দুই চাকার পঙ্খীরাজ

গান্ধীর মাঠ। অনেকের সাথে আমিও মনে করতাম, মহাত্মা গান্ধী কোন একদিন এ মাঠে জনসভা করেছিলেন। সেই থেকে এই মাঠের নাম গান্ধীর মাঠ। আসলে তা নয়। মাঠের পশ্চিম পাশে ছিল ডাক্তার পাড়া। নারী শিক্ষার অগ্রগতির জন্য এই ডাক্তার পাড়ার গান্ধি পরিবারের কোন এক মহাত্মা মাঠের পূর্ব পাশের বালিকা বিদ্যালয়ের মেয়েদের খেলাধূলার জন্য এই জায়গাটি দান করেছিলেন। যদিও মাঠটি আন্তজেলা ফুটবল প্রতিযোগিতার মাঠ হয়ে খ্যাতি অর্জন করে এলাকার ছেলেদের তথা সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত ছিল। এছাড়াও লৌহজং কিশোর সংঘের নাটক, দূর্গাপূজা, মেলা, বাইসাইকেল শেখা, স্কুলের বার্ষিক প্রতিযোগিতা, রাজনৈতিক জনসভা ইত্যাদি কারণে বছরে কখনও কখনও মাঠটি ঘাসশূণ্য হয়ে যেত। লৌহজং উপজেলার বহু মানুষ এ মাঠের ফুটবল আর বাইসাইকেলের স্মৃতি নিয়ে দীর্ঘদিন বেঁচে থাকবে। আজ আর গান্ধীর মাঠ নেই। বর্তমানে গান্ধীর মাঠসহ উপজেলার প্রায় অর্ধেক পদ্মার কড়াল গ্রাসে বিলীন হয়ে গেছে। লৌহজংবাসীর স্মৃতিতে আজও জেগে আছে এ মাঠ।
এ মাঠের দক্ষিণ-পশ্চিম কোনে ছিল একটি পুরনো সাইকেলের গ্যারেজ। দিঘলী বাজারের ভিতরে আরো ২টি গ্যারেজ ছিল। সকাল থেকে দেখতাম, সবাই সাইকেল ভাড়া নিয়ে চালানো শিখতো। যারা ভালো পারতো তারাও চালাতো। কেউ কেউ ঘন্টায় ৫ টাকা করে কয়েক ঘন্টা ভাড়া নিয়ে দূর-দূরন্তে বন্ধু অথবা আত্মীয়দের বাড়িতে চলে যেত। আমার খুব ইচ্ছে হত, সাইকেল চালানো শিখতে। কিন্তু পকেটের অবস্থা ভালো ছিল না। তাছাড়া আমি খুব ভীতু ছিলাম। দু’একবার পরিচিত জনের ভাড়া নেওয়া বাইসাইকেলে উঠে একটু-আধটু চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু ভয়ে বারবার পড়ে যেতাম। তাই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অন্যদের চালানো দেখতাম। বন্ধু দেলোয়ারের ভাড়া করা সাইকেল একবার শিখতে যাওয়ার বেশী চেষ্টা করতে গিয়ে হাঁপিয়ে উঠেছিলাম। বারবার সামনের দিকে না তাকিয়ে নিচের দিকে তাকাতাম আর পড়ে যেতাম। সেদিন আমার প্রচন্ড শ্বাসকষ্ট হয়েছিল। ব্যক্তিগত জীবনে আমি ছিলাম হাঁপানী রোগী। উত্তেজিত হলে, ভয় পেলে, শ্বাসকষ্ট আরো বেড়ে যায়। আমার এরকম অবস্থা দেখে দেলোয়ার আমাকে মাঠে ফেলে পালিয়ে গিয়েছিল। একদিন পরে আমি ওর বাসায় গিয়ে বলে আসলাম বন্ধু, আমি মরি নাই।
ছোট বেলা থেকে আমি ছিলাম স্বপ্নে-বিভোর একজন মানুষ। ভাবনার আকাশে বাইসাইকেল নিয়ে কত যে মাঠ-ঘাট-পথ পাড়ি দিয়েছি। কেউ আমার সাথে জিততে পারত না। স্বপ্নে বিভোর হয়ে দুই চাকার পঙ্খীরাজ মানে বাইসাইকেল নিয়ে উড়াল দিয়ে জ্বীন-পরীর দেশে কতবার যে গিয়েছি হাঁপানী রোগের ঔষধ আনতে। কারণ আমার মা তাবিজ-কবজ, পানি-পরা, রসুনের তেল-পড়া চিকিৎসা করাতে করাতে ক্লান্ত হয়ে গিয়েছিল। কোন এক ফকিরের কাছ থেকে মা শুনেছিল জ্বীন-পরীর দেশ থেকে ঔষধ এনে খেলে হাঁপানি রোগ চিরতরে ভালো হয়ে যায়।
সে যাই হোক, আমার খুব খারাপ লাগতো যখন দেখতাম দুই বন্ধু অথবা দুই ভাই-বোন মিলে সাইকেল চালিয়ে মাঠ-ঘাট পেড়িয়ে যাচ্ছে। যদি আমি এরকম পারতাম, তাহলে আমার বোনকে সাইকেলের, পেছনে নিয়ে স্কুলে যেতে পারতাম। দুই ক্রোশ দূরে স্কুল, দূরত্বের কারণে বোনটির বেশী লেখাপড়াও হলো না।
তবে বন্ধুর সাইকেলের পিছনে ওঠে ২১ শে ফেব্রোয়ারীর ভোর রাতে পাল বাড়ীর ফুল বাগান থেকে ফুল চুরি; শীতের ভোরে দূরের কোন বড়ই গাছ থেকে বড়ই পেরে গৃহকর্তা দেখার আগেই কেটে পড়া; আলু খেতের মেঠো পথ দিয়ে যাবার সময় আলু চুরি করে পুঁড়িয়ে ভর্তা খাওয়া; কাপালী বাড়ীর পাকা গাব পেরে আমাদের ধরার আগেই সাইকেল দিয়ে দ্রুত পলায়ন--আজ সব মনে পড়ে। কোন বন্ধুর ভালোবাসার মানুষটি থাকত দূরের কোন গ্রামে। তার জন্য চিঠি লিখতে লিখতে কবে যে নিজের অজান্তে আমি সখা হয়ে গেছি--তা বুঝতে পারলাম বন্ধুটি ছেঁকা খাওয়ার পড়। ভোমালী বাড়ীর বুড়ির গরুর দুধ বেঁচতে প্রায় যেতে হতো বাজারে। আমি দুধের জগ অথবা বালতি হাতে রেখে সাইকেলের পেছনে বসতাম আর বন্ধু দেলোয়ার সাইকেল চালিয়ে যেত বাজারে। এই সাইকেলের পেছনে থেকে কত যে ভাল কাজ করেছি; মন্দ কাজ করেছি--তা লিখে শেষ করা যাবে না।
বন্ধু দেলোয়ারের সখিদের তালিকা ছিল বড় লম্বা। এই সখিদের জন্য ফুল আর পত্র বাহক হিসাবে আমার একটা সুনাম ছিল--দুর্নামও ছিল। গ্রীষ্মের দাবদাহে জনজীবন বিপর্যস্ত। সাইকেল নিয়ে ক্লান্ত দেহে বন্ধুদের প্রেমিকাদের কত যে চাঁপা, বেলী, বকুল, জুঁই, জবা, করবী ফুল দিয়েছিÑতার হিসাব নেই। বর্ষার অঝোর ধারা মাথায় নিয়ে কদম ফুল আর শাপলা দিয়ে সখিদের খুশি করতে না পেরে, অপেক্ষায় ফিরে আসি শরতে। শিউলী ফুল দিয়ে মালা গেঁথে সাইকেলকে সাঁজিয়ে কোন বন্ধুর সাইকেলের পেছনে বসে ছুটে চলি শরতের কাঁশবনের সীমান্ত দিয়ে হেমন্তের কোন রাস্তায়, কোন নতুন সখির খোঁজে। পাকা ধানের মৌ মৌ গন্ধের মেঠো পথে শেফালী আর কামেলী ফুল হাতে নিয়ে ছুটে চলি নতুন কোন গাঁয়ে। বাইসাইকেল কখনও একাত কখনও ওকাত হয়ে চঞ্চলা হরিণের মত পথ চলে। কনকনে ঠান্ডা প্রকৃতিতে গলায় মাফলার জড়িয়ে শিশির মাখা শীতের সকালে অথবা সন্ধ্যায় জঙ্গলের আঁকা-বাঁকা পথে গোলাপ, চন্দ্রমল্লিকা, রজনীগন্ধা, দোপাটি, বেলী, সূর্যমুখী অথবা পিঠা পায়েস, এমনকি রাতের বেলা চুরি করা খেজুরের রস দিয়ে কতনা অভিমান ভাঙ্গিয়েছি কত সখিকে।
কোন সখিই বেশী দিন থাকে নাই--আমার বন্ধুদের জীবনে। ওদের জন্য চিঠি লিখতে লিখতে আমিও নিজের অজান্তে সখা হয়েছি সখি ছাড়াই; হয়েছি স্বপ্নে-বিভোর কবি। পকেটে হাঁপানীর ট্যাবলেট অথবা ইনহেলার নিয়ে আমার জীবনে দুই চাকার পঙ্খীরাজ, বাইসাইকেল চালানো শেখা আর হয় নাই। পরিণত এই বয়সে এখন আর সেই ইচ্ছা নেই। কারণ সেই কৈশোর, সেই পুরনো সাইকেল, সেই বন্ধুরা, সেই সখিরা আজ আর নেই।

No comments:

Post a Comment