আড়িয়াল বিলের ইতিকথা

[img|http://ciu.somewherein.net/ciu/image/78831/small/?token_id=34963a64322b52a6b1cac106a77a134d]
বর্ষায় দিগন্ত বিস্তৃত আড়িয়াল বিলের ফাঁকে ফাঁকে ছোট ছোট গল্পের মত ভেসে থাকে ছোট ছোট গ্রাম। বর্ষার পলিমাখা জল শুকিয়ে গেলে বিলের নিচু জমিতে ধানের ক্ষেত সারা বছর রং বদলায়। এক সময় বিলের জলে হাত ডুবিয়ে ইচ্ছে করলে মুঠি মুঠি মাছ তুলে আনা যেত। নানা জাতের অসংখ্য মাছ, সাপ, কুমির, ঘড়িয়াল, কাছিম, শুশুক, ডলফিন, কাঁকড়া ব্যাঙ, জোঁক, পোঁকা-মাকড়, পাখি, শিয়াল, বাগডাসা, বেজি, শাপলা, কচুরীপানা, হিজল গাছ আর অগণিত জাতের পোকা-মাকড়ের এক মহা জীব-বৈচিত্রের রাজ্য ছিল এ বিলে। ‘কড়কড়া ভাত আর সরপড়া পুঁটি অথবা কই পাতরি’; খাইয়া মাছের ঝোল, শুইয়া রমণীর কোল--আনন্দে বলো হরি হরি বোল’; ‘মাগুর মাছের ঝোল--নব যুবতীর কোল--আর হরি হরি বোল’--এ রকম নানা কথা, নানা ছড়া এক সময় এ বিলের পাড়ায পাড়ায় প্রচলিত ছিল। আজ ধীবর বা কৈবর্ত জাতের জেলেরা ভাল নেই; ভাল সেই আড়িয়াল বিলের মানুষ। আজ যেন, শুধুই অংকিত কোন বিলের ছায়া! আর যদি কথিত বিমান বন্দর গড়ে উঠে তাহলে এ বিল হবে হাস্যকর, অবিশ্বাস্য কোন রুপকথা!
[img|http://ciu.somewherein.net/ciu/image/78817/small/?token_id=c0facc37118bc70c37d7c556bf1d143c]
এক সময় ভাগ্যকুল, বালাশুরের কুন্ডুরা বিক্রমপুরের সবচেয়ে ধনী পরিবার ছিল। বাংলার নবাব খুশী হয়ে এদের অতি সন্মানীত ‘রায়’ উপাধী প্রদান করেন। সেই সময় কুমার প্রমথ নাথ রায় অবিভক্ত বঙ্গদেশের মধ্যে সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি ছিলেন। ইন্ডিয়া ব্যাঙ্ক ১৯১৯-২০ সালের দিকে এ বংশের ধনকুবের কুমার প্রমথনাথের কাছ থেকে বিরাট অংকের  ঋণ গ্রহণ করে। অবিভক্ত বাংলার প্রতি জেলাতে, এমনকি বিহারের কোথাও কেথাও এই বংশের জমিদারী  ছিল। এই বংশের যোগ্য সন্তান পঙ্কজ রায় এক কালে ক্রিকেটের জগতে এক নম্বর ব্যাটসম্যান ছিলেন। ভিনু মানকর ও পঙ্কজ রায় জুটি একবার একত্রে ৪১৩ রান তুলেছিলেন।

ভাগ্যকুলের রায়েরা ছিলেন জাতে তিলি, টাইটেলে কুন্ডু--এদের বলা হত সৎশুদ্র। এক কালে এরা খুব গরিব ছিল। প্রচলিত মিথ আছে--এদের এক পূর্ব পুরুষ নদী পথে চলতে  হঠাৎ দেখেন, নদীর পাড় ভাঙ্গার সাথে সাথে বিশাল অট্রালিকা ভেঙ্গে পড়ছে, আর ভাঙ্গা দেওয়ালের সংগে সংগে জলে পড়ছে  বিক্রমপুরের বিখ্যাত রাজা বল্লাল সেনের গুপ্তধনের ভান্ডার --অজস্র সোনার মোহর আর রৌপ্য মুদ্রা, তারপর...। কৃঞ্চজীবন কুন্ডু--রামচন্দ্র রায়--গঙ্গাপ্রসাদ--গুরু প্রসাদ, হরিপ্রসাদ, চৈতন্যপ্রসাদ ও প্রেমচাঁদ প্রসাদ--মধুরামোহন, প্যারীমোহন , কিশোরীমোহন, গোপীমোহন, বৈকুন্ঠমোহন, শ্রীনাথ, সীতানাথ, রাজা জানকীনাথ--কুমার প্রমথনাথ, রমেন্দ্রনাথ--যদুনাথ রায়, প্রিয়নাথ রায়: এই বংশ ধারার মধ্যে রামচন্দ্র প্রথম রায় উপাধী লাভ করেন; শ্রীনাথ ও জানকী নাথ ব্রিটিশ সরকারের কাছ থেকে ‘রাজা’ উপাধী লাভ করেন; শ্রীনাথের পুত্র প্রমথনাথ ‘কুমার’ উপাধী লাভ করেন। শুরুতে এদের বসতি ছিল বিক্রমপুরের নুরপুর গ্রাম, পদ্মার ভাঙ্গনে এরপর আওয়াল গ্রাম, হাতারপাড়া গ্রাম, সবশেষে ভাগেরকুল (ভাগ্যকুল) ও  রাঢ়িখালের বালাশুর গ্রাম। ১৮৭৪-৭৯--এ সময়ে ভাগ্যকুলের প্রাসাদ পদ্মার করাল গ্রাসে হারাতে থাকলে, আড়িয়াল বিলের ধারে বালাশুর গ্রামে সীতানাথের দুই পুত্র যদুনাথ ও প্রিয়নাথ নতুন প্রাসাদ গড়ে তোলেন। জমিদারী, মহাজনি, জাহাজের ব্যবসা ইত্যাদি করেই তাদের এত সমৃদ্ধি। বালাশুরের এই প্রাসাদ, রাজকর্মচারীদের বসতি আর জনপথের নিরব চিহ্ন দেখে রাঢ়িখালের কৃতি সন্তান ডঃ হুমায়ুন আজাদ লিখেছেন, বিলের ধারে প্যারীস শহর।
[img|http://ciu.somewherein.net/ciu/image/78818/small/?token_id=c0facc37118bc70c37d7c556bf1d143c]
আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন্  বিজ্ঞানী আচার্য স্যার জগদ্বীশ চন্দ্র বসুর বাড়ী এ বিলের রাঢ়িখাল গ্রামে। তার বাড়ী এখন বসু ইন্সটিউট ও কলেজ। তাদের পাকা ঘরটি এতদিন যাদুঘর হিসাবে ছিল। যে কোন দিন ভেঙ্গে যেতে পারে এই কারণে যাদুঘরটি পূর্ব দিকে নব নির্মিত একতলা পাকা ঘরে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। এখানে তার বেতার তরঙ্গ, গাছের প্রাণ আছে ইত্যাদি গবেষণার ডকুমেন্ট, তার নানা সময়ের ছবি এবং তার পরিবারের ছবি প্রদর্শন  করা হয়েছে।

হাজার বছরের মনীষী--যার মেধা আর মননে মানুষ আর ধর্ম সত্যিকারভাবে প্রকাশ পায়। আমাদের দু’ শতাধিক সুহৃদের দলটির ভাগ্য অতি সুপ্রসন্ন বলতে হয় কারন, হুমাযুন আজাদের কবর দেখতে দেখতে আমরা যখন  চোখ বন্ধ করে তার লেখায় ভাসছি তখনি চোখ খুলে দেখি তার অনুজ মন্জুর কবীর মাতিনকে। কথা হয় হুমায়ুন আজাদের নানা সময়ের নানা বিষয়ের বিভিন্ন দিক নিয়ে। চমৎকার তার কবরবেদী--যে বইটির জন্য তার অসময়ে চলে যাওয়া--সেই বই এর মত নকশার মাঝে  চির শায়িত মুক্ত চিন্তার পথিকৃত।


সমযের লাশ

 দরজার বাইরে বাবার হাসির শব্দ শোনা গেল। বাবার সাথে আর একজনের হাসিও শুনতে পেলাম। আমি রাম প্রসাদের মাথায় জল ঢালতে ঢালতে রামকে জিজ্ঞাসা করলাম--‘রাম,আরো জল ঢালব ?’ --না, শব্দটি বলেই দৌঁড়ে দরজা খুলতে গেল। আনন্দে নেচে নেচে বলতে লাগল, ‘বাবা আসছে, বাবা আসছে।’ আমি প্রায় অপ্রস্তুত ছিলাম। রামকে আর থামানো গেল না। জল বেয়ে পড়ছে সারা শরীরে; জ্বর অথচ দুষ্টামীর শেষ নেই। রাম দরজা খুলে দিল। আমি তো হতভম্ব! কারণ বাবা প্রায়ই দুপুরবেলা একজন অতিথি নিয়ে আসেন। ঘরের ভিতরে না যেতেই রাম দরজা খুলে দিল। তখন আমার শরীরে ছিল পাতলা ধুতি--যা জড়িয়ে কোন রকমে লজ্জা নিবারণ করেছি। রামকে মাথায় জল দেবার আগে দুপুরের লক্ষ্মীর পূজাটুকু মাত্র সেরেছি । পূজা শেষ হতেই মা ডেকে বলল--‘হাত ব্যথা হয়ে গেছে কল্যাণী, এবার তুই ওর মাথায় আর কতক্ষণ জল দে--।’ সব জামা-কাপড় ছিল অশুদ্ধ। আলমারীতে শুদ্ধ কাপড় থাকলেও মার ধমকে বের করতে পারিনি। তাই ধুতি পড়েই পূজা দিলাম। ধুতি না ছাড়তেই মার ডাকে রামের মাথায় জল দিতে লাগলাম। ভালই লাগে ধুতি পড়তে; কোন রকমে লজ্জা নিবারণ মাত্র। কিন্তু আমার মনে হয়, আমি যেন নগ্ন হয়ে আছি। বারবার কাঁধের আঁচলটা মাটিতে পড়ে যায়। রাম দরজা খুলতেই দেখি, একটি ছেলে ঘরে ঢুকেছে। আমি লজ্জায় পূজার ছোট রুমে মানে ঠাকুর ঘরে ঢুকে পড়েছি। পরে বাবা ঘরের ভিতরে ঢুকেই মাকে ডাকতে ডাকতে চলে গেলেন। রামকে কোলে নিয়ে বাবা মাকে বলছে, একি অবস্থা লক্ষ্মী, ওর মাথাটা মুছে দাওনি। মা বলছে, কল্যাণীতো মাথায় জল দিয়েছে, মেয়েটা মুছেও দেয়নি? বোধ হয়, মা আঁচল দিয়ে মুছে দিচেছ ।

এদিকে ছেলেটি ঠাকুর ঘরে ঢুকে প্রণাম করল। পরিধানের কারণে লজ্জায় কিছু বলতেও পারছিনা। ছেলেটা বলতে লাগল, মা দেবী, তোমার পূজা যদি স্বল্প পোশাকে করতে হয়, তবে পোশাক না পড়লে হয় না? এরপর যা বলেছে--তা আর বলার মত না। তবে স্বরস্বতী দেবীর দিকে তাকিয়ে বলতে লাগল--‘স্বরস্বতী মহাভাগে--বিদ্যে কমললোচনে--বিশ্বরূপে বিশালাক্ষি--বিদ্যাংদেহী নমস্তোতেঃ। আহা দেবী ! এই মন্ত্র পাঠ করিলে যদি তুমি বিদ্যাই দিতা, তবে এই কিশোরী আর যাই হোক ধর্মে আর অংকে ফেল মারিত না।’ বুঝতে আর বাকী রইল না, ছেলেটা আমাকে দেখেছে। দরজার কোনায় রোদে শুকানো মায়ের শাড়ী টেনে দিয়ে পর্দার আড়াল করেছি।  হঠাৎ করেই সেটা টান দিয়ে ফেলে দিল। অনুসন্ধিৎসু মন নিয়ে চেয়ে রইল আমার চোখ আর মুখের দিকে। আমি এমন হতভম্ব হয়েছি যে, কাঁথের উপর ধুতির অংশটুকু কখন যে পড়ে গেছে আমার পায়ের কাছে, টেরও পাইনি। নবম শ্রেণীর ছাত্রীর বুকের আকাশটা কি হতে পারে--সে অভিজ্ঞতা তখন বুঝিনি। আজ নাতনীর বুক দেখে সে দিনকার কথা মনে পড়ে। আমার মনে পড়ে, ছেলেটা শুধু তাকিয়ে ছিল; হাত দিয়ে কোথাও ছুঁয়ে দেখেনি। শুধু বলেছে, ‘তুমি এত সুন্দর ! ইচ্ছে করে রক্ত দিয়ে তোমাকে সাজাই--দেখি আরো কত সুন্দর দেখায়।’ কি আশ্চর্য! যে বটি দা দিয়ে পূজার ফল কাটতে ছিলাম, সে দা দিয়ে সে তার আঙ্গুল কাঁটতে উদ্দত হল। হঠাৎ বাবার কণ্ঠস্বরে সে দৌঁড়ে চলে যায়। সে যাত্রা আমার জীবনের...। ছেলেটা বাবার সাথে আবার বাইরে চলে গেল। অবাক হলাম, কি করে জানল, আমি অংকে আর ধর্মে ফেল করেছি। বোধ হয়, বাবা বলেছে।

এই সেই ছেলে--এই সেই যুবক--এই সেই শহীদ--সুমাদ জাকারিয়া। ওকে প্রতিদিন পলাশ গাছের গোড়ায় বসতে দেখি। করুন চোখে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। দাদুর কাছে পড়তে গেলে ওকে প্রায়ই দেখতাম। বিগত ৪১ বৎসরে স্বামী তথা সকলের ভয়ে, লোক লজ্জায় এ লেখা প্রকাশ করতে পারিনি। জীবনের গভীর মায়াময় স্মৃতিটা আজো বুকের ভিতর লুকিয়ে রেখেছি। ছেলেরা বড় হল--বিয়ে করল। মেয়েদের বিয়ে দিলাম। আজ নিঃসঙ্গ চিত্তে নাতী-নাতনীদের ভিড়ে খুঁজতে বেড়াই সুমাদকে। প্রতিবছর খুঁজি বই মেলায়--শহীদ মিনারে--পথে পথে--কোথাও ওকে পাইনি খুঁজে। জানিনা, এ লেখা প্রকাশ হবার পর ছেলে-মেয়েরা কি ভাববে। আমি বলব, সবাই আমরা মানুষ। সবারি জীবনে ঘটনা আছে, স্মৃতি আছে। কারোটা গভীর ক্ষত হয়ে আছে, কারোটা ভাসা ভাসা। আগে একুশের মাঝে ওকে খুঁজে পেতাম; এখন কেমন যেন  জাপসা দেখায়। বয়সের ভার বোধ হয়, এ নশ্বরদেহ আর বইতে পারছে না।

স্বামীর মৃত্যুর পর কি যেন হারালাম । আমি শুধু স্বামীই নয়, সুমাদের স্মৃতিও যেন হারাতে লাগলাম। নিজেকে বড় শূণ্য লাগে। বাড়ীতে অনেক লোক থাকা সত্ত্বেও মনে হয়, কেহ নাই। এরকম মনে হয়েছিল সুমাদের মৃত্যুর কয়েক মাস আর বিয়ের পর বিমল বোম্বে চলে গেলে। শূণ্যতা যে কি অসহায় অবস্থা তা আমার মত বৃদ্ধারাই জানে। সময়ের কাছে জীবনের পরাজয় মেনে নিলেও সময়ের সাথে সুমাদের স্মৃতি বিস্মৃত হবে, এ আমি মেনে নিতে পারিনা; আর পারিনা বলেই, গদ্যের এই স্মৃতিগত ক্ষুদ্র প্রয়াস।

দাদুর কাছে পড়তে গেলে আগে দু’একদিন বন্ধ দিতাম। এখন পারলে দিনে দু’বার যাই। কারণ যখনই পড়তে যাই, তখনই ওকে দেখি। হয় মাঠে বসে আড্ডা দিচ্ছে; নয়তো অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। দু’মাস বয়ে গেছে শুধু দেখা দেখি। আমাদের বাসা থেকে খানিক দূরে দাদুর বাসা। দীননাথ চক্রবর্তী আমার বাবারও শিক্ষক, তাই মায়ের কথামত দাদু বলি। আজ দাদুর জন্য পিঠা নিয়ে যাচ্ছি। মা দাদুর জন্য পিঠা দিয়েছে । রাস্তার  হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ সমস্ত বুকটা কেঁপে উঠল। যাকে দূর থেকে আড়চোখে দেখতাম, সে আজ রাস্তায় দাঁড়িয়ে কি করছে? ভয়ে ভয়ে এগোতে লাগলাম। দেখি, একটা কাগজ ইট দ্বারা চাপা দিয়ে ও সরে গেল। বুঝতে আমার বাকী রইল না। সোজা হেঁটে দাদুর বাসায় চলে গেলাম। চিঠির দিকে ভ্র“ক্ষেপও নেই আমার। পরের দিনও দেখি চিঠি একই অবস্থায় ইটে চাপা পড়ে আছে। কিছুক্ষণ কাগজটির দিকে তাকিয়ে রইলাম। হঠাৎ কি যেন অনুভূতি জাগল মনে। ভয়ে ভয়ে কাগজ উঠায়ে চারদিকে তাকালাম। না, কোথাও কেউ নেই। বেশ পাকা হাতে বুকের ভিতর কাগজটা লুকিয়ে রাখলাম। যেন, কেউ না দেখে। রাত তখন বারোটা। রাম আমার পাশে শুয়ে আছে। চারদিক নিস্তদ্ধ। কেউ জেগে নেই। ভয়ে ভয়ে বুকের ভিতর থেকে কাগজটি বের করলাম। খুলতে দারুন ভয় লাগছে। সবুজ জমিনের উপর লাল বৃত্তের একটি কাগজ সুন্দর করে ভাঁজ করা। পুরো কাগজটা খুলতেই আরো দুইটি  কাগজ বের হয়ে এল। একটা কাগজের ভিতর ওর নিজের আঁকা ছবি। কি সুন্দর হাসছে। আর একটা কাগজে আঁকা একটা মানচিত্র---পূর্ববাংলার। আরেকটা কাগজে ছোট ছোট করে লেখা। কিন্তু হায়! সব উল্টা করে লেখা। একেবারে উপরে লেখা ঞধশব ধ সরৎৎড়ৎ ধহফ...আমি আমার পড়ার টেবিল থেকে আয়না আনলাম। বুঝলাম, ও আমাকে কষ্ট দিতে চায়। ও চায় ওকে নিয়ে আমি ভাবি। আমি আয়নার সাহায্যে পড়তে শুরু করলাম--
‘‘রূপশ্রী, তোমাকে প্রথম থেকেই আমি চিনেছি। আমি কে? তুমি আমাকে চিনবে না। আমাকে চিনতে তোমার অনেক সময় লাগবে। আমি নক্ষত্রের কোন এক বিদ্রোহী তারা। না, এ পৃথিবীরই শুধু আমি বাসিন্দা নই, আমি মহাবিশ্বের। পৃথিবীর মত আরো পৃথিবী আছে, এ মহাবিশ্বে। যেখানে সংঘাত, বিশৃংখলা, দুর্নীতি, জালিয়াতি, অত্যাচারের ঝড়ো হাওয়া বয়ে যায়Ñসেখানকার অধিবাসী হয়ে জš§ নিই আমি বারেবারে। তোমাদের এ ভারতবর্ষে আমাকে অনেক বার জš§ নিতে হয়েছে। ভয় পাচ্ছ? ভয় নেই, তোমাকে মুক্ত করতেই এ মর্ত্যে আমার জš§। তোমাকে স্বাধীনতা দেব। তোমার বুকে একটা মানচিত্র আঁকব আর রক্ত দিয়ে মেখে মানচিত্রের পাকা দলিল তোমার হাতে দিয়ে যাব। তুমি সুন্দর। তুমি বাংলার মানে পূর্ববাংলার এক প্রতীকি মানচিত্র। পাগল ভাবছ? সব নারীরা পুরুষদের একটু পাগল ভাবে কারণ নারীরা পুরুষ জাতিকে গর্ভে ধারণ করে এবং তাদের স্বেচ্ছাচারিতাকে প্রশ্রয় দেয়, ফলে পাগল সন্মোধনটা আদর অথবা ভালোবাসার কারণে চলে আসে। কিন্তু তাই বলে তুমি আমার মা, বোন কিবা প্রেমিকা না। তোমাদের কুসংস্কারচ্ছন্ন সমাজে যাদের তোমরা পিসি, মাসী, কাকা ইত্যাদি ডাকÑআমি সে দলের কেউ নই। আমি অন্য রকম আত্মীয়; এ আত্মীয়ের স্বরূপ রবীন্দ্র, বঙ্কিম কিবা মাইকেল মধুসূদন কেউ বর্ণনা দিয়ে যায়নি। রহস্য লাগছে, থাক পড়তে হবে না আর। কোথাও লুকিয়ে রাখ অথবা ছিঁড়ে ফেল, তারপর ঘুমিয়ে পড়। আমি গভীর রাতে সব বুঝিয়ে দেব। আমাকে বুকে রেখ না, তাহলে হৃদয়ে চলে যাব।” ‘ ইস্ এত সহজ, দুষ্টু, এতক্ষণতো বুকেই ছিলে। যাও বুকেই থাকÑহৃদয়ে যাওতো দেখি।’ বালিশে মাথা রেখে চিন্তা করতে লাগলাম। চিন্তার ঘোরে একসময় ঘুমিয়ে গেলাম। হঠাৎ চোখের সামনে ভেসে উঠল পদ্মা-মেঘনা-যমুনা। সারা দেশ কাঁদছে আমার জন্য। কিন্তু এখানে কারা হাসছেÑওদের  হাতে বোমা কেন, পিস্তল কেনÑবন্ধুক কেন? আমার হাত যুদ্ধ বিমান হচ্ছেÑপা ছুটে চলেছে ট্রেনের গতিতেÑমুখ চিৎকার করছেÑকেউ শুনছে না। আমার একটা কলঙ্ক আছে। একদল পাখি আমাকে শুনিয়ে দিয়ে গেল। কি সেই কলঙ্ক! আমার হৃদয় সমস্ত দেহের ভালোবাসা চায়। অথচ অঙ্গ-পতঙ্গ আমাকে ছেড়ে দূরে যাচ্ছে কেন? আমার বুকে প্রবাহিত নদীগুলি শুকিয়ে যাচ্ছে। মাথার উপরে পাখিরা কাঁদছে। কাঁদছে আমার হৃদয়। হঠাৎ কোন এক অপরিচিত মহিলাÑনিজেকে সাহিত্যিক পরিচয় দিচ্ছেÑঅনেকটা আমার মত দেখতেÑতার লেখা ‘না গদ্য না পদ্য’ আমাকে শুনাচ্ছেÑ“একটি মরুভূমি ভালবাসার প্রত্যাশায় যেমন সুদীর্ঘকাল অপেক্ষা করে সাগরের ছোঁয়া পেতে। সময়ের রুদ্র প্রখরে তীব্র তাপে তার হৃদয় যখন গলতে শুরু করে স্মশানের জ্বলন্ত লাশের মতÑতখন সে পাগলিনীর মত ডাকে, সাগর, সাগরÑ। কেউ তার ডাক শুনে না। শুনতে পায় না কোন মরুযাত্রী। সে ডাক বাজপাখী কিবা বাদুর পাখির ডাকের মত। যে ডাক বারবার প্রতিফলিত হয় খেঁজুর গাছের মাথা থেকে। সে ডাক আকাশকে কম্পিত করে। আকাশের বুকে হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে থাকা পাহাড়কে ভীতির সঞ্চার করে জাগায়ে তোলে। সময়ের তীব্র ক্রোপানলে, আগুনের মতো জ্বালাময় কষ্টে মরুভূমির বুক খসে খসে ধূলো হয়ে যায়। ধূলো উড়ে যায় আকাশের বুকে, পাহাড়ের শিখরদেশে, বাতাসের নাসারন্ধ্রে, কালো মেঘের কন্যার কাছে। ধূলো-বাতাস পৌঁছে দেয় মরুদুলালী হতভাগিনীর ব্যর্থ ভালবাসার শ্মশান জ্বালার করুণ হৃদয়স্পর্শী চিত্র, নির্মম বেদনার লেলিহান প্রখর দৃষ্টির ছোবল কাহিনী। আকাশ-বাতাস সবাই শুনেÑসবাই দেখেÑতারপর বিরহ বেদনায় খানিকক্ষণ আফসোস করে। বেদনা বেদনাই রয়ে যায়। কেউ তাকে ভালবাসে না। তার জ্বালা তার বেদনা তার নক্ষত্রসমদূর কষ্ট ক্রমোত্তর বাড়তে থাকে। তবুও এক টুকরো জোনাকী আলোর মত ভালবাসা কারো কাছে প্রত্যাশা করেও আশাহত হয় বারবার।

সাগর-নদ-নদী-শাখানদী সবার কাছে সে ভালবাসা চায়, এক টুকরো লাল ফিতা কিংবা এক টুকরো ওড়নার মত ভালোবাসা কিন্তু তার কলঙ্ক জীবন যাকে ছুঁতে চায় সেই তার মতো মরুময় হয়ে যায়। নদীর বুকে জেগে উঠে চর। তার কলঙ্ক ছোঁয়ায় জেগে উঠে সাগরের বুকে দ্বীপ। তাহলে কোন শতাব্দিতে, কোন সত্য যুগে সে ভালবাসা পেয়েছিল। আবার কত সহস্র কলিযুগ পরে সত্যযুগ আসবেÑসে ভালবাসা পাবে। যখন সাগর তাকে বুকে আঁকড়ে ধরবে। সে তখন হবে সাগরিকা কিংবা সাগর কন্যা। তখন নদী, গাছপালা, পথ-প্রান্তর, পশুপাখী সবাই তাকে মুঠি মুঠি ভালোবাসা দেবে। তার বুকের স্রোতে ভাসবে জাহাজ, নৌকা ইত্যাদি। তার পায়ে বাজবে ঘুঙ্গুর। তার হৃদয় কণ্ঠ থেকে শিবের শঙ্খ বাজবে। তখন তার প্রেমের গভীরতা সবাই বুঝবেÑতার সুদীর্ঘ পরাধীনতার কলঙ্ক চিরতরে দূর হবে।”  কাঁথের পাটের ব্যাগ আমার বিছানায় রেখে মহিলা সাহিত্যিক কি যে বুঝালÑতার কিছুই বুঝলাম না। তবে উক্তি গুলি কেমন যেন রহস্য সৃষ্টি করল। বড় জটিল এর অর্থ কিন্তু শেষ উক্তিটির ‘পরাধীনতা’Ñশব্দটি আমাকে বেশ ভাবিয়ে তুলল। হাত দিয়ে কপালের চুল সরাতে গিয়ে দেখি বৃদ্ধা আঙ্গুল জলবিন্দুতে ভিজে গেল। আশ্চর্য! চোখে জল কেন! তাহলে এ গদ্যের অর্থ আর যাই হোকÑপুরোটা বুঝলে যে চোখে ঝর্ণা ঝরবেÑএ বিষয়ে আমি নিশ্চিত।
হঠাৎ চোখের সামনে ভেসে উঠলÑএকটি মানুষ। সে প্রতিনিয়তÑসেই মহিলা সাহিত্যিক হচ্ছেÑআবার সুমাত জাকারিয়া হচ্ছেÑকখনো আমারি মতো কিশোরী হচ্ছে। ক্রমাগত এই তিনরূপে একটি মানুষ পরিবর্তন হচ্ছে। সুমাত একজন নেতাÑসে আমাকে রক্ষা করার জন্য দলের নেতৃত্ব দিচ্ছে। আশ্চর্য দলে এখন মহিলা সাহিত্যিক, সুমাত আরো অনেকে। আর আমি পরাধীনতার শিকলে বন্ধি। কত মিটিং, কত মিছিল, কত রক্ত বয়ে যাচ্ছে আমার জন্য । হঠাৎ গুলিবর্ষণ, কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ শুরু হয়ে গেল। দলের সবাই মরে যাচ্ছে। সুমাতের বুকে গুলি ...। নাÑবলে চিৎকার দিয়ে ঘুম থেকে জেগে উঠলাম। মা-বাবা দু’জনে দৌড়ে এল। ভাগ্যিস চিঠিটা রামের পিঠের নীচে চাপা পড়ে ছিলÑতা না হলে মা কি যে ভাবত! মা লবণ জল নিয়ে এল, আমাকে পান করাল। তারপর মা-বাবার কাছে সব বললাম। মা বলল, তোমাকে কতবার বলছিÑভাল একটা সম্ভন্ধ দেখ। না, মেয়েকে পড়াবে, পড়াও। মেয়েটি এত বড় হল। এখনো একা একা...।

দু’জনেই চলে গেল। বাবা অবশ্য আদর করে বলেছিল এগুলো কিছ ুনা, মা। কালই আমি সুমাদকে নিয়ে আসব। স্বপ্নের কথা বললেও ঠিঠির কথা গোপন রেখেছিলাম। আবার ঘুমিয়ে ভাবতে লাগলাম আর মনে মনে বলতে লাগলামÑআমি কে ? না আমি দিলীপ দাসের মেয়ে কল্যাণী। আমার বয়স চৌদ্দ। বাবা-মা আমার জন্য বর দেখছে। আমি শিক্ষিতা, সুন্দরী (সবাই বলে) আমার হবু স্বামী নিশ্চয়ই খুব সচ্ছল হবে। তবে সুমাত একি বলছেÑআমি একটা মানচিত্র। রাত তিনটা বাজে। আমি আবার কাগজ পড়তে শুরু করলাম। ‘তোমার সারা দেহের লোমে লোমে ছড়িয়ে আছে আ- ই- ক- ম- ইত্যাদি। ওরা তোমাকে দলিত মথিত করে তোমার লোমগুলি একটি একটি করে তুলে নকল উর্দু অক্ষরযুক্ত লোম লাগিয়ে দেবে। তুমি অপসংস্কৃতিতে ডুবে যাবেÑপরাধীনতার শৃংখলে ডুবে যাবে। তোমার ভাষা হবে দেহের সাথে সম্পর্কহীন। তোমার কথা এত মধুর শুনাবে না। বুঝতে পারনি ? পাকিস্তানীরা তোমার ভাষা কেড়ে নেবে। ভয় নেই, আমি তো আছি। আমি এসিড হয়ে ক্ষারের সাথে বিক্রিয়া করে উৎপাদন করবো লবন ও পানি। লবণ দিয়ে দেশের জোঁকগুলোকে মারব। আর পানি দিয়ে তোমার বুকের উত্তপ্ত মরুভূমি ভরে দেবÑপদ্মা, মেঘনা, যমুনাতেÑএঁকে দেব তোমার ঠিকানা।

অবাক হচ্ছো। বারো তারিখে বিকাল তিনটায় আমাদের সভা হবে তোমাদের ঐ পশ্চিমের মাঠে। তুমি জানালা দিয়ে দেখ এবং সব বক্তৃতা শুনিও। তুমি তথা তোমরা কোথায়, কেমন আছ সব বুঝবে। এবার রাখি। কষ্ট দিলাম। দিদি, এর চেয়েও ভয়ংকর কষ্ট সম্মুখে তোমাদের...বিদায়।

১২ তারিখে মিটিং হল। সব শুনলাম, বুঝলাম,  আমরা কেমন আছি, কোথায় আছি ? যে ভাষায় আমরা কথা বলিÑযে ভাষা রক্তের সাথে আছে মিশেÑসে ভাষা পাকিস্তানীরা কেড়ে নিয়ে নিক্ষেপ করবে সমুদ্রের অতলে আর তার পরিবর্তে পাকিস্তানীদেও উর্দু ভাষায় কথা বলতে হবে। তার মানে আমাদের দেহের রক্ত পরিবর্তন করে ওদের রক্ত আমাদের দেহে ভরে দেবে। মিটিং এর শেষটা অত্যন্ত লজ্জাস্কর পরিস্তিতিতে শেষ হল। তখন সুমাদ বক্তব্য রাখছেÑ‘মাতৃভাষাকে কেড়ে নেওয়া মানে আমার মাকে তথা আমাদের মাকে কেড়ে নেওয়া। আজ আমাদের যুদ্ধের যাবার সময়Ñআজ আমাদের মিছিলে যাবার সময়। আমরা যুদ্ধে যাবÑআমরা মিছিলে যাব। মাননীয় অধ্যাপক সাহেব, সম্মানিত...ওদের সাথে আমাদের কোন সম্পর্ক থাকা উচিত নয়। আমাদের ভাষা কেড়ে নিতে দেব না। আমরা স্বাধীনতা চাই...।’ হঠাৎ কাঁদানে গ্যাস আর লাঠিচার্জ সেদিন সমস্ত মিটিং পন্ড করে দিল। ছত্রভঙ্গ হলো সবাই।

যাই হোক,আরেকদিন দাদুর কাজে অংক পরীক্ষা দিতে গিয়ে দেখি সেই আগের মত ইটের নীচে চিঠি রেখে চলে গেল। সেদিন আর ভয় পেলাম না। ওর দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে চিঠিটা উঠালাম। পা দিয়ে ইট সরাতে গিয়ে পায়ে ব্যথা পেয়ে কঁকিয়ে উঠলাম। সুমাদ দৌড়ে এল।
ঃ দেখি দেখি। পায়ের আঙ্গুল আলতো ভাবে ছুঁইয়ে দিল।
ঃ ব্যথা কমেছে?
আমার কি যে ভালো লাগলো। সারা শরীরে শিহরণ বয়ে গেলো। পায়ে চুমু দিতে আমি দৌড়ে চলে এলাম। পথে দু’একজন ছোকরা দেখেছে । বাড়ী ফিরে ড্রইং রুমে আসলাম। বাবা-মা-রাম তিন জনেই রামকৃষ্ণ মিশনে গেছে। অতএব চিঠিটা খুলতে শুরু করলাম। পুরো চিঠিতে প্রকৃতির আবছা চিত্র। আর চিত্রের উপর দিয়ে নিপূন হাতে লেখাÑ

কল্যাণী দি,
কেমন অছো ? নিশ্চয়ই স্নান সেরেছ ? চুলগুলি নুয়ে পরেছে বিছানায়। কি দেখছÑএ লেখা। তোমার অস্তিত্বের কাল্পনিক মানচিত্র এখানে লুকিয়ে আছে। তুমি ওকে খুঁজে পাবে না কারন তুমি এখনও তোমাকে চিনতে পারনি। চুলের গুচ্ছ থেকে দু’এক ফোটা জল ফেলে দেখ, কাগজটি কাঁদবে। এ কাগজ আমার শত জনমের না পাওয়ার ব্যর্থ প্রয়াসÑহারিয়ে যাওয়া লক্ষ বছরের স্মৃতির ঠিকানাবিহীন বেদনা। কাগজের প্রান্তগুলো দেখ। বামদিকে সিঁদুরের স্পর্শ দেখেছ ? ডানদিকে সবুজ রং ? সূক্ষè কতগুলো সূতা চুল হয়ে ছড়িয়ে আছে। নদীর মত প্রশান্ত জলরেখার দাগ সবুজ আর সিঁদুরের প্রান্ত ছুঁয়ে যায়। নীচে তাকাওÑচঞ্চল, নৃত্য পটিয়সী, লাস্যময়ী ঝর্নার নৃত্য শুনতে পাও। ভয় পেয়েছ? নিচে পায়ের ঘুঙুর বাঁধানো পদধ্বনি শুনেছ? আবার ভয় পেয়েছ? ভয় নেইÑএতো তুমি আর আরেকজনÑযে তোমারি মতÑঠিক তোমারি মত। তাই তোমাকে এত ভালবাসি। আমার প্রেমিকার রূপ খুঁজতে খুঁজতে একটা প্রতীক, একটা সুন্দর ছবি হিসেবে তোমাকে পেয়েছি। আমার সেই প্রেমিকাÑতোমারি মত। বুঝতে পারনি কিছ ু? লুকিয়ে রাখো হৃদয়ের গভীরে। স্মৃতির সাগরের হাজার ফুট নীচে। মরুভূমির ছোঁয়া পেলে এ লেখা আবার আসবেÑতখন বুঝবে কি এর অর্থ। খারাপ লাগছে? আজ আর নয়, এটুকুই থাক। স্বাধীন হোক, তোমার জীবন।

আরেকদিন দাদুর জন্য লুচি, চিড়া, আর নাড়–-মোয়া নিয়ে পড়তে যাচ্ছি। পথে হঠাৎ আমার পাশে এস দাঁড়িয়ে কোকিল সুরে একটা ধ্বনি দিল। পাশে তাকাতেই ভয় পেয়ে গেলাম। সুমাদ হাসছে। অথচ ওর কপাল আর মাথায় ব্যান্ডেজ।
ঃ আমাকে সারারাত বুকের কাছে নিয়ে শুয়েছিল। এখন আমাকে দেখে ভয় পাচ্ছ। আমার চোখের কাছে তার চোখ রেখে বলল, ক্ষিধা পেয়েছে, মিছিল করে আসলাম তো। পথে যেতে দেখি, তুমি আসছ। ভাবলাম টিফিনে নিশ্চয় খাবার আছে। দেবে ক্ষেতে? জান, মিছিলে মার খেয়েছি...  তারপর হাসপাতালে...

আমি টিফিন বাটি ওর হাতে দিয়ে মাথা কাঁত করলাম। টিফিন বাটি খুলেই একটা নাড়– আমার মুখে দিল। আমি মুখে নাড়–টা নিয়ে মুখটাকে স্থির করে রেখেছি। বাম হাতে একটা লুচি আর ডান হাতে এক মুঠো চিড়া নিল।
ঃ কি গো, খাবার সব অশুদ্ধ হয়ে গেল, তাই না ?
আমি মাথা নাড়লাম।
ঃ বা! তুমি তাহলে তোমাদের সংস্কার নামক কুসংস্কার মান না।
আবার মাথা নাড়লাম।
ঃ এই মেয়ে, কথা বল না কেন? ও মা! মুখে এখনো নাড়–? কষ্ট দিলাম, যাই আবার দেখা হবে।
আমার মাথায় হাত রেখে বলল, আমি কে জানতে ইচ্ছে করে না?
কিছু বললাম না। ও চলে গেল। মাথা কতটুকু ফেটেছে, কিভাবে ফাটল কিছু বললাম না। কারণ আমি কখনও ওর সাথে কোন কথা বলিনি। বাড়ীতেও খুব কম কথা বলি।

খুব সুন্দর দেখতে। নাকটা তীরের মত ধারালো। বিশাল বুক যেন, মাঠ। বোতাম খোলা শার্টটা যা ময়লা! হোস্টেলে থাকে, কে ধুইয়ে দেবে। ওমা টিফিনের বাটি আলগা করে রেখে গেছে। আমি শক্ত করে আঁটকাতে গিয়ে দেখি লাল আর সাদা কি যেন। উপরের বাটিটা উঠালাম। ওমা, রক্ত মাখা কাগজ। দ্রুত বুকের ভিতর কাগজটা লুকালাম। দাদুকে টিফিন বাটিসহ খাবার দিয়ে চলে এলাম বাড়ীতে। বাথরুমে ঢুকলামÑ
চিঠিটা খুলে পড়ছি। একি! সারাটা চিঠি রক্ত মাখা। আবছা একটা মানুষের ছবিÑহাতে ফেস্টুনÑগুলিবিদ্ধ হয়ে ভীষণ কষ্ট পাচ্ছে। আমার সারাটা শরীর কেঁপে উঠল। পড়তে শুরু করলামÑ

“হ্যাঁ, সেদিন বেশী দূরে নয়। সেদিন আমি গর্ভবতী হব। আমার গর্ভ থেকে জš§ হবে একজন মহাবিদ্রোহীরÑযে সারা বিশ্বকে মুঠি মুঠি ভালবাসা দেবে। বিভক্ত ভারতবর্ষকে আবার একত্র করবে। আতুড়ে ঘরে প্রসুতি যখন অব্যক্ত যন্ত্রণা, অসহ্য বেদনায় সমস্ত দেহ-মন নিয়ে বিদ্রোহ করে নারী জাতির প্রতি ঘৃনা অথবা ভালবাসা ঢেলে দেয়; মা, মা বলে চিৎকার করে; সাগর যখন সমস্ত জল শুকিয়ে মরুভূমি হবার সীমাহীন বেদনার শেষ গোধূলীর ছায়া যখন আঁকড়ে ধরবেÑতখন আমার মৃত্যু হবে বড় অস্বাভাবিকভাবেÑনির্মমভাবেÑযা দেখে যত ধাই, যত দর্শক আছে সবাই কাঁদবেÑবিলাপ করবে কিন্তু হবু বিশ্ব কাঁপানো মহাবিদ্রোহী বেঁচে থাকবে বেদনার উল্টোপিঠে। যতদিন জাতিতে জাতিতে যুদ্ধ হবে, যতদিন অন্যায়-অবিচার, বিশৃংঙ্খলা থাকবেÑততদিন সে আমারি আজ্ঞাবাহী, বিদ্রোহ করে যাবে অনন্তকাল। সে অমর-অক্ষয়-অবিনশ্বর। অপেক্ষা করো কল্যাণী, সেই দিনের আশায়। আজকের রক্তের কাছে এই আমার প্রদীপ্ত অঙ্গিকার...।”
 পাগল, কি সাব লিখেছে? গর্ভবতী হবে? ওকি নারী নাকি? কিছু বুঝি নাÑহ্যাঁ, সেদিন কিছু বুঝি নাই। আজ বুঝি, সব বুঝি।

মনে পড়ে, আর একদিনের কথা। সেদিন পুকুরে এক ঘটি জল আনতে গিয়েছিলাম লক্ষ্মি পূজাটা সম্পন্ন করার জন্য। অনেকটা ইচ্ছে করেই গিয়েছিলাম। গিয়ে দেখি ও স্নান করছে। পায়ের কাপড়টুকু উঠিয়ে যেই ঘটিটা পানিতে ডুবিয়েছি অমনি সে বলতে আরম্ভ করল, আমি যাকে ভালোবাসি তার পা আমি কোনদিন দেখিনি। তার বুকে হেঁটেছি, শুয়েছি। একদিন হয়তো তার কোলে ঘুমিয়ে যেতে হবে। আমি বেশ লজ্জা পেয়েছিলাম। কোন কথা না বলেই সেদিনও চলে এলাম। ঘাটের সিঁড়ির চারটি ধাপ পাড় হতেই ও আমাকে পানি ছিটিয়ে দিল। বলল, তুমি সুন্দর আমার সেই প্রেমিকার মতÑঠিক প্রেমিকার মত।

কে ওর প্রেমিকা? সেদিন বুঝতে পারিনি। আজ সব বুঝতে পারছি। আরেকদিন কোন এক কথা প্রসঙ্গে বাবাকে বলেছিল, ‘জানেন স্যার, এই পূর্ব পাকিস্তানের সবাইকে আমার বড় আপন মনে হয়। আমার তো মাÑবাবা কেউ নেই। তাই এ দেশ, এই মাটিই আমার মা-বাবা।’ ওর সাথে কখনও কথা বলিনি। কেন? লজ্জা হয়? না, অন্য কিছুÑআমি জানিনা। আমাদের ব্যাপারটা মা-বাবা-রাম সবাই জেনে গেছে। তাই আমাকে প্রায়ই মায়ের বকা শুনতে হয়। সুমাদকেও একবার বকা শুনতে হয়েছে। একদিন দূর থেকে ওকে দেখেছিলাম। ও কাঁদছে। কেন কাঁদছে? কেন? সেদিন চিন্তায় চিন্তায় সারারাত ঘুমাতে পারিনি। শেষ রাতে ঘুমিয়ে গেলে স্বপ্নে দেখি সামাদ আমাকে ছেড়ে বহুদুরেÑগ্রহ থেকে গ্রহান্তরে চলে যাচ্ছে। আমি কাঁদছিÑসেই স্বপ্ন থেকে আজও কাঁদছি। আমার কান্না বোধ হয়, মৃত্যুতেও শেষ হবে না। মা যে বলেছিল, যবন, নাস্তিক ছেলেকে ভালোবেসেছি বলে ভগবান নরকে নিয়ে আমাকে কাঁদাবে।

কত চিঠি দিয়েছিলÑতা গুনেও দেখিনি। যে কয়টা সংরক্ষণে ছিলÑতা এই লেখনিতে সাজালাম। ধর্ম নিয়ে কথা উঠলে মাকে সুমাদ বলেছিল,‘ কাকীমা, আমি ও স্যারÑআমরা কোন নির্দিষ্ট ধর্মের শিকলে বন্ধি নইÑআমার সকল ধর্মের উর্ধেŸ।’ মা অবশ্য রেগেছিল। সুমাদ গরু, কাছিম, শুকর, ছাগলের মাংস খেতÑসামান্যও ঘৃনা হত না। আমি কোনদিন মাংস খাইনি, আজো খাই না। না খেতে খেতে এখন অভ্যাস হয়ে গেছে।

ফেব্রে“ায়ারীর ২০ তারিখ। বিকাল  বেলা রামকে নিয়ে ঘাটে গেছি জল আনতে। জল ভরে আমি সিঁড়ির উপর উঠে দেখি কৃষ্ণচুড়া গাছের গোড়ায় বসে অশ্র“নয়নে হাত-পা কাটছে। আমি ভয়ে ঝোপঝারের পথে দিয়ে আসতেই সে পথ আটকাল। ‘কল্যাণী, তুমি কি আমাকে ভালবাসনা?’ কোন কথা বললাম না। ভয় পেয়ে কাঁদতে লাগলাম। সুমাদ হাত কেটে রক্ত দিয়ে আমাকে সাজাতে লাগল। রাম দৌঁড়ে বাসায় চলে গেল। ঘটি পড়ে গেল হাত থেকে। ওর গলা  জড়িয়ে ধরলাম তবুও কোন কথা বললাম না। মনে মনে বলেছিলাম, হ্যাঁ আমি তোমাকে ভাল...। আমাকে জড়িয়ে ধরে কত চুমু খেতে লাগল সারা শরীরে। আমি আবেগের বশবতী হয়ে ওকে জড়িয়ে ধরে লতা পাতার মাঝে শুয়ে পড়েছিলাম। রক্ত সিঁদুর দিয়ে কপালে টিপ দিলÑচুলের সিঁথিতে রেখা একে দিল। আমি ওর বুকে খানিকক্ষণ আবেগভরা হৃদয়ে মুখগুঁজে রইলাম। সেদিন সময়ের কাছে আবেগ আর জীবনের পরাজয় হয়েছিল। মা এসে আমাকে নিয়ে গেল। সুমাদকে বকে গেল। আজ বুঝতে পারছি সেদিন হয়তো আমার গর্ভেই জš§ দিতে চেয়েছিল বিশ্ব কাঁপানো বিদ্রোহীকে। আজ সব বুঝি, সব...। ২১ তারিখের বিকাল বেলা। একটা ছেলে আমাদের বাসায় এসে দরজায় নক করছে। মা দরজা খুলে দিল।
ঃ কি চাই ?
ঃ কল্যাণী দিদি আছে ?
ঃ কেন ? তাকে কেন ?
ঃ এই চিঠিটা তাকে Ñ।

মা  চিঠিটা খুলে পড়তে লাগলেন। সব উল্টা করে লেখা। অতএব, মা কিছুই বুঝলো না। আমার মুখের উপর ছুঁড়ে দিয়ে বলে গেলেন, তোকে কোলকাতা পাঠিয়ে দেব অজয়ের কাছে। অজয় আমার মেজো মামা। আমি আয়নার সাহায্য নিয়ে চিঠি পড়তে শুরু করলাম―

কল্যাণী,
অনেক কষ্ট নিয়ে পরপারে চলে যাচ্ছি। দুঃখ, একটি বার বললে না, আমি তোমায় ভালবাসি। আমি আবার আসব। তোমাদের স্বাধীনতার জন্য যুগে যুগে আমি অবতীর্ন হব এ ভারতবর্ষে। দিদি, বিশ্বাস করো, আমি হিন্দু নই, আমি মুসলমান নই, আমি সকল ধর্মের উর্ধ্বে। আমি তোমাদের এ কুসংস্কার সমাজের কেউ নই। আমার জš§ও কেউ জানে না, মৃত লাশও কেউ পাবে না। আমি সময়Ñআমি ’৫২Ñআমি স্মৃতি। তোমাকে বাংলাদেশ ভেবে ভালবেসেছি, অন্য কিছু নয়। সময়ের উজানে এসেছিÑসময়ের ভাটায় চলে যাচ্ছি। না, পরাজয় নয় বরং জয় তোমার-আমার। এদেশকে একদিন নারীরাই শাসন করবে, সেবা করবে। আমি হয়তো সময়ের দৃষ্টি দিয়ে দেখব। তবু থাক না হয়Ñদু’তীরে দু’টি মন। হে কল্যাণী আমার, ঠিকানা আমারÑমুক্ত আকাশ। এ চিঠির মত পরিচয়Ñবিন্দু থেকে সিন্ধ ু; সিন্ধু থেকে আবার বিন্দু। চিরবিদায়...
সন্ধ্যার পর বাবা তার ছাত্র মোহাম্মদ মাহফুজ উল্লাহকে নিয়ে বাসায় আসলেন। মাহফুজ ভাই প্রায়ই আমাদের বাসায় আসতেন। তিনি কবিতা, গল্প লিখেন পত্র-পত্রিকায়। আমি সেই বিকাল থেকে কান্নার্ত চোখে শুয়েছিলাম। বিছানা থেকে উঠে দরজায় আসতেই মাহফুজ ভাইয়ের মুখ থেকে ছাত্র হত্যার ঘটনা শুনতে পেলাম। উনি বলতে লাগলেন, “আগের দিন থেকেই একটা আশঙ্খা ছিলÑ আগামীকাল মারাত্মক কিছু ঘটে যেতে পারে। ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে রাষ্ট্র ভাষার দাবীতে কোন মিছিল হলে সরকার কঠিন ব্যবস্থা নিতে পারে। অবশ্য মিছিলের উপর গুলি বর্ষিত হতে পারে এমন আশঙ্খা আমার মনে ছিল না। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাই ঘটলো। সংবাদ অফিসে থাকতেই শুনলাম, বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল কলেজের অবস্থা খুবই খারাপ। ১৪৪ ধারা ভেঙ্গে মিছিল শুরু হয়েছে, যে কোনো সময় মারাত্মক অবস্থা সৃষ্টি হতে পারে। আমি শংকিত চিত্তে আবার আজিমপুরের দিকে যাত্রা শুরু করলাম, সারা পথেই স্থানে স্থানে মানুষের জটলা। সবাই শংকিত কি ঘটে না ঘটে। আজিমপুরে পৌঁছেই শুনলাম, মেডিকেল কলেজের মোড়ে পুলিশ ছাত্র জনতার উপর গুলি করেছে, বহু মানুষ তাতে মারা গেছে। এই খবর শুনে আমিও অন্যান্য মানুষের সঙ্গে দৌঁড়ে পলাশী ব্যারাকের মোড়ে গেলাম। তখন ভয়ে আমার হাত-পা সিঁধিয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা। এই শোকাবহ ঘটনার পরই মেডিকেল কলেজের দিকে অসংখ্য মানুষের যাত্রা শুরু হয়। এরই মধ্যে সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে ও আহসান উল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ ভবনে মাইক লাগিয়ে পবিত্র কোরআন তেলাওয়াত ও জ্বালাময়ী বক্তিতা শুরু হয়ে গেছে। শোকের গভীর ছায়া ছড়ানোর পাশাপাশি মাইক থেকে সংগ্রামের অগ্নি স্ফুলিঙ্গ ঝরে পড়ছে। জালিম মুসলিম লীগ সরকারের বিরুদ্ধে উচ্চারিত হচ্ছে প্রচন্ড ঘৃণা ও ধিক্কার। পলাশীর ব্যারাকের মোড়েই জনতার ভীড়ের মধ্যে মোহাম্মদ আজিজুল হকের সংগে দেখা হল। সে মিছিলে ছিল। গুলি তার গায়ে লাগেনি। তবে ঐ গুলাগুলির পর সুমাদকে আজিজরা কেউ খুঁজে পেল না। পরে আমি...।”
ঃ স্যারÑ
ঃ হ্যাঁ, বল। না থাক, তুমি চা খাও। লক্ষ্মী-
ঃ না স্যার, আমি আসি-
ঃ সুমাদের কোন খবর পেলে-
ঃ আমি অবশ্যই আপনাকে জানাব

আমার আর কিছু মনে নেই। সুমাদকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যায়নি। আমি জানি, ওকে আর কখনও খুঁজে পাওয়া যাবে না। পৃথিবীতে অনেক কিছুই আছে, সময়ে আসে, সময়ে হারিয়ে যায় আর ফিরে পাওয়া যায় না। শুধু জানি, সুমাদকে আমি খুব ভালবাসতাম কিন্তু বলতে পারিনি। ভালবাসার শিকলে, সময় অথবা যৌবন কাউকেই বেঁধে রাখা যায় না। সময়ের কি লাশ হয়? হয় না? তাইতো সুমাদের লাশও হয়নি, সুমাদ সময়। সেই সময়টাকে আজ ৪১ বৎসর ধরে হৃদয়ের হাজার ফুট গভীরে লুকিয়ে রেখেছি। এতদিন লুকিয়ে রেখেছিলাম নারী বলে। আজ আমি বৃদ্ধ। সকল বয়সের বাইরে আমার জীবন। তাই সকল মানুষের কাছে শঙ্খের আওয়াজে না পারলেও বাঁশের বাঁশিতে বাজিয়ে দিলাম। সুর যাক ভেসে প্রত্যেক নারীতে-পুরুষে। হাজার মানুষের স্মৃতির ভীরে, এ স্মৃতি হোক সকলের আপন।

রচনাকালঃ ১৯৯২-৯৩

বিদায়, হে পৃথিবী

                             

নিস্তব্ধ সন্ধ্যা বেলা
দূর মসজিদ থেকে প্রবাহমান আযান-
মন্দির থেকে শংঙ্খধ্বনি
লাল আভায় ঢাকা পশ্চিম দিগন্ত
হৃদয়ে জাগে সহস্র স্মৃতি
আর একটি দুঃস্বপ্ন!

ধীরে ধীরে দিগন্ত জুড়ে
কালো আঁধার নামে
মেঘাচ্ছন্ন পূর্বদিক,
সন্ধ্যার আকাশে হেলান দিয়ে
ঘুমাবে পাহাড়; কাঁদবে মেঘ
রাতের আঁচলে ঘন ঘন চোখ মুছবে
সজল আকাশ
তারপর... ঘুমাবে আমার স্মৃতি
ঘুমাবে আমার জীবন সন্ধ্যা
আমার না পাওয়া স্বপ্ন
অতঃপর...আমি...চিরতরে...।

বিশাল আকাশ, সুশান্ত বাতাস
সবুজ বনানী, রাতের জোনাকী আলো
কেউ আমাকে মনে রাখবে  না।                                                            

এমনকি আমার ভালোবাসার মানুষটিও না
কেউ না...কেউ মনে রাখবে না।
অস্তিত্বের নিরব রেখাটুকু
তাই মুছে দিয়ে গেলাম
বিদায়, হে পৃথিবী
বিদায়...
                                                       


                                           রচনাকাল : ১৯৯২

এ বাংলার, শাশ্বত শীত প্রকৃতির গল্প ঃ ঝরা পাতার গান

    
 কুয়াশার অন্ধকারে হাজার বছর ধরে শীত কন্যা আসে ষড়ঋতুর লীলা বৈচিত্রের হেমন্তের ফসলে আঁকা মেঠো পথ ধরে। স্থান, কাল ভেদে এ শীত কন্যায় রূপ নানা অঞ্চলের দেব-দেবীর মত নানা সজ্জায় সজ্জিত হয়। হেমন্তের মাড়াই করা ধান বড় বড় কড়াওয়ালা মাটির হাড়িতে রাখতেই শীত রূপসী শীতের নানা উপকরণ কুয়াশার চাদরে ঢেকে এনে রাখে গৃহস্তের আঙ্গিনায়; কড়াওয়ালা মাটির হাড়িতে টোকা দিয়ে বলে, ‘এই গৃহস্ত আমি এসেছি ; চল, পিঠা-পুলি-পায়েস বানাই।’
  
হেমন্ত আর বসন্তের মাঝে শীত আসে শূন্য মাঠের পথে, নিরবে। প্রকৃতি যেন, মানুষের মত কাঁপতে থাকে ভীত সন্ত্রস্ত পদভারে। বৃক্ষ তার সমস্ত পত্র অর্ঘ হিসাবে অর্পন করে শীত দেবীর পদতলে। গাছে পাতা নেই, ফুল নেই, মাঠে ফসল নেই। প্রকৃতি যেন ধ্যানমগ্ন ভিক্ষু সন্নাসীর মত সব সম্পদ দান করে দীর্ঘ উপাসের মধ্য দিয়ে পরম বৈরাগ্য লাভ করে। শীতের রাত যেন, শেষ হতে চায় না। নির্ঘুম একটা রাত যেন, হাজার বছরের রাত। কুয়াশাচ্ছন্ন সকাল; কোনদিন সারাদিনেও সূর্য নেই; শুধু মাঝে মাঝে কুয়াশার মধ্য দিয়ে হালকা লাল আভায় উঁকি দিয়ে যায়। পাহাড় দেশের মেঘ যেন, কুয়াশা রূপ নিয়ে শীত দেবীর রথে চড়ে দূর কোন পাহাড় থেকে প্লাবিত হয়ে আসে ভাটি বাংলার দেশে।
            
প্রতিবেশী কারো কাঁপানো, ভাঙ্গা গলার ডাক শুনে হাড় কাঁপানো শীতে আমি চাদর মুড়ী দিয়ে দরজা খুলতেই একরাস কুয়াশা ঢুকে পড়ল আমার ঘরে। দরজা-জানালা সব বন্ধ করলেও কুয়াশা ঢুকে খড়-ধঞ্চে-পাটখড়ীর বেড়া-ছন-ছাউনির ফাঁকে ফাঁকে। ‘কামে যাইবা না, ধর তোমার পান্তা-পিয়াজ-মরিচ আর কাস্তে-কোদাল...।’  ঠোঁট ফাঁটা হাসির ফাঁকে কত কথাই না বলে যায় বীনা। কথার সাথে সাথে মুখ থেকে বের হওয়া কুয়াশা যেন, না বলা হৃদয়ের কথা অকপটে বলে দেয়। ঘুম ভাঙ্গা হাসিতে কত কথাই না তারে বলি। কে সে মোর, কেন এত আপন, আত্মার সে কি আত্মীয়--আমি জানি না। শুধু তারে না দেখলে মন যেন, কেমন করে। এই তারে দেখি, প্রকৃতির মত নানা রংয়ে, ঢংয়ে, হাসি কান্নায়। কি আশার আলো নিয়ে কুয়াশার অন্ধকারে কাস্তে-কোদাল, পান্তা-মরিচ-পিয়াজ নিয়ে মাঠে চলি নিরবে, একাকী। দু’হাতে কুয়াশা ঠেলে ধীর পায়ে এগিয়ে চলি ঘন শিশির মাখা মেঠো ঘাসের পথ ধরে। চোখে ঘুম লেগে থাকে। কত বেলা বুঝা যায় না।

শীত আসার সঙ্গে সঙ্গে গ্রাম বাংলার জলাশয় শুকিয়ে আসে। আমারি মত কর্মমুখর মানুষগুলি শীতের সকালে কাজের টানে ছুটে চলে মাঠ-ঘাট-হাওর-বাওর-বিলে। কাজের সাথীরা মাঝে মাঝে মাঠের কাজ না করে অথবা কাজ ফেলে কোথা যেন, ছুটে যায়। হঠাৎ কোন সাথীর ডাক শুনি, ‘কুইক্কা, যাবিনি, ভুইগদার বিলে, কাইলকা দুলাইললা মেলা মাছ ধরছে, যাবিনি?’ গ্রামে যারা বাস করেন তারা জানেন, খোকা থেকে কোকা, কোকা থেকে কুইক্কাÑকিভাবে নামের বিবর্তন হয়। যাই হোক, নিজের ক্ষেতের কাজ ফেলে ছুটি চলি সাথীদের সাথে। গ্রাম বাংলার হাওর-বাঁওর-ছোট নদী-নালা-খাল-বিল-ডোবায় মাছ ধরার হিরিক পরে যায়। ভুইগদার বিলে মাছ ধরতে কতবার গিয়েছি। ছয় সাত মাইল হাঁটাপথ। শীত যেন কোথায় পালিয়ে যায় আমার দেহ থেকে। কি টান, কি উদ্দাম--ঠান্ডা পানির মধ্যে মাছ ধরা। শিং মাছের কাঁটা ফুটে কত ক্ষত হয়েছে হাত-পা। বিষকাঁটালী বিরুৎ গাছের পাতা-ডগা দিয়ে কত ঘষেছি ক্ষতস্থান। পল, টাকজাল, জালি, ক্ষেতজাল, টেডা, বড়শী ইত্যাদি দিয়ে টেংরা, বউজ্জা, সিং, মাগুর, কই, পুটি, সৌল টাকি--কত না মাছ ধরেছি! বৃহত্তর ময়মনসিংহের ‘বিল বাওয়া’ উৎসবের মত আমাদের এই অঞ্চলেও ‘মাছের হরিলুট’ উৎসব হত। ঝুড়িতে, সিলভারের হাড়িতে অথবা গামছার আঁচলে মাছ বেঁধে রান্নার স্বাদ নিয়ে কত গল্পই না করেছি সাথীদের সাথে। বিক্রমপুর  অঞ্চলের কিছু কিছু বিল-ঝিল-হাওরের গভীর পানি হেমন্তের পরেও থাকে। গ্রীষ্মের চৈত্রমাসে সব শুকিয়ে আসে। কি যাদুর টানে অথবা কি রহস্যময় আনন্দে মাঘ মাসের শীতেও মাছ ধরতে শীত অনুভব হয় না। যেটুকু অনুভব হয়, দু’একটা সিং, কই ধরার পর তাও চলে যায়। মাঝে মাঝে আকিজ বিড়ি, রমনা বিড়ি অথবা যে কোন সুখটানে কোথা যেন শীত চলে যায়। বিল থেকে আসার পথে কলমী শাক, সরিষা পাতা নিয়ে আসি বাড়ীতে, সবাই খুশী হবে বলে। হরিলুটের মাছ পাড়া-প্রতিবেশী, আত্নীয়-স্বজনদের মাঝে ভাগ করে দেওয়া হত। বড় ভাগটা থাকত বীনাদের জন্য। গায়ের কোন পুকুরে মাছ ধরার ডাক পড়লে বীনাকে পুকুর পারে থাকতে বলি। নানা ভংগিতে মাছ ধরি আর ওর হাসি মাখা মুখটা দেখি। মাছ ধরার সেরা কৃতিত্ব নিয়ে শুকনো কাঁদার চটচটে পায়ে মাটির ঘরের আঙিনায় জুড়ী-ডোলার সব মাছ ফেলি। ছোট মাছগুলো রেখে সব দেই প্রতিবেশীদের বিলিয়ে। ঠোঁট চাপা, মুখ ভেংচি আর কথা কাঁটার ভংগি দেখে বুঝি, এই ভাগাভাগি বীনার পছন্দ হয়নি। বলি তারে, ‘আরে, অগো নাচানাচি আর দোয়ায়ইতো এত মাছ ধরলাম।’ বলে সে, ‘তাই বইলা, সব বড় মাছ হেগো দিবা।’

 মনে পড়ে, কাজের সন্ধানে কয়েকবার যেতে হয়েছে সুনামগঞ্জের জামালগঞ্জ। বর্ষায় দিগন্তবিহীন হাওর--কূল নাই, কিনারা নাই--এযেন, সাগর। শীতের আগমনে ছোট ছোট নদী-নালা-খাল-বিল হাওর থেকে যেন, জেগে উঠে ফসলের মাঠ। নদী-নালা-খাল-বিল-পুকুর-ডোবা মিলেই এ সুবিশাল হাওর। শীতকালে হাওরের সীমানায় দাঁড়িয়ে অবিশ্বাস্য চোখে আমি তাকিয়ে থাকি। ভাবি, হাওরের পানি কোথায় চলে যায়। দেখি, চারদিকে মাছ ধরার মেলা; কোন কোন নৌকার খোলা, মাছে পরিপূর্ণ। কোথাও হাঁটু পানি; গরু-মহিষ সেই পানি পেরিয়ে যাচেছ সবুজ তৃণভুমিতে। বিল-ঝিল হাওরের অতি আপন বৃক্ষ হল হিজল গাছ; মাসের পর মাস পানিতেই কেটে যায় এদের জীবন। শকুন, ভূবন চিল মাছ শিকারের ফাঁকে এ গাছের ডালে ডালে বিশ্রাম করে। ঝাঁকে ঝাঁকে পানকৌড়ি, বক, শালিক ইত্যাদি জানা-অজানা বিদেশী পরিযায়ী পাখিরা ভীড় করে হিজল গাছে, জেগে উঠা জলাশয়ে খুঁজে খাবার। কাজের অবসরে আনমনে ভাবতে থাকি--বর্ষাকালের জলডুবা হাওর আর শীতকালে সেই হাওরে ঢেউ খেলানো সবুজ ফসলের মাঠ--প্রকৃতির কি বিচিত্র খেলা!

রূপসী বাংলার হাওর-বাঁওর-বিল-নদী-নালা-খাল শীতকালে অতিথি পাখিদের কলকাকলীতে মুখরিত হয়। শ্রীমঙ্গলের হাওরের বাইক্কা বিল, সুনামগঞ্জের হাকালুকি, রাজশাহীর চলন বিল অথবা দিনাজপুরের রাম-সাগর, চট্রগ্রামের ফয়েজ লেক অথবা করতোয়া, নাগর, বাঙ্গালী, ইছামতি, বুড়িগঙ্গা, ধলেশ্বরী, মাতামুহুরী, কপোতাক্ষ, সুরমা, কর্ণফুলি, তুরাগ, কুশিয়ারা, নাফ, কির্ত্তনখোলা, পশুর ইত্যাদি জলধারায় মাছ ধরা অথবা নৌকার কত না ম্মৃতি মনে পড়ে। শুকনো নদ-নদীর শাখার বদ্বীপে, ঘাটে অথবা নদীর কূল ঘেঁষে ক্ষনস্থায়ীভাবে গড়ে ওঠে গ্রাম-গঞ্জ-বন্দর । বর্ষায় সব প্লাবিত হয়ে একাকার হয়ে যায়। আবার শীতের অপেক্ষায় জেগে থাকা মানুষেরা অন্য জায়গায় ছুটে চলে।

গায়ে ফিরে বীনাকে নানা দেশের নানান গল্প বলি। গল্পের স্রোতে ভেসে এক সময় বলে উঠে, ‘তুমি কেমনে সাজাও এত কথার মেলা, এত সুন্দর করে!’ নদী ভাঙ্গা আর নদী গড়ার মধ্যেই আমাদের জীবন। পদ্মা নদীর পারে আমাদের মত আরো কিছু পরিবারের বসতি। এক রাতের ভাঙ্গনে নদী আমার পরিবারের সব কেড়ে নিয়ে গেছে। আর বীনার পরিবারের বীনা আর ওর বাবা ছাড়া কেউ বাঁচেনি। স্কুলের বোডিং-এ আমি ছিলাম, তাই বেঁচে গেছি। বীনার বাবা সব হারিয়ে বীনাকে ওর নানীর কাছে রেখে কোথা যেন চলে গেছে। আমাদের দু’জনার নানী বাড়ি শরীয়তপুরের জাজিরার পূর্ব নাওডোবায়, উত্তর-দক্ষিণে দুই পুকুর আর পূর্ব-পশ্চিমে চার ঘর বেষ্টিত একই উঠোনে। দু’জনার  সম্পর্কের বিষয়ে সবাই জানে। আমার নানী আমার ভবঘুরে জীবন মাটির ঘরের মুলি বাঁশের বেড়ায় বাঁধার জন্য শীতকালের সময়টাকেই বেছে নিয়েছে। দুই নানীর বকা খেতে খেতে শীতের এক বিকালে ‘কবুল’ করে কাঁশ আর নাড়া দিয়ে নতুন ছাউনি করা ধঞ্চে-পাটখড়ী বেড়ার মাঝে মুলিবাঁশের দরজা ঠেলে দুজনে ঢুকলাম। ঢুকলাম না বলে, বলা যেতে পারে, দুই নানী ঘাড় ধাক্কা দিয়ে ঢুকিয়ে দিয়েছে এবং বলে দিয়েছে, এই শীতেই যেন, নাতির গন্ধ পাওয়া যায়, আচারের ব্যবস্থা তারাই করবে। আসলে আমার ভবঘুরে, বাউল জীবন নিয়ে আমার নানী বড়ই উদ্বিগ্ন ছিল। কত তাবিচ কবচ যে আমার হাত-গলা-মাজায় দিয়েছে--তা গুনে শেষ করা যাবে না। মসজিদের হুজুর আর মাজারের খাদেমের পানি পড়া আর নাই বললাম। শুনেছি, হিন্দু পাড়ার শিব-কালী মন্দিরের ঠাকুরের দেওয়া তাবিজ, পানি পড়াও নানী আমায় দিয়েছে। বনজঙ্গলে ঘুরি বলে, শ্মশান-জঙ্গলের শিব-মা কালী যেন, আমায় রক্ষা করে। প্রকৃতির বিশাল অথচ ক্ষূদ্র অংশ বীনা, তার কাছ থেকে ছুটে চলি অন্য প্রকৃতিতে, আবার ফিরে আসি তার কাছে। বিনা বাঁধায়, সহজেই বিনাকে পেয়েছি বলে, নাকি, ভবঘুরের সূতার টানে আস্তে  আস্তে বীনা প্রকৃতির গদ্য আমার কাছে ফুরিয়ে যেতে থাকে; আমি আরো গভীর গদ্যে হারিয়ে যেতে থাকি।

 হাইস্কুল পর্যন্ত লেখাপড়া জানা, কর্মঠ, গল্পপটু, গাতক, বই পড়ুয়া--সাথীদের কাছে আমি ইত্যাদি গুনে পরিচিত। তাই ওরা, যে যেখানে, যতদূরে, যে কাজেই যায় আমাকে স্মরণ করতে ভুল করে না। আমিও জায়গা পছন্দ হলে ওদের সাথে যে কোন কাজে চলে যাই। সালাম, বাবুল, শম্ভু, দুলাল--এদের সাথে শীতের রাতে বেশ কয়েকবার গিয়েছিলাম জঙ্গলের বনপথে। পদ্মা নদীর শাখা বেস্টিত বিশাল জঙ্গলের মহল। ঘাস, বাঁশ, গাছ ইত্যাদি কাটতে হবে--তুলতে হবে বড় বড় নৌকায়। নির্জন, ভীতিকর জায়গা। সারি সারি শাল-গজারী গাছ, নদীর কাছে ঝাউবন, কাঁশচর। কাঁশ, বাঁশ আর খড়ঘেরা দু’একটা ঘর--বনের ভিতর মাঝে মাঝে দেখা যায়। দু’একটা জনবিরল বন্য গ্রাম আর ছোট ছোট টিলা আছে আশেপাশে। শীতের বিকাল। ঘন ছায়া পড়েছে বিস্তীর্ণ জঙ্গলে। বনের মাথায় উঁচু গাছের পাতায় পাতায় অল্প অল্প কুয়াশা জমেছে। নির্জন শীতের সন্ধ্যা। কোথা থেকে মটর শাকের সুন্দর গন্ধ ভেসে আসছে। বিশাল আকৃতির বট আর ভেটকী গাছ--জড়াজড়ি করে আছে, গভীর আলিঙ্গনে। শত শত লতাগুল্মের গাছ বিশাল বটগাছকে জড়িয়ে আছে। ডালে ডালে পাখির বাসা। শীতের তীব্রতা আস্তে আস্তে বাড়ছে, এ বনপথে। পাখির বাচ্চারা এখন বেশী চেঁচামেচি করছে--হয়তো ক্ষুধায়, হয়তো পিতা-মাতার দেরীতে ফেরা অথবা না ফেরার কারণে; কারণ কিছু পাখি শিকারী সারাদিন বনে ঘুরাফেরা করে। মা-বাবার পালকের উষ্ণতা বড় বেশী প্রয়োজন এই শীতে কারণ বাচ্চা পাখির পালক পূর্ণভাবে গজিয়ে ওঠে না। শীতকালে দিন নয় থেকে দশ ঘন্টা। প্রকৃতির রূপ দেখতে দেখতেই সময় ফুরিয়ে যায়।

নদীর কাছে দীর্ঘ বনঝাউ, কাঁশবনের মাঝে সারি সারি গজারি, বাবলা, বন্য কাঁটা বাঁশ, বেত ঝোপ। সন্ধ্যায় বাতাসে বন্যপুষ্প ও তৃণগুল্মোর সুগন্ধ, পাখির কিচিরমিচির ডাক, বনের ডোবার অগভীর জলে ফুটন্ত লিলি ফুলÑবাতাসে সুবাস ছড়িয়ে দেয়। শীতকালে আমাদের অঞ্চলে লিলি ফুল হেমন্ত কালে দেখা যায়। নির্জন আকাশতলে দিগন্তব্যাপী জোৎস্না রাতে বনপুষ্পের সুবাশ, ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক, শীতের মধ্যে শিয়ালের পাক্কা হুয়া ডাক--রাত্রির পরিবেশে আমাকে যে কোথায় নিয়ে যায়। নির্ঘুমে আমরা সবাই। বিড়ি-সিগারেটের ফাঁকে গাছ ও ঘাস কাটার হিসাব শেষ করে বনের শুকনো ডাল-পাতা জ্বালিয়ে, আগুনের চারিদিকে পাটি, গামছা বিছায়ে বসে শীতের গান আর সেই সাথে বনমুরগী, বনহাঁস অথবা বনজলের মাছ পুড়াইয়া ভাত অথবা মুড়ি-পিয়াজ-তেল দিয়ে খাওয়া। আহা! সে কি স্বাদ, কি শান্তি এই ঘন কুয়াশা রাত্রিতে। মনে হয়, পিকনিক অথবা মাসুদ রানা সিরিজের কোন কাহিনীর নির্জন দ্বীপের ছবি। রাতের শীত বাড়লে অথবা শীতের ভোরে ধনে পাতার ভর্তা দিয়ে ভাত খাওয়া। শীতের পার্বণের কত স্বাদ নিয়েছি কত সাথীদের বাড়ী গিয়ে; অন্যের ক্ষেত থেকে পিয়াজ তুলে আনতে গিয়ে ধরাও পড়েছি।  গ্রামে থাকলে মা হয়তো শুঁটকী, মটরশুটি, শীম, আলু, ধনে পাতার ভর্তা দিয়ে চিতের পিঠায় মেখে দিত। মায়ের কথা মনে হলে শীত যেন, আরো বেড়ে যায়। পূরাণের গঙ্গা (পদ্মা নদী) দেবী যে, মা-বাবা সহ সবাইকে নিয়ে গেছে, দূরে থাকলে--তা মনে হয় না। বরং মনে হয়, বাড়ি গেলেই মাকে দেখতে পাব।

 উদীয়মান চন্দ্রের গোলাকার বৃত্তের নিচের পরিধি যেন বাঁশের চিকন পাতা ছোঁয়া দিয়ে যায়। আগুনের কাছে থাকলে শান্তি, দূরে গেলেই কনকনে শীত। মনে পড়ে, উত্তরবঙ্গের পথে--এখানকার মত ওখানেও খড়ের ঘর; তার মেঝে জমির সাথে সমতল; ঘরের বেড়া শুকনো ঘাস, পাটখড়ি, বনঝাউয়ের ডাল-পাতা; কোথাও কোথাও কাঠ, বাঁশ, বনঝাউয়ের সরু সরু গুঁড়ির বেড়া; তার উপর মাটি দিয়ে লেপা। এখনো সেই ঘরের কাটাখড়, অর্ধকাচা ঘাস, মুলি বাঁশের গন্ধ নাকে ভেসে আসে। শীতের রাতের গরুর গাড়ীতে যাত্রার কথা ভাবলে হাত পা গুটিয়ে আসে। জামা-কাপড়-কম্বল সব ঠান্ডায় বরফ হয়ে যায়। শুয়ে থাকা পাশে শীত কম থাকলেও অন্য পাশে কাত হয়ে শুতে গেলে মনে হয়, মাঘ মাসের জলডোবায় ডুব দিয়েছি।

এই বন পথে প্রতিদিন সূর্যের উদয় দেখি, দেখি দূরের টিলা, জঙ্গল; আবার সন্ধায় বন ঝাউ, দীর্ঘ ঘাস (বাঁশ) তথা বনশীর্ষ লাল আভায় মাখিয়ে সূর্য ঘুমিয়ে যায়। ফিরে আসি কিছু কাচা টাকা হাতে নিয়ে। আবার ছুটে চলি লাউয়া ছড়ায়, চিম্বুক পাহাড়ে, ভাওয়াল বনে অথবা অন্য কোথাও। রাতের চর বন আর ভাওয়াল বন একই রূপ ধারন করে। নিঃশব্ধ অরন্যভূমি, নিস্তব্ধ জনহীন নিশীথ রাত্রি, চকচকে সাদা বালু, কোথাও দো-আঁশমাটি মিশানো বন, দিনের রৌদ্রে কাচা শুকনা কাঁশবনে জোৎসার আলো পড়ে অপার্থিব সৌন্দর্যের অপূর্ব মহিমায় ভরে দেয় আমার দৃষ্টির দিগন্ত। জল ডোবায় সাদা-বেগুনি কলমী ফুলের সমারোহ আর এই ভিজা বালু-দো-আঁশ মাটিতে সাদা সাদা (কেউ বলে এর নাম দুধলি ফুল) ফুল--বড় মিষ্টি সুগন্ধ ছড়ায় আশেপাশে। গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি পড়ছে হঠাৎ করে। এ সময় বৃষ্টি! অবাক হলাম, এটা কি মাস? কখনো কখনো পৌষ মাসে কিছু কিছু বৃষ্টি পড়ে। মাঘ মাসে বৃষ্টি নাই। সবাই বন পথে সাপের ভয়ে গান গেয়ে অথবা হাততালি দিয়ে পথ চলে। আমি সবাইকে ‘শীতনিদ্রা’ সম্পর্কে বললাম--দেহের তাপমাত্রা শীতের সাথে উঠা-নামার কারনে সাপ-ব্যাঙ এখন দেখা যাবে না।

গায়ের চির চেনা পথে রোদের ছোঁয়ায় কুয়াশা কাটে। জমানো শিশিরে রাস্তাঘাট ভিজে যায়। গাছে গাছে অবিরাম চলে ঝরা পাতার খেলা। পাখিরা শশব্ধে উড়ে যায়। বাগানে ডালিয়া, চন্দ্র মল্লিকা, গাঁদা ফুল ফুটে। নানা জাতের ধান কাটা শুরু হয় কোন কোন মাঠে। আলু, সরিষা, মুগ, মসুর ইত্যাদি ফসলে; ফুলকপি, বাঁধাকপি, শীম, পিয়াজ, রসুন ইত্যাদি সবজিতে বাড়ীর আঙিনা, শুকনো ডোবা বিল ভরে যায় সৌন্দর্যে। পুকুরের হাঁটু ময়লা পানিতে ছোটদের ছোট ছোট মাছ, ব্যাঙাচি ধরার খেলা। গায়ের বধূয়ার কলসী কাঁখে নদীর ঘাটে যাওয়া। নতুন জামাই বেড়াতে আসলে অথবা নতুন বউ দেওর, ননদদের সাথে নিয়ে বাপের বাড়ী ‘নাইওর’ আসলে খেজুর রস আর পিঠার সুবাস ছড়িয়ে পড়ে পাড়াময়। মাটির সরাতে, বেতের থালে, কলাপাতায় অথবা পিতলের প্লেটে সাজানো থাকে গ্রাম বাংলার বাহারি রকমের পিঠা--পাকান পিঠা, ভাপা পিঠা, কুসলি পিঠা, চিতই পিঠা, পাটিসাপটা পিঠা, নকসা পিঠা, পাতা পিঠা, জামাই পিঠা, আন্দসা, কাটা পিঠা, চুটকি পিঠা, মুঠা পিঠা, চ্যাপা পিঠা, জামদানী পিঠা, হাঁড়ি পিঠা, ঝুড়ি পিঠা, ফুলঝুরি পিঠা, বিবিখানা পিঠা, মাছ পিঠা, হৃদয় পিঠা, গোলাপ ফুল পিঠা, পেঁচানো পিঠা, ফুল পিঠা, শাহী বিবিখানা পিঠা  ইত্যাদি আরো  কত রকমের পিঠা; মা, বোন, বউদের পিঠাশৈলী আর রাত-দিনের অক্লান্ত পরিশ্রম সকলের স্বাদ, তৃপ্তি আর স্বস্তির মধ্যদিয়ে পিঠাশৈলী আর পরিশ্রম সার্থক হয়। এত রকমের পিঠা খেয়ে কতবার হারিয়ে গিয়েছি কত স্বপ্নরাজ্যে। জামাইয়ের সাথে শালা-শালী, বিয়াইয়ের সাথে বিয়াইনরা মেতে উঠে গ্রাম-বাংলার মুখে মুখে প্রচলিত ‘ধাঁধা মিলাও--পিঠা খাও’ উৎসবে।                         

কুয়াশার ভোরে ‘গাছি’র কাঁধে মধুবৃক্ষ খেজুর গাছের রস। কতবার গিয়েছি ‘গাছি’র বাড়ী। খেজুরের রস থেকে গুড় বানানোর সে কি শিল্প--পাতলা ঝোলা গুড়, নলেন গুড়, দানা গুড়, পাটালী গুড়--আমি আনমনা হয়ে যাই গুড়ের সুগন্দে। সমগ্র দেশ, বিশেষ করে উত্তরবঙ্গ-দক্ষিণবঙ্গ আমার চোখের সামনে কুয়াশা ঘেরা মনে হয়। এই আমার মামাবাড়ী--শরিয়তপুরের জাজিরা--খেজুর রস আর সরিষা--এ রকম প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অন্য কোথাও দেখিনি। মনে হয়, আমি যেন মৌমাছির মত সরিষার ফুলে ফুলে উড়ে বেড়াচ্ছি, প্রকৃতিকে ত্রিমাত্রায় ধারণ করে গদ্য পুঁথির মালা গেঁথে চলেছি।

গায়ে ফিরে শুনি, কন্যা সন্তান জন্ম দিয়ে বীনা চলে গেছে না ফিরার দেশে। কাঁদি আর ভাবি, কত করে বলেছিল, ‘তুমি আর ঘন জঙ্গলে যাইও না; ফিরতে দেরী অইব; বাচ্চার মুখ দেইখা তারপর যাইও; বনে গেলে তোমার কোন কালেই সময় জ্ঞান থাকে না।’ তখন ভেবেছি, পাঁচ মাসের পোয়াতি, থাকুম তো দুই মাস, সংসারে টাকাওতো দরকার। উড়নচন্ডি ছিলাম, বিয়ের আগে তেমন টাকা-পয়সা জমানো হয়নি। মানুষের কটুকথা আর দুই নানী বকাবকিতে রোজগারের সব টাকা আর বীনার জন্য কেনা শাড়ী, চুড়ী আর বাচ্চার জন্য ছোট জামা সব উঠানে ফেলে চলে এলাম দক্ষিণে। প্রকৃতি আর আমার কবি মন আমাকে সত্যিই বাউল করেছে।

   সারাদিন হাঁটতে হাঁটতে আর কাঁদতে কাঁদতে উত্তরের বালুপথ আর নদীর তীর ধরে পদ্মা নদীর তীরে এসে বসলাম। গোদারা ঘাটের মাঝিরা আমার বাবাকে, আমাকে চেনে। তিন পুরুষের যাতায়াত এ নদী দিয়ে। পদ্মা বিধৌত উর্বর মাটির সন্তান আমি এবং আমার পূর্ব পুরুষ। এ নদীকে কেন্দ্র করে এর কাছাকাছি শরীয়তপুর, চাঁদপুর ও বিক্রমপুর-এ হাজার বছর ধরে আমাদের পিতৃগণ ও মাতৃগণের বসবাস। আমার জন্মস্থান বিক্রমপুরের লৌহজং-এ। নদী পার হয়ে দিঘলী বাজারে এসে কিছু চিড়া-মুড়ি খেয়ে কদম বাবার মেলায় চলে এলাম। কদম বাবার মেলা শীত প্রকৃতির আরেক অকৃত্রিম রূপ। নানা জাতের মাঘের পাগল এখানে এসে মাস খানিক ভীড় করে গান করে। ব্যবসায়ীরা আর ভক্তরা খুশী থাকলে এ মেলা সাত থেকে দশ দিন পর্যন্ত চলে। নানা রকমের পসরা সাজিয়ে বসে দোকানীরা। নানা স্বাদের মুড়ী, চিড়া, খইয়ের মোয়া, সন্দেশ, নাড়– ,বাতাসা, কদমা, মিষ্টি খই, চিনি মাখানো ছোট ছোট গোল মিষ্টি, নিমকী, গজা কত না স্বাদের, গন্ধের খাবার। মাঘ মাসের শীতের মেলায় মানুষের ভীরে একটুও শীত লাগে না। ছোট্ট বেলায় তাই আগুন না জ্বালিয়ে উষ্ণতার জন্য মেলায় চলে যেতাম।

কোথাও কোথাও ‘ক্ষেতের বত্ত’ পূজা শুরু হয়েছে। কোথাও ওয়াজ--মাহফিল, পীর-ফকিরের বাৎসরিক মেলা, কোথাও ভোজ-বাজির খেলা। কোন স্কুলে থাকে বার্ষিক-ক্রীড়া অনুষ্ঠান। বড় রাস্তায় গাড়ি হাঁকিয়ে মাইক বাজিয়ে কোন স্কুলের শিক্ষা সফর অথবা কোন ক্লাব, সংঘ বনভোজনে ছুটে চলে--নাচে,গানে, আনন্দে আত্নহারা হয়ে।

ঘন কুয়াশায় হেড লাইটের আলোয় গাড়ী চলে শহরে। সচ্ছল মানুষেরা দেহের উপর আরামের বোঝা চাপিয়ে অথবা নানা রংয়ের টুপি, জ্যাকেট, হাত মোজা, পা-মোজা, কোট-টাই পরিধান করে শীতকে হাসি দিয়ে মুখে বরন করে। অসচ্ছল, দরিদ্রদের হয় একটি চাদর, নয়তো একটি জামা, কারো মাফলার থাকে, কারো টুপি, কেউবা একটি লুঙ্গী গায়ে দিয়ে আরেকটি ছিঁড়া লুঙ্গী গায়ে জড়ায়ে রাখে--এরা সর্বদা আগুনের কাছে থাকতে চেষ্টা করে অথবা হাড় কাঁপানো শীতে ফুটপাতে কুড়ানো কাগজ পুড়ায়ে উষ্ণতা অনুভব করে। তাই মনে হয়-এ শীত যেন মানুষের হাতে গড়া এ বুর্জোয়া সমাজে বিত্তবানদের জন্য পোশাক প্রদর্শনী আর নিঃস্বদের জন্য সহিষ্ণুতার অগ্নিপরীক্ষা। শহরে কাজে আসলে কবি জসিম উদ্দিনের কবিতা মনে পড়ে, ‘‘তুমি যাবে ভাই--যাবে মোর সাথে আমাদের ছোট গাঁয়ে...।’’

 শীতের বনতল; শীতের সকাল-দুপুর-বিকাল-সন্ধ্যা; শীতের জোৎস্না রাত্রির চাঁদ, দিনের সূর্য; শীতের নির্জনতা আর স্থান কাল-পাত্র ভেদে সৌন্দর্যেয় বৈচিত্রতা; নির্জন আকাশতলে দিগন্তব্যাপী কত রুপে, কত সাজে যে শীত কন্যা সাজে, এ বাংলার প্রকৃতিতে। সৌন্দর্য পিয়াসীর চোখ অথবা কবির মন হারিয়ে যায় বারে বারে প্রকৃতির নদী-নালা-খাল-বিল-হাওর-বাঁওর-মাঠে-ঘাটে অথবা অন্য কোথাও, কোন কুয়াশার বাঁকে। মনে প্রশ্ন জাগে, হে শীতকন্যা, অনার্য যুগে অথবা যখন আর্যরা এদেশে এসেছিল তখন কি তুমি এ রকম ছিলে; চন্দ্রগুপ্তের রাজত্বকালে, গ্রীক সম্রাট সেলুকাসের দূত মেগাস্থেনিস ভারতে থাকা কালে; অতীশ দীপংকরের সময়ে, লক্ষন সেন, মোঘল আমলে অথবা নিকট অতীতে?

 আমি বিস্মিত ! কে তুমি সৃষ্টি করেছ এ প্রকৃতিকে? সাজায়েছ এ ঋতু নানা বৈচিত্রে? করেছ আমায় স্ত্রীহারা, ছন্নছাড়া বাউল--আমি সৌন্দর্যের শাশ্বত ধারায় অবগাহন করি অবলীলায়। কেন সারাটা দিন তোমার পিছু ছুটে চলি--আমি জানিনা, হে প্রকৃতি। কেন এত পাগল করে মন তোমার জন্য, হে শীত কন্যা--আমি জানি না।                
                                                                                                               


উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে স্বদেশ

   
 ১৯৪৭-এ বিতর্কিত দ্বিজাতি তত্ত্বের আলোকে দেশ ভাগ, ’৫২-এর স্বাধীনতার আন্দোলন, ’৬২-এর শিক্ষা আন্দোলন, ’৬৬-এর ছয় দফা আন্দোলন, ’৬৯-এর গণ অভ্যুত্থান, ‘৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা লাভ, '৯০-এ স্বৈরাচার পতন--এত রক্তের বিনিময়ে অর্জিত বাংলাদেশ, আজ কোথায়, কোন অবস্থায় আছে ! কেমন আছে আমার দেশ, দেশের মানুষ, আমার মাতৃভূমি, আমার প্রিয় জন্মভূমি, আমার স্বাধীনতা? এ বিজয়ের মাসে পরাজিত রাজাকার আর তাদের বংশধররা কার বা কাদের সহযোগিতায় ’৭১-এর মানবতাবিরোধী, কুখ্যাত রাজাকারদের মুক্তির জন্য আন্দোলন করে, দেশ ব্যাপী হরতাল করে ? কোথা থেকে তারা এত সাহস পায়? পৃথিবীর কোন দেশ  ধর্মীয় জাতি সত্ত্বার কারণে বিভাজিত হয়নি, শুধু ভারত ছাড়া; কোন দেশে স্বাধীনতার যুদ্ধে পরাজিতরা মাথা তোলে কোনদিন দাঁড়াতে পারেনি; শুধু বাংলাদেশ ছাড়া।

বিজ্ঞান ও সভ্যতার চরম উন্নতির এ যুগেও কোন কোন ধর্মীয় রাজনৈতিক গোষ্ঠী বেহেস্তে যাওয়ার টিকেট বিক্রি করে। তাদের জেলে ঢুকালে বলে আল্লাহ  তাদের ঈমানের পরীক্ষা করছেন আর উকিলের মাধ্যমে জামিন বা মুক্তি পেলে বলেন, আল্লাহ তাদের জামিন বা মুক্তির  জন্য ফেরেস্তা পাঠিয়েছেন। তারা তাদের অনুসারীদের এমনি মগজ ধোলাই করেন যে, তাদের মতবাদ বিশ্বাস না করলে বা মেনে না নিলে মুসলমান হত্যা করাও জায়েজ বলে তারা মনে করে। এ কাজ করতে গিয়ে যদি মৃত্যু হয়, তবে সে শহীদ, অনায়াসে বেহেস্ত লাভ আর বাঁচলে গাজীত্ব লাভ। তারা নারী নেতৃত্ব হারাম বললেও কৌশলগত কারণে ক্ষমতাধর নারীর আঁচলের নিচে যেতে বা লুকাতে লজ্জাবোধ করেন না। ইসলাম কায়েমের কথা বললেও গণতন্ত্রের লেবাস লাগিয়ে পৃথিবীর সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর দেশের কাছ থেকে উদারপন্থী, গণতান্ত্রিক ইসলামী গোষ্ঠী নামে সার্টিফিকেট নিয়ে আরাম বোধ করেন। এ সব ধর্মীয় গোষ্ঠী  ধর্মের নামে ’৭১ থেকে  আজ পর্যন্ত  হত্যা-ধর্ষণ-কালোবাজারী-চোরাচালানী-রগকাটা-ভিন্ন ধর্মের উপাসনালয় জ্বালানো--হেন কোন খারাপ কাজ নাই, যা করেনি।

কক্সবাজারের রামু, উখিয়া, টেকনাফ, চট্রগ্রামের পটিয়া ও পাশ্ববর্তী এলাকায় সংঘটিত নাশকতা, একটার পর একটা গার্মেন্টস্-এ আগুন, বিজয়ের মাসে ধর্মীয় গোষ্ঠীর মাথাচাড়া দিয়ে জেগে উঠা, সারা দেশে হরতাল সহ ঘর-বাড়ী-গাড়ী-বস্তি জ্বালাও পোড়াও আন্দোলন, পুলিশের উপর আক্রমণ (যা আগে দেখা যায়নি), গনতন্ত্র দিবসে পতিত স্বৈরাচারের  গণতন্ত্র রক্ষার্থে ক্ষমতা হস্তান্তরের হঠাৎ চমকপ্রদ ছবক, হরতালে বিশ্বজিৎ এর মত একজন দরিদ্র সাধারন নাগরিকের ছাত্রলীগ নামধারী সন্ত্রাসীদের দ্বারা  নির্মমভাবে খুন (ঘৃণা, বিস্ময় প্রকাশ করার ভাষা আমি হারিয়ে ফেলেছি), রাজনৈতিক নেতাদের মিথ্যা কথা বলার চরম প্রতিযোগিতা, সরকারী দলের এক গোয়েমী  স্বৈরাচারী আচরণ আর দুর্নীতিসহ রাষ্ট্র পরিচালনায় চরম ব্যর্থতা, বিজয়ের মাসে তথাকথিত ধর্মীয় গোষ্ঠীর সাথে তত্বাবধায়ক সরকারের দাবীতে প্রধান বিরোধী দলের রাজপথ অবরোধ, হরতাল, জ্বালাও-পোড়াও আন্দোলন চলছে--এ যেন কোন উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে স্বদেশ !

স্বাধীনতার ৪১ বছর পর আজও দেশ দারিদ্র মুক্ত হয়নি, শোষণ মুক্ত হয়নি। নদী ভাঙ্গনে, বর্ষার প্লাবনে উজান-ভাটার স্রোতে ভেসে আসা সর্বহারারা জল-কাঁদা মাখা রাস্তার দুপাশে পোকামাকড়ের মত বসতি গড়ে। রোগার্ত, ক্ষূধার্ত, কর্মহীন ফসলহারা মানুষেরা কচুরীপানার মত বানের জলে ভেসে চলে গ্রাম থেকে শহরে, গড়ে তোলে অস্বাস্থ্যকর বস্তি। রাস্তার ফুটপাতে ছিন্নমূল হাজার মানুষের মানবেতর জীবন যাপন; শীত, বর্ষায় নিদারুণ কষ্টে দিন-রাত যাপন; সোডিয়াম আলোয় পতিতাদের খদ্দেরদের সাথে বাক-বিতন্ডা। শ্রমিকদের ন্যায্য বেতন ভাতাদির জন্য মিছিল; পুলিশের লাটিপেটা খেয়ে মানুষ বানানোর কারিগর শিক্ষকদের আমরণ অনশন; স্মরণকালের শেয়ার ধস, বিখ্যাত ব্যক্তিদের তত্ত্বাবধানে, সহযোগিতায় হলমার্ক-ডেসটিনির মত জালিয়াতী ব্যবসার ছড়াছড়ি; তেল-গ্যাস-খনিজ রক্ষা কমিটির আন্দোলন; পদ্মা সেতুর মত আরো হাজারো কাজে দুনীর্তি--চরম ব্যর্থতায় ‘স্বাধীনতা যুদ্ধের ডাক দেওয়া’ দলের সরকার। এ যেন, স্বপ্নের হাত ধরে কৃষ্ণপক্ষের রাত্রির অন্ধকারে অনন্তের পথে চলেছি আমরা। এ পথের যেন শেষ নেই...।

 দূর থেকে শিল্পী হায়দার হোসেনের গান ভেসে আসছে। শিল্পী আমাদের মনের কথা সুরে সুরে  বড় যন্ত্রণায় গেয়ে চলেছেন, ‘কি দেখার কথা কি দেখছি, কি ভাবার কথা কি ভাবছি, তিরিশ বছর পরেও আমি স্বাধীনতাটাকে খুঁজছি...।’ শিল্পীকে এখন সংশোধন করে গাইতে হবে  ‘ ...একচল্লিশ বছর পরেও আমি স্বাধীনতাটাকে খুঁজছি...।’ কত বার, কত বছর শিল্পী এ গান সংশোধন করবেন, আর কত বার দেশ প্রেমিকদের কাছে গান গেয়ে কাঁদবেন। তথাকথিত দেশপ্রেমিকদের  সন্তানরা, স্বজনরা এ দেশে থাকেন না। তাদের দেশ প্রেমের জ্বালাও পোড়াও আন্দোলনে আমার, আমাদের দেশ তিলে তিলে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। আমরা কি এই বাংলাদেশ চেয়েছিলাম! এই জন্য কি  মুক্তিযুদ্ধে তিরিশ লাখ মানুষ শহীদ হয়েছিল, রক্ত দিয়ে এদেশের নাম রেখেছিল, বাংলাদেশ? এ জন্য কি  হাজার হাজার মা বোনের ইজ্জত নষ্ট হয়েছিল? আমাদের লজ্জাবোধ হয়, আমরা মরমে মরি, সোনালী সোঁদা মাটি-সমতল সবুজ ভুমি-পাহাড়-ঝরনা-ছড়া-মেঘ-কুয়াশা-আলো মাখা আকাশ-ডোবা-খাল-ঝিল-হাওর-বাওর-নদী-সমুদ্র--এত সুন্দর দেশ, অসীম সম্ভাবনার দেশ--এভাবে  তিলে তিলে ধ্বংশ হতে পারে না।

 মুক্তিযুদ্ধ প্রজন্ম তথা দেশের সত্যিকারের দেশ প্রেমিক, সচেতন মানুষদের কাছে আমাদের অনুরোধ, নানা মত পার্থক্য আমাদের মধ্যে থাকতে পারে, কিন্তু এ দেশ আমাদের জন্মভূমি, এ দেশ আমাদের, এ দেশ ছেড়ে আমরা কোথাও যাব না। আসুন, এ বিজয়ের মাসে শপথ করি, দেশ ও মানুষের বিরুদ্ধে ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র প্রতিহত করে এ দেশকে আমরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত করি, আলোকিত করি। আসুন, আমরা শুরু করি, আমরা জাগি, আমরা জাগলে, সবাই জাগবে, জাগবে বাংলাদেশ।

পাহাড়-ঝরণা-ছড়া-মেঘ-কুয়াশা-নদী আর রহস্যময় পাহাড়

প্রকৃতির পাহাড়-ঝরণা-ছড়া-মেঘ-কুয়াশা-নদী আর রহস্যময় পাহাড় ঘেরা দীঘির অপার সৌন্দর্যের টানে পুরান ঢাকার বন্ধুরা মিলে এ বছরের শুরুতে বেড়াতে গিয়েছিলাম বান্দরবানের বগালেক, কেওকারাডং আর জাদিপাই ঝরণায়। আর সেই সাথে বোনাস হিসাবে পেয়ে যাই বান্দরবনের রাজবাড়ী মাঠের ঐতিহ্যবাহী রাজস্ব আদায়ী অনুষ্ঠান বোমাং রাজপূণ্যাহ্ উৎসবের মেলার শেষ বিকাল ও রাতটি। প্রায় ছয় মাস ধরে নানা পরিকল্পনার মধ্য দিয়ে গত ১৯ শে জানুয়ারী বৃহস্পতিবার রাতে বাস যোগে বন্ধুরা সদলবলে যাত্রা করি মনোমুগ্ধকর সৌন্দর্যে ঘেরা রহস্যময় পাহাড় কন্যার দেশ বান্দরবনের উদ্দেশ্যে। এ যাত্রার প্রধান লক্ষ্য ছিল কেওক্রাডং এর সর্বোচ্চ চূঁড়ায় উঠে পুরান ঢাকার পরিবেশ রক্ষার শপথ স্মরণ করে চূঁড়ার ময়লা-আবর্জনা পরিষ্কার করা। সেই সাথে বান্দরবন শহর, বগালেক আর যাদিপাই ঝরণায় বেড়ানোর বিষয়গুলো পরিকল্পনার মধ্যে ছিল। অপেশাদার এ যাত্রী দলের প্রায় সকলেই অভিযানের পূর্বে পুরো এক মাস ভোর বেলা উঠে ব্যায়াম করতাম। তারপরও বগালেক থেকে যাদিপাই ঝরণা পর্যন্ত একদিনে ১৩ ঘন্টায় আসা-যাওয়া প্রায় ৫২ কি:মি: উচুঁ-নিচু-আঁকা-বাঁকা পাহাড়ী পথ অতিক্রম করতে সবারই ভয়ানক কষ্ট হয়েছিল। আমাদের ১০ সদস্যের ২ জন বগালেকের ২৭০০ ফুট উঠেই অভিযানের সমাপ্তি টেনে লেকের আশেপাশেই বেড়ানো শুরু করে। আরো ৩ জন কেওক্রাডং এর পথ থেকেই ফিরে আসে বগালেকে। গাইডসহ বাকী ৬ জনের টিম শেষ পর্যন্ত অভিযান সফলভাবে সম্পন্ন করি।

রাত ১১টায় সায়দাবাদ থেকে ইউনিক পরিবহনে চড়ে আমরা শুক্রবার সকাল ৮:৩০-এ বান্দরবান শহরে এলাম। দলনেতা মেহেদীর বন্ধু আবুল হোসেন এ শহরের বাসিন্দা, তার পরিচিত এক হোটেলে সকালের প্রাত:ক্রিয়া শেষ করি। পরিকল্পনা মত আবুল হোসেন পর্যাপ্ত শুকনো বিস্কুট নিয়ে সিএনজি করে রুমা বাস স্টেশন, হাফেজঘোনায় আমাদের পৌঁছে দেয়। এখানে এক রেস্টুরেন্টে হালকা নাস্তা করি। রুমা বাস স্টেশন থেকে যেতে হবে কৈক্ষ্যংঝিরি। ঠিক ৯:৩০-এ সিটিং গাড়ীতে করে আঁকা-বাঁকা-উঁচু-নিচু পিচ ঢালা ১০-১২ ফুটের প্রশস্ত রাস্তা দিয়ে মাঝে মাঝে কাত হয়ে পড়ি পড়ি করে দু’পাশে পাহাড় আর গিরিখাদ দেখতে দেখতে ১১:৩০-এ কৈক্ষ্যংঝিরিতে এলাম। পা পথে পাহাড়ী যাত্রা শুরু হল। এখান থেকে হেঁটে দক্ষিণের ঢালু পাহাড়ী পথ বেয়ে প্রায় শুকিয়ে যাওয়া সাঙ্গু নদীতে এসে ট্রলারে উঠে দেড় ঘন্টায় রুমা বাজারে এসে পৌঁছলাম। আবুল হোসেনের মাধ্যমে ঠিক করা গাইড সুমন দত্ত আমাদের ট্রলারের সামনে এসে হাজির।
 (সাঙ্গু নদী আর পাহাড়ের সঙ্গমস্থল--যেখানে জল, সবুজ আর মানুষের পদচারণায় জীবন্ত হয়ে উঠে পাহাড়ী সভ্যতা। )



 বগালেকের পথে
রুমা বাজারে লাঞ্চ করে সেনাবাহিনীর পাহাড় ক্যাম্পে আমরা সবাই এলাম। পাহাড়ের ক্যাম্পে উঠা অভিযানের প্রথম অভিজ্ঞতা। নাম, ঠিকানা, রেজি: লিখার পর জীপে করে কিছুদূর এসে সেনাবাহিনীর আরেকটি ক্যাম্পে এসে রেজি: খাতায় স্বাক্ষর করলাম। দুই ক্যাম্পে প্রায় ঘন্টাখানেক সময় লাগল। বিদেশীদের ক্লিয়ারেন্স পেতে আরো বেশী সময় লাগে। আর্মি সদস্যরা সবাইকে পাঠ দিতে লাগলেন। মনে হল, আমাজান বা আফ্রিকার কোন জঙ্গলে যাচ্ছি অথবা যেন, পাসপোর্ট নিয়ে অন্য দেশের ভিতর দিয়ে আমাদের কোন ছিটমহলে যাচ্ছি অথবা এ যেন, আমার দেশ নয়। ৪টার দিকে আমাদের জীপ বগালেকের পাদদেশে এসে থামল। মনে হল, পাহাড়ী জঙ্গল আর ভয়ঙ্কর গিরিখাদের মধ্য দিয়ে কোন চিত্রশিল্পীর আঁকা সরু আঁকা-বঁাকা পথ দিয়ে আমরা বগালেকের পাদদেশে এলাম। গাইডের ডাকে ঘোর কাটল আমাদের। শীতের জামাকাপড় খুলে সর্ট প্যান্ট আর পাতলা গেঞ্জি পড়ে কিন্ডার গার্ডেন স্কুলের ছাত্রের মত পিঠে ব্যাগ নিয়ে গাইডের দেওয়া দেহ সমান কচি বাঁশে ভর দিয়ে শুরু হল প্রথম পাহাড় অভিযান রিহার্সেল। সমুদ্র পৃষ্ঠ হতে ২৭০০ ফুট উচ্চতায় উঠতে গিয়ে সবাই বিভিন্ন উচ্চতায় হারিয়ে যাই। মোবাইলের নেটওয়ার্ক আসে আর যায়। প্রায় এক ঘন্টার ক্লান্তি শেষে সবাই বগালেক পাহাড়ে উঠে। পাহাড়ের উপড়ে পাহাড় ঘেরা মনোরম লেক, আদিবাসী বম, মারমাদের বসতি আর সবুজ ঢেউ খেলানো বৃক্ষরাজি পরিবেশটাকে একেবারে স্বর্গ বানিয়ে রেখেছে।
                               ( বগালেকের চূঁড়ায় উঠে হিমালয় জয়ের আনন্দ!)



এখানেও আর্মি ক্যাম্প আছে। গাইড আমাদের নিয়ে রিপোর্ট করে আবুল হোসেনের টেলিফোনে বুক করা লেকের দক্ষিণ পাশে ‘সিয়াম দিদি’র বাঁশের তৈরী নিসর্গ কটেজে উঠল। এক রুমে সবাই ক্লান্তি আর ভালোবাসায় মাখামাখি করে বিশ্রাম নিতে থাকি। বিকাল আর সন্ধায় লেকটা ঘুরে লেক সম্পর্কে নানা উপকথার গল্প নিয়ে রাতে আর্মি ক্যাম্পে খেয়ে ১০টার দিকে নিসর্গ কটেজে ঘুমিয়ে পড়ি ।

কেওক্রাডং-এর পথে
শনিবার, সকাল ৬:৪০। প্রধান লক্ষ্যে যাত্রা। বলে রাখা ভাল, আমাদের দলের ম্যানেজার কাম লিডার হল মেহেদী হাসান, সৌখিন ফটোগ্রাফার, সব ছবি তারই তোলা। যদিও তার এটা প্রথম যাত্রা কিন্তু তার কর্মকান্ডে মনে হল এর আগেও সে একাধিকবার এসেছে। তার ভাষায়, এটা তার ৩ বছরের সাধনা। যাই হোক, মেহেদী আর গাইডের নিঁখুত পরিকল্পনায় শুরু হল মহা অভিযান। কুয়াশার অন্ধকারে পূর্ব দিকের মনোমুগ্ধকর ঝিরিপথ দিয়ে চিংড়ি ঝরণা, রংতন পাড়া হয়ে রুমতুম পাহাড়ের ছাউনিতে জলাহার করে আধ ঘন্টা বিশ্রাম নিয়ে ৩ নং রেমাক্রি প্রাংসা ইউনিয়নের সাজানো গোছানো দার্জিলিংপাড়ায় চলে এলাম। পর্যটকরা চাইলে এখানকার কোন কটেজে এক রাত বিশ্রাম নিতে পারেন। দার্জিলিংপাড়ার পূর্বদিকে পাহাড় আর গিরিখাতের ফাঁকে ফাঁকে আদিবাসীদের ঘর-বাড়ি। উপত্যকার মত ঢেউ খেলোনো খাড়া ভূমিতে জুমচাষ আর জুমচাষ, হালকা কুয়াশায় ঘেরা পুরো পার্বত্য এলাকা। মাঝে মাঝে শওকতের দুষ্টামী--‘স্বপনদা, পাহাড় এত উঁচু নিচু কেন, মানি না, মানব না।’ শত ক্লান্তি সত্ত্বেও ওর কথায় সকলে হেসে উঠি। প্রকৃতির সৌন্দর্য আর শুকনো বিস্কুট খেতে খেতে মহাক্লান্তি নিয়ে কেওকাড়াডং পাহাড়ে উঠলাম। পরিচয় হল এ পাহাড়ের ভূপতি লাল মুন থন লালার সাথে। এবার চূঁড়ায় উঠার পালা।
                                          (কেওকাড়াডং এর র্চুঁড়া)



ঠিক বেলা ১০:২৫এ ব্যানার, ক্যামেরা, জাতীয় পতাকা নিয়ে সমুদ্র পৃষ্ঠ হতে ৩১৭২ ফুট উচ্চতায় বিজয়ী বেসে গাইড সহ মোট ৬ জন চূঁড়ায় উঠে আনন্দ উল্লাসে ফোনে বাংলাদেশের এক সময়ের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ কেওক্রাডং বিজয়ের কথা আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবদের জানালাম। চূড়ার পূর্বদিকে পাহাড়-বন জঙ্গল-গাছপালা আর বিস্ময়কর গিরিখাদ, উপত্যকার ফাঁকে ফাঁকে ছোট ছোট আদিবাসী পাড়া, উত্তর ও পশ্চিমে পাহাড়ী পথ, আকাশ আর ঘন কুয়াশার মাঝে মেঘ, দক্ষিণে কুয়াশার চাদরে ঢাকা অতি ঢালু জাদিপাই ঝর্ণায় যাওয়ার পথ, উপরে ভেজা তুলোর মত সাদা মেঘের তুলির আঁচড়ে সীমাহীন নীল আকাশ। আমরা আছি, মেঘের দেশে। বিস্ময়ে বিহ্বল আমাদের চোখ আর মন। তবে চূঁড়ার স্তম্ভ শিলায়, গোলাকার বিশ্রাম ঘরে পোড়া কাঠ, ছাই, ছেঁড়া কাপড়, পানির বোতল ইত্যাদি ময়লা আর দেয়ালে পর্যটকদের নাম, ঠিকানা, ফোন নং-এ ভরা--এতটা ময়লা-আর্বজনা দেখে মনটা আমাদের খারাপ হয়ে গেল। পুরান ঢাকার পরিবেশ রক্ষার শপথ স্মরণ করে চূড়ার ময়লা-আর্বজনা সবাই মিলে পরিষ্কার করলাম। পাহাড় মালিকের সাথে এ বিষয়ে অনেক কথা হল। তিনি বললেন, আবেগ প্রবন পর্যটকরা এখানে উঠে নিজেদের আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। তবে রাতের বার-বি-কিউ উৎসবই বেশী ময়লা করে ফেলে। তবে উনি আমাদের কাছে নিয়মিত পরিষ্কার রাখার অঙ্গিকার করলেন।


জাদিপাই ঝরণার পথে
আমাদের দলের কেউ বগালেক, কেউ দার্জিলিং পাড়া পর্যন্ত এসে আত্নসমর্পন করেছেন। আমরা গাইড সহ মোট ছয় জন শেষ পর্যন্ত কেওক্রাডং থেকে জাদিপাই ঝরণার দিকে যাত্রা করি। আনন্দ আর আবেগে আমার কন্ঠে বেজে চলেছে রবীন্দ্র আর লালনের গান, কবিতা, মাঝে মাঝে শওকতের দুষ্টামী, জাহাঙ্গীরের পায়ের রগ টানের বিড়ম্ভনায় বিরক্ত মেহেদীর চোখ-মুখ। কারণ সে সবার আগে হাঁটলেও মুভ (অবস করার স্প্রে) তার কাছে থাকায় এবং টিম লিডার হওয়ার কারণে তাকে শওকত আর জাহাঙ্গীরের জন্য বারবার থামতে হয়। আমাদের ভূড়িওয়ালা ছোট হাতির ছানা ইঞ্জিনিয়ার কাম ডাক্তার বেলাল আমাদেরকে বিস্মিত করে বারবার আল্লাকে ডাকতে ডাকতে পাকা অভিযাত্রীর মত সমস্ত ট্যুর শেষ করে।
                                               (প্রাসিং পাড়া)



দুই পাশের পাহাড়ী ঘাসের ঢেউ খেলানো সরু পথে শুধুই নামছি। শেষ আর হতে চায় না। হঠাৎ করে কোন লোকালয় দেখতে পেলে ক্লান্তি কমে আসে। প্রাসিংপাড়া। ছিমছাম, পূর্ব-পশ্চিমে খোলামেলা, সকাল-সন্ধ্যা বসে থাকলে সূর্যোদয়-সূর্যাস্ত দুটোই দেখা যায়, তুলে আনা যায় প্রকৃতির তুলিতে আঁকা আলো-ছায়ার অসংখ্য ছবি। এই পাড়ার এক বম নারীর কাছ থেকে অল্প দামে অতি সুস্বাদু পেঁপে খেয়ে আবার চলতে থাকি। খাঁড়া রাস্তা, নামছি তো নামছি, ঘন ঘন শ্বাস-প্রশ্বাস। পা আর চলতে চায় না। জীবনের চরম পথ চলা। প্রায় ১ ঘন্টায় মনে হয়, ২০০০ ফুট নিচের পাহাড় ঘেরা সমতল ভূমিতে নামলাম। সবাই এতটাই ক্লান্ত যে, রুমাল দিয়ে ঘাম মুছতে মুছতে সবাই গেঞ্জি খুলে উদোম গায়ে বাতাস লাগিয়ে আবার হাঁটতে লাগল। জাদিপাই পাড়া পার হয়ে আরো আধা ঘন্টায় সমতল নিসর্গের সরু পথে হেঁটে হঠাৎ করে থেমে যাই। শওকতের চিৎকার,‘ওরে বাপরে, নামবো কেমনে। স্বপন দা, একটা রিকসা ডাকেন।’ ওর কৌতুক যেন, ক্লান্তির উপর শ্রান্তি বয়ে আনে।
সবচেয়ে ভয়ঙ্কর গিরিপথ! এই খাড়া বন্ধুর পথে কিভাবে যে নামলাম, তা মনে হলে এখনও আঁতকে উঠি। ঐ সময়ে পরিবার-পরিজনের কথা খুব মনে হয়েছিল। বাঁশ, দড়ি, পাহাড়ী লতা, গাছের শিকড়-- যা পেয়েছি তাই ধরে যাদিপাই ঝরণায় নামি। ইউরেকা! ঝরণার রূপ দেখে আমাদের কারো কোন ক্লান্তি রইল না। ইচ্ছেমত জল খেলাম,অতি সুস্বাদু জল। পা ডুবিয়ে রাখলাম, পরম শান্তি! প্রায় ৩০০ ফুট উচ্চতার এই ঝরণার উপরে সরু একটি ছড়া দিয়ে অনবরত সুমধুর সুরে পানি ঝড়ছে। শান্ত ঝরণা, ধাপে ধাপে সাজানো গ্রানাইট প্লেট, আঁকা-বাঁকা কোন প্লেট মূল ভিত্তি থেকে বাইরে বেড়িয়ে আছে। ঝরণার সমতলে গ্রানাইট আর বেলে পাথর, খালি পায়ে হাঁটা যায় না। কঠিন স্তরীভূত এত শিলা পাথর হাজার হাজার বছর ধরে এখানে পড়ে আছে মহাকালের সাক্ষী হয়ে। দক্ষিণ-পশ্চিমে তাকিয়ে দেখি কাঠের সিঁড়ির মত শিলা পাথরের প্লেট। ঝরণার গোড়ায় গোসল করার সময় মনে হল, প্লেটগুলি বুঝি এখনি মাথার উপর পড়বে। হঠাৎ করে ঝরণার গতিবেগ ভয়ানকভাবে বেড়ে গেল। সবাই ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে ছুটতে লাগলাম। চারদিকে কোন বৃষ্টি নাই অথচ রংধনু ঝরণার পাদদেশের গা ঘেঁষে। দক্ষিণে তাকিয়ে দেখি সূর্য আলো দিয়ে চলেছে ঝরণার উলম্ব গায়ে। আমার ঘোর কাটল সকলের নাচানাচি দেখে। সবাই খুশি। সম্ভবত গাছের গুড়িতে জল আটকে ছিল অথবা জল আটকে কেউ মাছ ধরছিল। গাছের গুড়ি হঠাৎ সরে যাওয়ায় অথবা মাছ ধরা শেষে পাহাড়ীরা জল হঠাৎ করে ছেড়ে দেয়। জাহাঙ্গীরের সে দিনের উদ্দাম নৃত্য আমাদের বহুদিন মনে থাকবে। ছবি তোলা, গোসল করা শেষ করে হঠাৎ তাকিয়ে দেখি জলের নিচে প্রায় ডুবন্ত বড় এক পাথরে উঠে খালি গায়ে বেলাল নামাজ পড়ছে। মনে হল, পাথরসহ সে ভাসছে।
                              (ছবিঃ মেহেদী হাসান তালাত, ৫ মিনিট আগের ছবি )

                               ( ছবিঃ মেহেদী হাসান তালাত, ৫ মিনিট পরের ছবি )

                                                (হঠাৎ রংধনু)

মনটাকে ঝরণার কাছে রেখে আবার বহু কষ্টে কেওক্রাডং চলে আসি। গল্পে গল্পে দুপুরের খাবার খেয়ে খানিকটা সময় বিশ্রাম নিয়ে ঝিরি পথ দিয়ে ফিরতি পথ চলা। চিংড়ি ঝরণা পর্যন্ত আসতে রাত হয়ে গেল। ঘুটঘুটে অন্ধকার। ঝিঁ ঝিঁ পোকার ডাক আধার প্রকৃতিকে করেছে আরো ভীত সন্ত্রস্ত। যেন, স্বপ্নের হাত ধরে কৃষ্ণপক্ষের রাত্রির এই অন্ধকারে অনন্তের পথে চলেছি এই ঝিরি পথ ধরে। ঢালু পাহাড়ী পথের ফাঁকে ফাঁকে ছোট-বড় অসংখ্য গর্ত। হয়তো বনপোকা, ইঁদুর-শিয়ালের গর্ত। এ পৃথিবীর প্রাণীকুলের মধ্যে দিনের প্রাণীর চেয়ে রাতের প্রাণীর সংখ্যাই বেশী। দেহ সমান বাঁশে ভর দিয়ে ঢালু পথে চলা। হঠাৎ লাল মাটির ধুলোয় পা পিছলে পড়ে আবার ভারসাম্য ঠিক রেখে পথ চলা।
দেহের ওজন মনে হয়, দ্বিগুন হয়ে গেছে। পা ফুলে এমন অবস্থা হয়েছে যে, বিশেষ বেল্ট লাগানো সেন্ডেল খোলার পর জুতা আর কেউ পড়তে পারে নাই। তারপর গাইড আর রবার্ট বমের গাওয়া আর আমাদের তাল মেলানো বাংলা, হিন্দী আর বম গানের সুরে মধ্য রাত পর্যন্ত বার-বি-কিউ উৎসব চলে। মহাক্লান্তি নিয়ে একটানা ঘুমের পরদিন ফিরতি পথে বান্দরবানের বোমাং রাজপূণ্যাহ্ উৎসব বোনাস হিসাবে আমাদের হিসাবের খাতাটাকে পরিপূর্ণ করে দিয়েছে। এখনো চোখ বুজলে ভেসে উঠে, সেই স্মৃতি গাঁথা বান্দরবানের পাহাড়-ঝরণা-ছড়া-মেঘ-কুয়াশা-নদী- কৈক্ষ্যংঝিরি- রুমা বাজার-বগালেক-দার্জিলিংপাড়া-কেওক্রাডং- প্রাসিংপাড়া-জাদিপাই ঝরণা আর রহস্যময় পাহাড় ঘেরা সবুজ জঙ্গল।







হেমন্তের গান

ষড়ঋতুর বাংলাদেশে হেমন্ত এক অদ্ভুত ঋতু। শরৎ শেষে প্রকৃতি কিছুটা মলিন হতে থাকে। আগাম পড়তে শুরু করে শীতের হিম কুয়াশা। ছাই রঙ কুয়াশার চাদর মুড়িয়ে ফেলে সকাল-সন্ধ্যার সুনীল আকাশ। ফসলহীন মাঠ যেন, পরিত্যক্ত জনপদ; এর উল্টো পিঠও আছে। কৃষকের ঘর জুড়ে আনন্দের বন্যা। মাঠশূন্য করা ফসল যে তার গোলা ভরিয়েছে। মিটেছে অভাব। তাই তো দিকে দিকে শুরু হয়ে যায় নবান্ন উৎসব। শুধুই কি নবান্ন! হেমন্তে আরও কত কত উৎসব উদযাপন হয়ে আসছে সেই সুদীর্ঘকাল থেকে।

‘ভাইয়ের কপালে দিলাম ফোঁটা--যমের দূয়ারে পড়ল কাঁটা, যমুনা দেয় যমকে ফোঁটা--আমি দিলাম আমার ভাইকে ফোঁটা।--ভাইয়ের কপালে বোন এই ছন্দ বা মন্ত্র পাঠ করে চন্দন, ঘি, মধু দিয়ে ফোঁটা দেয়; ভাই যেন বিপদ মুক্ত থাকে। ভাইও বোনকে সামর্থ্য অনুযায়ী কিছু দিয়ে আশির্বাদ করে।’--কবে যে এই ভাই ফোঁটা উৎসব শুরু হয়েছে--তা কেউ বলতে পারে না। বলা হয়ে থাকে, এটা অনার্যদের আচার অনুষ্ঠান; কেউ বলে, অনার্য নারী-পুরুষ উভয়েই জঙ্গলে শিকারে যেত, চাষবাস করত আর আর্যদের মধ্যে সাধারনত পুরুষরা যুদ্ধ করত বা শিকারে যেত, তাই বোনরা ভাইদের বিপদ মুক্তির জন্য এই অনুষ্ঠান করত, তাই এটা অনার্যদের
চেয়ে আর্যদের আচার অনুষ্ঠান বলাই যুক্তিযুক্ত। তবে সব অনার্য নৃগোষ্ঠির মধ্যে মাতৃতান্ত্রিক ধারা ছিল না, কোন কোন গোষ্ঠীর মধ্যে পিতৃতান্ত্রিক ধারাও ছিল। অনার্যদের কোন কোন জাতির পুরুষেরা শিকারে বা যুদ্ধে যেত। তাই তাদের বোনেরাও হয়তো ভাই ফোঁটা প্রথম শুরু করে থাকতে পারে।

আর্যরা এই অঙ্গ,বঙ্গ, কলিঙ্গ, সমতট, রাঢ় দখল করার পর আর্য-অনার্য মিশ্রণের ফলে লোকায়ত পূজা-অর্চণা এবং সাংস্কৃতিক ধারায়ও মিশ্রণ ঘটে। পিতৃতান্ত্রিক আর্য সমাজে ধর্মীয় প্রথায় পুরুষ পুরোহিত প্রাধান্য পেলেও মাতৃতান্ত্রিক অনার্য সমাজে নারী পুরোহিতের প্রাধান্য ছিল। যদিও ধীরে ধীরে নারী পৌরোহিত্যের প্রভাব কমতে কমতে এখন গৃহের ছোট ছোট পূজা অর্চনায় সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে। আদিকাল থেকেই অনুকূল আবহাওয়া এবং নানা রকমের শস্য উৎপাদনের মাসগুলোতেই বাঙ্গালীর নানা আনন্দ উৎসব হয়ে আসছে। প্রাচীনকাল থেকে অগ্রহায়ণ মাসেই সবেচেয়ে বেশী ফসল উৎপাদন হয়, মানুষের মন থাকে উৎফুল্ল, ঘরে ঘরে আনন্দ বয়ে যায়। আর তাই হয়তো সম্রাট আকবর এই মাসকেই বছরের প্রথম মাস বা খাজনা তোলার মাস ঘোষণা দিয়েছিলেন।

বাংলার সাংস্কৃতিক ইতিহাসের শিকড় থেকেই নবান্ন উৎসব প্রচলিত। হেমন্তের ধান কাটার পর হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রচলিত অগ্রহায়ণ মাসে অনুষ্ঠেয় অন্ন খাওয়ার উৎসবই হল নবান্ন যা বাঙালি হিন্দুদের মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সব বাঙালির প্রাণের উৎসবে পরিণত হয়েছে। নানা ধরনের দেশীয় নৃত্য, গান, বাজনাসহ আবহমান বাংলার সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পালিত হয়। লাঠিখেলা, বাউলগান, নাগরদোলা, বাঁশি, শখের চুড়ি, খৈ, মোয়ার পসরা বসে গ্রাম্য মেলায়।

আমার গ্রাম্য বেলার জীবনে আমি দেখেছি হেমন্তের ফসল আঁকা মেঠো পথ ধরে কত আনন্দ উৎসবের ধারা বয়ে যেত। মেঠো পথে পথে বাশুরিয়ার সুরের তানে বাতাস-ফসলের নৃত্যে জীবন খুঁজে পায় জীবনের স্বাদ। কার্তিকে শুরু হত নতুন ফসলের উৎসবের প্রস্তুতি পর্ব। কার্তিকের শেষ দিন কার্তিক পূজা, বুড়া-বুড়ীর পূজা, সন্তোসী মায়ের পুজা দিয়ে মাস শেষ হতেই অগ্রহায়ণের প্রতি রবিবার হতে শুরু হত ক্ষেতের বত্ত ; শনিবার থাকত শনিপুজা, তারপর ভাই ফোঁটা উৎসব, গোবাচ্চার জন্য গোরক্ষনাথের পূজা--সারা মাসই দেব-দেবতাকে খূশী করতে নতুন নতুন শস্যের নানা উপাদেয় খাবার তৈরী হত। কার্তিক দেবতার মত বীর যোদ্ধা, সুন্দর অবয়বের বর পাবার আশায় কার্তিক মাসের শেষ দিন সনাতন নারীরা কার্তিক পূজার আয়োজন করে। নতুন বিবাহিত অনেক নারীর নতুন বর দেখলে আমরা যেমন বলে উঠি, মেয়েটি কার্তিকের মত বর পেয়েছে। ব্রাক্ষণ বালকদের মস্তক মুন্ডু করে, কানে ছুঁচ ফুটো করে হেমন্ত-অগ্রহায়ণ মাসেই উপনয়ন বেশী হত। উপনয়নের পর থেকে বালকরা ব্রাক্ষণ হতেন।

যদিও সরকারী পঞ্জিকা আর সনাতন পঞ্জিকার দিন তারিখ এক রকম হয় না। কোথাও কোথাও সরকারী পঞ্জিকা অনুযারী, কোথাও সনাতন পঞ্জিকা অনুযায়ী উৎসব হয়। তিথি-নক্ষত্রের শুভক্ষণ অনুযায়ী পূজার দিন স্থির করা হয়। তাই সরকারী ক্যালেন্ডার অনুযায়ী দেখা যায় আশ্মিনের দূর্গাপূজা হয় কার্তিকে, কার্তিকের কার্তিক পূজা হয় অগ্রহায়ণে। আসলে তিথি-নক্ষত্র, লোকনাথ পঞ্জিকা অনুযায়ী, সনাতন হিন্দুরা দূর্গা পূজার ঘট (মহালয়া) আশ্বিনেই বেদীতে বসায়, কার্তিক পূজার ঘট কার্তিক মাসেই বেদীতে বসায়।

ক্ষেতের বত্ত এক এক অঞ্চলের এক এক জাতি গোত্রের মধ্যে ভিন্নতা দেখা যায়। অগ্রহায়ণ মাসের প্রতি রবিবার সন্ধার পর নতুন চাল দিয়ে ছোট ছোট পিঠা (লবণযুক্ত ও লবণছাড়া), ধান-দূর্বা, তুলসীপত্র, কর্পূর, চালকলার নৈবেদ্য, ধূপধূয়া দিয়ে উঠোনে পুজা হত। উঠোনের মাঝখানে ছোট্ট গর্ত (আয়তাকার পুকুর আকৃতির) করা হত। ক্ষেত দেবতার কিচ্ছা শুনানো হত। পাড়ার সব ছেলেমেয়েরা উঠোনে ছোট্ট পুকুরের চারপাশে বসে মা, কাকীমা, ঠাকুমার মুখে কিচ্ছা শুনত। পিনপতন নিরবতার মধ্যে ছোট ছোট বাচ্চারা গল্পের রাজ্যে ঘুমিয়ে যেত। আমাদেরকে বলা হত, খুব ভোরে উঠে যে পুকুরে ভাসিয়ে দেওয়া পিঠা খাবে, বিশেষ করে প্রথমে যে লবণযুক্ত পিঠা খেতে পারবে, সৌভাগ্যবান হিসাবে দেবতা তার প্রতি অধিক সন্তুষ্ট হবে। তার গোলা ফসলে ভরে যাবে, তার ঘরে ভাল গৃহস্ত, লক্ষ্মী বউ আসবে। খেতের দেবতাকে খুশী রাখতে অনার্য নৃগোষ্ঠি সেই কবে ক্ষেতের বত্ত শুরু করেছিল, আজও তার মিথ স্রোত বয়ে চলেছে এই মিশ্র জাতির মধ্যে।

বাস্তপূজা শীতকালে হলেও কোথাও কোথাও পুরোহিতের পরামর্শ নিয়ে, বিশেষ করে আমাদের বিক্রমপুর এলাকায় কার্তিক-অগ্রহায়ণেও বাস্তুপূজা হত। বিল থেকে হিজল গাছের কচি ডাল এনে, যেখানে ঘর তৈরী হবে সেখানে মাটির তৈরী বেদীর উপর পুঁতে দেওয়া হত। এটিই বাস্তুদেবতার প্রতীক। চাল, গুড় ও দুধ দিয়ে তৈরী পায়েস পুরোহিতের সাহায্যে কলাপাতায় এমনভাবে ঢেলে হিজল গাছের ডালের কাছে রেখে দেওযা হত--যাতে পায়েস গড়িয়ে মাটিতে পড়ে, মাটিতে শোষিত হলেই ধরা হত দেবতা ভোগ গ্রহণ করেছেন। এবার ঘর তৈরীতে বাঁধা নেই। পুরোহিত থেকে আমরা জেনেছি, এই পূজা না করে ঘর বানালে, সংসারে অশান্তি হবে, ঘর কালবৈখাখী ঝড়ে গৃহস্তের উপর ভেঙ্গে পড়বে।

কার্তিক মাসের শুরুতে তুলসী গাছের নিকটে সারা মাস সন্ধ্যা থেকে জ্বালিয়ে রাখা হয় আকাশ প্রদীপ বা গাছ প্রদীপ । আকাশ প্রদীপ এর ক্ষেত্রে বাঁশের আগায় ছোট ঘর বানিয়ে সেখানে মাটির তৈরী মুছিতে সরিসার তেল ঢেলে বিধবাদের পরিত্যক্ত, পরিষ্কার কাপড় বা পাট দিয়ে বানানো সলতার সাথে সরিষা মেখে প্রদীপ জ্বালিয়ে বাঁশটিকে ঘরের ছাদ ছাড়িয়ে আকাশে প্রতিদিন সন্ধ্যা থেকে সকাল পর্যন্ত খাঁড়া করে রাখা হয়। ভূত-প্রেত, অশুভ ছায়া তথা অকল্যাণ থেকে রক্ষা পেতে আকাশ প্রদীপ বা গাছ প্রদীপের পূজা করা হয়।

গাভীর বাচ্চার বয়স একুশ দিন হলে গাভীর দুধ দিয়ে নাড়ু তৈরী করে গোরক্ষনাথ দেবতার উদ্দেশ্যে ভোগ দিয়ে সবাই সমস্বরে বলত, গোরখার নাড়ু, হেউচ্চ...। পূজার পর থেকে গৃহস্তরা গাভীর দুধ খেত। এই পূজা করলে গাভী প্রচুর দুধ দেবে, প্রতি বছর সুস্থ্য বাচ্চা জন্ম দেবে। এই পূজার দিবস নানা গোত্রের সনাতন গৃহস্তরা গাভীর বাচ্চা জন্মের ৭/১৪/২১/২৮ এর মধ্যে রাখেনি, নিয়মের পরিবর্তন এমন হয়েছে যে, সামান্য নিয়মাদি পালন করে প্রথম দিন থেকেই গৃহস্তরা গাভীর বাচ্চার সাথে নিজেরাও দুধ খেত। হেমন্তকালের কার্তিক-অগ্রহায়ণে অথবা নিজেদের ভাল সময়ে গোরক্ষনাথ পূজার অনুষ্ঠান করত। পরিবর্তনের যুগে এই পূজা এখন বিলুপ্তির পথে।

রাখীবন্ধন, মনসাপূজা, দূর্গাপূজা, লক্ষ্মী পূজা, কার্তিক পূজা, কালীপূজা, দীপাবলী পূজা, অমাবস্যার ১ম বা ২য় তিথিতে মুখের দুই পাশে দুই রংয়ের অবয়বে হরিপরমেশ্বর পূজা, পূর্ণিমাতে রাধা কৃঞ্চের জন্য কীর্তন সহকারে রাসলীলা পূজা, বনের অধিবাসীর জন্য বনদেবীর পূজা--নানা পূজা-অর্চণার মাধ্যমে বিপদ-আপদ-মঙ্গল কামনায় শরৎ-হেমন্তের গ্রাম্য বাংলার শাশ্বত সাংস্কৃতিক রূপের সাথে অগ্রহায়ণ-পৌষ মাসে যোগ হয় নানান পাগলের মেলা, পীর-মুর্শীদের ওরস, ওয়াজ মাহফিল। এ সময়ে ফসলে ফসলে ছড়িয়ে থাকে মাঠ-ঘাট-পথ-আঙ্গিনা-ঘর-গোলা। মুসলমানরা প্রথম ফসল দিয়ে মাজার, দরগায় শিন্নি দেয়; কেউবা কোন কিছু পাবার আশায়, কারো রোগ মুক্তি কিংবা মঙ্গল কামনায় পীর-মুর্শীদ বা পাগল বাবার জন্য প্রথম ফসল মানত করে রাখে। মানুষের দ্বারে দ্বারে ভাগ্যলক্ষ্মী কার্তিক-অগ্রহায়ণের কাঁধে চড়ে ঘুরে বেড়ায়, মাঠ-ঘাট শস্য শ্যামলায় ভরে দেয়। আর তাইতো, সনাতন জাতি, উপজাতি ও অন্যান্য ধর্ম জাতির মধ্যে অসীম রহস্যের প্রতি কৃতজ্ঞতায় নিজেদের তৈরী বিশ্বাসের মিথগুলোকে গড়ে তোলে নিজেদের মতো করে, পরিবর্তনও করে নিজেদের সুবিধা মতো।

হেমন্তের নবান্নের সময় প্রকৃতির সঙ্গে সঙ্গে মানুষের মন-মানসিকতায়ও পরিবর্তন আসে। ধানের হরিদ্রা রঙের সঙ্গে একাত্ম হয়ে মেয়ে ও বধূরা হলুদ শাড়ি সায়াহ্নের রক্তিম সূর্যের কিরণ যেন, পায়ের আলতা রঙে শাড়ির পাড়ে উঠে আসে; সেই সাথে ছেলেরাও যেন অঘ্রাণের পাকা হলুদ ধানের আভা ধারণ করে তাদের ফতুয়া ও পাঞ্জাবিতে। তাদের ফতুয়া ও পাঞ্জাবির নকশায় আবহমান বাংলার প্রতিচ্ছবিও ফুটে ওঠে। এ সময় গ্রামবাংলার পাড়া-মহল্লায় বিয়ের ধুম পড়ে যায়। পাকা ধান কিবা নানান শস্যের বিনিময়ে প্রাপ্ত অর্থ দিয়ে কন্যাকে পিতা পাত্রস্থ করেন। বিয়ে বাড়িতে বিয়ের গীত আর আলতা-মেহেদীতে রাঙানোর আসর বসে। মানুষের মুখে মুখে প্রচলিত, এ সময়ে বিবাহ নাকি নতুন সংসারে সুখ ও শান্তি বয়ে আনে।

প্রকৃতির সবুজ ফসল হরিদ্রাভ সাজে নতুনের জাগরণ ঘোষণা করে। শরতের গিঁড়া জল সরে গিয়ে মাঠ-ঘাট ভরে ওঠে সোঁদামাটির গন্ধে। সূর্যের রক্তিম আভা নদীর শান্ত জল আর ভোরের ফসলের কচি ডগায় জমে থাকা শিশিরে পড়ে ঝিকমিক করে, মধুমাখা শীতল বাতাস অঙ্গজুড়ে হিল্লোলিত হয়। ঘরে ঘরে নতুন ধানের চালে শুরু হয় উৎসব। ভোর রাতে বাড়ি বাড়ি ঢেঁকিতে চালের গুড়ি কোটা, চিড়া কোটার শব্দ উঠত--এখন যা অজপাড়া গ্রাম ছাড়া চোখে পড়ে না।

হেমন্তের নবান্ন উৎসবে নতুন ধানের চালের গুড়ি আর গুড় দিয়ে গ্রাম বাংলার ঘরে ঘরে তৈরী হয় নানা রকমের পিঠা, পায়েস। মাটির সরাতে, বেতের থালে, কলাপাতায় অথবা পিতলের প্লেটে সাজানো থাকে গ্রাম বাংলার বাহারি রকমের পিঠা--পাকান পিঠা, ভাপা পিঠা, কুসলি পিঠা, চিতই পিঠা, পাটিসাপটা পিঠা, নকসা পিঠা, পাতা পিঠা, জামাই পিঠা, কাটা পিঠা, চুটকি পিঠা, মুঠা পিঠা, চ্যাপা পিঠা, জামদানী পিঠা, হাঁড়ি পিঠা, ঝুড়ি পিঠা, ফুলঝুরি পিঠা, বিবিখানা পিঠা, মাছ পিঠা, হৃদয় পিঠা, গোলাপ ফুল পিঠা, পেঁচানো পিঠা, ফুল পিঠা, শাহী বিবিখানা পিঠা ইত্যাদি আরো অসংখ্য নামের নানা রকমের পিঠা। মা, বোন, বউদের পিঠাশৈলী আর রাত-দিনের অক্লান্ত পরিশ্রম সকলের স্বাদ, তৃপ্তি আর স্বস্তির মধ্যদিয়ে পিঠা শিল্পের পরিশ্রম সার্থক হয়। জামাইয়ের সাথে শালা-শালী, বিয়াইয়ের সাথে বিয়াইনরা মেতে উঠে গ্রাম-বাংলার মুখে মুখে প্রচলিত ‘ধাঁধা মিলাও--পিঠা খাও’ উৎসবে। এসব পিঠা নিয়েও গ্রাম বাংলায় আছে নানা রকমের মুখরোচক মিথ। অকল্যাণ থেকে রক্ষার জন্য সনাতন হিন্দুরা দেবতা সূর্যকে, কোথাও গরু দেবতাকে আগে পিঠা দিয়ে, মেয়ের জামাইকে (দেবতা রুপে) কলাপাতায় বা বেতের থালাতে পিঠা পরিবেশন করত। বউ-জামাইয়ের আলাদা থালার সাথে পাড়ার সবাই একসাথে পিঠা খেতে বসত। তবে আর্যধারা (সনাতন হিন্দু ?) মতে, আগে জামাইয়ের খাওয়া শেষ হবার পর বউঝিরা খেতে বসত।

নাগরিক সভ্যতার জাঁতাকলে আবহমান কালের সংস্কৃতির অনেকটাই হারিয়ে গেছে। একান্নবর্তী পরিবার প্রথায় মানুষের বন্ধন এক সময় দৃঢ় ছিল। উৎসব মুখর সমাজে সবাইকে সবার প্রয়োজন হত। মানুষে মানুষে সম্পর্ক ছিল সহজ-সরল। ভাইয়ে-ভাইয়ে, বোনে-বোনে সম্পর্ক ছিল আত্মার বন্ধনে। আজ, এখন সে সম্পর্কগুলো শিথিল হয়ে যাচ্ছে। অন্য ধর্মের কথা না হয় বাদই দিলাম, সনাতন হিন্দু জাতিরাই জানে না হাজার বছরের শক্ত বন্ধনের এই ছোট ছোট উৎসবের কথা--যা মিথ হোক আর গল্প-কাহিনী হোক, মানুষের শাশ্বত প্রেম-প্রীতি ভালোবাসাকে বিনা সূতার মালায় হাজার হাজার বছর ধরে বেঁধে রেখেছিল--যা এখন শিথিল হয়ে হিংসা-বিদ্বেষের রূপ ধারণ করেছে।

হেমন্তের রাজদরবারে শীতরাজের আগমণ বার্তা অথবা শীতরাজের হেমন্তরাজ্য দখলের আগাম হুংকার!

হেমন্তকাল। কার্তিকের শেষার্ধ। এ সময়ে সাধারনত ‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌'এ ভরা বাদর, মাহ ভাদর, শূণ্য মন্দির মোর'--আষাঢ়-শ্রাবণ অথবা ভাদ্র মাসের মত বৃষ্টি হবার কথা নয়, কারো মন মন্দির রিক্ত থাকার কথা নয়। এ সময়ে ফসলে ফসলে ছড়িয়ে থাকে মাঠ-ঘাট-পথ। সব প্রাণীদের মাঝে সখা-সখিদের কলকাকলীতে মুখরিত থাকে আকাশ-বাতাস-প্রান্তর। কারো কারো উঠোনে হয়তো প্রথম হেমন্তের ফসল উঠেও গেছে। অথচ গত দুই-তিন দিন ধরে রয়ে-সয়ে, যেন, মানুষের মনে শীতের আগমন স্মরণ করিয়ে দিতে, প্রকৃতির ভালোবাসার বা নিরবতার মাঝে, শীতল ছোঁয়ায় গুড়িগুড়ি বৃষ্টি হচ্ছে, মাঝে মাঝে মুসলধারে।

রাজ-রাজাদের আমলে, রাজা যখন রাজদরবারে প্রবেশ করতেন, তার আগমনের আগে গেটের প্রহরী চুঙ্গা ফুঁকিয়ে ঘোষণা দিতেন, উজিরে আযম, শাহানশাহ...........এখন রাজদরবারে প্রবেশ করিবেন, সবাই হুসিয়ার--। এ সময় রাজদরবারের ভিতরে ও বাহিরে স্ব স্ব পদ মর্যাদা, অবস্থান অনুযায়ী সবাই যেমন প্রস্ততি নিতে থাকে; ঠিক তেমনি করে হেমন্তের প্রথম হলুদ রংয়ের ফসল আঙিনার মেটে রংয়ের সাথে মিশে শীতের বাওয়াইয়া সুরে যেন, আগমনী গান গেয়ে চলেছে। যেন, আকাশ-বাতাস, নদ-নদী-খাল-বিল, দিন-রাতের প্রানী তথা প্রকৃতিকে জানিয়ে দিচ্ছে, শীত রাজ বা শীত দেবীর আগমণ বার্তা কিংবা রাজনীতিগতভাবে বলতে পারি, অসময়ে শীতরাজের হেমন্তরাজ্য দখলের আগাম হুসিয়ার বার্তা !

প্রকৃতি এখন আর নিয়ম মেনে চলে না, চলতে চায় না। আমরা গাছপালা উজার করে, ফসলি জমি ধ্বংশ করে তথা প্রকৃতি উজার করে ঘর-বাড়ি, শিল্প কারখানা গড়ে চলেছি, প্রকৃতির তাপমাত্রা দিনকে দিন বাড়িয়ে চলেছি, ফলে প্রকৃতি তার নিয়ম মানতে পারছে না।

গত কয়েক দিনের বৃষ্টির ফলে আকাশে, গাছে গাছে পাখিদের আনা-গোনা দেখা যায় না। প্রকৃতির পাখিগুলো গাছের ডালে ডালে নিজেদের বাসায় চুপচাপ বসে আছে। বাড়ির পাশের বড়ই গাছের পরজীবী স্বর্ণলতা বৃষ্টির স্পর্শে লাল আভায় চকচক করছে। অসময়ে জলে ভরা ডোবায় ব্যাঙ ডেকে চলেছে অবিরাম। ভিজা বনের শ্যাওলা পথে সাপ ব্যাঙ মুখে নিয়ে চলেছে কোন গুহা পথে। রাতের ঝিঁ ঝিঁ পোকারা বৃষ্টির জলে ভিজে চুপচাপ হয়ে আছে; মাঝে মাঝে দু’একটা পোকা রয়ে রয়ে ডাকছে। শ্মশান, গোরস্থান, বন-জঙ্গল, মেঠোপথ কোথাও হাঁটু বা কোথাও গিঁড়া জলে ভিজে আছে। শিয়ালগুলো পাকা রাস্তার অন্ধকারে গোঁড়াডুবা ডোলকলমীর ঝোপে বিপদাপন্ন সুরে ডেকে চলেছে। সেই সাথে রাস্তার কুকুরগুলিও শিয়ালের সাথে অবিরাম ডেকে চলেছে। গায়ের গৃহীনিরা এ পরিবেশকে অসনিসংকেত মনে করে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থণা করছে। আগাম রোপা আলুর বীজ পঁচে গেছে। কৃষক মাথায় হাত রেখে প্রকৃতির পানে চেয়ে আছে, মিনতি করছে আর যেন বৃষ্টি না হয়।

ষড়ঋতুর কীর্তন করতে গিয়ে প্রকৃতির মত আমার সাহিত্য কবি সত্ত্বাও নিয়ম মেনে গায়নি। শরতের কীর্তন গাইতে শরতের সাথে গেয়েছে বর্ষা ও হেমন্তের পুঁথি গান, বর্ষার কীর্তন গাইতে বর্ষার সাথে গেয়েছে গ্রীষ্ম ও শরতের পুঁথি গান, ঠিক তেমনি করে আমার সাহিত্য কবি সত্ত্বা হেমন্তের কীর্তনেও গেয়ে চলেছে বর্ষা, শরৎ ও শীতের পুথিঁ গান।

বাংলাদেশের আবহাওয়া অফিস ও তাদের আবহাওয়া বার্তাও নিয়ম মেনে চলে না। আজ তাদের আবহাওয়া বার্তায় বলেছে, মুসলধারার বৃষ্টি কার্তিক মাসের ২২ তারিখে শেষ হবে। তারপর প্রকৃতিতে শীতের আগমন শুরু হবে। আজ কার্তিকের ২২ তারিখ। ২৩ তারিখ থেকে ঝরা পাতার গান শুরু হবে। ভরা কার্তিক আর মরা কার্তিক না হয় কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি গেল, (সম্রাট আকবর প্রবর্তিত বাংলা মাসের প্রথম মাস ) অগ্রহায়নের কি হবে, সে তো এখনও আসেইনি। প্রকৃতির এ অবস্থা হলে সম্রাট আকবর অগ্রহায়নকে বছরের প্রথম মাস ঘোষণা দিতেন না। প্রকৃতির সাথে সমসুরে গীত গাইতে গিয়ে বৈশাখ মাস সুবিধাজনক হওযায় হয়তো পরবর্তীতে এ মাসকেই বছরের প্রথম মাস ঘোষণা দেওয়া হয়েছে আর বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ একটি গান দিয়েই এ মাসকে করেছেন বিশ্বনন্দিত।

প্রকৃতির এ বিরূপ কর্মকে কার্তিক দেবতাও সামাল দিতে পারছে না। সদ্য চলে যাওয়া মাসের বিদায় আর নতুন মাসের আগমণকে গ্রহণ করতে ১ লা অগ্রহায়ণ বিকাল বা সন্ধ্যায় গৃহিণীরা লেপ-চাদর মুড়ী দিয়ে হয়তো আঙ্গিনায় আঙ্গিনায় বুড়ার পূজা উৎসব করবে। হাজার বছর ধরে হেমন্তকালে হেমন্তলক্ষ্নী আর কার্তিকের কৃপায় ফসলে ফসলে মানুষের ভাগ্যলক্ষ্নী দ্বারে দ্বারে পৌঁছে যায়। ফসলের ডগার শিশির বিন্দু দিনের প্রথম আলোয় চিকচিক করে উঠে; যেন দিনকে জানিয়ে দেয় সুজলা-সুফলা-শষ্য শ্যামলার আগাম বার্তা। সনাতন জাতি, উপজাতির মাঝে ‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌'ক্ষেত্তের বত্ত' বা খেত ফসলের দেব-দেবতার পূজা শুরু হয়। হলুদ রংয়ের খড়-নাড়ার বিছানায় মাঠে মাঠে শুরু হয় ওয়াজ মাহফিল। দেশ বা দশের কোন কল্যাণ না হলেও হাজার হাজার বছর ধরে ওয়াজ মাহফিল, মিলাদ মাহফিল, মাজার মানত, পূজা-পার্বন, বুদ্ধ বন্দনা, খ্রীস্ট বন্দনা চলছে, চলবে।

(আমার হেমন্ত বন্দনাও চলবে, যদি দেশ ও জাতির কোন উপকার হয় ?! )

স্বপ্নের বীজ বোনার অপেক্ষায়

                          
                                   

গ্রীষ্মের শেষ, বর্ষার শুরু--আষাঢ় মাস; গত মাসের মত এ মাসেও  সূর্যের সাথে যুদ্ধ করে মেঘ খন্ডগুলো হেরে গেছে। ফলে সমস্ত মেঘ খন্ড হিমালয়ে একত্র হয়ে আবার আক্রমণের প্রস্তুতি নিচ্ছে। এদিকে গ্রাম বাংলার মাঠ-ঘাট ফেটে চৌচির হয়ে গেছে। নদী-নালার পানি রেখা একবারে তলায় ঠেকে গেছে। অসংখ্য ফল গাছের ফুলের রেনু রৌদ্রতাপে শুকিয়ে যাচ্ছে। পানির অভাবে ক্ষেতের ফসল কেমন যেন, হাহাকার করছে। ভোর হবার পর থেকেই সূর্যের প্রচন্ড তাপ পৃথিবীর বুক জুড়ে দগ্ধ কেয়ামতের সংকেত দিয়ে যাচ্ছে। নিরব নিথর দুপুরবেলা রাখালেরা গাছের ছায়ার গরুগুলিকে বেঁধে গামছাটা শীতল ঘাসের উপর বিছায়ে শুয়ে পড়ে। কৃষক গাছের ছায়ায় বসে লুঙ্গি দিয়ে দেহের ঘাম মুছে, মাথার বিড়া দিয়ে বাতাস করছে। এদের দেখে মনে হয় যেন, আগুন থেকে উঠে এসেছে। হাত-পা মুখ লাল হয়ে আছে রৌদ্রতাপে। গাছে গাছে পাখিরা থেমে থেমে ডেকে চলেছে। মাঠে মাঠে গরু-ছাগল-ভেড়া--প্রাণীগুলি সূর্যেরও তাপদাহে একটানা ডেকে চলেছে। এর মাঝে দু’একটা ছেলে-মেয়েকে গোবর কুড়াতে দেখা যাচ্ছে । কিছুদূরে দক্ষিণে বড় রাস্তা দিয়ে একটা ছোট ট্রাক যেতেই ধুলি-বালি উড়ে অন্ধকার হয়ে গেল। পথের পাশে বড় বড় গাছের ছায়ায় লুঙ্গি গামছা বিছায়ে পথিক বিশ্রাম করছে। চারদিক হঠাৎ নিরব হয়ে  গেলে দূর হতে দুই-একটি ঘুঘুর ঘু-ঘু ডাক শোনা যায়। মনে হয়, এরা যেন বৃষ্টির জন্য স্রষ্ঠার কছে মিনতি করছে। চৌচির মাঠ-ঘাট আর তৃষ্ণার্ত ফসল ক্রমাগত মিনতি করে চলেছে স্রষ্ঠার কাছে। মাঝে মাঝে ছোট ছোট ছেলেমেয়ে, কখনও বড়দের কণ্ঠ থেকে ধ্বনিত হচ্ছে--আল্লা মেঘ দে--পানি দে--ছায়া দেরে তুই--আল্লা মেঘ দে--। প্রখর বহ্নিজ্বালায় রুদ্রমুখী প্রকৃতি; শুষ্ক চৌচির ফসলের মাঠ; শ্যামলতাহীন রুক্ষ মরুর ধূসরতায় প্রাণহীন প্রকৃতি যেন, এক মৌনী তাপস। আবার হঠাৎ হয়তো একদিন ‘ধূলার ধূসর রুক্ষ উড্ডীন পিঙ্গল জটাজাল’ নিয়ে তপক্লিষ্ট, তপ্ততনু ভীষণ ভয়াল গ্রীষ্ম  অপরাহ্নে ডেকে আনে ক্রুদ্ধ শিবের কালবৈশাখী ঝড়--প্রকৃতিকে ভেঙ্গে চুঁড়ে নতুন করে সাজানোর খেলা শুরু করে। ।
 প্রকৃতি এখন  মাস-দিনের নিয়ম মেনে চলে না। তবুও অপেক্ষা করছি যদি মুসলধারে বৃষ্টি নামে । পুরো জৈষ্ঠ মাসের আম-জাম--কাঁঠাল-জামরুল-লিচুপাকা গরমের মধ্যে শিশির অথবা ভেজা ঘামের মত সামান্য বৃষ্টি হয়েছিল--তাও এক-আধদিন--সেটাও আবার প্রকৃতির চাহিদার সমুদ্রের মধ্যে এক ডোবার মত। অতএব বনের চাতকের মত মনের চাতকও  নির্ঘুম চোখে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে বৃষ্টির জন্য। কর্দমাক্ত মাটিতে কিছু স্বপ্নের বীজ বুনব; হয়তো লাউ, লিচু, জাম অথবা ডাটা শাকÑ কোনটা সংসারের নিত্যদিনের জন্য, কোনটা ছেলে-মেয়ের ভবিষতের জন্য অথবা দেশের ভবিষতের জন্য।
 সারাদিন-সারারাত নির্ঘুমে অপেক্ষায় থাকি--আসুক ঝড়-বৃষ্টি-তুফান, অপূর্ব মেঘের সমারোহে শ্যামল নয়নাভিরাম বর্ষা অতি ভৈরব হরষে সুচণা করুক তার শুভাগমন, আসুক শ্যামছায়াঘন দিন, শুষ্ক প্রান্তর, নদী-নালা ও খালবিলে জাগুক প্রাণোচ্ছ্বাস। প্রকৃতির ধূলি বিষন্ন অঙ্গ থেকে গ্রীমের ধূসর অবসাদ মুছে গিয়ে ফুটে উঠুক সজল বর্ষার শ্যামল সুন্দর রূপশ্রী। জেগে উঠুক স্বপ্নের বোনা বীজ থেকে অংকুরিত চারা গাছ। আসুক পুষ্প বিকাশের লগ্ন। কদম, কেয়া, জুঁই, গন্ধরাজ, হাসনাহেনা বিচিত্র বর্ণ ও গন্ধের উৎসবে শুরু হোক মেঘ, বৃষ্টি আর আলোর মেলা।


ঠিক এমনি মুহুর্তে চৌরা পাড়ার (যারা নদীর চর বা চরের কাছাকাছি বাস করে) দশ-বারোজন কিশোরী-যুবতী এবং মধ্যবয়সী মহিলা “কুলা ঠান্ডা করতে”




    সূর্য পশ্চিম দিকে হেলতে আরম্ভ করলে পরাজিত মেঘ খন্ডগুলি সদলবলে দক্ষিণ দিক থেকে প্রচন্ড বেগে ছুটতে আরম্ভ করে। মুহুর্তের মধ্যে শুরু হয় ঝঞ্চা, বিদুৎ চমকায়   মুহুর্মুহু, দিগন্ত প্রসারিত হয় বজ্র-নির্ঘোষে, পথের ধূলিকনা ও নদীর তীরের বালুকারাশি বিক্ষিপ্ত হয়ে চারদিক ঢেকে ফেলে


ঝড়ের তান্ডব লীলায় গাছ-পালার শাখা- প্রশাখা ভেঙ্গে যাচ্ছে। কিছু কিছু উঁচু ভিটির গাছের গোড়া সহ উঠে যাচ্ছে। বাঁশবন ধরাশায়ী হয়ে পড়ছে পাখিদের বাসা ভেঙ্গে যাচ্ছে। এরা ঝড়ের বাতাসে উড়ছে। নিজেদের গতি ঠিক না রাখতে পেরে চিৎকার করছে। কালীদের উঠান লতা-পাতা আর বিভিন্ন ময়লায় ভরে গেছে। তুলসী উত্তর ঘর থেকে আর শেফালী দক্ষিণ ঘর থেকে ভগবানকে ডাকছে।
দুপুর আর সন্ধ্যার মাঝামাঝি হল বিকাল। পূর্বাকাশে আবছা রংধনু উঠেছে। মেঘের গুড়–ম গুড়–ম শব্দের ফলে পুকুর হতে অনেক কইমাছ ডাঙ্গায় অল্প জলে লাফালাফি করছে। কালীদের বাসার দক্ষিণের বিস্তৃত অগভীয় ডোবায় (অনেকটা ছোট্র ক্ষেতের মত) অনেক পানি জমেছে। তরলের ধর্ম অনুযায়ী, এই পানি নি দিকে পুকুরে গড়িয়ে যাচ্ছে। এই ডোবায় নেমে কিছু ছেলেমেয়ে মাছ ধরছে। কেউ কাগজের নৌকা, জাহাজ বানিয়ে ঐ জলে ভাসিয়ে হাত তালি দিয়ে







কোরবানী ঈদের সময়ের সত্যি ঘটনা নিয়ে লেখা দুই পর্বের গল্প : আলোকিত অন্ধকারের জনপথে

২য় পর্ব/শেষ পর্ব.


ঈদের একদিন পর, সকাল বেলা, দেখি নারীটি ওখানেই পড়ে আছে। তবে আগের চেয়ে কিছুটা সুস্থ্য। আরো কিছু আয়া-বুয়া ও স্থানীয় কয়েকজন মমতাময়ী, দয়াময়ী মহিলার সাহায্যে জটা পাকানো চুল কাটালাম, নক কাটালাম। পরিস্কার করিয়ে বন্ধু ডাঃ ফেরদৌস এর সাহায্যে- Medicine ward-এ অজ্ঞাত বলে Police case হিসাবে ভর্তি করালাম। ওর সাহায্য পাওয়াতে দ্বিগুণ উৎসাহে কাজ এগোতে লাগল। এখন ডাক্তার, নার্স, স্থানীয় মানুষ, ঔষধের দোকানদার আয়া-বুয়া সবাই সাধ্যমত মানবীয় দায়িত্ব পালন করতে লাগল।

ঈদের দুইদিন পর, সকাল বেলা। Medicine ward unit-IV এর Bed no.Ex-16 তে গিয়ে দেখি নারীটি শুয়ে আছে। দুপুর বেলা দক্ষিণ বঙ্গের আমার দুই জন আত্মীয়--এডভোকেট স্বপন, এডভোকেট সঞ্জিত, আমার ছাত্র-ছাত্রী নিশু, আরজিনা, আলী আহমদকে নিয়ে ওয়ার্ড-এ গিয়ে দেখি নারীটি বসে বসে ভাত খাচ্ছে। নিশু অবাক হয়ে বলছে, স্যার একি !
পুরোপুরি সুস্থ্য। অবাক হবার কারণ সে আমার সাথে প্রথম থেকেই ছিল। এ রকম অবস্থা থেকে একটু ভালোবাসায় ছোঁয়া পেলে মানুষ যে বাঁচতে পারে--এটা তার প্রথম অভিজ্ঞতা। এডভোকেট স্বপনদাকে বললাম, আপনাদের অঞ্চলের মানুষ, দেখুন কথা বলে, কোন ঠিকানা বলে কিনা। স্বপনদা কিছু কথা বললেন, ঠিকানা উদ্ধার করতে পারলেন না। বললেন, আর কিছুদিন পর আবার আসব, আরো সুস্থ্য হোক।

চিকিৎসা বিদ্যার পাশাপাশি মানুষ হিসাবে নৈতিক দায়িত্ব ও কর্তব্য শিক্ষার জন্য এখন প্রতিদিন সকাল এবং অফিস শেষে ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়ে দু’বার রোগীটি দেখতে যাই। আমার পরিবারের উৎসাহ আমার চেয়ে কম নয়। আমার সহধর্মিনী ডাঃ সুপ্রিয়া রায় জামা-কাপড়, ফল নিয়ে একদিন রোগীটিকে দেখে গেছে। গত শুক্রবার পুরান ঢাকার বন্ধু জাহাঙ্গীর আলমকে নিয়ে রোগীটিকে দেখতে গিয়েছিলাম। সব ঘটনা শুনে নিজের অজান্তে বলে ফেললেন, আল্লাহ আপনাকে দিয়ে এই নারীটিকে বাঁচিয়েছেন।

ওয়ার্ডের সিনিয়র নার্স হাসিনা খানম অকৃত্রিম মাতৃস্নেহে রোগীটিকে সেবা করে যাচেছন। এই রকম নার্স হাসপাতালে কিছু সংখ্যায় থাকলে এরকম অজ্ঞাত,অসহায় রোগীর ভাল সেবা হয়। হাসিনা খানম গত শনিবার বললেন,স্যার,মানসিক বিভাগে ভর্তি করানো মনে হয় লাগবে না।রোগী কথা-বার্তা ভালই বলছে। আমি আর একটু চেষ্টা করে দেখি। এখন সে নিজে খায়। নিজে নিজেই বাথরুমে যায়। সবার সাথে একটু একটু কথা বলে।আমি শুনলাম,খুশি হলাম, বললাম, মানসিক বিভাগে না নিলে তার প্রকৃত চিকিৎসা হবে না।

অফিসে বসে ভাবছি, বিস্তীর্ণ শীতের কুয়াশা অথবা অন্ধকারের পথে আমরা আজো হাজার বছর ধরে পথ হাঁটছি। এত মানুষ, এত সম্পদ, এত কুরবানী, এত আনন্দ, আবার মানুষের কারণে কত যন্ত্রণা, কত দুর্বিসহ ঘটনা ঘটে। একজন Diabetic রোগী, সারাদিনে আধা কেজি খাবারও খেতে পারেনা অথচ কোটি কোটি টাকার সম্পদ তার। সম্পদ বাড়ানোর জন্য এদেশের মুষ্টিমেয় কিছু মানুষ, হেন কোন খারাপ কাজ নেই--যা তারা করে না। যদি এরা যাকাত ঠিকমত আদায় করত অথবা সরকারী নিয়মে ট্যাক্স ঠিকমত দিত তাহলে এদেশের পথে পথে এ রকম নারীরা পড়ে থাকত না।

কেন যে সমাজ কল্যাণ মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে মানুষকে সচেতন করছে না--বুঝিনা। মানুষরূপী কিছু মানসিক ভারসাম্যহীন যাদের কে খুব সহজ করে পাগল বলি ; এরা আমাদের আশে পাশে থাকে বিড়াল কুকুরের মত ছন্নছাড়া হয়ে। ফুটপাতের সর্বহারারা তো তবুও ভিক্ষা বা কাজ এর মাধ্যমে খাবার চাইতে পারে। এরা তাও পারে না। কেউ তাদের কাছে ঘেঁষতে দেয় না।

মানুষ, প্রকৃতির এ নির্মম খেলা থেকে কিছুই শিখে না। শিখে না ইতিহাস থেকে, শিখে না এ নিথর পড়ে থাকা মানুষরূপী এ নারীটির জীবন থেকে। তবে এ কাজ থেকে একটা বিষয় বুঝতে পারলাম । সাধারণ মানুষরা কেউ একা একা জামেলায় জড়াতে চায় না। তবে মানবীয় গুনাবলী প্রকাশ করার সুযোগ সবাই চায়, সবাই খুঁজে। চায় একজন নেতা এবং তার নি:স্বার্থ নেতৃত্ব। এই যে আমি, নেতৃত্ব দিয়ে কাজটি শুরু করেছি, এখন সবাই যার যার সাধ্য মত কাজ করছে। আসুন, আমরা শুরু করি, আমরা জাগি, আমরা জাগলে, সবাই জাগবে, জাগবে বাংলাদেশ।

কোরবানী ঈদের সময়ের সত্যি ঘটনা নিয়ে লেখা দুই পর্বের গল্প : আলোকিত অন্ধকারের জনপথে

১ম পর্ব

মিটফোর্ড হাসপাতালে চাকুরীতে যোগদানের দিন এবং তারপরও আরো কিছুদিন বুড়িগঙ্গার বিষাক্ত পানির দুর্গন্ধে বেশ কষ্ট হয়েছিল আমার। ভাবতাম, আর সব মানুষেরা কিভাবে চলছে। কিছুদিন পর এই পরিচিত গন্ধ আমার নাকের Olfactory nerve স্বাভাবিকভাবে মেনে নিয়েছে এবং আমি আর এখন গন্ধ পাই না। হাসপাতালে রোগীর ভীড় খুব বেশী। এখানে কোন কোন বিভাগের Out door এর ডাক্তাররা দিনে ২০০-৩০০ জন রোগী দেখে । Out door এর রোগীদের মধ্যে ৮০% মুখ খোলা বোরকা পড়া মহিলা, ৫% মুখ ঢাকা বোরকাপড়া (হাত-পা এর আঙ্গুলসহ), ১০% লুঙ্গি-শার্ট পড়া, আর বাকীরা লুঙ্গির সাথে গেঞ্জি, লুঙ্গির সাথে পাঞ্জাবী-টুপী, কেউবা শুধু লুঙ্গি পড়ে, কিছু রোগী প্যান্ট শার্ট ইত্যাদি পরিধান করে এখানে আসে। পরিধানের এই বর্ণনা দিয়ে বুঝাতে চাচ্ছি, এদের প্রায় সবাই অতি সাধারণ মানুষ। এ দেশের দারিদ্র আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে এরা আচ্ছাদিত। এদের সবাই ধর্মভীরু। আমাদের চিকিৎসার পাশাপাশি এরা তাবিজ-কবজ, ডিমপড়া, পানিপড়া, পীর-ফকির ইত্যাদিতেও বিশ্বাস করে। যোগদান করার পর থেকে আমার মনে হয়েছে আমি সতেরশ অথবা আঠারশ শতাব্দিতে এসে পড়েছি। রোগীরা খুবই সহজ-সরল এবং রোগ-বালাই সম্পর্কে এদের ধারণা হাস্যকর। দরিদ্রতা, অজ্ঞতা, অশিক্ষা, পারিবারিক অশান্তি এদেরকে মনে হয়, একুশ শতকের আলোকিত অন্ধকারের জনপথে আবদ্ধ করে রেখেছে।
হাসপাতালের প্রথম গেটের গলি দিয়ে রোগী, রোগীর সাথী ও সাধারণ মানুষের যাতায়াত খুব বেশী। প্রথম গেটের গলি দিয়ে হাসপাতালের দক্ষিণ দিকের গেট পার হয়ে বুড়িগঙ্গা ঘাটে যাওয়া যায় এবং সেই ঘাট দিয়ে বিষাক্ত পানিপথ নৌকাযোগে পর হয়ে কেরানীগঞ্জ যাওয়া যায়। কোরবানী ঈদের আগের কয়েকদিন প্রথম গেটের গলি দিয়ে রোগী ও সাধারণ মানুষের যাতায়াত খুব বেশী দেখা গেছে। বিশেষ করে, ঈদের দুই দিন আগে নয়া বাজার হাটের গরু, ছাগল, মোটর গাড়ী, রিকসা, ভ্যান আর মানুষের প্লাবনে প্লাবিত হয়েছে মিটফোর্ডের রাস্তা, হাসপাতালের গেট, বুড়িগঙ্গা ব্রীজের এপারের তীরদেশ। প্রথম গলি দিয়ে ঢুকতে হাতের বাম পাশের ছোট ফুটপাতে সাড়ে তিন হাতের কম পরিমাণ জায়গার সাপের মত কুন্ডুলী পাকিয়ে একটি কঙ্গালসার, অর্ধনগ্ন নারী পড়ে আছে গত কয়েকদিন যাবৎ। প্রায়ই দেখতাম, কিছু মানুষ উৎসুক হয়ে দেখছে ; কেউ কথা বলতে চেষ্টা করছে। আমি নারীর কাছে ভীড় করা মানুষের নানা কথা শুনেছি ; নানা জন নানা ধরণের কথা বলেছে ; কিভাবে সাহায্য করা যায় --তাও আমি শুনেছি তাদের আলোচনা থেকে। আমিও ভীড় করা মানুষের একজন, দায়িত্ব এড়িয়েছি। তবে ভেবেছি, শত শত ধর্মভীরু মানুষ, বোরকা পড়া রোগী, তাদের সাথিরা অথবা কোন ষ্টাফ নিশ্চয়ই Emergency-তে নিয়ে যাবে। কিন্তু না, ঈদের দিন পর্যন্ত কেউ আসেনি তার সাহায্যে।
ঈদের পরের দিন। গেট দিয়ে ঢুকতেই গরু-ছাগলের বিষ্টার চেয়েও বেশী তীব্র গন্ধ নাকে এসে লাগল। না, এ গন্ধ কোন পশুর নয়, মানুষের মলমূত্রের গন্ধ। বাম দিকে তাকালাম। সেই নারী, অর্ধনগ্ন, মলত্যাগ করে তার চারপাশে ছড়িয়েছে। মনে হল, পূর্বের কয়টা দিন এ নারী মানুষ নাকি কুকুর বিড়াল--এ গবেষণায় ছিল। কারণ এ নারী খাবার ছাড়া আর কিছু চাইতে পারে না। তার পরিচয় সে নিজেও জানে না। মানুষের মত (অস্পষ্ট স্বরে ) দু’একটা কথা বললেও কুকুর, বিড়ারের মতই ঠিকানাবিহীন। নিরব, নিথর দেহ সাপের মত কুন্ডুলী পাকিয়ে আছে। অসুস্থ গরু অথবা গাভী হলেও কোন কাজে আসত। এ যে মানুষরূপী শান্ত কোন প্রাণী; এর জন্য আলোচনা হতে পারে; কোন কর্ম হতে পারে না। নারীর মুখটা দেখা যাচ্ছে না। মনে হচ্ছে, She is going to die--পৃথিবীর মানুষ রূপী নির্দয় জন্তু-জানোয়ারের চেহেরা সে দেখতে চায় না। কারণ এ রকম কোন
জানোয়ারের কাছ থেকে আঘাত পেয়েই সে আজ মানসিক বিকারগ্রস্ত, নাম ঠিকানাবিহীন কোন প্রাণীর মত। কয়েকদিনে মশার কামড়ে হাত-পাত-মুখ Purpuric spot এর মত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রক্ত জমাট চিহ্নে ভরে গেছে।
ঈদের আগের দিনের মত, ঈদের পরের দিনও অফিস খোলা। রোগী কম। আমি আমার স্টাফ মনিরকে নিয়ে কিছু করার ইচ্ছা প্রকাশ করলাম। মনির নারীটির কাছে গিয়ে বলল, স্যার মহিলা স্টাফদের আসতে বলি ? আমি চিরায়ত সমাজ প্রথায় মাথানত করে ওর কথার অর্থ বুঝলাম। বসে না থেকে দু’একজন আয়া-বুয়া নিয়ে ইসলাম, কোরবানী, বেহেস্ত-দোজখ, পাপ-পূন্য এবং এই নারী সম্পর্কে নানা মত আলোচনা করলাম। বুঝাতে চেষ্টা করলাম, এই যে নারী, আধা মরা কুকুর-বিড়ালের মত পড়ে আছে, কেউ নেই তার,খাবার চাইবার শক্তিও নেই, একটি মশা তাড়াবার শক্তিও নেই, কয়দিন যাবৎ না খাওয়া--আমরা কেউ জানি না। এটা কি তার দোজখের
শাস্তি হচ্ছে না? আজ আমরাও যদি দেখে না দেখার ভান করি, একদিন আল্লাহপাক আমাদের কাউকেও এভাবে শাস্তি দিতে পারেন....ইত্যাদি, নানা ভাবে তাদের বুঝালাম। আয়া-বুয়ারা আমাকে বড় পরহেজগার মানুষ মনে করল। ওদের টাকা দিলাম স্যালাইন, সিরিঞ্জ, ইনফিউশন সেট, ভিটামিন কিনার জন্য । ওরা নারীটিকে গোসল করাল। ফুটপাতকে খোলা ছাদের Single patient ward বানালাম। স্যালাইন ঝুলিয়ে দিলাম দেয়ালের সাথে দড়ি বেঁধে। হাসপাতাল থেকে কিছু ঔষধ আনলাম। এখন কিছু মানুষ এবং ঔষধের দোকানীরা ঔষধ, পানি দিচ্ছে। মনে হলো “তুমি জাগলে, সবাই জাগবে--জেগে উঠবে একদিন বাংলাদেশ।''
বলে রাখা ভালো--আমি ধর্ম, ঈশ্বর, পাপ-পূন্যে বিশ্বাসী কোন মানুষ নই। আমি ধর্মভীরু নই, বিবেক বিশ্বাসী কর্মভীরু মানুষ। মানুষ হবার জন্য জ্ঞান হবার পর থেকে চেষ্টা করছি। মানুষ কিছুটা হতে পেরেছি বলে কখনও কখনও মনে করতে ইচ্ছে হয়; পরক্ষণে ভয় হয় মানুষ হবার অপরাধে মানুষরূপী অমানুষেরা অথবা ভন্ড, ধার্মিকরূপী অধার্মিকেরা আমাকে পদে পদে যদি কাঁটা ছড়ায়ে দেয়।
নারীটিকে স্যালাইন সেট করার সময় কয়েকবার Canula দিয়ে পিক করতে হয়েছে ধমনী পাচ্ছি না বলে। ধমনীগুলি মৃত্যু ভয়ে যেন চুপসে গেছে। পিক করার সময় সব রোগীই ব্যথা অনুভব করে। এই নারীটির যেন কোন অনুভুতিই নেই। বলেই চলেছে, ‘মোরে পানি দে, কইলজাটা জ্বইল্লা গেল’। বুঝলাম, বরিশাল অথবা দক্ষিণ বঙ্গের মানুষ। এই প্রথম মুখখানা দেখলাম ; শত শত কষ্টের ছাপ তার চোখে মুখে ; বয়স বেশীই মনে হয়। চুলগুলিতে যেন জট লেগে আছে শহরের যানজটের মত। বুড়ীগঙ্গার মত দুর্গন্ধ তার আশে পাশে। বুয়ারা তাকে গোসল করায়ে পরিস্কার করালেও, তার মলমূল যা চারিদিকে ছড়িয়ে আছে, তা পরিস্কার করেনি। নিথর দেহ পড়ে আছে। চিবুক বসে গেছে । গাল দুটি ঢুকে গেছে মুখের ভিতর। হাড়-গোড় যেন বের হয়ে আসতে চায় কারণ এ দেহ তাদের খাবার দেয়না। মাঝে মাঝে গোঙ্গানোর শব্দ, কাকে যেন গালি দিচ্ছে। ভাবি, হে প্রকৃতি, এ নারীটি যা তোমারই জীবন্ত অংশ; পানি, ভাত শব্দগুলি মনে রেখেছে; মনে রাখেনি স্থান-কাল-পাত্র অথবা ঠিকানা। কারণ এ সমাজে ঠিকানাবিহীন মানুষ ভাবা যায় না। বড় দুর্ভাগা এ দেশে তারা।
এই যে এ কাজটি করছি, কেউ ভাল বলছে, কেউ অবাক হচেছ। কেউ বলছে, সারাদেশে এ রকম মানুষ হাজার হাজার কয়টার সেবা করবেন, স্যার। আমি বললাম, আমরা ১৭ কোটি মানুষ যদি ১০ জনে মিলে একজনের জন্য নূন্যতম দায়িত্ব পালন করি ,তাহলে তো হবে। সবাই আমরা যে যার জায়গা থেকে দায়িত্ব পালন করতে পারি । হাসপাতালের স্টুয়ার্ড গোলাম মোস্তফাকে সব বললাম। তিনি উৎসাহ নিয়ে আমার সাথে থাকা বুয়াকে বললেন, এই তুমি প্রতিদিন যতবার খুশী খাবার নিয়ে যাবে। স্যার, খাবার নিয়ে কোন চিন্তা করবেন না।
(চলবে)