ধারাবাহিক গল্পঃ সোনালি আঁশের গল্প

পাটখড়ি
--শাশ্বত স্বপন


দূর মসজিদ থেকে সুমুধুর কন্ঠে ভোরের আযান প্রকৃতিতে প্রবাহমান বাতাসের মত ছড়িয়ে পড়ল। কি সুমুধুর সে আযান--‘আস্সালাতো খাইরুন মিনান নাউম...।’ প্রকৃতিতে কেমন জানি নিরবতা ভাঙ্গতে শুরু করল। দূর থেকে আযানের ধ্বনি ধীরে ধীরে এ গাঁয়ে এসে বাতাসের সাথে মিশে যায়। গ্রামটির নাম স্বর্ণগ্রাম। হ্যাঁ স্বর্ণগ্রাম। এ গাঁয়ে এক কালে সোনা ফলত। সোনার ফসলে মুখরিত হত এ গাঁয়ের সহজ সরল জীবন যাত্রার। মাটির মত মায়াশীল মায়েরা মেয়ের নাম তাই হয়তো রাখতো স্বর্ণলতা, সবুজী, সোনাবিবি ইত্যাদি। ফসলের নামে নাম রাখত ছেলেদের--শৈষশ্যা, ধনিয়া, নীলা ইত্যাদি। আজ আর সেই দিন নেই। আউশ ধানের চালের সাথে মিশে গেছে ইরি ধানের চাল । খাঁটি সরিষা আজ আর পাওয়া যায় না । মানুষেরা আজ ছন্নছাড়া, ক্ষুধার্ত, তৃষ্ণার্ত । দু’বেলা জোটে না দু’মুঠো ভাত। দরিদ্র চাষী বৃষ্টির অভাবে দেহের ঘাম দিয়ে চৈত্রালী ফসল ফলায়। তবুও জীবনের বিড়ম্বনা।

আযানের সুমধুর কন্ঠের তান শেষ হতেই ছোট এক কুঁড়েঘর থেকে চান মিয়া আরেক কুঁড়ে ঘরের দিকে মুখ করে বারবার ডাকতে লাগল, আদু--‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌'আরে ঐ আদু, দরজা খোল, আযান দি হালাইছে...।' চান্দু ঘরের কোণার মাটির কলস থেকে এক বালতি পানি নিয়ে বাইরে গেল। তারপর বালতি থেকে এক বদনা পানি ভরে নিয়ে জঙ্গলে ঘেরা বাঁশ আর পাটের চট দিয়ে বানানো পায়খানায় চলে গেল। প্রকৃতির কাজ শেষ করে পুকুরে গিয়ে ওযু করে ঘরে এল। উত্তর ঘরে চেয়ে দেখল আদু তখনও দরজা খুলে নাই। চান্দু আবার ডাকতে শুরু করল। না-- কোন সারা শব্দ নাই। চান্দু দরজার কাছে গিয়ে দরজাটা বারবার ধাক্কা দিল। পটপট্ করে উঠল পাটখড়ির দরজা, কয়েকটা পাটখড়ি ভেঙ্গেই গেল। গতকাল আদু হাড়ভাঙ্গা খাঁটুনী খেটেছে। তাই তার এত গভীর ঘুম! ‘--আদু, আরে ঐ আদু, পাট বেঁচতে যাবি কোন সুম্?’ আদু এবার গোঙ্গানী দিয়ে উঠল, হাত-পা মোড়ামুড়ি দিয়ে উঠে দরজা খুলল। ‘-- কিরে তর ঘুম অইল, ওসমানগো টলার তো যাইবগানে, তারাতারি আগদে যা--।’ চান্দু নামাজটা শেষ করে বউয়ের মাথায় হাত দিয়ে বলল, জহুরা, আরে এই জহুরা ওঠ--। তারপর নিজেই পান্তা ভাত থালে নিয়ে মরিচ, পিয়াজ খুঁজতে লাগল। কোথাও পিয়াজ-মরিচ না পেয়ে জহুরাকে আবার ডাকতে লাগল--‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌ 'ঐ জহুরা পিয়াজ-মরিচ কৈ রাখছস? হুদা পান্তা খাওন যায়! এই জহুরা--।'


বাঁশ, কাঠ আর পাটের দড়ি দিয়ে বানানো ছোট পাটাতনে চান্দুর বড় মেয়ে স্বর্ণলতা আর ছোট মেয়ে ফতি, নীচে মাটির উপর হোগলা আর কচুরী দিয়ে বানানো মাদুর বিছিয়ে চান্দু আর জহুরা ঘুমায়। জহুরা হোগলা ও কচুরী অথবা রোদে শুকানো শুধু কচুরী ডগা দিয়ে মাদুর বানাতে পারে। কাঠের দাম বেশী বলে কাঠ দিয়ে পাটাতন গড়তে পারেনি। খাট কিনার সামর্থ নেই বলে মেয়ে দু’টোর জন্য বাঁশ, জীর্ণ কাঠ আর পাট দিয়ে নিজ হাতে পাটাতন বানিয়েছে। গত কয়েক মাসের গতরে খাটা জমানো টাকা দিয়ে নিজের পরিবারের জন্য দু’চালা ঘর তৈরী করেছে। আর উত্তরের ঘরটা--ছন, বাঁশ আর পাটখড়ির তৈরী, যেখানে আদু থাকে, সেটা একই অবস্থায় আছে। তবে স্বর্ণার বিয়ের আগে ঐ ঘরটার ছনের ছাউনি পরিবর্তন করে টিন দিয়ে চালা দেবার বিষয়ে প্রায়ই কথা উঠে।


জহুরা অসুস্থ শরীর নিয়ে ঘুম থেকে উঠে হাত-মুখ ধুয়ে পিয়াজ-মরিচ-লবণ দিয়ে ভর্তা তৈরী করেছে। আদু লুঙ্গি দিয়ে হাত-মুখ মুছে চান্দু মিয়ার সাথে খেতে বসল। জহুরা দু’জনার থালাতে সব ভর্তা ভাগ করে দিল।
--এ কি করলা, সব ভরর্তা--
--আরো পিয়াইজ-মরিছ আছে--
খাওয়া শেষে আদু ঢেকুর দিল। লুঙ্গিটা মাজায় ভালভাবে পেচিয়ে গেন্জিটা গায়ে দিয়ে চাচীর দিকে তাকাল--
--চাচীগো, গলা দিয়া বেক ভাত বাইর অইয়া আইতে চায়--
--যাও বাজান দুপুরে তোমার বরশীতে ধরা টাকী মাছ রান্দুমনে-
মজার খাবারের কথা শুনে আদু মুচকী হাসি দিল। গতকাল ফতিকে সাথে নিয়ে বোগদার বিল থেকে বরশী দিয়ে সে বারোটা টাকি মাছ ধরেছে।
-- চাচী, গোটা দুই টাকী দিয়া বর্তা কইরেন।
--আইচ্চ--
চান্দু ঘরে গিয়ে বড় মেয়েকে ডাকতে লাগল--
--স্বর্ণা, মাগো, ওট মা, পাটগুলান উত্তর ঘর থিকা উডানে আন, টলারে উডাইতে অইব। ওট মা--
স্বর্ণা এক পাইরা শাড়ীটা ঠিক করে হাম্ দিয়ে বিছানা থেকে উঠল। ছিঁড়া-ফাঁড়া কাঁথাটা ছোট বোন ফতির গায়ে ভালভাবে জড়ায়ে দিল। স্বর্ণা উত্তর ঘর থেকে তিনটা চটের টুকরা এনে উঠানে বিছিয়ে দিল। আর এই সুযোগে আদু আশে-পাশে তাকিয়ে ভিজা হাত স্বর্ণার শাড়ীর আঁচলে মুছে নিল।
--এই কর কি!
--কিরে তোর শাড়ীতে গন্ধ কেন ? রাইতে বিছিনায় মুতছসনি ?
--দূর! তোমার মতনি...

স্বর্ণা লজ্জা পেয়ে উত্তর ঘওে চলে গেল। না, আদু এ পরিবারের কেউ নয়। পিতৃমাতৃহীন এই ছেলেটি নাওখোলা, নাওডোবা, বড়কৃষ্টনগর হাঁটে হাঁটে ভিক্ষা করে। চান্দুর নিজের কোন ছেলে সন্তান না থাকায় ছলেটির জন্য তার খুব মায়া লাগে। ছেলেটি দরাজ গলায় বেশ পল্লীগীতি গায়। প্রায়ই চান্দু ওকে হাঁটে দেখতে পায়। গত বছর নাওডোবার হাঁটে এসে ওর সাথে খাঁতির করে সে ওকে বাড়িতে নিয়ে আসে। সেই থেকে সে চান্দুর সাথে গৃহস্থালী কাজ করে।
-- চাচা, আগের মতন এইবার পাট ফিরতি আনুম না কছকি! ১০০০ টাকা দরে না বেচতে পারলে মোল্লাগো সুদ দিমু কেমনে? মাইয়া ডাঙ্গর অইচে না--বিয়া দেওন লাগব না?
-- হ,বয়স কি অইছে-- দেহস না কালাই বেপারী কেমন তাগাদা শুরু করছে। আরে বেডা, তর বউ আছে--পোলা আছে --আমার মাইয়া লইয়া টানাটানি কেন?
--চাচা, এই পাট ধইয় কইতাছি--অরে খুন করুম। শালার পাট কাইট্রা দিলাম--শালায় ১০০ টাকার কথা কইয়া ৫০ টাকা দিল। আর কইল তার পশ্চিমের ক্ষেত কাইট্রা দিলে তহন এই ৫০ টেকা দিয়া দিব।
-- হ, অইছে ও মাথায় ল। হুন গাঙ্গে যাইয়া ওসমাইননাগো টলারে উডাবি, বুচছস্--
-- হ, বুচছি--

ট্রলারে চান্দু মিয়ার সাথে শওকত মিয়ার কথা চলছে। সেও হাঁটে পাট বিক্রি করতে যাচ্ছে। গতকাল একজন মহিলা শওকত মিয়ার বাড়িতে এসে তার পরিবারের সবাইকে বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা সম্পর্কে বুঝিয়ে গেছে। সে বিষয়ে শওকত চান্দুকে বলছে,
--জানস চান্দু, কাউলকা এক শিখ্খিত মাতারি আমাগো বাইতে আইয়া আমাগো কাসুরে ইসকুলে যাওনের কতা কইতাছে। আমাগোও পড়নের কতা কইতাছে। হেয় কয় আমরা নাকি চখ থাকতেও কানা। নিজেগো নামডা নিজেরা লিখতে পারলে--কত কামে লাগে । ঠিক অইতো কইছে, তাই না? আরে এট্রু লেহাপড়া জানলে মোল্লায় আমাগো জমিডা টিপসই দিয়া লইতে পারে? কিন্ত কি করুম চান্দু, সংসারে ১০ জন মানুষ আমরা, একলা কামে সংসার চলে না। কাসু আমার লগে কামে গেলে ৫০ টাকা পায়। অহন কও, লেহাপড়া আগে, না কাম আগে। আগে পেডের মইদ্যে ভাত গেলে তো তারপর অন্য কথা। না খাইয় মইরা গেলেও তো কোন হালায় জিগায় না।
-- আর কইও না শওকত বাই, আমাগো জীবনে শান্তি নাই। দেহ আউজগা হাডে পাডের কি অবস্থা অয়।

(চলবে)

No comments:

Post a Comment