় কষ্ট।

জন্মের পর থেকে মেয়েরা পিতামাতা আর নারীত্বের নিয়মে বন্ধি থাকে। সমাজে নরীদের জন্য যা সিদ্ধ, হোক সেটা ভাল বা মন্দÑ পিতা-মাতারা সমাজের মান রক্ষার্থে তাই করে। যেমন অতীতে ধর্মও সমাজের মানÑইজ্জত বাঁচাতে সতীদাহ নামক উর্বর মস্তিষ্ক থেকে আবিস্কৃত ভন্ড একটা প্রথা ছিল; চিরবিধবা নামক কুসংস্কার, স্বার্থসম্বলিত একটা রীতি ছিলা আজো বহু নিয়ম সমাজে আরশোলার মত বেচে আছে। সবাই বলে মা-বাবা যা করেন ছেলেমেয়েদের মঙ্গলের জন্যই করেন। তারপর মা-বাবার মঙ্গল সিদ্ধবিবাহ দেবার পর দেবক্রম কন্যা যদি রিটান্ট বাপের বাড়ী ফিরে আসে তখন কেউ কেউ হয়তো বলে মা-বাবা দেখে শুনে বিয়ে দেয় নাই? কিন্তু অধিকাংশ বলবে মেয়ের ভাগ্য খারাপ। কেউ বলবে অলক্ষ্মী মেয়ে। শুভস্য শীঘ্রম আর শুভ লগ্ন দেখে বিয়ে দিয়েও ৯০%বর-কন্যে যে অসুখী--সে কথা ভ্র“নাক্ষরে কেউ ভাবে বলে, মনে হয় না। এত অগ্নি, বায়ু, মাটি ইত্যাদি সাক্ষী ও আশীবাদ দ্বারা বিয়ে হয়Ñতারপরও ভেঙ্গে যায়Ñসংসার অশান্তিতে ভরে থাকে।

গ্রাম অঞ্জলে ছোট ছোট মেয়েরা ভোর সকালে উঠে শীতকালে ১মাস সূর্য পূজা করে । গুনে গুনে ৫ বছরে ৫ বার করতে পারলে পঞ্চম বারের শেষের দিন পাড়ার সকলকে নিমন্ত্রণ কওে মেয়েকে সূর্যের সাথে অভিভাবকরা বিয়ে দেয়। ঠিক বিয়ের মতই নিয়ম-কানুন। সুর্য থাকে আকাশে আর আবীর দিয়ে আঁকা সূর্যমূর্তি থাকে উঠোনে। বিভিন্ন রং দিয়ে আাঁকা ছবি বেশ তেজদীপ্ত থাকে। সূর্যের সাতে বিয়ে দেবার পর শুরু হয় ভোজন। অবশেষে, সবাই আর্শীবাদ করে, বড় হয়ে এই শিশুকন্যা যেন সূর্য দেবতার মত বর পায়।
কিন্তু আমার জানা মতে আমি ১৪/১৫টি মেয়ের সংসার জীবন দেখেছি। দেখেছি মেয়েদের কাঁদতে কাঁদতে বাপের বাড়ী ফিরতে। সেই মেয়েদের প্রত্যেকেরই ছোট বেলায় সূর্য দেবতার সাথে বিয়ে হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে সূর্যদেবতার মত এমন তেজী বর, যৌতুক মার্কা শ্বশুর আর ঝগড়াটে শ্বাশুরী পেয়েছে--যা তারা স্বপ্নেও ভাবেনি। আমার মনে হয় গতানুগতিক বিশ্বাসের ফলেই এসব কুসংস্কার আজো প্রবাহমান। এগুলো যদি বাঙ্গালীর সংস্কৃতি হিসাবে মেনে নেওয়া হয়, তবে তা হবে গ্রহণীয়।
অথচ ধর্মের এতসব অতীত, বর্তমান কুসংস্কার দেখে, শুনেও উর্বর মস্তিস্কের মানব প্রফুল্ল বন্দোপাধ্যায় কেমন করে বললেন, হিন্দু ধর্ম অতি আদি এবং বিজ্ঞান সম্মত বলেই আজো টিকে আছে। মনে হয় আরশোলা তত্ত্ব । বাবরী মসজিদের মত ৫০০ বছরের পুরনো ভারতীয় ঐতিহাসিক সম্পদ যারা রামের মান রক্ষার্থে, ধর্ম রক্ষার্থে ভেঙ্গেছে তারা আসলে ধর্ম ব্যবসায়ী নাকি রামের হনুমানের বংশধর অনুসন্ধান করতে ইচ্ছে করে।
কোন একদিন কালী, মিলন ও নাসরিনকে কাছিমের মাংস খাইয়েছিল। অবশ্য ওরাই ইচ্ছে করে খেতে চেয়েছে। কালী পরবর্তীতে গরুর মাংস খেয়েছে। এবার আগের মত প্রতিক্রিয়া হয়নি। কোন কালে , কোন সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে কোন কারণে, কোন যুক্তি দেখিয়ে কারা এসব খাওয়া নিষেধ করেছেÑতা কি বর্তমানের এ যুগে প্রবাহমান থাকবে? সমাজ পরিবর্তনশীল। একই ধর্মের লোকদের জন্য যে জিনিস হারাম সেই একই জিনিস স্থান, কালভেদে কোথাও হালাল রূপে প্রতীয়মান হয়। যদি সেই আদ্যিকালের নিয়ম মানতে হয় তবে সতীদাহ, চিরবিধবা, শিশুবিবাহ আবার শুরু হোক। মুসলমান নারীদের ইংরেজী তথা পূঁথিগত শিক্ষা বন্ধ করে বোরখার আড়ালে চাপা দেওয়া হোক। যারা ধর্মের এতসব গোঁড়ামী সৃষ্টি করেছিল, যারা ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র এবং এই চার জাতের মধ্যে হাজার হাজার বর্ণ--বৈষম্য সৃষ্টি করেছিল তারা স্বর্গের জানালা দিয়ে পৃথিবীতে উঁকি দিয়ে ফোঁকলা দাঁতে হাসতে থাকবে। এদের আনন্দ দেখে ভগবান খুশী হবেন কিনা জানিনা। সারাদিন উপাস থেকে দেব-দেবীদের পূজা দেবার মত মনমানসিকতা অন্যান্য হিন্দু মেয়েদের থাকলেও কালীর তা এক বিন্দুও নেই। আগে তা পূর্ণভাবেই ছিল। তার চিন্তাশক্তি এখন অন্যরকম হয়ে গেছে। এখন সে খুবই কঠিন, খুবই নরম মনের মানবী। এতটা দিন সে পূজা--পার্বণ করে যা পেয়েছে তা মনে রাখতে চায়না। টানা-পোড়া সংসার তাদের। বিদ্যার দৌড় ঠাকুরঘর পর্যন্ত। কোনদিনই সে মেধাবিনী ছাত্রী ছিল না। স্বরস্বতী মেধাবিদ্যা দেননি বলেই ২/১ বিষয়ে ফেল তার নিত্য ব্যাপার। সব হিন্দু মেয়েরাই লক্ষ্মী পূজা করে লক্ষ্মী পাবার জন্য। কিন্তু শ্বশুর বাড়ী গিয়ে কি রকম লক্ষ্মী কপালে জুটে তা কালী ভালভাবেই পর্যবেক্ষণ করেছে। লক্ষ্মীপূজা করে কোন মেয়ে কি রকম ধনসম্পদের মালিক হয় তা বরের যৌতুকের দাবীর ফল ভোগ করলেই বুঝা যায়।
বেশ কয়েকমাস হল কালীপদ দোকানে একজন কর্মচারী রেখেছে। ছেলেটির নাম পাশা। এতিম খানায় ৮ম শ্রেণী পর্যন্ত কোনমতে লেখাপড়া করেছে। ত্রিজগতে তার আপন কেউ নেই। আগে বালিগাঁও বাজারে এক মুদির দোকনে কাজ করত। ছেলেটি খুব ভাল। আচারÑব্যবহারও সুন্দর। খরিদ্দারকে সুন্দর কথায় বশ করতে পারে। কালীপদ আশ্বাস দিয়েছে এই দিঘলী বাজারেই তাকে একটা দোকান করে দেবে। পাশার বয়স ২৩/২৪ হবে। চেহেরাতে জ্ঞানী জ্ঞানী ভাব। ছোটবেলা থেকে অন্যের বাড়িতে মানুষ হয়েছে। সে মুসলমান কিন্তু নামায--রোজাতে তার সামান্য লক্ষ্যও নেই। কালীর সাথে তার একটা ভাল মিল, দু’জনেই গল্প--পড়ুয়া। পাশা রাতÑদিন দোকানে থাকে। কালীপদ বাড়ীতে ভাত খাইয়ে ওর জন্য খাবার নিয়ে যায়। আবার কখনও পাশাও বাড়ীতে খেয়ে দোকানে কালীপদের জন্য ভাত নিয়ে যায়। কালীর সাথে প্রথম ৬ মাস ভাল করে তেমন কথা হয়নি। ৬ মাস পর থেকে গল্পের বই চেয়ে নেবার সময় পাশা ওর সাথে দু’একটা কথা বলা শুরু করেছে। তবে আস্তে আস্তে কথা বাড়তে থাকে।

(চলবে)

*** উপন্যাসটি ১৯৯১-৯২ সালে রচিত,তাই পাঠকদের ঐ সময়ের স্কুল সিলেবাস স্মরণ করার জন্য অনুরোধ করছি।

No comments:

Post a Comment