উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে স্বদেশ

   
 ১৯৪৭-এ বিতর্কিত দ্বিজাতি তত্ত্বের আলোকে দেশ ভাগ, ’৫২-এর স্বাধীনতার আন্দোলন, ’৬২-এর শিক্ষা আন্দোলন, ’৬৬-এর ছয় দফা আন্দোলন, ’৬৯-এর গণ অভ্যুত্থান, ‘৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা লাভ, '৯০-এ স্বৈরাচার পতন--এত রক্তের বিনিময়ে অর্জিত বাংলাদেশ, আজ কোথায়, কোন অবস্থায় আছে ! কেমন আছে আমার দেশ, দেশের মানুষ, আমার মাতৃভূমি, আমার প্রিয় জন্মভূমি, আমার স্বাধীনতা? এ বিজয়ের মাসে পরাজিত রাজাকার আর তাদের বংশধররা কার বা কাদের সহযোগিতায় ’৭১-এর মানবতাবিরোধী, কুখ্যাত রাজাকারদের মুক্তির জন্য আন্দোলন করে, দেশ ব্যাপী হরতাল করে ? কোথা থেকে তারা এত সাহস পায়? পৃথিবীর কোন দেশ  ধর্মীয় জাতি সত্ত্বার কারণে বিভাজিত হয়নি, শুধু ভারত ছাড়া; কোন দেশে স্বাধীনতার যুদ্ধে পরাজিতরা মাথা তোলে কোনদিন দাঁড়াতে পারেনি; শুধু বাংলাদেশ ছাড়া।

বিজ্ঞান ও সভ্যতার চরম উন্নতির এ যুগেও কোন কোন ধর্মীয় রাজনৈতিক গোষ্ঠী বেহেস্তে যাওয়ার টিকেট বিক্রি করে। তাদের জেলে ঢুকালে বলে আল্লাহ  তাদের ঈমানের পরীক্ষা করছেন আর উকিলের মাধ্যমে জামিন বা মুক্তি পেলে বলেন, আল্লাহ তাদের জামিন বা মুক্তির  জন্য ফেরেস্তা পাঠিয়েছেন। তারা তাদের অনুসারীদের এমনি মগজ ধোলাই করেন যে, তাদের মতবাদ বিশ্বাস না করলে বা মেনে না নিলে মুসলমান হত্যা করাও জায়েজ বলে তারা মনে করে। এ কাজ করতে গিয়ে যদি মৃত্যু হয়, তবে সে শহীদ, অনায়াসে বেহেস্ত লাভ আর বাঁচলে গাজীত্ব লাভ। তারা নারী নেতৃত্ব হারাম বললেও কৌশলগত কারণে ক্ষমতাধর নারীর আঁচলের নিচে যেতে বা লুকাতে লজ্জাবোধ করেন না। ইসলাম কায়েমের কথা বললেও গণতন্ত্রের লেবাস লাগিয়ে পৃথিবীর সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর দেশের কাছ থেকে উদারপন্থী, গণতান্ত্রিক ইসলামী গোষ্ঠী নামে সার্টিফিকেট নিয়ে আরাম বোধ করেন। এ সব ধর্মীয় গোষ্ঠী  ধর্মের নামে ’৭১ থেকে  আজ পর্যন্ত  হত্যা-ধর্ষণ-কালোবাজারী-চোরাচালানী-রগকাটা-ভিন্ন ধর্মের উপাসনালয় জ্বালানো--হেন কোন খারাপ কাজ নাই, যা করেনি।

কক্সবাজারের রামু, উখিয়া, টেকনাফ, চট্রগ্রামের পটিয়া ও পাশ্ববর্তী এলাকায় সংঘটিত নাশকতা, একটার পর একটা গার্মেন্টস্-এ আগুন, বিজয়ের মাসে ধর্মীয় গোষ্ঠীর মাথাচাড়া দিয়ে জেগে উঠা, সারা দেশে হরতাল সহ ঘর-বাড়ী-গাড়ী-বস্তি জ্বালাও পোড়াও আন্দোলন, পুলিশের উপর আক্রমণ (যা আগে দেখা যায়নি), গনতন্ত্র দিবসে পতিত স্বৈরাচারের  গণতন্ত্র রক্ষার্থে ক্ষমতা হস্তান্তরের হঠাৎ চমকপ্রদ ছবক, হরতালে বিশ্বজিৎ এর মত একজন দরিদ্র সাধারন নাগরিকের ছাত্রলীগ নামধারী সন্ত্রাসীদের দ্বারা  নির্মমভাবে খুন (ঘৃণা, বিস্ময় প্রকাশ করার ভাষা আমি হারিয়ে ফেলেছি), রাজনৈতিক নেতাদের মিথ্যা কথা বলার চরম প্রতিযোগিতা, সরকারী দলের এক গোয়েমী  স্বৈরাচারী আচরণ আর দুর্নীতিসহ রাষ্ট্র পরিচালনায় চরম ব্যর্থতা, বিজয়ের মাসে তথাকথিত ধর্মীয় গোষ্ঠীর সাথে তত্বাবধায়ক সরকারের দাবীতে প্রধান বিরোধী দলের রাজপথ অবরোধ, হরতাল, জ্বালাও-পোড়াও আন্দোলন চলছে--এ যেন কোন উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে স্বদেশ !

স্বাধীনতার ৪১ বছর পর আজও দেশ দারিদ্র মুক্ত হয়নি, শোষণ মুক্ত হয়নি। নদী ভাঙ্গনে, বর্ষার প্লাবনে উজান-ভাটার স্রোতে ভেসে আসা সর্বহারারা জল-কাঁদা মাখা রাস্তার দুপাশে পোকামাকড়ের মত বসতি গড়ে। রোগার্ত, ক্ষূধার্ত, কর্মহীন ফসলহারা মানুষেরা কচুরীপানার মত বানের জলে ভেসে চলে গ্রাম থেকে শহরে, গড়ে তোলে অস্বাস্থ্যকর বস্তি। রাস্তার ফুটপাতে ছিন্নমূল হাজার মানুষের মানবেতর জীবন যাপন; শীত, বর্ষায় নিদারুণ কষ্টে দিন-রাত যাপন; সোডিয়াম আলোয় পতিতাদের খদ্দেরদের সাথে বাক-বিতন্ডা। শ্রমিকদের ন্যায্য বেতন ভাতাদির জন্য মিছিল; পুলিশের লাটিপেটা খেয়ে মানুষ বানানোর কারিগর শিক্ষকদের আমরণ অনশন; স্মরণকালের শেয়ার ধস, বিখ্যাত ব্যক্তিদের তত্ত্বাবধানে, সহযোগিতায় হলমার্ক-ডেসটিনির মত জালিয়াতী ব্যবসার ছড়াছড়ি; তেল-গ্যাস-খনিজ রক্ষা কমিটির আন্দোলন; পদ্মা সেতুর মত আরো হাজারো কাজে দুনীর্তি--চরম ব্যর্থতায় ‘স্বাধীনতা যুদ্ধের ডাক দেওয়া’ দলের সরকার। এ যেন, স্বপ্নের হাত ধরে কৃষ্ণপক্ষের রাত্রির অন্ধকারে অনন্তের পথে চলেছি আমরা। এ পথের যেন শেষ নেই...।

 দূর থেকে শিল্পী হায়দার হোসেনের গান ভেসে আসছে। শিল্পী আমাদের মনের কথা সুরে সুরে  বড় যন্ত্রণায় গেয়ে চলেছেন, ‘কি দেখার কথা কি দেখছি, কি ভাবার কথা কি ভাবছি, তিরিশ বছর পরেও আমি স্বাধীনতাটাকে খুঁজছি...।’ শিল্পীকে এখন সংশোধন করে গাইতে হবে  ‘ ...একচল্লিশ বছর পরেও আমি স্বাধীনতাটাকে খুঁজছি...।’ কত বার, কত বছর শিল্পী এ গান সংশোধন করবেন, আর কত বার দেশ প্রেমিকদের কাছে গান গেয়ে কাঁদবেন। তথাকথিত দেশপ্রেমিকদের  সন্তানরা, স্বজনরা এ দেশে থাকেন না। তাদের দেশ প্রেমের জ্বালাও পোড়াও আন্দোলনে আমার, আমাদের দেশ তিলে তিলে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। আমরা কি এই বাংলাদেশ চেয়েছিলাম! এই জন্য কি  মুক্তিযুদ্ধে তিরিশ লাখ মানুষ শহীদ হয়েছিল, রক্ত দিয়ে এদেশের নাম রেখেছিল, বাংলাদেশ? এ জন্য কি  হাজার হাজার মা বোনের ইজ্জত নষ্ট হয়েছিল? আমাদের লজ্জাবোধ হয়, আমরা মরমে মরি, সোনালী সোঁদা মাটি-সমতল সবুজ ভুমি-পাহাড়-ঝরনা-ছড়া-মেঘ-কুয়াশা-আলো মাখা আকাশ-ডোবা-খাল-ঝিল-হাওর-বাওর-নদী-সমুদ্র--এত সুন্দর দেশ, অসীম সম্ভাবনার দেশ--এভাবে  তিলে তিলে ধ্বংশ হতে পারে না।

 মুক্তিযুদ্ধ প্রজন্ম তথা দেশের সত্যিকারের দেশ প্রেমিক, সচেতন মানুষদের কাছে আমাদের অনুরোধ, নানা মত পার্থক্য আমাদের মধ্যে থাকতে পারে, কিন্তু এ দেশ আমাদের জন্মভূমি, এ দেশ আমাদের, এ দেশ ছেড়ে আমরা কোথাও যাব না। আসুন, এ বিজয়ের মাসে শপথ করি, দেশ ও মানুষের বিরুদ্ধে ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র প্রতিহত করে এ দেশকে আমরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত করি, আলোকিত করি। আসুন, আমরা শুরু করি, আমরা জাগি, আমরা জাগলে, সবাই জাগবে, জাগবে বাংলাদেশ।

No comments:

Post a Comment